এ পৃথিবীতে সে-ই মানুষটি সবচাইতে দুঃখী, যাকে তার মতো করে বোঝার একটিও মানুষ নেই। তখন সে দুঃখী মানুষটি নিজেকে অন্তত একজনের কাছে হলেও মেলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। তা করতে গিয়ে সে কখনও কখনও মিথ্যা বা ভানের আশ্রয়ও নেয়। মানুষ সাধারণত সত্যের চাইতে মিথ্যা সহজে গ্রহণ করতে পারে, অকৃত্রিমতার তুলনায় কৃত্রিমতার আদর সমাজে বরাবরই বেশি। ফলে অনেকেই নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য অনেকটা বাধ্য হয়েই একধরনের কপট মননে ও আচরণে বাঁচে। যারা তা করতে পারে না, তাদের অর্জন অল্প, জাগতিক ব্যর্থতা অনেক বেশি। তাদের বন্ধু কম, কাছের মানুষও তেমন নেই বললেই চলে। এ পৃথিবী এমন বোকা মানুষের পৃথিবী নয়।
আমি স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাবিলাসী মানুষ। হয়তো খুব একটা বাস্তববাদীও নই। দুনিয়ার অত জটিলতা-কুটিলতা বুঝি না। আমার মনে যা, মুখেও তা। আমাকে আপনারা বোকা মেয়েও বলতে পারেন। আমি মানুষ হিসেবে স্বাধীনচেতা। রোমাঞ্চ পছন্দ করি। ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাসায় বইপড়ার একটা পরিবেশ পেয়েছি। এর সবচেয়ে বড়ো অবদান মায়ের। তিনি শরৎসমগ্র পড়েছেন, বঙ্কিমসমগ্র পড়েছেন। রবীন্দ্র থেকে গোর্কি, কি রাজনৈতিক উপন্যাস, কি গোয়েন্দা গল্প, কি কবিতা…হেন কিছু নেই যা তিনি পড়েননি। পড়ার বিষয়বৈচিত্র্য-নির্বাচনের বেলায় তাঁর কোনও বাছবিচার ছিল না। মায়ের মুখে ছোটবেলা থেকে নানান ক্লাসিক বইয়ের গল্প শুনতাম, আর মুগ্ধ হতাম। আমি তার চারভাগের একভাগও পড়িনি, ছোটবেলায় পড়েছি কিছু সহজপাঠ্য বই, যেমন হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক স্যারের প্রিয়ভাজন ছিলাম বলে কিছু বিখ্যাত প্রবন্ধ পড়ার সুযোগ আমার হয়। হিস্ট্রিক্যাল কিছু বই আছে আমার কাছে। এর মধ্যে জয়া চ্যাটার্জির বাংলা ভাগ হলো, স্যার উইলিয়াম উইলসন হান্টারের দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, রজত কান্ত রায়ের পলাশির ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ…বইগুলি পড়েছিলাম। বিমল মিত্রের ‘বাদশাহী আমল’ মামার কাছ থেকে নিয়ে প্রথম দিকে কিছুটা পড়েছিলাম, খুব ভালো লেগেছিল, পরে অরজিনাল ইন্ডিয়ান প্রিন্টের বইটা আজিজ সুপার থেকে কিনে আনি, যদিও এখনও খুলে দেখিনি। আমার অনেক বই-ই এই খুলে-দেখিনি অসহায়ত্বের নির্মম শিকার। মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা বিতর্কিত বই পড়েছিলাম---শর্মিলা বসুর ডেড রেকনিং: ১৯৭১ এর বাংলাদেশ যুদ্ধের স্মৃতি। ভালো কি খারাপ, সে বিচারে যাব না। ইতিহাস, ধর্ম সবকিছুরই পক্ষে-বিপক্ষে সব ধরনের বই-ই পড়তে চাই, আমার মায়ের মতো। বেঁচেথাকার সময়টাতে এটাই আমার ইচ্ছে।
২০০৫ সালে সবে এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হলাম। অমনি হুড়মুড় করে আমার ঘাড়ে প্রেম এসে পড়ল, ওই যে টিন-এজ প্রেম যাকে বলে আরকি! ওই বয়সের প্রেম কোনও হিসাব মেনে হয় না। একেবারে বাচ্চামিমাখা হেঁয়ালিটাইপ প্রেম। কলেজের অনেক ছেলেই আমাকে পছন্দ করত। আসল ব্যাপার হলো, আমি দেখতে অতটা অসুন্দরীও নই। তবে ওদের কাউকেই আমার ভালো লাগত না। আমার ভালো লাগত আমার বাসার পাশে একটা ঝুপড়িটাইপ ঘর থেকে বের-হওয়া লম্বা সুদর্শন, শার্টের হাতা গুটিয়েরাখা ছাপোষা এক যুবককে। যখন ওদের বাসা থেকে সে বের হতো, আমি তখন ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম রোজই। এমনও হয়েছে, ওকে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমার সেদিনের প্রথম ক্লাসটাই মিস হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে টানা একবছর এভাবেই চলতে থাকল। ওকে কিন্তু আমি এসএসসি পাস করার আগে থেকেই দেখতাম। একটা সময় পর ছেলেটাও আমাকে দেখত। প্রতিদিন যাওয়া-আসার সময়। ওর সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। আমাদের মধ্যে ছিল না পরিচয়, না কোনও কিছুই।
