জীবনে এই প্রথমবারের মতো নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। খুউব! আমি পালিয়ে যাবো, লুকিয়েই থাকবো। কিন্তু কোথায় পালাবো? কোথায় লুকাবো? জানি না। শুধু এইটুকু জানি, আমি আর পারছি না। “তোকে যে পারতেই হবে রে!” এই কথাগুলি ইদানিং বড় হ্যাকনিড্ শোনায়। আরও বেশি করে দম বন্ধ হয়ে আসে! ওরা কী করে বুঝবে আমি যে কতটা কষ্টে আছি!
Please leave me alone! মানুষ যখন কিছু লুকাতে চায়, ভদ্রতার মুখোশটা অভদ্র হতে দেয় না, কাউকে আর কাছের ভাবতে পারে না, তখন বোধহয় দূরত্ব বাড়াতে ইংরেজিতে কথা বলে। এটা কি ভীরুতা? নাকি, অস্বস্তি? আমি সেইদিন কিছুই শুনিয়ে দিতে পারিনি। শুধু তাকিয়ে ছিলাম উনার মুখের দিকে। স্পষ্ট মনে আছে, উনার চোখ আমার চোখের দিকে ছিল না। অন্যদিকে লুকিয়ে-রাখা চোখজোড়ায় আমি সেইদিন শীতলতা দেখেছি। উনার সামনে থেকে নীরবে চলে আসতে না পারলে আমার কোনোদিনই জানা হতো না আমি মানুষকে অমন হাসিমুখেই ক্ষমা করে দিতে পারি!
আমি কেন ওরকম করলাম? কেন কিছুই বলতে পারলাম না উনাকে? কেন জিজ্ঞেস করলাম না, এতদিন ধরে তাহলে আমাদের মধ্যে এসব কী ছিল? কেন উনি আমাকে শেখালেন কীভাবে উনাকে ছাড়া বাঁচতে ভুলে যেতে হয় বেমালুম? কেন উনার জন্য আমি সবকিছুকেই ছাড়তে চাইলাম? কেন পুরো পৃথিবীটাকে দূরে সরিয়ে উনার কাছেই রয়ে গেলাম এতগুলি দিন? যে মেয়েটি ওর ফ্যামিলির বাইরে এই প্রথমবারের মতো অতিরিক্ত কাউকে বিশ্বাস করলো, সে মেয়েটিকে কেন এতোটা নিষ্ঠুরভাবে বাস্তবতা বুঝতে হবে? কেন কিছু ছেলের নাটকের মহড়ায় এমন মেয়েকেও বিধাতা নিয়ে আসেন যে কখনোই অভিনেত্রী হওয়ার কথা ভাবেওনি? যার সাথে অনেকগুলি অপার্থিব সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়েছে, কেন ছেলেরা তাকেই আর মনেই করতে পারে না? কোন সে নৈপুণ্যে যেটাতে বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে প্রত্যেক ছেলেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমিক হয়ে ওঠে? কেন ছেলেরা সবচাইতে দুঃসময়ের পরম বন্ধুটিকেও ভুলে যায়? কেন সারাটি জীবন একসাথে কাটানোর স্বপ্ন দেখিয়ে কেউ বিনা কারণেই ‘নেই’ হয়ে যায়? কেন কারোর কারোর চোখে সারাজীবন মানে ৩টি বছরমাত্র? কেন অবস্থানের বদলের সাথে সাথে কারোর কারোর হৃদয়ও বদলে যায়? কেন ছেলেরা হঠাৎ করেই কীরকম জানি বিশ্রীরকমের ব্যস্ত হয়ে পড়ে? কেন কেউ কেউ আশ্রয় দিতে পারবে না জেনেও প্রশ্রয় দিয়ে যায় দিনের পর দিন? কেন এই ছোট্ট একটা জীবন কারণে-অকারণেই বারবার রং বদলায়?
মেয়েদের নাকি চেনা যায় যখন ওদের প্রিয় মানুষটি কম অবস্থাসম্পন্ন থাকে, আর ছেলেদের চেনা যায় যখন তারা ভাল অবস্থানে থাকে। উনার খারাপ সময় আমার চাইতে বেশি কাছ থেকে আর কেউই দেখেনি। একমাত্র আমিই পাশে ছিলাম সেই মুহূর্তে যখন উনি প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে ছিলেন। জীবনটা যখনই উনার কাছে মনে হয়েছে ধূসরিত, তখনই আমি উনার হাতটা ধরে পাশে দাঁড়িয়ে বলেছি, “ভয় কীসের? আমি তো আছি!” আমার এই হাত এখনও অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায়…….
