বাবার ইচ্ছেয় প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা অনুষদে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, পদার্থবিদ্যা আমার জন্য নয়। হায়ার ফিজিক্সের আশি শতাংশই মুখস্থ করতে হতো। ছোটোবেলায় পেটব্যথা করলে বড়ো মামা নারকেলের সাথে শুকনো লঙ্কা মেখে ভাত খাইয়ে দিতেন, এতে নাকি পেটের ব্যামো একদিনেই সেরে যায়। পাকস্থলির অমন গোলযোগে শুকনো লঙ্কার মতো ভূতুড়ে জিনিস কী করে ব্যথা উপশমের ঔষধ হতে পারে, তার মাথামুণ্ডু না জেনেই, না বুঝেই গেলার মতোই অনেকটা এই হায়ার ফিজিক্স।
তাই ওটা ছেড়ে চলে এলাম জাহাঙ্গীরনগরে। রসায়ন বিভাগে ভর্তি হলাম। আমার এই সিদ্ধান্তে বাবা কোনো রকমের বাধ সাধলেন না, অবশ্য আমার কোন ব্যাপারেই-বা উনি জড়িয়ে ছিলেন যে বাধ সাধবেন! রসায়ন ব্যাপারটা আমার সেই উচ্চমাধ্যমিক থেকেই ভালো লাগত। জীবনের সাথে, প্রকৃতির সাথে মিল খুঁজে পেতাম। জীবন, প্রকৃতি আর রসায়ন—ঠিক যেন এক মায়ের তিন সন্তানের মতো।
কিন্তু বিধি বাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম এবং মারাত্মক ধাক্কাটা খেলাম কার্তিকের সতেরোতে। সেদিন আমার ছায়া আমাকে ছেড়ে পৃথিবী থেকে, এক অনাকাঙ্ক্ষিতকে জেতানোর লড়াই থেকে চিরবিদায় নিলেন। সেদিন থেকে আমার মনে হতে লাগল, আমি সত্যিই অনাকাঙ্ক্ষিত। আবার সেই ভয়, সেই লজ্জা আমাকে চেপে ধরল। শেকড় ছাড়া নেতিয়ে-পড়া একটা গাছ আমি। যেখানেই যাচ্ছিলাম, যার কাছেই যাচ্ছিলাম, বার বার মনে হচ্ছিল, আমার কোনো আশ্রয় নেই, এসব আমার নয়, আমাকে শিগ্গিরই চলে যেতে হবে। কিন্তু কোথায় যাব? আমার তো কোনো ঘর নেই। আমার ঘরটা সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে কেউ নিয়ে চলে গেছে, আমার কথা একটা বারও ভাবেনি।
নানু চলে যাবার পরের দিনগুলো আমার জন্য কঠিন হয়ে উঠতে লাগল। নিজেকে এক গৃহহীন শিশু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারতাম না। স্নাতকের প্রথম বর্ষ কীভাবে কেটেছে জানি না, শুধু জানি, অনেকখানি সময় পেরিয়ে গেছে আর আমার অর্জনের ঘরে প্রাপ্তি বরাবরই শূন্য। নানুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে আমরা সবাই ময়মনসিংহে গেলাম। মসজিদে মিলাদ পড়ানো হলো, আর বাসায় সবাই মিলে কুরআন খতম ও দোয়াপাঠ করে নানুর আত্মার মাগফেরাত কামনা করলাম। এতগুলো বছর পরে আমার শৈশবে-ঘেরা পুরোনো বাড়িতে ফিরে কান্নায় ভেঙে পড়লাম।
