সিগ্রেট

 
জীবনে সিগ্রেট খেয়েছি দুবার।


প্রথম সিগ্রেটটা দিয়েছিল মিশু, আমার প্রিয় প্রাক্তন।


বহু বছর আগে একদিন কোনও এক মধ্যাহ্নে আমাদের ভার্সিটির শিমুলতলায় আশিকমামার টংয়ের বিরিয়ানি খাওয়াশেষে অলসদুপুরে আয়েশি ভঙ্গিতে দুজন বসলাম সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে। মিশু তার হাওয়াইশার্টের কুঁচকানো পকেট থেকে দুইটা সিগ্রেট বের করে মেলে ধরল আমার সামনে! এগারো টাকা দামের বেনসন সিগ্রেটের এমন কোনও বিশেষত্ব নেই যে তা পকেট থেকে এমন আলগোছে বের করে প্রেমিকাকে দিতে হবে অতি যতন সহকারে!


তবে এই সিগারেটের বিশেষত্ব আছে বই-কি। কারণ কাগজে-মোড়ানো এই ধূম্রপানের নিকোটিন যেন তেন জায়গা থেকে আসেনি! সুদূর বিলেত থেকে এসেছে। মিশুর বন্ধু সদ্য বিলেত থেকে এসে তাকে এই দুখানা বিলেতি সিগ্রেট খেতে দিয়েছিল। সে খায়নি! বিদেশি জিনিস বলে কথা! ভালো জিনিস একা খেতে নেই। প্রিয়মানুষকে সাথে নিয়ে খেতে হয়। তাই সুদূর বাসা থেকে এই ভার্সিটিক্যাম্পাস অবধি বয়ে নিয়ে এসেছে প্রিয়তমার জন্য দুখানা ধূম্রশলাকা, একখানা সে খাবে, আর-একখানা প্রেয়সীকে দিবে।


মিশুর ওয়ালেটে গোটা পঞ্চাশেক টাকা, পায়ে ক্ষয়ে-যাওয়া অতিপুরনো চটি, সাথে পকেটে করে প্রিয়তমার জন্য বয়ে-বেড়ানো একজোড়া বিলেতি দামি সিগ্রেট। সিগ্রেট হাতে পেয়ে অতিবিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম, কোন পাশে আগুন ধরাব, সেটা বুঝতে! বোধকরি, সিগারেটের কোন পাশে আগুন ধরাতে হয়, এটা মনে রাখার যন্ত্রণাতেই সিগ্রেটটা আমার আর কন্টিনিউ করা হয়ে ওঠেনি!


যা-ই হোক, মিশু জায়গামতো আগুন ধরিয়ে দিল। অতঃপর দুজন মিলে সুখটান! অতটা খারাপও নয়! বিদেশি সিগ্রেট বলে কথা! সেবার মিশুর সাথে প্রথম সিগ্রেট খেতে গিয়ে জানলাম, বাংলাগুলি বেশ কড়া হয়, সে তুলনায় বিদেশিগুলি হালকা তামাকের। তাই খেতেও হালকা। ওর ভাষায়, বিদেশি সিগ্রেট হলো লেডিসসিগ্রেট! যারা সিগ্রেট খেতে পারে না, ওরা লেডিসসিগ্রেট খায়।


গত বছর আমাদের পরিবারে একজন নতুন সদস্য যুক্ত হলেন। আমার আদরের ড্যাশিং দুলাভাই। অবশ্য শ্যালিকা-দুলাভাইয়ের যে রঙ্গতামাশার সম্পর্ক, তা আমাদের মধ্যে তা নেই। দুলাভাই বেশ রাশভারী মানুষ, ওরকম কারও সাথে ঠাট্টা চলে না। তো বিয়ের পরপরই তিনি নরওয়ে যাচ্ছেন কনফারেন্সে। জিজ্ঞেস করলেন, কী আনতে হবে? ভীষণ গম্ভীরকণ্ঠে বললাম, এক প্যাকেট সিগ্রেট!


অতঃপর তিনি এলেন সাথে করে আমার জন্য নীলকাগজের র‍্যাপিংপেপারে মোড়ানো সুদৃশ্য এক প্যাকেট সিগ্রেট নিয়ে! সত্যি সত্যিই! এখন কাহিনি হলো, এই ধূমপান করবার জন্য কোনও নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান পেলাম না! অতঃপর সেই ট্র্যাডিশনাল ওয়াশরুমই একমাত্র ভরসা। এই জগতের কোটি কোটি বিড়িখোরের শেষ আশ্রয়স্থল এই ওয়াশরুম।


ওদিকে দীর্ঘদিন পর সিগ্রেট খেতে গিয়ে আবারও সেই একই সমস্যা! কোন দিকে ধরাতে হয়, এটা নিয়ে ধন্দে পড়ে গেলাম! শেষে দুদিকেই চেষ্টা করে করে আসল দিকটা বের করে সিগ্রেটে একটা বড়ো করে সুখটান দিলাম! মুখ থেকে বিশাল বিশাল ধোঁয়াকুণ্ডলীর উদ্‌গিরণ। কিন্তু না, সেই বিলেতি সিগ্রেটের স্বাদটা আর নেই! এগারোখানা সিগ্রেটের একখানা শেষ করেছি সবে! বাকি দশখানা কী করি? কাকে দিই? ভাবছি আর চোখের সামনে ধোঁয়ার খেলা উপভোগ করছি। আহা, এই জীবনটাকে যদি সিগ্রেটের মতো একটানে শেষ করে দেওয়া যেত! শালার লাইফ!