অরিত্র, আজ আপনি ভাল আছেন। বেশ ভাল। দামি চাকরি, দামি পোশাক, দামি বন্ধুরা। মনে আছে, আমরা কতদিন একসাথে ঝুপড়িতে বসে লাঞ্চ করেছি পাশাপাশি বসে। আপনাকে প্রায়ই বলতে হতো, “কিছু টাকা হবে? বিলটা দিয়ো……” এখন আপনি ভাল অবস্থানে চলে গেছেন। এখন আর আমাকে দরকার নেই। নীলাকে ছাড়াই অরিত্রের এখন লাইফের বেস্ট পার্ট দিব্যি চলছে! মিস্টার বোস এখন ভীষণ ব্যস্ত! সামনের কয়েক বছর আর কোনোদিকেই মন দেয়ার টাইম নেই। উপরে উঠতে হবে, অনেক উপরে! লাইফটা এখন চলছে কলিগ আর নতুন বন্ধুদের নিয়ে। অরিত্রের এখন আর বন্ধুর অভাব হয় না। খুব জানতে ইচ্ছে করে অরিত্র, “আপনার অ্যাক্সিডেন্টের পর যখন ক্লিনিকের বেডে পড়েছিলেন দিনের পর দিন তখন কোথায় ছিল আপনার এই বন্ধুরা? কেউ একবার ফোন করে খবর নিয়েছিলো? কেউ একবেলা খাবার নিয়ে দেখা করতে এসেছিল, অরিত্র বোস?” এখন আপনি বেশ ভাল আছেন নতুন ফ্রেন্ডদের নিয়ে। ফুর্তি, ঘোরাঘুরি, পার্টি, ফান—এইতো জীবন! একটা সময়ে আপনার রিকশাভাড়াটাও নীলা দিয়েছে। আপনি কখনোই চাননি, তবুও! কী করবে বেচারি! ভালোবাসে যে! প্রেমে পড়ার চাইতে শরীরে কুষ্ঠ হওয়াও ভাল।
জানেন অরিত্রবাবু, এই আপনি একদিন বলেছিলেন, আমাকে ছাড়া আপনি আপনার জীবনটা কল্পনাও করতে পারেন না। আমাকে ছাড়া আপনি কিছুতেই বাঁচতে পারবেন না। বিশ্বাস হচ্ছে না? না হওয়ারই কথা। ছেলেরা যখন মেয়েদের শরীরের খুব কাছে চলে আসে, তখন ওদের সব কথা বিশ্বাস করতে নেই। কিন্তু এই সহজ কথাটি কেউ যে বলে দেয়নি আমাকে! তাই ঠেকে আর ঠকে শিখতে হল! বড় ভুল সময়ে আপনার সাথে দেখা হয়েছিলো অরিত্র! একটা ছেলে যখন পুরোপুরি এস্টাব্লিশড হয়ে যায়, তখন সে যদি কোনো মেয়েকে হৃদয় দিয়ে বসে, তবে সে হৃদয়ের হাতবদল হয় কম। আচ্ছা, আপনার মনে আছে, আপনি আমাকে ফাঁকি দিয়ে কখনো কখনো স্মিতার সাথে ঘুরতেন। আমি জানতে পেরে ভীষণ রেগে যাই, কাঁদতে থাকি। আপনাকে অনেক অনেক বকাও দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, “আর নয়! আমাকে মুক্তি দিন!” আপনি আমার হাঁটুর কাছে বসে বলেছিলেন, “আমাকে ক্ষমা করে দাও সোনা। তুমি চলে গেলে আমার জীবনটা ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যাবে। আমি আর কখনোই ওরকম করবো না। প্রমিজ!” আপনার মতন রাগী মানুষ যখন বলে ‘ক্ষমা করে দাও’ তখন সেটা কিছুতেই ফিরিয়ে দেয়া যায় না। মেয়ে তো, তাই সবকিছু ভুলে গিয়ে আপনাকে জড়িয়ে ধরে সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম। বলেছিলাম, “আমি কখনোই আপনাকে ছেড়ে যাবো না। আপনি জীবনের পথে সামনের দিকে এগিয়ে যান। পাশে আমি আছি, থাকব সবসময়।” আমি আমার কথা রেখেছি। আপনার জীবনটা এখন সুন্দর, মোলায়েম। এখন আর নীলাকে প্রয়োজন নেই আপনার। প্রিয় অরিত্র, আপনি না প্রায়ই বলতেন, আপনি বিশ্বাসঘাতকতা পছন্দ করেন না? আপনার যে বন্ধুকে আপনি একটা সময়ে দিনের পর দিন হাতখরচ দিয়ে সাহায্য করেছেন, সে বন্ধুটি এখন আর খবরই নেয় না, ফোন করলে কেটে দেয়। যে দুঃসময়ে পাশে থাকে না, সে নাকি বন্ধু নামের কলঙ্ক। বেঈমানরা নরকের কীটের মতো। আমার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে অরিত্র, তবে আপনি কী?