একদিন আবিষ্কার করলাম, আমাদের পাড়া থেকে একটু দূরে ছেলেটার ছোট্ট একটা ফার্মেসি আছে। ওই বয়সে যা দেখতাম, তাতেই মুগ্ধ হতাম। ওটা হচ্ছে খুব সহজেই মুগ্ধ হবার বয়স। এদিকে কলেজে উঠার পরেও ছেলেটাকে কিছুতেই ভুলতে পারছি না। একদিন সাহস করে ছেলেটার হাতে আমার লেখা একটা কবিতার খাতা দিলাম। মুখে কিছুই বললাম না। এতদিন দুজনের দৃষ্টিবিনিময় থেকে বোঝাই যেত, দুজনের মধ্য কিছু একটা হয়েছে। কাজেই তাকে কিছু দেওয়াটা তার কাছে খুব একটা অবাক হবার বিষয় ছিল না। বরং সে নিজ থেকে কোনও দিনই আমাকে কিছু বলতে পারত না। কারণ একটাই, আমার আর তার সামাজিক অবস্থান। যা-ই হোক, এভাবে দিনকতক পর সে আমার সাথে কথা বলার জন্য প্রতিদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত। তখন ফোন ছিল না। কাজেই যোগাযোগ করতে পারত না। একদিন আমাকে সামনে পেয়ে বলল, ‘তোমার সাথে কথা আছে। কোথায়, কখন বসবে?’ এরপর আমরা একটা জায়গায় দেখা করতে গেলাম। কলেজ শেষ করে আমি আমার কিছু বান্ধবীকে সাথে নিয়ে এবং সে তার এক বন্ধুকে নিয়ে ওখানে গেলাম। আমাদের প্রথমসাক্ষাৎটি হলো।
পরিচয়সূত্রে জানতে পারলাম, কোনও একটা কলেজ থেকে সে অ্যাকাউন্টিং-এ বিকম করেছে। এখন ছোটোখাটো ব্যবসা করে। বাবা-মা কেউ নেই। দুইভাই। আর-এক ভাই সৌদিআরব থাকে। সে এখানে তার এক চাচাতো বোনের আশ্রয়ে থাকে। লাইফে যতটুকু উঠেছে, সম্পূর্ণই নিজের চেষ্টায়। কাউকে কখনও তার পাশে সে পায়নি। তার জীবনটাই কেটেছে যুদ্ধ করে করে। এতকিছু শুনে খারাপ লাগল তার জন্য। তখনও বুঝিনি, ওটা আসলে ভালোবাসাই ছিল না। ওটা বড়োজোর করুণা ছিল হয়তোবা! কিন্তু সেই মোহ কাটতে আমার অনেক বছর চলে যায়। ভালোবাসা ছিল, না কি শুধুই ভ্রমে পড়ে এতগুলি বছর পার করলাম, জানি না। বন্ধুরা কেউ আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে রাজি ছিল না। কারণ সে আমার যোগ্য নয়। সামাজিক-আর্থিক-শিক্ষাগত কোনও দিকেই মিল ছিল না আমাদের। বলা যায়, ওটা ছিল একধরনের ‘অসম প্রেম’। তার উপর আমার চেয়ে দশ বছরের বড়ো ছিল সে। এত অসমতাকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। তার প্রতি আমার একধরনের দুর্বার আকর্ষণ কাজ করত। ওই বয়সে এমন হয়।
আমি খুবই একরোখাটাইপ মানুষ। নিজের মতো করে চলি। কারও কথাই শুনি না। আমাদের প্রেম চলতে থাকে। ‘সেকেলে প্রেম’ ছিল ওটা। সে ছিল আমার জীবনে আসা সবচেয়ে চরিত্রবান, নিরীহ, ছাপোষা, গরিব পুরুষ। তাকে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ বলতে আমার ছয় মাস লেগেছিল। দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলাম। এখানে আর-একটা অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ বলে রাখি। আমি সারাবাংলাদেশে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিইনি, শুধু বাসার পাশেরটাতে দিয়েছি। এর একমাত্র কারণ, বাবা-মা, বড়ো বোনকে ছাড়া দূরে থাকব না। বড়ো বোনের কথাটা পরে আবার প্রসঙ্গক্রমে বলব।
