ভাবনা: একশো নব্বই।
……………………………………..
আমি রাখি তারে
যত্ন করে,
ভালোবাসাঘেরা ছায়াতলায়…….
সে রেখেছে আমায়
মনের পৃথিবীর
ছায়াপথের বহিঃসীমায়…….
দিন কেটে যায় এমনি করেই।
কখনওই আর
ভালোবাসার
অজস্র অশ্রুর
এক ফোঁটার
হিসেব চাইব না তার কাছে।
প্রতি ফোঁটা লোনাজল গিলে
তার বদলে প্রতি ফোঁটা রক্তে দেবো—হৃদয় নিংড়ে।
একটা সময়ে
নিজেই নিজের শোধ নেবো
চিরতরে, নীরবে।
আমার অশ্রুসাগরে যখন
বেঁচে গেছ তুমি,
সাঁতারটুকু আর শিখো না,
ভয় নেই।
জলের গভীরতা আর বিস্তৃতি
হোক যতই,
ঠিক বেঁচে যাবে।
আকাশ তারা আকাশ মাঝে
থাকে প্রকাশে, কিংবা লুকিয়ে,
মনের তারা মন আকাশে
লুকিয়ে থাকে চুপটি করে—
খোঁজ নাওনি, তাই জানো না।
বলতে পার,
দুজনাতে হয় দেখা
কীসের ছোঁয়ায়?
পানি কঠিন হয়ে পাথরের মত শক্ত বরফ হয়ে যায়। তবু, বরফ ভাঙে, বরফ গলে; কিন্তু পাথর—শুধুই ভাঙে—জীবন, সময়, মানুষ! হায়! হয় তো এমন, হয় না?
আমায় যেভাবে দেখ—মেসেজ টোনে ফোনটা বেজে উঠে, কিংবা নীরবে একটা ছোট্ট নীল বাতি মিটমিট করে জ্বলতে থাকে, হয়তোবা একটু ভাইব্রেশন। ব্যস্ততার মাঝে একটু সুযোগে আগ্রহ নিয়ে মেসেজটা চেক করা হয়—মন বলে, হয়তো কোন প্রিয় মানুষ বা এমন কেউ, যার মেসেজের অপেক্ষাই মন করে ছিল। কিন্তু হায়! মেসেজটা যে আমার! মন আর মেজাজ দুটোই খারাপ হয়ে যায়! ফোনটা টেবিলের স্পর্শ পায় আচমকাই, একটু বেশিই স্বশব্দে! হয় এমন, তাই না?
মরতে যে চায়, সে তো আসলে মরেই যায়। মরতে চাওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে যে বেঁচে যায়, সে তো আগের সে নয়, সে অন্য কেউ। জীবিত ও মৃত্যুফেরত জীবিত—কখনওই এক মানুষ নয়। তপ্ত বালিতে পানি দিয়ে সে পানি খুঁজতে যাওয়া—বড্ড বোকামি। বালি যে পানি শুষে নিবেই নিবে! তবু কিছু মানুষ সে পানিরই খোঁজে জীবনটা কাটিয়ে দেয়। এক সময় নিজেই হারিয়ে যায়।
ইসসস্ কী সুন্দর শুকনো, ঝরঝরে, ঝরা পাতাগুলো গাছের নিচটায় বিছিয়ে আছে! কেমন যেন একটা মায়া-মায়া আবেশ। ইচ্ছে হচ্ছে, দুহাতে দুমুঠো নিয়ে এক দৌড়ে তোমার কাছে চলে যাই!
একটা নূপুর, আরেকটা নেই—হারিয়ে গেছে।
বাবার চিঠির একটা অংশ—তাও ছেঁড়া।
দুহাতে জমানো বৃষ্টি জল—কয়েক ফোঁটা আঙুল গলে পড়ে গেছে।
নানান রঙের স্বপ্ন—ফিকে হয়ে গেছে আজকে এসে।
তবু—
অনেক চুমু,
গভীর আলিঙ্গন,
চায়ের গন্ধ,
ঠোঙায় বাদাম।
যদিও—
শুকনো ফুল,
লোনা টিস্যু,
আর ছাই—যে লেখা পুড়ে গেছে, তার।
হারিয়ে যায়নি, লুকিয়ে আছে—
বোতল ভর্তি কান্নাজল,
একটা কাপড়ের পুতুল,
কাগজের পুরনো নৌকো,
একটা বুকের নদী,
একটা আনকোরা তুলি,
এক হৃদয় কষ্ট।
কত কী যে দিতে ইচ্ছে করে!
দেয়া হয় না কোনোকিছুই।
কখনও চাইনি, ইচ্ছের বিরুদ্ধে, কেবল ফিরিয়ে দেয়া যাবে না বলে, কেউ কিছু নিক—তাই।
ভাবনা: একশো একানব্বই।
……………………………………..
গতকাল একটা ভীষণ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছি। কী সেটা, বলছি, শুনুন। বেশি সময় নষ্ট করব না আপনার। মাত্র পাঁচ মিনিটে শেষ করব। দুরন্ত এক্সপ্রেসে দেবুল থেকে আমি যখন উঠি, আমার পাশের সিটটা ফাঁকাই ছিল। দেখে তো আমি মহাখুশি! খুব রিলাক্সড্ মুডে আধশোয়া হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি, কখনও একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছি, অনেকটা সময় কেটে গেল, এমন সময়, ঠিক মনে নেই, আমার গন্তব্যের তিন স্টেশন আগের স্টেশন দেবপুরের কাছাকাছি, কিংবা তার আগের স্টেশন সেবাতলার শেষের দিকে এক লোক, দেখতেশুনতে বেশ ভদ্রস্থ, মানতেই হবে, গুড লুকিংও বটে, আমাকে বললেন, “আমি কি এখানে বসতে পারি?” আমি উঠে দাঁড়িয়ে উনাকে বসবার জায়গা করে দিলাম। উনি কেন পছন থেকে উঠে সামনে এলেন, সেটা উনাকে জিজ্ঞেস করিনি, হয়তো সামনেই নেমে যাবেন, তাই বাসের সামনের দিকে এসে বসেছেন, এমনটাই ভেবেছিলাম। অনেকক্ষণ আমি আমার মত হাতের ‘মেমসাহেব’টা পড়ছি, ঘুমাচ্ছি, কোনও কথাবার্তা নেই। হঠাৎ জানা গেল, কোন দেশের জানি রাষ্ট্রপতি স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে আসছেন, রাস্তার জ্যামটা অনেকক্ষণ থাকবে। ঘড়িতে তখন ৩:৪০, আমি একটু জোরেই বলে ফেললাম, তাহলে তো আজকে বাসায় পৌঁছাতে খবর আছে! ব্যস্! এর পর শুরু হল আমার পাশের যাত্রীর আলাপ। আমি কি ডাক্তার নাকি, কী করি, কোথায় থাকি, বিয়ে করেছি কি না, এটা সেটা, অনেক প্রশ্ন। আমার প্রতি তার ইন্টারেস্ট বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি, এবং বিশেষ আকর্ষণটাও ঠিক বুঝতে পারছিলাম! সব মেয়েই ছেলেদের এই ‘বিশেষ’ আকর্ষণের খবর ওদের চোখের দিকে তাকিয়েই পেয়ে যায়। ছোটবেলা থেকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বড় হওয়ার ফল এটা। গতকাল একটা লালকালো মণিপুরি শাড়ি পরা ছিলাম। কেমন দৃষ্টিতে জানি উনি আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। বেশিরভাগ পুরুষমানুষই দৃষ্টি দিয়ে মেয়েদের ধর্ষণ করে, তাই আমি তেমন কিছু মনেও করিনি। এ ধরনের বদ লোকদের গা থেকে এক ধরনের অস্বস্তিকর ঘ্রাণ পাওয়া যায়, ওরা এতটাই কাছ ঘেঁষে বসে যে না চাইলেও তা ঠিক টের পাওয়া যায়। যা-ই হোক, আমি খুব স্বাভাবিক স্বরেই অন্য দিকে তাকিয়ে তার কথার উত্তর দিচ্ছিলাম। কথা প্রসঙ্গে যখন জানতে পারলাম যে উনি ডাক্তার, সপ্তাহে একদিন নিজের গ্রামে গরীব লোকদের ফ্রি চিকিৎসা করেন, এবং ডাক্তারির পাশাপাশি তার নিজ জেলায় ‘শ্রয়ণ’ নামে একটা বৃদ্ধাশ্রম চালান, তখন উনার প্রতি স্বাভাবিকভাবেই আমার আগ্রহ বেড়ে গেল, এবং বৃদ্ধাশ্রম বিষয়ে আমরা অনেকটা আলাপ করলাম। তার ফ্যামিলি নিয়েও জানলাম, তার বাচ্চারা কোথায় পড়ে, ভাবি কী করেন, বাসা কোথায়, উনি সে সবও জানালেন। উনার ব্যাপারে আমার আগ্রহ বাড়ার কারণ হচ্ছে, আমি নিজেও অসহায় বৃদ্ধদের নিয়ে কিছু করতে চাই। আমি সপ্তাহে দুইদিন ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে কাজ করি—এটা বলা মাত্রই উনি খুব উৎসাহের সাথে বললেন, “আমাকেও আপনাদের এ কাজে অ্যাড করে নিন না! আমি ইন্টারেস্টেড আপনাদের সাথে কাজ করতে।” বলেই উনি আমার নাম্বারটা চাইলেন, আমিও সরল মনে দিয়ে দিলাম। উনি উনার নাম বললেন, ডাক্তার আব্দুল হাই। উনার নাম্বারটা সেভ করার সময় আমার মাথায় রিটনের একটা ছড়া ঘুরছিল—আব্দুল হাই করে খাই-খাই…….কিন্তু এমন রসিকতা এত স্বল্প পরিচয়ের কারও সাথে করা যায় না বলে চেপে গেলাম চাপা একটা হাসি দিয়ে। যেহেতু দেবপুরের ১২ মাইলের মধ্যেই উনার বাসা, তাই উনি আমাকে দুপুরে খেতেও ইনভাইট করলেন। আমি হেসে ‘না’ করে দিই। গাড়ি তখনও এক ইঞ্চিও নড়েনি। বাজে প্রায় সোয়া চারটা। আমাকে সেই ডাক্তার ভদ্রলোক (তখন পর্যন্ত উনি আমার পাশে বসলেও আমার শরীরে ভুলেও কোনও ভাবে উনার সামান্যতম টাচ্ পর্যন্ত লাগেনি, অতএব উনাকে ভদ্রলোক মানতেই হচ্ছে) বললেন, “শশী আপা, এই জ্যাম ছুটতে পাঁচটা বাজবে। আপনার বাসায় ফিরতে অনেক দেরী হবে। আপনি চাইলে আমার সাথে হেঁটে ওই পাড়ে গিয়ে রিক্সা নিতে পারেন। আপনাদের স্কুলটা নিয়েও কিছু কথা বলা যাবে। আমি আপনাদের কাজ নিয়ে জানতে চাই। আসুন…….” বলেই নেমে গেলেন। আমি না নেমে গাড়িতেই থাকলাম।
গেমের শুরু এখানেই।
একটু পরই রিং এল। স্ক্রিনে ডিআরডট এইচঅ্যাআই। রিসিভ করলাম।
“হ্যালো শশী আপা, আপনি নামেননি? আমি নিচে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি তো! নামুন নামুন!”
“ওহ্ সরি ভাইয়া। আচ্ছা, আমি আসছি।”
অনর্থক জ্যামে বসে না থেকে চলে যাওয়াটা খারাপ হবে না ভেবে আমি গাড়ি থেকে নামতে চাইলাম। এবং, এটাই ছিল আমার ভুল সিদ্ধান্ত। কেন আমি নেমে যাচ্ছিলাম, সেটা আমি সত্যিই জানি না। হেল্পারকে বললাম আমি দেবুল থেকে উঠেছি, এখানে নামব। আমার কিছু টাকা ব্যাক করা যাবে কি না। আরও জিজ্ঞেস করলাম জ্যামটা ছুটবে কখন। আমি কখনওই এত কম ভাড়া ব্যাক নেয়ার মত মেয়ে না। কিন্তু কেন কালকে টাকা ফেরত চেয়েছি, আমি নিজেও জানি না। জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মিস্টার হাই হাই তুলছেন আর যথেষ্ট উদ্বিগ্ন চোখেমুখে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। হেল্পার যেন আমাকে বাঁচিয়ে দিল। ছেলেটা বলল, “আমরা তো গাড়ি নিমতলা পর্যন্ত রিজার্ভ করে এসেছি। আপনার জায়গায় তো অন্য কাউকে নেয়া সম্ভব না। সরি, টাকাটা ফেরত দেয়া যাচ্ছে না। আর কিছুক্ষণের মধ্যে জ্যাম ছুটলেই গাড়ি ছাড়বে। আপনি এখানে নেমে কি হেঁটে সেই নিমতলা যেতে পারবেন নাকি? বাকিটা আপনার নিজের বুদ্ধি, দেখেন যা ইচ্ছা।” আমি বললাম, “হাঁটব কেন? সামনে গিয়ে অন্য গাড়িতে যাব। সে ভাড়াটা আমাকে দাও। কিন্তু জ্যাম ছাড়বে কখন?” “না আপা, টাকাটা দিলে মালিককে আমার পকেট থেকে টাকা বুঝায়ে দিতে হবে।” হঠাৎ খেয়াল হল, আমার সাথে যারা নিমতলা যাবার জন্য উঠেছে তারা কেউই গাড়ি থেকে নামেনি। আমি হাত নেড়ে হাই সাহেবকে বিদায় জানিয়ে আমার সিটে ব্যাক করলাম।