এখন আমি টেক্সটের পর টেক্সট পাঠিয়ে যাই, আর আপনি কখনো কখনো একটু দয়া হলে রিপ্লাই দেন, Please don’t disturb me. I’m busy. ওইটুকুই! অথচ আমি ওটার দিকেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আপনার জন্য প্রার্থনা করি। আমি যেমনই থাকি, মানুষটা ভাল থাকুক। আচ্ছা, আপনি কি সত্যিই অনেকবেশি ব্যস্ত? খাওয়াদাওয়া করেন তো ঠিকমতো? আমাকে তো আর খবর রাখতে দেন না। জানি, এখন আপনার খবর রাখার লোকের অভাব নেই। সবাই ভালোবাসে আপনাকে! এতো এতো ভালোবাসা! এও হয়! সম্ভব? একসময় এমন একটা রাতও ছিল না, যে রাতে আপনি আমাকে না বলে ঘুমাতে যেতেন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফোনে নীলার একটা চুমু না খেলে অরিত্রের ঘুম হয় না। এটাই ছিল অলিখিত নিয়ম। খুব জানতে ইচ্ছে করে, সেই পুরোনো নিয়মটা কি এখনও আছে? এখন কার চুমুতে চোখে ঘুম নামে অরিত্রের? রাতবিরাতে আপনি ফেসবুকে পড়ে থাকেন। আমি এখনও আগের মতো করে ভাবি, মানুষটা কেন নিজের দিকে একটুও খেয়াল রাখে না? শরীর খারাপ করবে তো! কেন ভাবি? হায়! মেয়েদের বেহায়া মন! সব বুঝেও কিছুই বোঝে না!
আমি কখনোই আমার নিজের জন্মদিনের জন্য কোনো প্ল্যান করিনি। জন্মদিন আসত, চলে যেত। কিন্তু আপনার জন্য ছিল। সবসময়ই! কীভাবে আপনাকে উইশ করবো, কীভাবে আপনাকে সারপ্রাইজ দেবো, কীভাবে আপনাকে জন্মদিনে খুশি রাখবো, কীভাবে আপনার সবচাইতে পছন্দের ডিশগুলি রান্না করবো, আপনাকে নিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবো, আপনার জন্য পাঞ্জাবি-কেনা নিয়ে রীতিমতো রিসার্চ করে ফেলতাম, আপনার পছন্দের কোন শাড়িটা পরে আপনার হাত ধরে হাঁটব, খোঁপায় কোন ফুলটা জড়াবো, চোখে কাজল দেবো কীভাবে। এরকম আরও কত কী! জানি, আপনার ওসব এখন আর মনেও পড়ে না। এই জন্মদিনে আপনাকে এতবার উইশ করলাম, আপনি একটাও রিপ্লাই দিলেন না। আমাকে তো ফেসবুকে ব্লক করে দিয়েছেন। আমি আরেকটা অ্যাকাউন্ট থেকে বেহায়ার মতন সারাদিন আপনার ওয়ালে পড়ে ছিলাম, জানেন? কত মেয়েকে আপনি শুভকামনার উত্তরে অন্তত একটা স্মাইলি হলেও দিয়েছেন। আমার খুব ইচ্ছে করছিলো, ওই স্মাইলিটা একটু ছুঁয়ে দেখি! আমি তো আর কিছুই পাইনি! ওদের কত ভাগ্য! ঈর্ষা হয়েছিলো ভীষণ! আচ্ছা মিস্টার বোস, আপনার মেয়েদের এই অ্যাটেনশন ভাল লাগে? এতো মেয়ে কি আপনার পেছনে ঘুরে বেড়াত যখন আপনি ‘কেউ না’ ছিলেন? ওরা এখন আছে আপনি ভাল জায়গায় আছেন বলে। আপনি কি সত্যি সত্যিই কিছু বোঝেন না?