আমার ইচ্ছে ছিল বাংলায় পড়ার। চান্স পেলাম না। কখনও ভাবিনি, কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসে ইতিহাসে পড়ব। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্টইয়ার থেকেই বেশ চৌকস, প্রাণবন্ত আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী থাকার ফলে সহজেই শিক্ষকদের নজরে এসে গেলাম। তখন মনে হতো, এই ইতিহাসে পড়েই আমি পৃথিবীজয় করে ফেলব। ফার্স্টইয়ারেই ফার্স্টক্লাস থার্ড হলাম। মায়ের স্বপ্নটা তখন থেকেই…আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব! এরপর প্রতি ইয়ারেই ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড না হলেও এক থেকে সাত-এর মধ্যেই থাকতাম। পড়াশোনায় খুবই সিরিয়াস ছিলাম। সারাদিন লাইব্রেরিওয়ার্ক, ৭/৮টা বাংলা, ইংরেজি বই মিলিয়ে নোট করতাম। অ্যাকাডেমিক পড়া নিয়েই বিজি ছিলাম। তখন কেউ আমাকে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য গাইডলাইন বা বুদ্ধি, কোনওটাই দেয়নি। তখন অবশ্য লক্ষ্য সরকারি চাকরি ছিলও না। কী যে হতে চাইতাম, নিজেও বুঝতাম না। তবে মায়ের ইচ্ছেটা বুকের মধ্যে ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে লবিং লাগে, রাজনীতি লাগে। আমি তো এর কোনওটাই পারব না। টিচাররা আমাকে পছন্দ করলেও আমি তাদের কাছ থেকে একটু লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করতাম। এক স্যারের কথা মনে পড়ে। স্যার ক্লাসে বলতেন, ‘এই মেয়েরা! ভালো করে পড়ো। ভালো করে পড়লে ভালো একজন স্বামী পাবে। তোমাদের জন্য বেচারারা অনেক চেষ্টা করছে জীবনে ভালো কিছু করার জন্য। তোমরাও একটু পড়ো।’ আমরা সবাই হাসতাম স্যারের কথা শুনে।
তো এর মাঝেই, মাঝেসাঝে সে ক্যাম্পাসে আসত। দেখা হতো, কথা হতো। যখন সেকেন্ডইয়ারে পড়ি, তখন বাসায় জানাজানি হয়ে যায় আমাদের এই ‘অসম প্রেম’-এর বিষয়টা! প্রচণ্ড রাগারাগি করেন মা। বাধা আসে। কোনওভাবেই তাঁরা মেনে নিবেন না। আমাকে ত্যাজ্য করবেন। একদিকে বাসায় অশান্তি, আর-এক দিকে আমার প্রেম। ছোট ছিলাম তো, বাধ্য হয়ে ব্রেকআপ করে দিলাম। টানা ছয় মাস যোগাযোগ নাই। তারপর আবার কীভাবে কীভাবে যেন যোগাযোগ হলো। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা দেখা করতে পারতাম না। দেখা করলেই বাসার ল্যান্ডফোনে খবর চলে যেত! বাসা থেকে আমার পেছনে স্পাই লাগিয়েছিল। এরপর আমরা দেখাকরা বন্ধ করে দিই। ভার্সিটি যাবার পথে ফোনে, আর আসার পথে ফোনে একটুখানি কথা। ব্যস্ ওইটুকুই! এভাবে চলছিল প্রতিদিন। মাঝেমাঝে দূর থেকে একটু দেখা। এই হলো আমাদের প্রেম। এর মধ্যে আমার কাছে অনেক ভালো ভালো প্রস্তাব আসত। আর্মির ক্যাপ্টেন, ভার্সিটির স্যারও আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু আমি আমার প্রেমের ব্যাপারে নৈতিক অবস্থানে শক্ত এবং ডেসপারেট ছিলাম। আমরা দুজন ছিলাম প্রচণ্ড জেদি, এবং এই জেদটাই শেষপর্যন্ত আমাদের ব্রেকআপের দিকে নিয়ে যায়। আমাদের প্রায়ই ঝগড়া হতো। কখনও ছয় মাস, কখনও চার মাস, কখনও তিন মাস কোনও যোগাযোগ হতো না। বলতে গেলে, এত দীর্ঘসময়ে আমরা বেশিরভাগ ঝগড়া করে বিচ্ছিন্নই থাকতাম। তবু তাকে ছাড়তে বিবেকে বাধত।
এখানে একটা অফটপিক মনে আসায় বলে রাখি। আমার জন্ম চট্টগ্রামে, সিএমএইচ-এ। জন্মের পর ঢাকায় চলে আসি। ঢাকাতেই আমার শৈশব। শৈশবে অনেক কিছুই তখন চোখে পড়েছে। ডিফেন্সের এলাকায় থেকেছি। বৈষম্য কতটা প্রকট হতে পারে, সামনাসামনি দেখেছি। আমাদের স্কুলের নিয়ম ছিল, লম্বারা পেছনে বসবে। আমি অফিসারের মেয়ে বলে আমাকে সামনাসামনিই টিচাররা বসাতেন। হসপিটালে অফিসারদের আলাদা বসবার জায়গা, আর নন-অফিসারদের আলাদা। এত রুলস রেগুলেশনস ছিল যে, মাঝেমধ্যে হাঁপিয়ে উঠতাম। এমনকি বাবা বাসার পাশে লুঙ্গি পরে মসজিদেও যেতে পারতেন না। এসব দেখে ডিফেন্সের প্রতি বিতৃষ্ণা আসত। বাবা রিটায়ার্ড করার পর সিভিলদের সাথে মেশার সুযোগ হয়। তখন এ ধরনের স্বপ্নই ছিল---সিনেমার নায়কদের মতো গরিব ছাপোষা কাউকে বিয়ে করব। কমিউনিজমের উপর একটা ঝোঁক ছিল। আসলে সেইসব চিন্তা থেকেই আমার এই সম্পর্কে জড়ানো।
