কীভাবে অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতে হয়, তা শেখা প্রয়োজন। নিজে কথা বলার লোভ সংবরণ করে কী করে অন্যদের কথা শুনতে হয়, সে আর্টটা রপ্ত করা দরকার। কারও সাথে মিশতে হলে প্রথমেই যা জরুরি, তা হলো ধৈর্য। কারও সম্পর্কে ঠিকমতো না জেনে বা কোনো বিষয় সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা না নিয়ে, কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। আমার আচরণ, আমার কথা আমাকে অন্যদের চোখে সন্তও করে দিতে পারে, শয়তানও করে দিতে পারে। বাহ্যিক পর্দাটা সরিয়ে দেখতে পারলে প্রকৃত মানুষটাকে দেখা যায়। আমরা যদি কারও বাহ্যিক দিকটাই শুধু দেখি, তবে আমরা তার সম্পর্কে যা জানব, সে আসলে তা নয়।
কারও হৃদয়ের দিকে তাকাতে হলে তাকানোর মতো নিজ-হৃদয়ের চোখ লাগে এবং তা দিয়েই তাকাতে হয়। যার হৃদয় অন্ধ, সে অন্যের মধ্যে স্রষ্টার অস্তিত্ব বুঝতে পারে না। মানুষের মাঝে ঈশ্বরকে দেখতে না পেলে নিজের মাঝে ঈশ্বরকে অনুভব করা অসম্ভব। কারও ভালো কিছু অনুভব করলে নিজের অনুভূতি সুন্দর হয়, শুদ্ধ হয়। এতে যে-আনন্দ পাওয়া যায়, সে প্রাপ্তির কৃতিত্ব নিজের হৃদয়-ঐশ্বর্যের। আপনি কারও চাইতে কতটা ভালো, সে বিচার করবেন না। আপনি ধরেই নিন, আপনি সবার চাইতে খারাপ, কিন্তু আপনি খারাপ হয়ে থাকার জন্য পৃথিবীতে আসেননি। ভালো হয়ে থাকার সকল যোগ্যতাই আপনার আছে—এই আত্মবিশ্বাসকে আপনার ইচ্ছেশক্তির সাথে সঠিকভাবে সমন্বয় করতে পারলে আপনি এখন যেমন আছেন, তার চাইতে উন্নত মানুষে পরিণত হবেন।
আত্মতুষ্টি মানুষকে পঙ্গু করে দেয়। স্বর্গ কেমন, নরক কেমন, কে খারাপ, কে মন্দ, কে দেখতে সুন্দর, কে দেখতে কুৎসিত, কে সৌভাগ্যবান, কে দুর্ভাগা, কে সাধু, কে পাপী, কে চরিত্রবান, কে দুশ্চরিত্র—এসব কিছু বিচার করার অধিকার বা দায়িত্ব আমাদের দেওয়া হয়নি। আমাদের নিজেদের সম্পর্কেই আমরা ঠিকমতো জানি না, অন্যদের সম্পর্কে কীভাবে জানব? কে স্রষ্টার প্রিয়, আর কে অপ্রিয়, এটা কে বলতে পারে? এটা কীভাবে আমাদের মাথায় আসে যে, আমিই শুদ্ধ, আমিই ঠিক, আর অন্যরা সবাই ভ্রান্ত? আহা, কী নির্বুদ্ধিতা! রীতিমতো হাস্যকর! অন্যের বিচার করা আমাদের কাজ নয়। আমরা যত বেশি অন্যের সমালোচনা করি, তত বেশি নিজেদের অসুন্দর দিকগুলির প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ি। এমন ঔদাসীন্য মানুষকে একেবারে শেষ করে দেয়।
যদি বিবেচনা করতেই হয়, তবে আমরা মানুষের উন্নত দিকগুলি নিয়ে ভাবব, সেগুলিকে বিচার করব। আমাদের সে বিচারে বেরিয়ে আসবে, আমাদের নিজেদেরকে কতটা বিকশিত করতে হবে। আমাদের জন্য কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, সেটার খোঁজ আমাদের কেউই কখনও দিতে পারবে না। কোনো বন্ধু, কোনো পিতা-মাতা, কোনো শিক্ষক, কোনো ধর্মগুরু—কেউই না। আমাদের ভেতরে যে-’আমি’টা বাস করে, তার কথা মন দিয়ে শুনতে হয়। আমাদের হৃদয়ের কণ্ঠস্বরটা কখনোই ভুল কিছু বলে না।
জলের খোঁজে জীবনটা নষ্ট না করে, কতটা তৃষ্ণার্ত হয়ে জলের খোঁজে মরছি, যদি হৃদয়কে তা বোঝানো যেত, তবে অফুরান জলের উৎস আপনাআপনিই আমাদের চোখের সামনে দেখতে পেতাম। হৃদয়ঘরে জলভর্তি কলসিটা কোনায় ফেলে রেখে একফোঁটা জলের খোঁজে সারা পৃথিবী ঘুরে মরি। হায়, “লালন মরল জল-পিপাসায়, থাকতে নদী মেঘনা/হাতের কাছে ভরা কলস, তৃষ্ণা মেটে না!”