সবাই এখন আপনার অনেক প্রশংসা করে। আমার ভাল লাগে, আবার কান্নাও পায়। ভাবি, আহা! উনার আসল রূপটা কেউ দেখল না, জানল না। এই পৃথিবীতে শুধু আমিই জানি। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে, সবাইকে সবকিছু জানিয়ে দিই। জানিয়ে দিই, চাকরিটা পাওয়ার পরপর আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। এই মুহূর্তে নীলার মধুচন্দ্রিমাযাপনের কথা ছিল। জীবনের এইসব স্বপ্ন নীলা বোকার মতো একা একা দেখেনি। নীলাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন অরিত্রবাবু! আমি জানি, অরিত্রবাবু কত ভাল কফি বানাতে জানেন। এও জানতাম, বিয়ের পর কফি বানানোর দায়িত্বটা ওঁর। আজ বড় ইচ্ছে করে টেনেহিঁচড়ে সামনে নিয়ে আসতে আপনার সততার সমস্ত ফাঁকা বুলি, রাশিরাশি মিথ্যে প্রতিশ্রুতির স্তূপ, সেইসব দিনের সব কথা। মুখোশবিহীন মিস্টার অরিত্র কেমন, এটা সবাইই জানুক!
খুব রাগ আপনার, না? ভীষণ? আমাকে বকতে দারুণ লাগত তো! আমি যে সব মেনে নিতাম! কখনো তো জানতে চাননি, আমি কতটা কষ্ট পাচ্ছি সবকিছুকে মেনে নিয়ে! আমাকে আপনার প্রয়োজন, এখুনিই! কিন্তু আমি বাসা থেকে বের হতে পারছি না। আপনি বলতেন, “অতো কিছু বুঝি না। আসবে কিনা বল!” বের হয়ে গেছি কতবার! বাসায় ম্যানেজ করে বের হওয়া সে কী যে ভীষণ কঠিন! মনে নেই কিছু? একটুও না? ভাল ভাল! পেয়ে গেলেই সব শেষ! পুরুষমানুষ তো! আপনি যেমন ছিলেন, আমি আপনাকে তেমনভাবেই গ্রহণ করেছিলাম। আমার জন্য আপনাকে কিছুই বদলাতে হয়নি, আমিই বদলে ফেলেছিলাম নিজেকে।
আপনি চেয়েছিলেন, নীলা ক্যারিয়ার গড়বে না। চাকরি নিয়ে ভাববে না। শুধু অরিত্রের পাশে থাকবে। আমিও তা-ই মেনে নিয়েছিলাম। আমি শুধুই অরিত্রের জন্য বাঁচব। নিজের সবকিছুকেই আপনার পছন্দমতোই কাস্টমাইজ করে নিয়েছিলাম। আর এখন? আমি যে বাঁচতে পারছি না আর! প্লিজ অরিত্র, একটু আমার মনটাকে একবারের জন্য হলেও আমার মতন করে বুঝুন। প্রথমবারের মতো! প্লিজ! আমি সত্যিই আর পারছি না। অনেক চেষ্টা করেছি স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার, তবুও পারছি না। এভাবে বাঁচা যায়?