ব্রেকআপের পর প্রায় বছর চারেক বাদে আমাদের দেখা। অনেকদিন ধরেই দেখা করতে চাইছিল সে, আমাকে কিছু উপহার দেবে বলে! বেচারা আমাকে কোনও দিনই কিছু দিতে পারেনি। এখন তার আয়-রোজগার ভালো। চেহারাও বেশ পরিণত। বিয়ে থা করে গৃহস্থ হয়েছে। নতুন সংসারে ঝাঁ ঝাঁ চকচকে ফ্রিজ! অথচ কথা ছিল, মাটির ঘরে থাকব আমরা, সে ঘরে থাকবে কলসভরা টলটলে ঠান্ডা পানি! ডাল-আলুভর্তা দিয়ে মেখে একসানকি ভাতের সমুদ্রে ডুবব আমরা, দুজনের হাতে থাকবে পোড়া শুকনোমরিচ। কোথায় গেল সেইসব স্বপ্নমাখা প্রতিশ্রুতি!


‘তুমি কবিতার বই বের করছ না?’ ভ্রম কাটল আমার! উত্থানবিহীন আমার এই জীবনে কেবল পতনের পর পতন! সে জীবনে বইলেখাটা আর হয়ে ওঠেনি! হয়তো আর হবেও না। কিছু না বলে হাসলাম। দেখলাম, সে পকেট থেকে অভ্যাসবশত হাত বের করল। তবে এবার তার হাতে সিগ্রেট ওঠেনি! চকচকে হাজার খানেক টাকার নোট। জোর করে আমায় দিয়ে বলল, কোনও দিন তোমাকে কিছু দিতে পারিনি, সব সময় তুমিই দিয়ে এসেছ। একটা সময় কিছুই ছিল না আমার, শুধুই তুমি ছিলে! এখন আমার সব হয়েছে, তুমিই শুধু নেই!


কারও ভালোবাসার দান ফিরিয়ে দিতে নেই। আমি তাই আঁজলা ভরে তার এই ভালোবাসা গ্রহণ করলাম, যদিও এখন আর তার প্রতি আমার কোনও ভালোবাসা নেই! সময় চলেছে, বয়স বেড়েছে, বুদ্ধি খুলেছে। কী দিব কী দিব করে কিছু দিন আগে সদ্য নরওয়েফেরত দুলাভাইয়ের আনা এক শলাকা-কম এক প্যাকেট সিগ্রেটখানা ব্যাগ থেকে বের করে তার হাতে দিলাম।


বহু বছর আগের একখানা সিগ্রেটের বিনিময়ে তাকে দশখানা সিগ্রেট ফিরিয়ে দিলাম। আমি জানি, মিশুদের কাছে প্রিয়তমার হাত অপেক্ষা সিগারেটের প্যাকেট ধরতেই বেশি আনন্দ! এজন্যই আজ থেকে চার বছর আগে তাকে বলেছিলাম, ‘তোমার সাথে প্রেম করার চেয়ে বৃক্ষের সাথে প্রেম করাও ভালো!’ অতঃপর ব্রেকআপ!


সেদিন মিশুর যে কাজটা সহজ করে দিয়েছিলাম আমি নিজেই, সে কাজটার বিনিময়ে আজ আমি তাকে নয়টা সিগ্রেট বেশি ফেরত দিয়ে দিলাম!


সেইদিন থেকে পণ করেছিলাম, এরকম মিশু টাইপ ছেলেকে কোনও দিন বিয়ে করব না! এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে অবশ্য আমার এই বন্ধুটি বিশেষ আশীর্বাদপ্রাপ্ত! একটা সরকারি চাকরি তাকে এই বেকার মানুষীটির করালগ্রাস থেকে বাঁচিয়ে দিল!


মধ্যাহ্ন শেষের দিকে। বিদায় নিয়ে আমরা আবার আলাদা পথে হাঁটলাম। একই পথ, গন্তব্য ভিন্ন। আমরা এই প্রথম একবাসে আলাদা সিটে। আমি বাসের প্রথমদিকের সিটে, সে শেষের দিকের সিটে। জানালার পাশে বসা আমার বরাবরের অভ্যাস। বসলামও ওখানে।


জানালা দিয়ে বাতাস আসছে না কোনও! কেবলই শব্দ ভেসে আসছে। একজন ব্যর্থ প্রেমিকের ছলছল করুণ চোখের হাহাকার মেশানো একটার গায়ে আর-একটা লেপটেথাকা শব্দগুচ্ছ---তোমার মতো মেয়ে পাওয়া সো টাফ! সো টাফ!


আমার চোখে ভেসে উঠল একজন ব্যর্থ প্রেমিকের মুখশ্রী।