এই তো সেদিনের কথা, যেদিন পড়ায় ফাঁকি দেবার ধান্দায় হিসু লেগেছে বলে দৌড়ে পালানোর সময় নাহার চৌধুরির হাতা-খুন্তির মার খেলাম। আজ এক বছর হয়ে গেল, হাতা-খুন্তি পড়ে আছে, আমার পড়ার ঘরটা সুন্দর করে গোছানো, গোছানো সব স্মৃতিগুলোও, শুধু নাহার চৌধুরি অতীত। এখনও যেন কানে বাজছে নাহার চৌধুরির গমগমে কন্ঠ, আমার হাসির তীব্র শিস, মাঠে ফুটবল খেলায় হেরে যাবার পর মামাদের সে কী রোষ উপচে পড়ছে বাকি খেলুড়েদের উপর! সন্ধ্যায় চা খেতে বসে নানুর ধোঁয়া-সাদা সোয়েটারে চা ফেলে দেওয়া। তারপর কাঠবাদামের তলায় গিয়ে লুকিয়ে থাকা, একটা কেরোসিনের কুপি নিয়ে নাহার চৌধুরির খুঁজতে বের হওয়া। ঝিমিয়ে-আসা দুপুরে ছোটো ছোটো বেগুন ভর্তা করতে বসে শুকনোলঙ্কা-মাখানো হাত দিয়ে চোখ ডলে, সারাবাড়িতে বাঁদরনাচ নাচা...কোথায় হারিয়ে গেল সেসব দিন? বেশি দূরে কোথাও যায়নি বোধ হয়, আমার কাছেপিঠেই আছে। নইলে এমন ঠা-ঠা খালি গর্তে সাপের হিস হিস শব্দের মতো আমার মৃত অতীত আমার কানে হানা দেবে কেন!
আমরা বেশ কিছুদিন ময়মনসিংহে ছিলাম। ওখান থেকে গাজীপুরের বাসায় ফিরে আসার দু-তিন দিনের মাথায় একদিন সকালে বাবা বাজারে গিয়ে সেরখানেক গোরুর মাংস নিয়ে এলেন, মাকে বললেন সব একসাথে রান্না করতে, বড়ো আপাও এসেছিল সেদিন। মায়ের হাতের গোরুর মাংস যেন অমৃত! গোরুর মাংস আলু দিয়ে রান্না, গোরুর মাংসের কালাভুনা আর পালংশাক দিয়ে শুকনো করে ভুনা—মা এই তিন ধরনের পদ রান্না করলেন। সাথে কালিজিরার ভর্তা, ঘন করে পাঁচ-সাত রকমের ডাল একসাথ করে ভুনা করলেন আর লেবুপাতা দিয়ে মৌরলা মাছ। আহা!
বেলা দুটোয় সবাই খেতে বসেছিলাম, বাবাকে বেশ আমুদে লাগছিল। মা সব কিছু করলেও প্রধান একটা জিনিস ভুলে গিয়েছিলেন। সেটা হচ্ছে পোলাও। বাবা মাংস দিয়ে পোলাও খেতে ভীষণ পছন্দ করতেন। খেতে বসে বাবা মিষ্টি করে বললেন, কী গো, সাভেরার মা। আইজ পোলাও করলা না যে? ভুইল্লা গেছিলানি?
মা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। পোলাও রান্না করতে আজ কীভাবে ভুলে গেলেন! মা একেবারে দমে গেলেন। বাবা অভয় দিলেন।
- আইচ্ছা, থাউক। এত টেনশন নিবার ক্যা? আইজকা নয়া কিছু ট্রাই করবাম। না কি, সাভেরা?