ক্লাইম্যাক্স সেখানেই। ডাক্তার হাই তখন সঙ্গে-সঙ্গে দৌড়ে আমার জানালার কাছে এসে একটু উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, “আপা, আপনার কি মাথা খারাপ! এই জ্যাম কখন ছুটবে তার ঠিক আছে কোনও! আপনি নামেন, চলেন আমার সাথে।” পারলে উনি জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমাকে জানালা দিয়েই টেনে নামান যেন! ততক্ষণে বাসের সবার দৃষ্টি আমার দিকে। আমি হেসে তাকে বললাম, “না ভাইয়া, অসুবিধা নেই। আপনি যান।” “কী আশ্চর্য! আপনি নামবেন না? আমি এতক্ষণ ধরে আপনার জন্য ওয়েট করছি!” জোর করে বাসের জানালা দিয়ে এক প্যাকেট পপকর্ন ঢুকিয়ে দিয়ে মুখে একটা মেকি হাসি ফুটিয়ে তুলে একটু দূরে গিয়ে উনি দাঁড়িয়ে রইলেন। উনার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।
সত্যিই এর কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি ছাড়ল, পাঁচটা বাজার মিনিট দশেক আগেই। ছয়-সাত মিনিটের মধ্যেই ওই হাই সাহেবের ফোন আসল দুইবার, কারণ প্রথমবার রিসিভ করিনি, আর দ্বিতীয়বার নম্বরটা ব্লক করি। আরেকটা নাম্বার থেকে ফোন এল। রিসিভ করে উনার কণ্ঠ চিনেই ব্লক করে দিলাম। চৌধুরী বাজার পার হতেই পেছনে দেবুল থেকে ওঠা এক মুরুব্বি ভদ্রলোক আমাকে বললেন, “আপনি তখন ওই লোকের সাথে কোথায় যেতে চাচ্ছিলেন? আপনাকে বোঝানোর আমার কিছুই নেই, তবে কাজটা আপনি ঠিক করেননি। বিষয়টা আমার ভাল লাগেনি। আপনার বয়সি আমার মেয়ে আছে, তাই এত কথা বলছি। চেনাজানা নাই এমন একটা লোকের সাথে আপনি এভাবে নামতে যাচ্ছিলেন!” মোহদনগর থেকে ওঠা এক ভদ্রমহিলা এতক্ষণ আমার পাশে বসে ছিলেন, তিনি আমার কাছ থেকে লজেন্স চেয়ে খেয়েছেন একটু আগে। তিনিও সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালেন। আমাকে বললেন বাসে অপিরিচিত মানুষের সাথে এভাবে কখনও যেন নেমে না পড়ি। আমি খুবই লজ্জিতভাবে খালি বললাম, “না উনার সাথে অনেকক্ষণ আলাপ হল তো…….আর পরে যখন দেখলাম, আপনারা কেউই নামছেন না, তখন আমিও আর নামলাম না।”
গতকাল রাতেই উনার আরও ৫টা নাম্বার ব্লক করতে হল আমাকে। কী যে ভীষণ বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি, তা এখনও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
ভাবনা: একশো বিরানব্বই।
……………………………………..
যোধন, বড় অসহায় বোধ হয়। আমার জীবনের ছক যেভাবে সাজাই, যেমনটা দেখে অভ্যস্ত থাকি, তার কোনওটাই ঠিক সময়ে আমার সামনে কেন এসে ধরা দেয় না? অথবা আমিই সঠিক সময়ে সেখানে কেন পৌঁছতে পারি না, তা একমাত্র আমার ভাগ্যই জানে। এভাবে সব কিছু কেবল আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলে। প্রশ্নের ভার বইতে-বইতে আর মুখোমুখি হতে ইচ্ছা করে না কোনও জিজ্ঞাসার। আমার জীবনের সকল উত্তর আমাকে বারবারই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রতিটি উত্তরের জন্য কয়েকটি প্রশ্ন থাকেই!
পথ তো অনেক রকমই হয়ে, জন্ম থেকে আজ অবধি কেন অমসৃণ পাথুরে পথটাই আমার চলার জন্য বরাদ্দ রয়ে গেল, জানি না। জন্মালাম এক বিরাট পরিবারের নিদারুণ সঙ্কটের সময়। তারপরও সেখানের পরিধি বেড়েই চলছিল কেবল প্রাকৃতিক নিয়ম রক্ষায়। আমার পরেও সেখানে দেখতে-দেখতে নতুন মুখ এল আরও পাঁচটি। প্রতিদিন কেবল এটাই শিখতে হয়েছিল, আমাদের বাঁচতে হলে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে হবে। কোনও না কোনওভাবে এগিয়ে যেতেই হবে। চেষ্টা করতে থাকলে স্রষ্টা নিশ্চয়ই সহায় হবেন, এটা বিশ্বাস করে আমরা বড় হয়েছি। এক সময় মায়ের সমস্ত গয়না একে-একে বন্ধক পড়তে থাকল, বিক্রি হল ঘরের আরও কিছু জিনিস। তারপর গ্রামের জমিজমা যা ছিল, তার প্রায় সবই বিক্রি হয়ে গেল। গরুছাগলও বাদ গেল না। তবু যখন ক্ষুধা মিটানোর ব্যবস্থা হচ্ছিল না, বাবার ব্যবসা কেবলই লোকসান গুনে-গুনে এগুচ্ছে, ঠিক তখনও দেনা চাইবার জন্য অবশিষ্ট ছিল না আর কেউ-ই। পাড়া প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়স্বজন কেউই আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। অবশ্য, তেমন কোনও সহৃদয় ধনী লোকের সাথে আমাদের পরিবারের সখ্যতা ছিল না কোনোকালেই। ঢাকায় যেখানে থাকতাম, সে জায়গা বিক্রি করে গ্রামে চলে যাওয়ার পরামর্শ আসত সবদিক থেকেই। আমি সেই থেকে ব্যবসাকে ভীষণ আতঙ্কের চোখে দেখি। ঝুঁকির পর ঝুঁকি জীবনকে কতটা নিঃশেষ করে দিতে পারে, আমি সেটা জানি। আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন সেভাবেই শুরু। তাই অবধারিতভাবেই দরিদ্র তহবিল ছিল আমার ন্যায্য অধিকারের ঘরে। আমার জন্য নতুন বই অথবা খাতা দুইই ছিল সোনার হরিণ সমতুল্য। সেভাবেই আমার বেড়ে ওঠা। লেখাপড়ায় ফাঁকি