আমাদের আর্থিক অবস্থাটা একটু বলি। আমরা টেনেটুনে চলা নিপাট মধ্যবিত্ত। বাবারা বারো ভাই-বোন। বাবা সবার বড়ো। দাদা কিছু করতেন না। সংসারে টাকার দরকার পড়লেই জমি বিক্রি করতেন। স্বাভাবিকভাবেই বাবার উপর সব দায়িত্ব বর্তায়। চাচা-ফুপুরা প্রায়ই আমাদের সরকারি কোয়ার্টারসে এসে থাকতেন। মাসশেষে রেশন ফুরিয়ে যেত। বাবা আমার চাচাদের পড়াশোনা করিয়ে বিদেশ পাঠান। সেই চাচারা এখন আমাদের কোনও খোঁজই নেন না। কখনও একটা ফোন করেন না। জগতের এটাই বোধহয় নিয়ম। বাবা সংসারের প্রতি উদাসীন ছিলেন। চাচাদের পড়াতে আর বিদেশ পাঠাতে গিয়ে আমাদের পড়াশোনায় তেমন খরচ করতে পারতেন না। মেজো বোনটাকে টাকার অভাবে প্রাইভেটে ডাক্তারি পড়ানো গেল না। ইন্ডিয়াতে পড়ানোর জন্য টাকাপয়সা, কাগজপত্র সব রেডি-করা ছিল, কিন্তু ভুয়া এজেন্টের পাল্লায় পড়েছিলাম আমরা। শেষমেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো সে।
আমি হবার পর ঘরের অভাব কিছুটা কমে। বাবা অত্যন্ত সৎ এবং ধার্মিক মানুষ। অডিট-সেকশনে, যেখানে বাবা কাজ করতেন, সেখানে ছিল ঘুষের আখড়া। বাবাকে কেউ কিছু দিতে পারত না, শেষে ওরা জোর করেই খাওয়াবার চেষ্টা করত। বাবা করলেন কী, রোজারাখা শুরু করলেন। আমার বাবা এমনই। চাকরির মেয়াদ আরও দুবছর বাড়াতে পারতেন। কিন্তু তিনি আর চাকরি করবেন না। আমাদের নিয়ে গ্রামে চলে যাবেন। সেখানে খামার করবেন, সবুজবিপ্লব ঘটাবেন, এই তাঁর স্বপ্ন। মা বাধ সাধলেন। এই মহিলাটি অত্যন্ত আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন। সারাজীবন বাবা তাঁকে তেমন দামি শাড়ি-গহনা দিতে পারেননি। মায়ের তেমন আফসোসও নেই। চাচাদের বিদেশ পাঠাতে মা-ও একটা একটা করে নিজের গলার চেইন বিক্রি করেছেন। বাবা মাসশেষে বেতনের বেশিরভাগই বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। সংসারের দৈন্যদশা, অথচ বাইরে আমাদের ঠাট বজায় রাখতে হবে। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিই এমন। বাইরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট। ডিফেন্সে এসব আরও বেশি, ওখানে চাকরি করলে বাইরের মানুষকে অনেক শো-অফ করে চলতে হয়।
আমার মায়ের অবশ্য খুব বেশি চাহিদা নেই। বিয়ের পরে সল্টগোলাতে ছিলেন। কোয়ার্টারসে স্থানসংকুলান না হওয়ায় সিভিল বাসায় থাকতে দেয় বাবা-মাকে। কারেন্ট ছিল না সে বাসায়। মায়ের তাতে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। মা বই পড়তে ভালোবাসতেন দেখে বাবা অফিসের লাইব্রেরি থেকে বই এনে দিতেন। দিনে-রাতে কুপিবাতি জ্বালিয়ে নীহাররঞ্জনের কালোভ্রমর, মৃত্যুবাণ, কালনাগ, উল্কা, উত্তরফাল্গুনী, হাসপাতাল, কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী, লালুভুলু, রাতের রজনীগন্ধা ইত্যাদি পড়ে মুগ্ধ হতেন। প্রমথনাথ বিশী, কিরোর বই গোগ্রাসে পড়তেন। সময় কীভাবে চলে যেত, টেরই পেতেন না। দুইজনের সংসারে টাকাপয়সার অভাব ছিল, কিন্তু সুখের কোনও অভাব ছিল না। বাবার সবকিছুতেই মা খুব খুশি ছিলেন। মানুষ হিসেবে বাবা একজন ধার্মিক ও ভালো মানুষ। সেসব গল্প মা আমাদের মাঝে মাঝেই বলেন।