- হ, মা। বাবা ঠিকঅই কইছে। আইজ পোলাও খাইতাম না আমরা। তুমি বইসা যাও। একলগে খাই।
তারপরও মা আশ্বস্ত হতে পারলেন না। মনের মধ্যে একটা আফসোস আর অপরাধবোধ তাঁকে জেঁকে ধরল। সবাইকে ভীষণ আনন্দের সাথে খাবার উপভোগ করতে দেখে মা কিছুটা সহজ হলেন।
সেদিন অনেকরাত অবধি আমরা সবাই একসাথে অনেক গল্প করলাম। বাবাকে সব থেকে বেশি উত্তেজিত মনে হচ্ছিল। একেক বার একেক জনকে ডেকে আদর করে দিচ্ছিলেন, আর থেকে থেকে গর্ব করে উঠছিলেন। তাঁর সন্তানেরা সবাই প্রতিষ্ঠিত হবার পথে, সমাজের উচ্চআসনে তাদের স্থান হবে। তিনি ভীষণ তৃপ্ত।
পারিবারিক সময় কাটিয়ে সবাই যে যার ঘরে ঘুমুতে চলে গেলাম। রাত প্রায় দুটো কি আড়াইটের সময় মায়ের আর্তনাদে বাসা ভারী হয়ে উঠল। ধড়ফড়িয়ে সবাই মায়ের ঘরে গিয়ে জড়ো হলাম। দেখি, বিছানায় বাবা কেমন যেন করছেন, ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছেন না। বড়ো আপা, ছোটো আপা কেঁদে উঠল। আমি তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য বলে দিলাম। মা তেল গরম করে বাবার বুকে-পিঠে মালিশ করতে লাগলেন। কিন্তু বাবার অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স এসে পড়ল, স্ট্রেচারে করে সবাই মিলে বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলাম। মা ক্রমাগত কেঁদেই চলেছেন। ভোর চারটের দিকে ডাক্তার সাহেব বাবাকে মৃত ঘোষণা করলেন। সবাই যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হলো। ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায়, বাবার শুধু স্বরযন্ত্রটা ওঠানামা করছে। মা এই ধাক্কাটা সামলাতে পারলেন না। জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
জন্ম থেকে জীবনের দীর্ঘ একুশ বছর বয়সে আমি কোনোদিন বাবার ঘরে ঢুকে তাঁর কোনো জিনিস ছুঁয়ে দেখিনি। বাবার লেখা পত্র, বাবার সম্মানে দেওয়া সার্টিফিকেটগুলো, প্রশংসাপত্র, পুরস্কার, বই কিচ্ছু না, এমনকী কখনও চশমাটাতেও হাত দিইনি। ওগুলো সব আপারা করত, দেখত; বাবাও দেখাতেন, গল্প করতেন। হয়তো আমি কখনও প্রয়োজন মনে করিনি বা বাবাও কখনও প্রয়োজন মনে করেননি। তাই আমি সব কিছু থেকে দূরেই ছিলাম।
একুশ বছরের জীবনে সেদিনই প্রথম বাবার কোনো জিনিস হাতে নিয়েছি, আর সেটা হলো বাবার ডেথ-সার্টিফিকেট। আমার নিজের ভাগ্যের উপর আমার নিজেরই ঈর্ষা হয়। এমন ভাগ্য পৃথিবীতে কয়জনের হয় যে, জন্মদাতা পিতার প্রথম ও শেষ ছোঁয়া তাঁর মৃত্যুসনদ দিয়ে হয়, তাঁর জীবনের শেষ গোসল দিয়ে হয়! অন্যদের কাঁধের উপর ভরসার যে-ছায়া থাকে, সেটা হয় বাবার হাত—খুবই শক্ত একটা হাত! আর আমার কাঁধের উপর ভরসার ছায়া আমার বাবার শেষযাত্রার খাটিয়া! এটাও জীবন? আরে হ্যাঁ, এটা তো আমারই জীবন! অদ্ভুত! করুণাও হয় না বুঝি বিধাতার…এমন একটা জীবনের জন্য!