দেয়া তাই আমার কাছে ছিল চরম বিলাসিতা। সে কি আর সাজে আমার? তাই পড়াশোনাই ছিল আমার একমাত্র ব্রত। প্রচুর প্রচুর প্রচুর পড়াশোনা করতাম, মানে, করতে হয়েছে। শিক্ষকরা মনোযোগী শিক্ষার্থীদের যতটা স্নেহ করেন, তার সবটুকুই পেয়েছিলাম স্কুলে। বেতন আর বইয়ের পাশাপাশি নতুন ড্রেস পর্যন্ত মিলে যেত উদার শিক্ষকদের মমতার গুণে। এভাবেই স্কুল পেরিয়ে কলেজে গেলাম। ততদিনে ভাইয়া বুয়েটে পড়েন, আপু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওরা দুজনই স্যারদের প্রজেক্টে কাজ করে সাংসারিক ভার কিছুটা লাঘবের জন্য নিরন্তর চেষ্টা করছে। ইন্টার পাশ করেই বাকি দুই বোনও বিভিন্ন সরকারি প্রজেক্টের কাজে বাসা ছেড়ে মাসের পর মাস ইউনিয়ন আর উপজেলায়-উপজেলায় টিম হিসেবে ঘুরছে। বাকিরা আমরা নিজেদের খরচ যতটা সম্ভব টিউশনি আর কোচিংএ ক্লাস নিয়ে চালিয়ে নিচ্ছি। ইন্টারে কোনও স্যারের কাছে যাতে পড়তে না হয়, সে চেষ্টা করেছি। ভুল ছিল সিদ্ধান্তটা বুঝি, কিন্তু আমার তো অন্য কোনও উপায়ও ছিল না—ভাইবোনদের উপর আর কতটা চাপ দেয়া যায়! স্বপ্ন আর চেষ্টার সম্মিলনে তাই প্রত্যাশিত গ্রেড অধরাই রয়ে গেল, আর হলিক্রস কলেজে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করা আমি ছিটকে পড়লাম স্বপ্ন থেকে বাস্তবে। আমার আর্কিটেক্ট হওয়ার স্বপ্ন ছিল। হল না। বড় ভাইয়া স্বপ্ন দেখতেন, ডাক্তার হব, পারলাম না। বুয়েট কিংবা মেডিক্যালে চান্স না পেয়ে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজিতে। নোটবুক, বই, যাতায়াত খরচ নিজেই মেটাতাম, তবে সবসময় একটাই ভাবনা গ্রাস করত—নিজের অন্ন আর বস্ত্রের জন্য এখনও আমি নির্ভরশীল আমারই বড় ভাইবোনের কাছে। এর থেকে মুক্তি চাই, নিজের পায়ে শক্তভাবে দাঁড়ানো দরকার—এই বোধটা তীব্রভাবে খোঁচাতো কেবল। যে সময় অন্যরা প্রেমিকের চোখে নির্ভরতা আর স্বপ্ন খোঁজে, আমি তখন জীবনের ভারটা কীভাবে নিজের হাতে রাখা যায়, সেই সূত্রের খোঁজে হন্যে হয়ে ছুটছি।
আমার সবচেয়ে ছোট তিন ভাইবোনকে সংসারের রুদ্ররূপটি তেমন করে বুঝতে হয়নি। তবে একটা দারুণ পরিবর্তন ঘটে গেছে ততদিনে। আমি ক্লাস এইটে থাকতে বাবা প্রথম ব্রেইন স্ট্রোকটা করেন, আর সেটাই ছিল সবচেয়ে বড়, এরপর আরও দুই-তিনবার স্ট্রোক করেছেন, যার প্রতিটিই ছিল ছোট-ছোট, মানে মাইল্ড স্ট্রোক। বাবার এক মামা কলকাতায় থানার দারোগা ছিলেন, শুনেছি উনি হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করতেন। বাবা উনার কাছ থেকে বিদ্যেটা টুকটাক শিখে নেন। একটা পুরনো দিনের কাঠের মেডিসিন বক্স ছিল। বাবার কাছ থেকে খুব ছোটবেলায় আমারও ওতে হাতেখড়ি হয়। জ্বর, মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, অম্বল, ফোঁড়া, কিংবা ক্রনিক কোনও ডিজিজের বই দেখে বা কখনও দেখা ছাড়াও লক্ষণ মিলিয়ে চিকিৎসা দিতে পারতাম বেশ। বাবার স্ট্রোকের সময় সঠিক সময়ে নাক্স ভমিকা ওষুধটা দিতে না পারলে হয়তো অনেক কিছুই আজকের মতন হত না। হ্যাঁ…….হয়তো! যা হোক, সেই ক্লাস এইটে পড়ার সময় থেকে সব ছেড়ে বাবা পুরোপুরি ঘরে বন্দি অবস্থায় কাটান। এখন পর্যন্ত এ ২১টি বছর রোজই মৃত্যুর প্রহর গোনেন। এপারে দুইপা রেখেও কেমন করে একটা মানুষ ওপারে যাওয়ার সকল প্রস্তুতি সাজিয়ে চলেন, তা তাকে না দেখলে বোঝা কঠিন। একটা মানুষ খাচ্ছে, টিভি দেখছে, রাজনীতির চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার চলছে সমান তালে, একই সাথে গল্প বিনোদনও ফুঁকছে ধুমসে, অথচ যে-ই আসছে, তাকেই শোনাচ্ছে, “আমি তো ভাই এক পা কবরেই রেখেছি।” সত্যিই তা-ই। এক ছাদের নিচে থেকেও বাবা-মা’র বিছানা ২১ বছর ধরেই আলাদা। আর ইনফেকশন এখনও পুষে চলেছে পরম যত্নে; ডাক্তারও বলেছেন, এভাবেই চলবে।
আমরা ভাইবোনরা বেড়ে উঠেছি হাত ধরাধরি করে সংগ্রামে আর সংঘাতে। একদম শেষের যে তিনজন, ওরা এ কষ্টের খোঁজ পায়নি ততটা। ভাইয়া আপুরা আমরা কেউই চাইনি যে কষ্টটা যে সংগ্রামটা করেছি, অসময়ে তা ছিনিয়ে নিক ওদের চলার পথের মসৃণতাকে। তবু কথা থেকে যায়, ওরা বাবার টাকায় বেড়ে ওঠেনি, বেড়েছে ঋণের বোঝায়—ভাই আর বোনের দয়ামায়ায়। চাইলেই তাই সব পাওয়া হয়নি কোনও দিনই। বেশিরভাগ সময়ই চাইবার সংকোচটাই কাটেনি হয়তো। আমার মধ্যে অবুঝ আক্রোশ কাজ করত প্রায়ই, সবার বাবা যে দায় নেয় নির্দ্বিধায়, আমার বাবার দায়িত্বটা তবে কোথায়? অবশ্য এই টানাপড়েনে জীবন থেমে থাকেনি, ঠিকই এগিয়ে গেছে।