আমি তো কখনোই চাইনি আপনি আমার জীবনে আসুন। আপনার টেক্সটের রিপ্লাই পর্যন্ত দিতাম না। তবে আপনি কেন এলেন? কেন বললেন, এখন থেকে যত স্বপ্ন, তার কোনটাই তোমারও নয়, আমারও নয়, আমাদের? আপনি আসার আগে যে আমি খুব সুখে ছিলাম, সেটাও বলছি না। কষ্টেই ছিলাম। সেটাতেই অভ্যস্ত ছিলাম। তবে কেন আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতে এলেন আপনি আনন্দের ফোয়ারা সাথে নিয়ে? এলেন, কিছু সময়ের জন্য থাকলেন, আবার চলে গেলেন। তবে আমি কি ছিলাম স্রেফ একটা ট্রানজিট পয়েন্ট? আপনার গন্তব্যের? গন্তব্যে পৌঁছেই আপনি আপনার মতো, আমি আমার মতো? এটাই আপনার বিবেকের রায়? বাহ্, মিস্টার বোস, বাহ্! আমার যে জীবনে বলতে গেলে কিছুই ছিল না, সে জীবনে আপনি এসে যা একটুখানি অবশিষ্ট ছিল স্রেফ বেঁচে থাকার মতো, সেটুকুও শেষ করে দিয়ে চলে গেলেন! তিন বছরের অরিত্রের সাথে আজকের মিস্টার বোসের কোনো মিলই নেই। এতদিন মানুষটা কীভাবে পারল আমাকে মিথ্যে বলতে? কীভাবে পারল বানিয়ে বানিয়ে রাজ্যের স্বপ্ন দেখাতে? কীভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিল সেই হাতটি যে হাত আজ অন্যকারোর হাতে? আজ বুঝি অন্য মেয়ে বেশি ভাল লাগে? আগে লাগেনি কেন? আমি ফেসবুকে আসতামই শুধু আপনার জন্য। ভাইবার হোয়াটস্অ্যাপ খুলেছি শুধু আপনার জন্য। ইমোতে গেছি শুধু আপনাকে ভিডিও কল দেয়ার জন্য। নিজের আজন্ম খোলস থেকে বের হয়েছি শুধুই আপনার জন্য। নিজের কাছেই অবিশ্বস্ত হয়েছি শুধুই আপনাকে ভালোবাসি বলে। অরিত্র, আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে, কেন আমার মতন আড়ালে নিভৃতে থাকা একটি বোকা মেয়েকে আপনি বের করলেন? কেন কেন কেন? আর কেউ ছিল না ওসব ক্ষণিকের সুখনিবৃত্তির জন্য? আমি কেন?
কাল পরীক্ষা, আর আমি কিছুই পড়তে পারছি না। ভাবিকে ফাঁকি দিচ্ছি। ভাইকে ফোনে বলেছি, আমি পড়াশোনা করছি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে অরিত্র! বুকের ভেতরে সারাটিক্ষণ কেমন জানি হুহু করে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে, চোখের জল যতবারই বেয়াড়া হয়ে পড়ছে ততবারই বাথরুমের বেসিনে ছুটে যাচ্ছি! ভাবি ভাবছে, পড়ছি। আমি আর পারছি না। শুধু আপনি চোখের সামনে এসে পড়ছেন। আপনি এসে মাথায় একটু হাতটা রাখুন না আগের মতো করে, অরিত্র! একটু পর পর ভাবি, এই বুঝি আপনার একটা টেক্সট আসবে: “কী করা হচ্ছে ম্যাডামের? হুঁ?” হোয়াটস্অ্যাপে নক করবেন, বলবেন, ইমোতে আস, তোমাকে বড্ডো দেখতে ইচ্ছে করছে! শুধু এইটুকুও যদি বলতেন, “জানোই তো আমি রাগী। একটু রাগ করেছিলাম, আর কিছু না। একটু হাসো তো দেখি!” সত্যি বলছি, আমি সবকিছু ভুলে গিয়ে আবারও ছুটে যেতাম আপনার বুকে। কিছুই আসে না, কিছুই না! আমি শুধু মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকি। টাচস্ক্রিনে আমার অনবরত ছোঁয়ায় ব্যাটারির চার্জ ফুরোতে থাকে, সাথে আমার জীবন!
আমি জানি, আমি আর বাঁচব না। এভাবে করে আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়ে চলে যেতে পারলেন! আমি ৫/৬ রাত ঘুমাই না, হয় জেগে থাকি, কিংবা আধোঘুম; সেই আধোঘুমেও আপনি স্বপ্নে আসেন, আমার হাত ধরে হাঁটেন, আমার চুলগুলি নিয়ে খেলতে থাকেন আর আমি খিলখিল করে হাসতে থাকি। আপনি নিষেধ করায় আমি আর চুল কাটি না। চোখের জলে বালিশ ভিজতে থাকে প্রতিরাতে। আমার মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা হয়, চোখেও ঝাপসা দেখি, ডাক্তার আঙ্কেল বলেছেন চশমা নিতে। প্রতিদিন সকালে বমি হয়, মাথা বনবন করে ঘুরতে থাকে। আমাকে সবাই বলে, তোমার কী হয়েছে? তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছ! তুমি ঠিকমতো ঘুমাও। আমি তো জানি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি আর কোনোদিনও ঘুমাতে পারবো না। আমার সব শক্তি কোথায় জানি চলে গেছে। আমি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারি না। রাস্তা পার হওয়ার সময় এতো আস্তে আস্তে হাঁটি, তবুও কোনো গাড়ি এসে আমাকে চেপে মেরে ফেলে না। কেন বেঁচে আছি? এতো এতো লোক মরে রাস্তাঘাটে, আমি কেন মরি না?