তো রিটায়ার করার পর বাবা গ্রামে যাবেন আমাদের নিয়ে। ওতে মায়ের তীব্র আপত্তি। আমাদের লেখাপড়া, ভবিষ্যৎ এসব নিয়ে তো ভাবতে হবে। বাবার যুক্তি, তিনি পারলে আমরা কেন পারব না? বাবা কি গ্রামে পড়াশোনা করে মানুষ হন নাই? মা বাবার সাথে অনেক ঝগড়াটগরা করার পর শেষপর্যন্ত আমরা এখানে বাড়ি করি। আমাদের বাড়ির আশেপাশে প্রাসাদতুল্য বাড়িগুলির মাঝে আমাদের জীর্ণশীর্ণ দোতলা বাড়ি। অবশ্য পাঁচতলার ফাউন্ডেশন করা আছে। আশেপাশের গজদন্ত-মিনারবাসীর বেশিরভাগই দ্বিতীয়শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। আর আমার বাবা প্রথমশ্রেণির হয়েও…বাবার কলিগদের লাইফস্টাইলের সাথে আমাদের আকাশপাতাল তফাত। তাতে আমার একটুও ক্ষোভ নেই। বরং এই মানুষটাকে নিয়ে আমি গর্ব করি। এই দারিদ্র্য আমাদের অহংকার। সুদ ঘুষ দূরে থাক, এই বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চি হালাল উপার্জনের অর্থে গড়া। বাবা দোতলাও করতেন না। তাঁর ইহজগতে বাড়ি গাড়ি করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তিনি তাঁর চিন্তাভাবনার সমস্ত কিছু পুঞ্জীভূত করছেন পরকালের জন্য। রাত দুইটা-আড়াইটায় উঠে ইবাদত শুরু করেন, ভোর পর্যন্ত চলে। নিচতলার একটা রুম শুধু এলাকার গরিব ছেলেমেয়েদের ফ্রি আরবি পড়ানোর জন্য নিয়েছেন।
তিনি সহীহ করে কোরআন পড়তে শিখেছেন পাকিস্তানের কোয়েটায়, যখন যুদ্ধের সময় অন্য বাঙালি সৈন্যদের সাথে তিনিও বন্দি ছিলেন। চাকরি-করা অবস্থায় করাচি ইউনিভার্সিটিতে বিএ কমপ্লিট করে সবে এমএ পরীক্ষার ফরম ফিলআপ করেছেন, কিন্তু পরীক্ষাটা আর দেওয়া হলো না। বন্দি হলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে মুক্তি পেলেন। দাদা-দাদি জানতেন না, বাবা বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন। বাবার একটা এক্সট্রাঅর্ডিনারি গুণের কথা বলতে খুব লোভ হচ্ছে। বাবা খুব দ্রুত যে-কোনও বিদেশি ভাষা রপ্ত করে ফেলতে পারেন। বাবা যে দেশেই গেছেন, খুব অল্প কদিনের মাথায় সে দেশের ভাষা আয়ত্ত করে রীতিমতো দোভাষী বনে যেতেন। বাবা অল্পবয়সে দেখতে ছিলেন একেবারে লম্বা সুদর্শন রাজকুমারদের মতন এবং এখনও তা-ই আছেন! তাঁকে দেখে বোঝার উপায় নেই, তিনি একজন কৃষকপুত্র! তো বাবা ইংরেজি, উর্দু আর আরবিতে বেশ তুখোড়। যুগোস্লাভিয়াতে গিয়েও মাত্র একুশ দিনে সব আয়ত্ত করে ফেলেন! আমি ওই দেশের ভাষায় এক থেকে দশ পর্যন্ত বলতে পারি। ইয়াদন দোয়া ত্রি চত্রি পেত শসেত অসেত দেবেত দসেত। বাবা গোঁড়া ধার্মিক মানুষ। কিন্তু আমাদের সব ধরনের স্বাধীনতা দিয়েছেন। কোনও কিছুতেই বাধা দেন না। আমি হবার পর আমাদের অভাব একটু একটু কমতে থাকে। যখন যা চেয়েছি, তা-ই পেয়েছি। ছোটবেলায় সাইকেল চেয়েছি, কিনে দিয়েছেন। সেই সাইকেলে কোয়ার্টারস, বাস্কেটবল ফিল্ড দাপিয়ে বেড়াতাম সন্ধ্যা পর্যন্ত।
যা-ই হোক, বাবা কষ্টেসৃষ্টে একটা দোতলা বাড়ি করলেন। শুরুতে একতলা ছিল। এই দোতলাটা হয়েছে শুধু আমার কারণে! সেই কথায় পরে আসছি। তবে বাড়ি করাতে শুধু বাবার না, মায়ের অবদানও আছে। তিনি তাঁর সব গহনা বিক্রি করেছেন। আমার একটা চেইন ছিল, সেটাও বিক্রি করা হয়েছে। অবশ্য আমার স্বর্ণের প্রতি একদমই আকর্ষণ নেই। আমার অ্যান্টিকসের গহনা পছন্দ, আর পছন্দ গাঢ় কাজল। মা একজন অন্যরকম মহিলা। সব সময় বলেন, ‘পৃথিবীতে সবাই যদি জিততে চায়, ঠকবেটা কে? সবাই জিতলে জিতুক, ঠকে-যাওয়ার দায়িত্বটা নাহয় আমিই নিলাম।’ কাউকেই কিছু বলতেন না, কোনও ব্যাপারেই উচ্চবাচ্য ছিল না মায়ের কণ্ঠে। তাই সবাই মাকে ইচ্ছেমতো ঠকিয়েছে। মামারা মাকে যৎসামান্যই জমি দিয়েছেন। মা সেগুলি পানির দরে বিক্রি করে এই বাড়ি করতে টাকা ঢেলেছেন। ঠিকমতো ঠিকদামটা পেলে আমাদের এদ্দিনে চার/পাঁচতলা উঠে যেত। জমিজমার দিকে মায়ের কোনও লোভ নেই। শুধু আমাদের তিন বোনের একটা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য এই বাড়িটা করতে চেয়েছেন।