ভাবি, আমার বাবা জীবন নিয়ে বাজি খেলেছে, স্কুল পর্যন্ত পাস না করেই বাড়ি ছেড়েছে, ব্যবসা করেছে, ঢাকায় এসে জায়গা কিনেছে, বিয়ে করে সংসারী হয়েছে, এগারো সন্তানের জন্ম দিয়েছে। জীবনে প্রথম বারো বছর যে পরিশ্রম করেছে, তার উপর আমরা যেভাবেই হোক, আঁকড়ে থেকে নিজেদের একটা ভিত দাঁড় করিয়েছি। এই ঢাকায় থাকার এটুকু জায়গা না থাকলে, হয়তো আমাদের হারাতে হত কোন অন্ধ পল্লীতে, ভাসমান বস্তিতে, অথবা গ্রামে। শুয়েবসে খেলে রাজার ধনও যে ফুরায়, তা কে না জানে! কিন্তু আমরা হারাইনি। ঘুরে দাঁড়িয়েছি। যে জমি বিক্রি করে চলে যাবার সদুপদেশ দিয়েছিল আশেপাশের সবাই, সেই জমিতে সাড়ে ছয় তলা দালান উঠেছে। হোক তা লোন করে, জমি মর্টগেজ রেখে, তবু সে টাকা সুদেআসলে শোধ তো হচ্ছে। পুরনো যা ঋণ ছিল সবার কাছে, তা শোধ হয়েছে ভাইয়া আপুর চাকরির টাকা দিয়েই। ভাইয়া বিয়ে করেছে, ওর দুই মেয়ে বড় হচ্ছে। গাড়িও কিনেছে। ভাইয়া ম্যাজিস্ট্রেট হয়েও চাকরিতে জয়েন করেনি, কারণ সে বেতনে এত বিশাল সংসার চলত কীভাবে? আজ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ইউএনডিপি’র কনসালটেন্ট হয়ে মাসে দারুণ বেতন পাচ্ছে! তবে তার জীবনটা একই সাথে নিশ্চিত আর কখনও অনিশ্চিত জীবন, কারণ তার কামাইয়ের সবই প্রজেক্ট নির্ভর।
এখানে এখন যার-যার জীবন তার-তার হাতে। বোনেরা বিয়ে করেছে নিজের চাকরির জমানো টাকা দিয়েই। ছোট বোনটাও। আমি আর কী-ই বা দিয়েছি ওকে! সামান্য উপহার দিতে পেরেছি, তাও হাজার দশেক মোটে। হ্যাঁ, মার গয়নাগুলি হয়তো আবার গড়েছে—হয়েছে বালা, চুরি, হার। ভাইবোনরাও গড়িয়ে দিয়েছে কিছু-কিছু। কষ্টের সেই সব নীল হয়ে যাওয়া দিনগুলি দূরে ফেলে এগিয়ে এসেছি অনেকটুকু। আমি ক্যাডার পোস্টে চাকরি করছি, যার ন্যূনতম সামাজিক মূল্য অন্তত আছে, সাথে আছে নিশ্চয়তা। অনিশ্চিত অতীত জীবনে যেটা ছিল আমার সব থেকে বড় চাওয়া। তবু থমকে থাকা জীবন যেন আর এগোয় না। দিন আসে, দিন যায়। রাত নামে, ভোর হয়। জীবনের সুখগুলি ছোঁয়া আর হয় না। এখানে জীবন শুকিয়ে গেছে, যোধন। একটা পাথুরে জীবনে কেবলই বেঁচে আছি। শ্বাস নিচ্ছি সেই অর্থে। আমি আর পাথর থাকতে চাই না। আমি জীবন চাই, একটা জীবন খুঁজি কেবলই। এখনও পর্যন্ত যা পেয়েছি, তা দারুণভাবে স্বপ্নাতীত। কে জানে, হয়তো, সামনে আরও সুন্দর কিছুই অপেক্ষা করছে আমার জন্য। এ অপেক্ষাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
ভাবনা: একশো তিরানব্বই।
……………………………………..
আজকে ইফতারে ছোট ভাইটাকে ইফতার টেবিল সাজানোর কাজে দারুণ ভাবে লাগাতে পেরেছি। নিজেকে সার্থক ম্যানেজার মনে হচ্ছে। আমাদের মা তার ছেলে সন্তানগুলিকে পুরাই অকর্মণ্য বানিয়ে রেখেছেন, অবশ্য সাত বোনের ভাইগুলি অকর্মণ্যই হবে, এতে আশ্চর্যের কী আছে? আমাদের ভাইগুলি ঘরের একটা কুটাও নাড়ায় না, অথচ শুধু বড় না, বিশাল-বিশাল বাণী প্রসব করে চলে। তখন মেজাজ সপ্তমের উপরে যদি আরও কিছু থাকে, সেখানে পৌঁছে যায়। গত কয়দিনে কলেজ, রান্না, পরিবেশন, গৃহ ব্যবস্থাপনা সব কিছুতেই নেতৃত্বের ভূমিকায় থেকে প্রায় একক দায়িত্বে সম্পন্ন করতে গিয়ে বারবারই মনে হচ্ছিল, বোধ হয় আর সম্ভব না। আমি পারব না, আমি ব্যর্থ।
কলেজ না থাকায় নিজেই টুকটাক বাজার করে এনে শান্তি মতন রান্না করতে পারলাম। আজকের মেন্যু: ছোলা ভুনা, পিঁয়াজু, আলুর চপ, সালাদ, চিকেন সাস্লিক, ডাল, পটল ভাজি, ভাত, লুচি, সুজির হালুয়া আর সরবত। সাথে ফল (খেজুর, কলা, নাসপাতি) আর দই-চিড়া। সংসার ব্যবস্থাপনা, রান্না, পরিবেশনা, সর্বোপরি চাকুরি—সব একসাথে হয় না। যখন তা করতে হয়, তখন ওই সময় নিজেকে আর মানুষই মনে হয় না। যে পরিবারে আমার জন্ম, চাকরি না করলে নিজের অস্তিত্বই বাঁচত না। ভাগ্যিস শিক্ষা ক্যাডারে হয়েছিল, সহজেই বাড়ির কাছে বদলি হয়ে আসা যায়, আর তাছাড়া চাপ কিছুটা কম বলে বাসায়ও সময় দেয়া যায়। নয়তো এ সাধের সংসার কত আগেই কোন গোল্লায় যে যেত!
এটা সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র তখন তোমাকে নিয়ে যে পাগলামিটা করেছিলাম, তার জন্যই। ওই পাগলামি মাথায় না চাপলে অত পড়তাম নাকি? ভাগ্যিস! সে কথা এখন মনে পড়লেও হাসি পায়! সেজন্যই বলে, যা হয়, ভালর জন্যই হয়। আমার ইচ্ছাই ছিল, এমন চাকরি করব যে, সপ্তাহে মাত্র দুইতিন দিন কাজ করব, বাকি সময় ঘর সাজাব, আপন মানুষটাকে সময় দিব, তার জন্য নিজেকে সাজাব। আমি এতদিন পর্যন্ত টাকার পিছনে ছুটিনি, এখনও ছুটব না। যেটুকু অবসর, তাই নিয়ে আমার আপন স্বর্গ রচনা করব। শুধু তুমি সেখানে থেকো, কেমন?