আমার পাশে আপনি নেই, এটা আমি কোনোদিনও ভাবতে শিখিনি। ভাবতে পারবও না। পারবো না কোনোদিনই অন্য কারোর হাত ধরতে। কোনোদিনই না, মরে গেলেও না। আমি আর কারোর হবো না, অরিত্র। আমি বলেছিলাম, আমি অপেক্ষা করবো। আপনি যতদিন নিজের পায়ে না দাঁড়াচ্ছেন, ততদিন যত ঝড়ই আসুক, আমি সামলে নেবো। আপনি ভাববেন না, আপনি একা। আমার শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত আমি আছি আপনার পাশে। আর এখন? এ কী হল? কত কাকুতিমিনতি করলাম আপনার কাছে। বলেছি, আপনি যা বলবেন, আমি তা-ই করতে রাজি, শুধু আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আপনি বলেছেন, আপনার বাইন্ডিং ভাল লাগে না, এক্সপেক্টেশন ভাল লাগে না, কমিটমেন্ট ভাল লাগে না। আচ্ছা, আপনার আগেও এসব ভাল লাগত না বুঝি? কই, কোনোদিনই তো বলেননি! আপনি আর কোনোদিনই কি কারোর সাথে কমিটেড হবেন না? এই ধরুন, আজ যে মেয়েরা ঘুরঘুর করে আপনার আশেপাশে, তাদের মধ্য থেকে কারোর সাথে? আমি তো বলেছিলাম, অপেক্ষা করবো। করেছিও। আপনি ছাড়া আর কোনোকিছুই কখনো মাথায় আনিনি। বাসায় বলেছি আমি পাস করে বের হওয়ার আগে কিছুতেই বিয়েটিয়ে করবো না। যে প্রপোজালই আসুক, ফিরিয়ে দিয়েছি। আমি তো অনেক যুদ্ধ করে হলেও আমার সব কথা রেখেছি। কিন্তু আপনি? একটু মায়াও লাগল না এই নীলার জন্য? আপনার মনে আছে মিস্টার বোস, এই নীলাকে যখন আপনি প্রপোজ করলেন, আর আমি কিছুতেই সাড়া দিচ্ছিলাম না, তখন আপনি দিনের পর দিন কীরকম পাগলের মতন করছিলেন? মনখারাপ করে ছিলেন। ফোন করে কান্নাকাটি করতেন বাচ্চাদের মতন, কী কীসব এলোমেলো বলতেন, যেন আমি আপনার জীবনটাকে আপনার বুকের ভেতর থেকে বের করে নিচ্ছি। ভার্সিটি বন্ধ হলে সারাদিন আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন আমাকে এক পলক দেখবেন বলে। আপনার জন্য আমার এতো মায়া লাগলো, নিজের উপরেই রাগ হল, ‘হ্যাঁ’ বলে দিলাম, প্রেমে পড়ে গেলাম আপনার, আস্তে আস্তে ভালোবেসেও ফেললাম। আর আজ? আমি কখনোই সিগারেট পছন্দ করতাম না, মনে মনে শপথ করেছিলাম, আমার বর কিছুতেই সিগারেট খেতে পারবে না। তবুও তেমন একজনকেই মেনে নিলাম শুধু ভালোবাসি বলে। আমাকে শিখিয়েছিলেন, আরে ধুরররর্…….!! Get a life! সিগারেট ছাড়া বাঁচা যায় নাকি? এই ধোঁয়াতেই তো জীবন। Life is for cigarettes, with cigarettes, on cigarettes! হুহ্! লাইফ! লাইফ তো শেষই করে দিলেন! কোথা থেকে আনবো আরেকটা লাইফ? চুপ করে থাকবেন না, মিস্টার বোস! বলুন! সবকিছু এতো সহজ? এক তুড়িতেই জীবন চলে? একটা টেক্সট দিয়েছিলেন: Forgive & forget! ক্ষমা আমি করে দিতেই পারি, কিন্তু ভুলবো কীভাবে? কীভাবে সম্ভব? এতোকিছুর পর! হয়তো আপনার জন্য ওসব কিছুই না! কিন্তু আমার জন্য যে ওটাই জীবন! আমি বাঁচব কী করে? আমার যে সব শেষ! কীভাবে সম্ভব! কীভাবে?