এতকিছু বলা আমাদের আর্থিক সঙ্গতিটা বোঝাবার জন্য। আমার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিকোচিং করার টাকা জোগাড়ের জন্য মা তাঁর গয়না বন্ধক রেখেছিলেন। আমি তখন দিন-রাত শুধু পড়তাম আর পড়তাম। যেমন করেই হোক, যত পচা সাবজেক্টেই হোক, আমাকে চান্স পেতেই হবে মায়ের জন্য, বাবার অর্থসাশ্রয়ের জন্য। কারণ আমাকে প্রাইভেটে পড়ানোর অত খরচ করার সামর্থ্য বাবার নেই। বাড়িতে বিধবা দাদি। আর তাঁর চার পুত্র-কন্যাসমেত বিধবা মেজো চাচি। এঁদের কারও খরচই চালানোর সামর্থ্য সিঙ্গাপুরে-থাকা বিলাসবহুল লাইফস্টাইলে-চলা মেরিন ইঞ্জিনিয়ার সেজো চাচা, আর সৌদিতে ভালো চাকরি করা ছোট চাচার নাই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবার পর হাতে মোবাইল পাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেম-করা বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়াতামই বেশি। আমার আগেই বলা ছিল---আমার স্বাধীনতায় কোনও হস্তক্ষেপ করা যাবে না। বন্ধু-বান্ধবদের সময় আমি বেশি দেবো, এ নিয়ে হস্তক্ষেপ করা যাবে না।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটো সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলাম। রোটারেক্ট ক্লাব, এটার ভাইসপ্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হয়েছিলাম। আর একটা আবৃত্তিসংগঠনের সদস্য ছিলাম। আমার তখনকার প্রেমিক এমনিতেই অসচ্ছল, তার উপর ব্যবসায় লস খেয়েছিল, শেয়ারে লস খেয়েছিল। মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্টে খেলে আমি অর্ধেক বিল শেয়ার করতাম। জন্মদিনে, উৎসবে অনেক কষ্টে একটু একটু করে জমানো টাকা থেকে গিফট কিনে দিতাম। যেহেতু তখনও স্টুডেন্ট ছিলাম। সে আমাকে তা-ও দিতে পারত না। মা একবার তাঁর জমি-বেচা ত্রিশ হাজার টাকা আমাকে আর মেজো বোনকে ভাগ করে দিয়েছিলেন যার যার আলাদা অ্যাকাউন্টে রাখতে। সে সময় পাওয়া ১৪ হাজার টাকা আমি ওর হাতে তুলে দিই। ওর তখন খুবই দৈন্যদশা। ব্যাংকে লোন, প্রতিদিন তাগাদা দেয়, কিন্তু ওকে ধার দেবার কেউ নেই। সেই টাকা একটু একটু করে ব্রেকআপের পর পর্যন্ত ও শোধ করে আমার কাছে।
২০১৪। আমাদের মাস্টার্স শেষবর্ষ। আমি পরীক্ষা দিয়ে সার্কট্যুরে যাবার স্বপ্নে বিভোর। ডিপার্টমেন্টের প্রতি ব্যাচই যায়। এই ট্যুর নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। জীবনে কোথাও যাইনি, কিছুই দেখিনি, এক দিনাজপুর কান্তজীউ মন্দির ফিল্ডওয়ার্ক ছাড়া। আমি ঘরকুনো মানুষ। কোনও দিন বাসার বাইরে রাত কাটাইনি। এই প্রথম বের হলাম। আমরা সাত বন্ধু সার্কট্যুরের জন্য রেজিস্ট্রেশন করলাম। সাথে এক স্যার, তাঁর স্ত্রী আর একজন ম্যাম। টানা একুশ দিনের ট্যুর। কথা ছিল পনেরো দিনের। বন্যার কারণে কাশ্মীরের কাছে কাটরাতে আটকা পড়ে ছিলাম এক সপ্তাহ। কলকাতা, আগ্রা, জয়পুর, জয়সালমির, দিল্লি, পাঞ্জাব, আর কাশ্মীরের কিয়দংশ ঘুরেছি। শুধু কাশ্মীরটাই অধরা রয়ে গেল! কী এক রোমাঞ্চকর সেই ভ্রমণ বন্ধুদের সাথে! যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মতো ওড়াওড়ির, তা কি আর ফিরে পাব? সেই ছিল আমার জীবনে পাওয়া শেষসুখ, যা মনে রাখার মতো। এরপর হয়তো ছোটখাটো কিছু সুখ এসেছে জীবনে, তবে তা মনে রাখার মতো না।