মায়ের জ্ঞান ফিরেছে প্রায় শেষবিকেলে। বাবাকে আমরা তখনও মাটি দিইনি। শেষবারের মতো মা যেন একবার দেখতে পারেন, সেজন্য রেখে দিয়েছিলাম। মা হামাগুড়ি দিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন উদ্ভ্রান্ত এক প্রৌঢ়ার মতো বাবার খাটিয়ার দিকে এগিয়ে গেলেন। বাবার মুখটা তখনও স্থির, মৃত্যুর ক্লান্তি যেন তাঁকে ছুঁতেই পারেনি। প্রতিদিন যেমন মায়ের হাতে রান্না-করা তরকারি মেখে ভাত খেয়ে ভরপেটে তৃপ্ত হয়ে ভাতঘুম দিতেন, ঠিক তেমনই যেন ঘুমিয়ে আছেন। মা নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন; বাবার মুখ, চোখ, কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন। বড়ো যত্নে-রাখা এতদিনের ভালোবাসাকে আজ সময় হয়েছে একলা ছাড়ার। নিঃশব্দে মা উঠে এলেন বাবার পাশ থেকে; ঘরে গিয়ে বাবার একটা চাদর, বাবার প্রিয় দুটো বই, বাবার চশমা আর মশারি নিয়ে এলেন; আমার হাতে দিয়ে বললেন, যেখানে বাবাকে রেখে আসতে যাচ্ছি, এগুলো যেন সেখানে বাবাকে দিয়ে আসি। এটুক বলেই ঘরে ঢুকে গেলেন।
এই এতক্ষণে আমি নড়েচড়ে উঠলাম। আমার মনে হলো, আমি সজ্ঞানে আছি, আমি সুস্থ আছি। আমার ভেতরে রক্তস্রোত বইছে। বাবা মারা গিয়েছেন, মা জ্ঞান হারিয়েছিলেন, আপারা বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে, একটু পর জেগে উঠে আবার অঝোরে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে—এইসব কিছু ঘটছে, আমি জেগে আছি। এটা কোনো দুঃস্বপ্ন নয়। মা আমাকে বাবার কিছু জিনিপত্র দিয়ে গেছেন। হ্যাঁ, সত্যিই এসব ঘটেছে। আমার কাঁদা উচিত, কিন্তু আমার চোখ শুকনো, স্থির। আমরা কয়েক জন মিলে বাবাকে রেখে এলাম বাবার নতুন ঘরে। ফিরে এসে গাজীপুরে আমাদের পুরোনো বাড়িটাকে আর চিনতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, ভুল করে কোনো এক আদিম গুহায় ঢুকে পড়েছি, যেখানে শুধু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু দৈহিক-কাঠামো পড়ে আছে চারদিকে।
কিছুক্ষণ আগ অবধি জানতাম, শুধু বাবা মারা গিয়েছেন, ফিরে এসে আবিষ্কার করলাম, আরও কিছু আত্মার মৃত্যু ঘটেছে। অসংখ্য স্মৃতির বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, একটা শক্তহাত কেউ এসে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে। আচ্ছা, ওরাও কি এখন আমার মতোই নিজেদেরকে গৃহহীন ভাবছে—এতিমখানার একলা, অসহায়, আশ্রয়হীন ওই ছেলেগুলোর মতো? ওদেরও কি অ-নে-ক কষ্ট হচ্ছে আমার মতন? নিত্যনৈমিত্তিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে একমুহূর্তেই আমার মতো? আমারও এমন মনে হতো…!
বাবার মৃত্যুর পর থেকে মা আর কখনও পোলাও মুখে তোলেননি। যে যে খাবারগুলো বাবার প্রিয় ছিল, অথচ মা সেদিন রান্না করতে ভুলে গিয়েছিলেন আর শেষবার বাবাকে খাওয়াতে পারেননি—সেসব খাবার মা কখনও মুখে তুলতেন না। যখনই বাসায় পোলাও রান্না হতো, মা ডুকরে কেঁদে উঠতেন আর বলতেন, মানুষটার পোলাও ম্যালা পছন্দ আছিল। আমি খাওয়াইতে পারি নাই তারে। হেইদিনও রাইতে খাইতে চাইছিল। কত শখ কইরা বাজার থেইকা এতখানি গোস্ত আনছিল পোলাও দিয়া খাওনের লাইগা। আমার মরণ হয় না ক্যান? কেমনে ভুইলা গেছিলাম আমি! পারলাম না তারে খাওয়াইতে! হেইরাইতেই আমারে বিদায় দিয়া গ্যালো গা! এই দুঃখ রাহনের জায়গা নাই আমার কাছে! আল্লায় আমারে নিয়া গ্যালো না!