গত কয়দিন ধরে অতিরিক্ত চাপের কারণে শারীরিক কষ্ট হয়েছে অনেক, মেজাজও ঠিক ছিল না। ছোট ভাই দুইটাকে হয় কথার উত্তর দিইনি, নয়তো বকা দিয়েছি প্রতি উত্তরে। এখন ঠাণ্ডা হাওয়ায় সারাদিনের পরিশ্রম জুড়িয়ে কলেজ থেকে শান্ত সবুজ প্রকৃতিকে পাশ ঠেলে বাড়ি ফিরছি দেউন্দির চমৎকার রাস্তাটা ধরে। খারাপ লাগছে ওদের বকাবকি করার জন্য। আচ্ছা, ওরা কি বোঝে ওদের বকলে যে আমারই কষ্ট হয় বেশি?
ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। মনটা কত কিছু ভেবে চঞ্চল হয়ে আছে সেই কখন থেকে। সব কিছু ভাল লাগছে, আবার কিছুই ভাল লাগছে না। যেটা ভাল, সৃষ্টিকর্তা সবসময় সেটাই নির্ধারণ করে রাখেন আমাদের জন্য, তবুও আমরা মানুষ প্রায়ই ধৈর্যহারা হয়ে পড়ি।
তুমি ইদানিং উত্তর দাও না ঠিক মত। আসলে কোথায় আছ, ব্যস্ত আছ কি না কে জানে, হঠাৎ আমার ফোন বা মেসেজ যদি তোমাকে বিপদে ফেলে দেয়, সে ভেবে ফোন আর টেক্সট করি না। এই এক আশা, যদি এখানে কখনও সুযোগ সময় বুঝে উত্তর দাও!
কেমন আছ এখন? জানতে পারলে ভাল লাগবে।
ওদেরকে কীভাবে বোঝাই! কোন দোয়া দরবারে কিচ্ছু কাজ হবে না। কোন পীর-ফকির-ওঝা কিছুই বদলাতে পারবে না আমার। যতক্ষণ আমি নিজ থেকে না চাইব, কিছুই বদলাবে না। আর আমি কেমন করে বলি যে, আমি আসলে কী চাই? তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই গ্রহণ করা আমার সাধ্যাতীত। আবার এও ঠিক, তোমাকে পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি বুঝে গেছি, এ জীবনে না পারব কাউকে খুশি করতে, না পারব নিজে সুখী হতে।
তুমি শুনতে বিরক্ত হচ্ছ? হলে হও গিয়ে! এসব তোমাকেই তো বলব, সেদিন তুমি আমাকে বুঝিয়েশুনিয়ে না ফেরালে আমি তো তন্বীর ভাইকেই সত্যি-সত্যিই বিয়ে করে ফেলতাম। তন্বী এতদিনে আমাকে আপু না ডেকে ডাকত ভাবি। হয়তো সংসার বেড়ে এতদিনে দুই থেকে তিন কি সাড়ে তিন হতাম। আমার চাকরি হত না, কোনও অবলম্বন হত না। তা হোক না সে যেমনতর, একটু দুর্বল মেধার মানুষ, একটু মাথাগরম স্বভাবের অতি সরল আর বোকার মতো দাম্ভিক একটা মানুষের সাথে জীবন কেটে যেত! গিটারে নতুন সুরটা তো তুলত সে আমার জন্যই! অবশ্য, কোনও জীবনের এত সহজ রায় সে জীবনটা কাটানোর আগ পর্যন্ত কিছুতেই বলা যায় না। ওরা কেন বোঝে না জোর করে আর যা-ই হোক, সংসার হয় না। অমন সংসারে অন্তত আমি বিশ্বাসী নই।
তুমি অমন করে না বললে আমি আমার আড়াল ভাঙতাম কখনও এমনি করে? মনে তো হয় না! আজ বলবে আবার সেই আড়াল তুলতে, হঠাৎ করে দূরে যেতে—নাহ্, সেটা আমি পারব না। আমায় কাছে টানতে না পার, দূরে অন্তত ঠেলে দিও না কখনওই।
ভাবনা: একশো চুরানব্বই।
……………………………………..
প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়ছে প্রকৃতি,
সাথে পুড়ে যাক—সব ভালোবাসা!
আকাশ কালো করে নামুক বৃষ্টি,
সাথে নিয়ে আসুক—অভালোবাসা!
সে-ই ভাল!
এই তারা, শোন!
ওই আকাশে
চুপটি মেরে বসে,
সবই তো দেখিস!
বলতে পারিস,
সে কেন নেই ভাল?
সে কি কখনও বলবে আমায়?
আরে ধুউউররর্!
আমি কে তার,
যে বলবে?
এ জানতে চাওয়া,
তাই কেবলই বৃথা!
বল না রে তুই!
বলবি আমায়, লক্ষ্মী তারা?
তুইও কি সবার মতই স্বার্থে চলিস?
কেউ কিছু বলে না। কিছুই ভাল লাগছে না। কেউ যদি বুঝত!
তোমাকে ভালোবাসি!—কী এক গভীর অনুভূতির, অথচ মাত্র দুই শব্দের ছোট্ট বাক্যটা বলার জন্য কখনও-কখনও বিশাল এ পৃথিবীতে একজন মানুষও থাকে না। কিংবা, যে-ই একজন মানুষকে বলতে ইচ্ছে করে, তার কাছে এই কথাটার গভীরতা হয়তো একেবারেই শূন্য। তাই আর বলা হয়ে ওঠে না। একজন বিএফ, জিএফ বা বর, বৌ থাকা না-থাকার সাথে এ কথা বলা না-বলার কোনও সম্পর্ক নেই।
একটা ক্ষুদে বার্তা পাওয়ার পর তুমি আমাকে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ সম্বোধনে সম্মানিত করেছিলে। মনে পড়ে, কী পাঠিয়েছিলাম?
ভয় পেয়ো না, আমাদের সব কথা আমাদের মধ্যেই থাকবে। আমার সব দুঃখকষ্টের অনুভূতি শুধু তোমার সাথেই শেয়ার করা হয়। আমার এই কথাগুলো শুধুই তোমার জন্য লেখা, তোমাকে ভেবেই। তাই আর কারও সাথে তা কখনওই ভাগ করব না। আমার জন্য এভাবে থাকবে তো সবসময়?