জানেন অরিত্র, এতোকিছু করেও আমার মধ্যে একটুও অপরাধবোধ কাজ করে না, একটুও না। ভালোবাসতাম যে! ইদানিং সবচাইতে বেশি রাগ হয় নিজের উপর। সব দোষ আমারই তো! আমি কেন বিশ্বাস করতে গেলাম? আবার পরমুহূর্তেই ভাবি, উনি যে আমাকে দিনের পর দিন বিশ্বাস করতে বাধ্য করলেন? সেটার কী হবে? আমার দোষ যে আমি রিলেশনে গেলাম। উনি কি যাননি? কিন্তু আমি একাই যে শাস্তি পাচ্ছি? এরকম কেন হয়? এমন শাস্তি যার শেষ নেই। পৃথিবীতে কি শুধু এই শাস্তিরই কোনো শেষ নেই? আপনি এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। ভাল ভাল! তাই আমি আর কিছুই না। আমি দেখতে ভাল না, সুন্দর করে কথা বলতে পারি না, সাজগোজ করে চলতে পারি না। আমার সাথে হাঁটলে লোকে কী বলবে? আমাকে যে সোসাইটিতে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায় না। আমি কোনো ছেলের সাথে ঠিকমতো কথা বলতে পারি না, মিশতে পারি না। আচ্ছা অরিত্র, এসব কি আপনি জানতেন না? আমি কি লুকিয়েছি কোনোকিছু আপনার কাছ থেকে? আপনি বলতেন, আপনি মেয়েদেরকে বিশ্বাস করেন না। একমাত্র আমাকে দেখেই নাকি আপনার জীবনে প্রথমবারের মতো মনে হয়েছে, মেয়েদেরকেও বিশ্বাস করা যায়। আমি আপনার প্রত্যেকটা কথাই অন্ধভাবে বিশ্বাস করতাম। পুরো পৃথিবী ভিন্ন কথা বললেও আমি আপনার কথাটাই সত্যি ধরে নিয়ে বসে থাকতাম। সেই আপনি আজ আমাকে দুনিয়ার সবাইকে অবিশ্বাস করতে বাধ্য করে দিয়ে আমার জীবন থেকে সরে গেলেন।
জানেন, সবচাইতে বেশি ঘেন্নার ব্যাপারটা কী? আমি এখনো আপনার জন্য অপেক্ষা করি। ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি! আপনার প্রতিটি কথা আমার কানে অনবরত বাজতে থাকে। আপনার প্রতিটি স্পর্শ আমি চোখ বন্ধ করলে অনুভব করতে পারি। আপনার শরীরের ঘ্রাণ আমি পেতেই থাকি পেতেই থাকি। আপনার তাকানোর ধরনটা ভাবলে আমি এখনও এলোমেলো হয়ে যাই। আপনি আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে মিশে আছেন। কত যে চেষ্টা করি ভুলতে, রাগ করতে, অভিশাপ দিতে, ঘৃণা করতে………… পারি না, আমি কিছুতেই পারি না। বুকের ভেতর থেকে গুমরে গুমরে কেমন জানি কান্না পায়। বাঁচার স্বপ্ন দেখার শাস্তি হিসেবে আমার বাঁচতেই এতোটা কষ্ট হবে, এটা আমি আগে কখনোই বুঝিনি। আমি জানিও না এর শেষ কোথায়। প্রতিদিন আমি প্রতিটি মুহূর্তেই কাঁদি। আমি যে কিনা সবাইকে বুঝাতাম কীভাবে বাঁচতে হয়, সেই আমিই আজ হেরে গেলাম। আমি হেরে গেছি অরিত্র, আমি হেরে গেছি! আমি জানি হার মানা ঠিক নয়। ওটা ভীরুতা, কাপুরুষতা। সব জানি, বুঝি। কিন্তু আমার খুব কষ্ট হয়। খুউব। এতোটাই যে আমি অসহায়ের মতো পরে থাকি বিছানায়, অনন্ত ঘোরের মধ্যে ডুবে থাকি। শক্তি নেই এতটুকুও, মনও সামর্থ্য দেয় না। জানেন, এখন আমি চোখে সবসময়ই চশমা দিয়ে রাখি, কেঁদে ফেলি কখন না কখন, কে না কে দেখে ফেলে। বাসায় কাঁদি খুব সাবধানে, ভাইয়া দেখে ফেললে খুব খুব খুব কষ্ট পাবে। বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইয়া আমাকে কোনোদিনই জোরে একটা বকাও দেয়নি। আমি এই জীবনে যেসব ভয়ংকর বকাগুলি খেয়েছি, সব আপনার কাছ থেকে। ভাবি মায়ের মতন আদর করে। ওদেরকে কীভাবে কাঁদাই? বাসা থেকে বাইরে বের হলে ভার্সিটি যাওয়ার পথে রিক্সায় যে কত কাঁদি কত কাঁদি, তা বলে বোঝানো যাবে না। রিক্সাওয়ালারা হয়তো অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে, ওরা আর পেছন ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে না, “আপা, আপনার কী হইসে?”