আবার যাবার স্বপ্ন নিয়ে ফিরে এলাম। কাশ্মীরের বরফ ছুঁবার আর ডাললেকের নৌকাতে সারারাত কাটাবার স্বপ্ন! তবে আবার গেলে বন্ধুদের সাথে হয়তো যাওয়া হবে না। হবে বরের সাথে। কিন্তু স্রষ্টা কি আমার ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন রেখেছেন? জানি না। স্পন্সর পেয়েছিলাম ত্রিশ হাজারের মতো। সব মিলিয়ে ভারতসফরে চল্লিশ হাজারের মতো খরচ হয়েছে। যেখানেই গিয়েছি, সবার আগে আমার মায়ের কথা মনে হয়েছে। মায়ের জন্য সামনে যা পেয়েছি, তা-ই কিনেছি। কাশ্মীরের কাছে কাটরা হোটেল থেকে বন্ধুরা মিলে সন্ধ্যার পর শহর দেখতে বের হলাম। আমরা তখন সমতল থেকে কয়েক হাজার ফুট উপরে পাহাড়ের পাদদেশের শহরে। এই জায়গাটা তীর্থভূমি। পাহাড়ের শীর্ষমাথায় জয় মা তারার মন্দির। লোকে দূরদূরান্ত থেকে দেখতে আসে। প্রথমেই আমরা গেলাম মার্কেটে। মায়ের জন্য শাল কিনব। কাশ্মীরি শাল। দোকানদার আমাকে ‘সাস বহু কি শাওল’ দেখালেন! একপাশে মেরুন, আর একপাশে ছাইরঙা। ইধার সাস, ইধার বহু। আমি বললাম ‘সাস বহু’র জন্য না, মা-মেয়ের জন্য নিব। ইধার মা, ইধার মেয়ে!
যেদিন ভারতের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়লাম, কলকাতার বাসে উঠে মাকে বললাম, ‘আর কথা বলা যাবে না, নেটওয়ার্ক চলে যাবে।’ মা ওপাশ থেকে কেঁদেছিলেন। অবশ্য সেখানকার সিম কিনে পরে আবার যোগাযোগ হয়েছে। যেদিন ফিরে আসি, বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখতেই মাকে ফোন দিলাম। আমাকে কিছু একটা বলতে গিয়েও মা বললেন না। তাঁর গলাটা ধরে এল। বাসায় ফিরলাম দীর্ঘদিন পর। মা এই কদিন আমার প্রিয় সিঙ্গারা খাননি। সবার জন্য বানিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু নিজে খাননি। বাসায় এসে শুনলাম, বড়ো বোন গুরুতর অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। ডায়বেটিস দুইয়ে নেমে গিয়েছিল, মারাও যেতে পারত। শুনে বুকটা ধক্ করে উঠল!
এর সপ্তাহখানেক পর একটা বিসিএস কোচিং-এ ভর্তি হলাম। সবাই বলছিল ভর্তি হতে। খুব একটা সময় পাইনি প্রিপারেশনের জন্য। ৩৫তম বিসিএস দিলাম। ওটা ছিল ইতিহাসের কঠিনতম বিসিএস প্রিলি। আমার হলো না। কোচিং-এ আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির এক স্যার আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। এবং, এখন পর্যন্ত আমি নাকি তাঁর সব ক্যাম্পাসের (কোচিং-এর নানা ব্রাঞ্চ, যেগুলিতে গিয়ে গিয়ে স্যার ক্লাস নিতেন) মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী। তাঁর ধারণা, আমি একদিন ম্যাজিস্ট্রেট (অ্যাডমিন ক্যাডার) হব! আসলে মাস্টার্সে আমার সাবজেক্ট ছিল ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস। এ কারণে টুকটাক পারতাম, ক্লাসের ক্যুইজে ফার্স্ট হতাম। তা ছাড়া সাধারণ জ্ঞানে ছোটবেলা থেকেই মোটামুটি ভালো ছিলাম। আমার সমস্যা মূলত গণিতে। আমার গণিতের বেসিক একেবারেই ভালো না। তো স্যার যেচে যেচে আমার ফোন-নাম্বার নিলেন। ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলার নানান চেষ্টা চালাতে লাগলেন। তখনও আমার ফেইসবুক আইডি ছিল না। স্যার তাঁর আর্টিকেলগুলি পড়ানোর জন্য একপ্রকার জোর করেই আমাকে দিয়ে আইডি খুলালেন। আমি বুঝতাম, তিনি আমাকে পছন্দ করেন। আমার এ ধরনের কোনও ইনটেনশন ছিল না। তা ছাড়া আমি একটা রিলেশনের মধ্যে ছিলাম। আমি আমার জীবনে সব সময়ই শতভাগ সৎ এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার চেষ্টা করেছি।
এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল। আমাদের বাসায় আরও একজন সদস্য আছেন। আমি তাঁকে আপা ডাকি। আমার জন্মেরও আগে, এখন থেকে প্রায় ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় আগে তিনি আমাদের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে এসেছিলেন। ছোটবেলায় তাঁর বাবা মারা যায়। তখন একবার এক বুড়ার সাথে বিয়ে হয়েছিল। সেই বুড়াকে ছেড়ে তিনি চলে আসেন। ঢাকায় এসে বাড়িতে বাড়িতে কাজ নেন। কোনও বাসাতেই টিকতে পারেননি চুরি আর মিথ্যাকথার জন্য। শেষপর্যন্ত আমাদের বাসায় টিকে যান আমার মায়ের সৎগুণাবলির কারণে। আমাকে ছোটবেলা থেকেই আপা পেলে পুষে বড়ো করেছেন। প্রচণ্ড আদর করেন। এখনও আমার মশারি টাঙিয়ে দেন, বিছানা গুছিয়ে দেন। বাসার তদারকি-দেখাশোনা উনিই করেন। বাজার-সদাই, রান্নাবান্না। জনমদুখী মেয়ে উনি, বিয়ে থা, সংসার, ছেলেমেয়ে…তাঁর কিছুই হলো না এ জীবনে। আমাদের সাথে রয়ে গেলেন। গ্রামে ওঁর মা ছিলেন। তিনিও বছর চারেক আগে মারা গেছেন। এক বোন থাকে শহরে। এ ছাড়া ওঁর তিনকুলে আর কেউ নেই। যাদের কেউ নাই, তারা কাউকে না কাউকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। এরা ভালোবাসার বড়ো কাঙাল। আমরাই ওঁর ভাই, বোন, মা, বাবা, আপনজন।
তো এই আপাই একদিন খবর নিয়ে জানলেন, যার সাথে আমার প্রেম, সেই ছেলে ইন্টার-পাস এবং ওরা ছয় ভাই-বোন। আমি বিশ্বাস করলাম না। আমাদের কথা ছিল, মাস্টার্স শেষ করে আমরা পালিয়ে বিয়ে করব, যেহেতু বাসায় এ বিয়ে মেনে নিবে না। ওর কাছেই এর সত্যতা যাচাই করতে চাইলাম। সে বেকায়দায় পড়ে সব স্বীকার করল। বলল, সম্পর্ক রাখার জন্য সে মিথ্যা বলেছে। কান্নাকাটি করল। আমার কাছে মাফ চাইল। আমি ফিরতে পারলাম না। মন নরম হয়ে গেল। এদিকে আমি বিসিএস পরীক্ষার পড়া-কোচিং নিয়ে কিছুটা বিজি হয়ে পড়লাম। ওর সাথে যোগাযোগ কমে আসল। চিন্তা করলাম, চাকরি করলে নিজের পায়ে শক্ত অবস্থান হবে। তখন এ বিয়ের সামাজিক স্বীকৃতির জন্য আমারও একটা সাহস হবে। কিন্তু ওকে ছাড়ার চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। যাকে ভালোবাসি, তাকে ভালোবাসিই। তার সাথে সারাজীবনই থাকব, পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন! তাকে ছেড়ে যাব কেন? তার সামাজিক অবস্থান খারাপ বলেই ব্রেকআপ করে ফেলতে হবে? এর নাম ভালোবাসা নাকি? এটা তো একধরনের স্বার্থপরতা! এত হিসেব করে কাউকে ভালোবাসা যায়? এইসব চিন্তাই তখন মাথায় আসত।
২০১৫ সাল। তিন মাস যাবত মায়ের খুব কাশি, কিন্তু ডাক্তারের কাছে যেতে তাঁর অনীহা। তার উপর মামা ডাক্তার হওয়াতে মা-ও হাফ-ডাক্তারের মতো নিজে নিজেই অনেক ওষুধের নাম জানতেন। আমাদের অসুখবিসুখ হলে তিনিই বলে দিতেন, কী ওষুধ খেতে হবে। শেষদিকে মায়ের অবস্থা খারাপ হলো। নিউমোনিয়া হয়ে গেল। সিএমএইচ-এ যেতে বাধ্য হলেন। ডাক্তার দেখে বললেন, অবস্থা খুব খারাপ। যে-কোনও মুহূর্তে…! অথচ আমার মাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। মায়ের মুখে অক্সিজেন-মাস্ক। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল! ডাক্তাররা বললেন, আর মাত্র দুইরাত বড়োজোর। শেষরাতটা আমি মায়ের সাথে শুয়ে ছিলাম। ডাক্তাররা শেষচেষ্টা করবেন। গলায় একটা ছিদ্র করে পাইপ ঢুকিয়ে দেখবেন, ফুসফুস বাতাস নিতে পারে কি না, কারণ ততদিনে মায়ের ফুসফুস কফ জমে জমে শক্ত হয়ে গেছে। ডাক্তাররা বলেই দিয়েছেন, এ ধরনের অপারশনে রোগীর জ্ঞানফেরার সম্ভাবনা মাত্র টেন পার্সেন্ট। আমরা ধরেই নিয়েছি, মা আর বাঁচবেন না এবং আমরা সবাই তাঁর মৃত্যুসংবাদের অপেক্ষায় আছি!
(চলবে...)