যখন খুব বেশি দমবন্ধ লাগে, তখন জানালা দিয়ে ওই আকাশটা দেখি। বুক ভরে শ্বাস টেনে নিই, এ যেন নিজেকে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলা! আমার যখন খুব বেশি মন খারাপ হয় তখন তোমাকে খুঁজি! কারণ তুমি আমার খোলা আকাশ, মুক্ত বাতাস, অবারিত প্রকৃতি। এই প্রকৃতিতে অবগাহনের সুযোগ কি আমার জন্য অবারিত থাকবে না সবসময়? বাসার মানুষজনের অতি সচেতনতা আর ভাল লাগে না। চাকরিও করতে হবে, এক্সট্রা ডিগ্রিও নিতে হবে, আবার একা-একা জার্নিও করা যাবে না—এ সব কোনও কথা! এরা ভাল যন্ত্রণা দিতে পারে—ঢাকার আশেপাশে ঢাকার আশেপাশে করতে-করতে পারলে আমাকে বাসাতেই বসিয়ে রাখবে—বাসায় থাকো, বাপ-মা ভাই-বোনের সেবাযত্ন করো। যখন যার দরকার ডাকো, আমি তো আছিই! বান্দা হাজির টাইপ হয়ে থাকো আরকি। এসব করতে-করতে তিনটা চাকরি থেকে ছাড়িয়ে নিল। মাঝখান থেকে লাভের লাভ কী হল? যত অশান্তি সব আমার! ঘরেও যে শান্তিতে থাকব তার কী উপায়, কয়দিন পরপর এই পাত্র দেখো, ওই পাত্র দেখো, এইসব ঢং আর কত ভাল লাগে! জীবনটা একঘেয়ে হয়ে গেছে, আর ভাল লাগে না বাঁচতে।
সব ছেড়ে ছুঁড়ে মরে যেতে পারলে বেশ হত। জীবন মানেই একগাদা যন্ত্রণা! ভাগ্যও সহায় হয় না। খালি ঘোরায় আর ঘোরায়! জীবন আর কত কিছু দেখাবে আমায়?
মানুষ যখন অনেক বড় কোনও ভূমিকায় অবতীর্ন হয়, তখন আমরা আমজনতা ভুলে যাই যে, সেও আমাদের মত রক্ত মাংসের গড়া মানুষই, ভিন্ন কিছু নয়। তারও হৃদয় আছে, প্রেম আছে, দুঃখবোধ হয়! আমাদের প্রত্যাশা অতিমানবের মানবিকতা ছাড়িয়ে আরও অনেক ঊর্ধ্বে পৌঁছে যায়! তখন আর তাকে ক্ষমা করতে পারি না। কিন্তু মানুষ তো মানুষই! তাই অতিমানবও তার মানবিকতার সীমা অতিক্রম করতে পারে না! মহৎ ব্যক্তির জীবনের ক্ষুদ্র অধ্যায়গুলিকে আমরা কেন মেনে নিতে পারি না? আমাদের কি নেই সেগুলি? ওসব সবারই থাকে, নাহলে সে জীবন পূর্ণ হবে কীভাবে! এভাবেই চলে আমাদের সীমার মাঝে অসীমের নিরন্তর সন্ধান!
ভাবনা: একশো পঁচানব্বই।
……………………………………..
একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের রাস্তার দুই প্রান্তে দুই জন থাকলে কেউ একজন হাঁটা নিলেও, ঠিক এক সময় দূরত্ব ঘুচে যায়। কিন্তু সম্পর্কের দূরত্ব কেবল একলা চলায় কখনও কমে না, বরং কখনও-কখনও দূরত্ব বেড়েও যায়।
“রাতে খেয়েছেন?”
এতদিন পর এসে, আমার স্রেফ এই কথাটা জিজ্ঞেস করাটাও আমার বিপরীতে আপনার কাছে পার্সোনাল ব্যাপার হয়ে গেল, ঋত?
আসলে নিজের কাছ থেকে একটা ত্যক্ত ছিঃ ছাড়া কিছুই ডিজার্ভ করি না আমি। নাহ্, আপনি ঠিকই করেছেন, ঋ……
শুধু আমিই মাঝেমাঝে অহেতুক এক-ব্যক্তিক ভালোবাসায় ভুলে যাই, ‘ব্যক্তিগত’ ব্যাপারের পরিধি ব্যক্তিভেদে অনেক রকমের হয়। সত্যিই কেবল বয়সেই বড় হয়েছি।
আচ্ছা, ছোটবেলায় আপনি কখনও ‘কটকটি’ খেয়েছেন? ওটা গুড়ের মধ্যে বাদাম দেয়া একটা খাবার। মাঝেমাঝে এত শক্ত থাকত, কামড় দিলে ঠিক বুঝতাম না, কী ভাঙল—দাঁত? নাকি কটকটি? আব্বু খুব বকা দিত এসব খেলে। আমরা লুকিয়ে-লুকিয়ে কিনতাম। খুব মজা খেতে। লুকিয়ে কিনতাম বলে স্বাদটা আরও বেড়ে যেত যেন! লুকিয়ে খাওয়া চুমুর মতই মিষ্টি ছিল ওই লুকিয়ে খাওয়া কটকটি। খেয়েছেন কখনও এই কটকটি?
নীরব রাতে,
সরব ঝড়ে,
এলো হাওয়া বয়।
একমুঠো হাওয়া
করেছি চুরি,
শুধু তোমার জন্য।
রাতের অনুভূতি ভোর না হতেই মিলিয়ে যায়। একে নাকি প্রেম বলে! আমার জীবনে কেন অমন চড়ুই পাখির প্রেম আসে না? নাকি, আসে ঠিকই, আমি তা নিতে পারি না বলে পালিয়েও যায়?
এক ইঞ্চি প্রস্থের পথ ধরে, দুই ইঞ্চি কাঁটা আড়াআড়ি হেঁটেছে বহু পথ। যদি দেখ, রক্তাক্ত হয়নি, তবু নিশ্চিত জেনো, কেটেছে—অন্য কোথাও, অগোচরে।
ইদানিং আপনাকে কম বিরক্ত করি, তাই না? ইগনোর করা শিখে গেছেন, বেশ হয়েছে! আপনিও বাঁচেন, আর আমিও বাঁচি! নিজের ওয়ালে নিজের মনে বকে যাই, আপনার ঘরে যে আমার ঠাঁই নাই। খুব আপদ হয়ে উঠেছি বুঝি আপনার জীবনে? জানেন, আমি না ভীষণ সনাতন! সময়ের সাথে বদলে যেতে পারি না ঠিক তেমন। জানেনই তো, পুরনো সুরায় যেমন ঘোর বেশি, পুরনো সম্পর্কে তেমনি টান বেশি। আর আমি তো এক সম্পর্কেই আটকে গেছি! আমার ক্ষেত্রে এ টান নয়, সাক্ষাৎ মরণ! যে প্রেম বোঝে, যে আসলেই ভালোবাসে, সে সত্যটা থেকে কীভাবে সরে আসে, বলুন?
সব থেকে সত্য যা মোর, সে-ই মৃত্যুঞ্জয়—সে আমার প্রেম!