হায়! জীবনে এটা আমি কী করলাম…………
একটাই সান্ত্বনা। আমি জানি, আপনাকে আমার মতন করে কেউই কোনোদিনও ভালোবাসতে পারবে না। এতেই আমার জয়!
আমার কথা।
আচ্ছা নীলা, তুমি এমন কেন? কেন ঈশ্বরকে এইজন্য ধন্যবাদ দিচ্ছ না যে একজন ভুল মানুষ তোমার জীবন থেকে অনেক দেরি হওয়ার আগেই চলে গেছে? কেন এটা বুঝতে পারছ না যে একটা ভুল জীবন তোমাকে অনেক বছর ধরে কাটাতে হয়নি? কেন তুমি এটা ভাবছ না যে যেইদিন সে তোমাকে ছেড়ে চলে গেল, প্রকৃতপক্ষে ঠিক সেইদিন থেকেই তোমার জীবনের শুরু? এর আগের সবকিছুই ছিল মিথ্যে?
কিছু কথা বলি, শোনো:
এক। যে তোমাকে অপরিহার্য মনে করে না, কখনোই তোমার জীবনে তাকে অপরিহার্য বানিয়ো না, সে মানুষটি যে-ই হোক না কেন।
দুই। যে মানুষটি তোমাকে ছাড়াই দিব্যি বেঁচে আছে, ভাল আছে, শান্তিতে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, সেই মানুষটির জন্য দম বন্ধ করে মরে যাওয়ার তো কোনো মানেই হয় না!
তিন। তুমি কতটা সময় তার সাথে ছিলে, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, তুমি সামনের কতটা সময় তাকে জীবন থেকে ডিলিট করে থাকতে পারছ।
চার। যে মানুষটির কাছে তোমার কোনো গুরুত্বই নেই, সে মানুষটির জন্য কখনোই তুমি একটা বর্ণও বাজে খরচ করবে না। তোমার প্রতিটি টেক্সটই অনেক দামি। ওতে তোমার আবেগ জড়িয়ে আছে। নিজের আবেগকে এতোটা মূল্যহীন হতে দিচ্ছ কেন?
পাঁচ। একজন মানুষকে ঠিক ততটুকুই দাম দেবে, যতটা দাম তুমি ওর কাছ থেকে পাচ্ছ। এর চাইতে বেশি দিলে ও ভাববে এটা তোমার দুর্বলতা।
ছয়। যে মানুষটি তোমার কষ্টের সময়ে তোমার পাশে নেই, তুমি ভাবছ কী করে যে সে মানুষটি সারাজীবন তোমার পাশে থাকবে?
সাত। যে তোমাকে তার জীবনে one of the alternatives ভাবে, তাকে কখনোই নিজের জীবনে mandatory ভেবো না।
আট। তোমার হৃদয়ের ব্যথা যে অনুভব করে না, তার সাথে আর যা-ই হোক, সংসার করা সম্ভব নয়। সে তোমাকে সারাজীবন ব্যথাই দিয়ে যাবে। তখন না পারবে পালাতে, না পারবে সহ্য করতে।
নয়। যে তোমাকে বিয়ের আগেই প্রাপ্য সম্মানটুকুও দেয় না, সে তোমাকে বিয়ের পর খুব ভাল রাখবে, এই কথা তুমি ভাবছ কীভাবে? কোন বিশ্বাসে?
দশ। এই মেয়ে! শোনো! তুমি এই মুহূর্তে ভাল থাকলে ও কিন্তু ভীষণ অখুশি হবে। আর কিছু না হোক, শুধু ওর মেজাজটা খারাপ করে দিতেও তো ভাল থাকতে পারো! কী, পারো না? শুধু ওর জন্য হলেও ভাল থেকেই দেখোই না কী হয়! তুমি না ওকে এখনও ভালোবাসো? ওর জন্য এইটুকু করতে পারবে না?
আর কিচ্ছু বলবো না। শুধু তোমাকে সামনে পেলে মাথায় তুলে জোরে একটা আছাড় মারতাম! হাত থাকতে মুখে কী?