তাকে আমি রেখে আসি কোথায়, বলো?
এসে দাড়াঁনোর কোনও বিশ্বস্ত প্লাটফর্ম তো পাওয়া চাই! ভাগ্যটাই এমন, বিশ্বাসের সাথে আর কেউ জুড়বার যোগ্যতাই রাখে না। আমার বিশ্বাস বড্ড দামি—এত সহজে মেলে না, ভাঙে না, গড়েও না! একে নষ্ট করলে যে আমিই নষ্ট হয়ে যাব!
তাই বুঝি অতটা হালকা টানে গাড়িও চলে না!
আমি বসে থাকি যেন স্থবির স্থির—অটল পর্বত যেমন!
একদিন ওই আকাশ ছোঁব—সেই প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে একা সমুন্নত।
নয়তো আকাশ ছোঁবে আমায়—সেই অনন্তের প্রতীক্ষায়।
প্রশ্নরা বুঝি তোমাতে পৌঁছে অর্থহীন হয়ে যায়! তবু এ বোকা মন অহেতুকই থাকে উত্তরের অপেক্ষায়।
কাকে যেন অনেকগুলো উত্তর দেয়া হয়ে গেছে—এবার একটা হলেও প্রশ্ন চাই!
ভাবনা: একশো ছিয়ানব্বই।
……………………………………..
আমাগো খাইয়াদাইয়া কাজকামের বড়ই অভাব। আমাগোরে কিসু কাজকাম দেয়া হউক!! নিজের টয়লেটে দুর্গন্ধে যাওন যায় না, আরেকজনের টয়লেটে যাইয়া খুঁজতে থাকি, ওই হালার কমোডে অতিআণুবীক্ষণিক পুরাতন গুয়ের দাগ পাওন যায় কিনা। গু পাইলে আমাগো আর কিছুই লাগে না। আমরা মূলত গুখোর জাতি। গুয়ের গন্ধে ঘুম আসে না, তাই তো জেগে রই। আমাগো প্রিয় শখ অন্য মাইনষ্যের লাস্যময় পাছাপানে লালায়িত নয়নে জিভ বাইর কইরা হাঁ কইরা চাইয়া থাকা। আমাগো মতন পাছাচাটা জাতি মেলা ভার। আমরা চাটাচাটিপ্রিয় জাতি—-পা কিংবা পাছা! আমাগো একমাত্র কামই বেবাক মাইনষ্যের পাছায়-পাছায় ঘুরা। পাছায়-পাছায় জীবনযাপন! যার পাছা তার খবর নাই, আমাগো চক্ষে ঘুম নাই। আমরা পৃথিবীর সকল সুগন্ধ পাই আরেকজনের পাছায়। পাছা সত্য, পাছা ধর্ম। জগতের সকল সুখই তো অন্যের পাছায়! অনলি পাছা ইজ রিয়েল! আরেকজন ডেইলি কয়বার হাগে আর মুতে সেই খোঁজ রাখতে না পারলে বাঁইচা থাইকা কী লাভ? জীবনের কী মানে যদি অন্যের দুর্গন্ধবায়ু সেবনই করতে না পারলাম? আমাগো মাথার ঘিলু নড়ে অন্যের পাছার বায়ুতে।
আমাগো পরশ্রীকাতরতা আর পরস্ত্রীকাতরতা—-দুইটাই এপিক লেভেলের। আরেকজনের বউ সুন্দরী ক্যান, এই টেনশনে আমাগো ঘুম হয় না। পরশ্রীকাতরতা আমাগো সম্পত্তি নয়, পরশ্রীকাতরতা আমাগো কইলজার সম্পদ। এইজন্যই এই শব্দের যথার্থ কোনো ইংরেজি পরিভাষা খুঁইজা পাওন যায় না। স্বাভাবিক। ওদের এই জিনিসের দরকার নাই। যারা নিজেরাই পারে, তারা আরেকজনের পারন দেইখা কান্দন দিব ক্যান? যার জীবনে কোনো অ্যাচিভমেন্ট নাই, সে-ই আরেকজনের অ্যাচিভমেন্ট সেলিব্রেট করতে পারে না। মজার বিষয়, এই ঈর্ষার দুষ্টচক্র থেইকা ওরা বাইর হইতে পারে না। যে একবার ঈর্ষার দাস হইয়া যায়, সে আর সহজে সুখের প্রভু হইতে পারে না। যে পারে, সে করে। যে পারে না, সে হিংসায় জ্বলে। এটাই জগতের নিয়ম। এই পরশ্রীকাতরতা নামক বস্তু আমগো রক্তে যেভাবে মিইশা আছে, ওদের মূত্রেও এর এক শতাংশও নাই। আর ওদের সে টাইমই বা কই? ওরা তো আর আমাগো মতন ভ্যারেণ্ডাভাজন জাতি না। আমরা সবাই পারি না, কেউ-কেউ পারে। ওরা পারে, অতএব, আমরা ওদের দেইখা কান্দি। শুধু কান্দিই না, ওদের পিছনে যাইয়া ঘেউ-ঘেউ কইরা চিল্লাই। আমাগো নাসিকা ফুলের সুবাসে নয়, পাছার গন্ধে বেশি সুখ পায়। মাঝেমধ্যে ওরা বায়ুত্যাগ করে, আর আমরা সেটা সেবন কইরা নিজেগোরে হ্যাডামওয়ালা ভাবি। ওদের বায়ুত্যাগ, আমাগো বায়ুসেবন—–এই তো জীবন! আমাগো ভাবখানা এমন, জগতের সকল দুর্গন্ধ বাহির হয় কেবল অন্যের পাছারন্ধ্র হইতে। সকলের যে ওইরূপ বায়ুসেবন করিয়া বাঁচিয়া থাকিবার সাধ জন্মায় না, সে কথা আমাদের ভাবনাতেও আসে না। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এই, জগতে কেবল স্বীয় পাছাই সুগন্ধময় বায়ুর ফ্যাক্টরি। অ্যাগেইন আওয়ার ট্র্যাডিশনাল পাছা সিনড্রোম! অবশ্য, যার জায়গা যেখানে। মুকুট মাথায়, টয়লেটটিস্যু পাছায়। কিছু লোকের জন্মই হয় টয়লেটটিস্যু হইয়া জীবন কাটানোর জন্য। ওদের বসবাস সর্বদাই মলের সহিত। একমাত্র মলসদৃশ বস্তু ব্যতীত আর সকলকিছুই ওদের সাথে বেমানান। তাই, নিজেকে দুর্গন্ধমুক্ত রাখতে পরশ্রীকাতর ব্যক্তির কাছের ব্যক্তি হইতেও নিরাপদ দূরত্বে থাকুন।
আমাগো দিলের সাফ কথাঃ আমি নপুংসক, তাই বলিয়া আমি তোমার সন্তানকে খামচি মারিব না কেন?