অর্ধেক মানুষ

পুরোনো হতে হতে প্রেম আর প্রেম থাকে না, একসময় তা হয়ে যায় গোটা একটা সংসার।




সে ঠিকমতো খেলো কি না, ভালো আছে কি না, তার মন ভালো কি না, সারাক্ষণই এসব জানতে ইচ্ছে করে। বাসায় আজ তরকারিতে লবণ কম হয়েছে, রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পায়ে হোঁচট খেয়েছে, টঙের দোকানের মামাটার তিনটা চুল সাদা হয়েছে, এই সব কিছুই মানুষটাকে নিয়ম মেপে বলা লাগে একাধিক বার।




বলা লাগে, খাটের তলায় ইঁদুরটার তিনটা ছানা হয়েছে, প্রিয় হাতঘড়িটা সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, হঠাৎ হাত ফসকে চিনির বয়ামটা পড়ে ভেঙে গেছে।




একসময় মানুষটা নিখুঁতভাবে জেনে যায় কোনটা তার প্রিয় রং, প্রিয় গান, প্রিয় দুঃখ।




জেনে যায়, কোন কথাতে তার পুরোনো ক্ষত জেগে ওঠে, কোন কথাতে তার মনটা নেচে ওঠে।




একসময় মানুষটাকে ইমপ্রেস করার কোনও তাড়া আর থাকে না। কাজলছাড়া চোখে অথবা পুরোনো স্যান্ডেলেও তার কাছে নিজেকে আর অসুন্দর লাগে না। মানুষটার সামনে কোনও রকমের প্রস্তুতি ছাড়াই তখন সহজে যাওয়া যায়।




ঘরের পোষা বেড়াল-কুকুরের মতো মানুষটাও একসময় খুব প্রিয় পোষা কেউ হয়ে যায়। হয়ে যায় ছাড়তে-না-পারা আজীবনের পুরোনো কোনও অভ্যাস।




পুরোনো হতে হতে একসময় মানুষটা আর প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা থাকে না। হয়ে যায় গোটা একটা ঘর, একটা ছাদ, একটা ছাতা; জীবনের সবচাইতে প্রিয় নিঃশ্বাস।




একসময় দুটো মানুষ হয়ে যায় দু-দেহের এক আত্মা।




অদ্ভুত এক মায়া, কী যেন এক স্নেহময় টান! মানুষটা রক্তের কেউ নয়, কিন্তু রক্তের মতোই আপন, যাকে ছাড়া যায় না, যাকে ছেড়ে থাকাও যায় না।




এভাবে একদিন সে ঠিকই বুঝে যায়, মানুষটা কখনও তাকে ছেড়ে যাবে না। নিজের অর্ধেকটা ছেড়ে পালাতে কেউ পারে কি! কী যেন আশ্চর্য এক মায়াবী রজ্জুতে দু-জন মানুষ খুব শক্তভাবে আটকে যায়।




আমরা অনায়াসেই বিক্রি হয়ে যাই ভালোবাসার কাছে, স্নেহ এবং অভ্যাসের কাছে। ভালোবাসার চাইতে নিখুঁতভাবে বশ মানাতে আর কিছুই পারে না।




এভাবেই মানুষ হয়ে যায় এক অর্ধেক-মানব; তার অর্ধেকটা নিজের কাছে, আর বাকি অর্ধেকটা থেকে যায় ওই মানুষটার কাছে। যদি কখনও সেই একান্ত নিজের মানুষটা জীবন থেকে চলে যায়, তখন বাকিটা জীবন তাকে বাঁচতে হয়ে একজন অর্ধেক মানুষ হয়ে।




এই পৃথিবীর বেশিরভাগ সংসারই দু-জন অর্ধেক মানুষের সংসার। সেই দু-জন মানুষের অর্ধেক আত্মা অন্য দু-জন মানুষের কাছে ফেলে রেখেই ওরা দু-জন মায়া ও অভ্যস্ততার বন্ধনে বেঁচে থাকে। সংসার বড়ো বিচিত্র এক জায়গা; কেবল এখানেই দুই অর্ধেক মিলে কখনও পরিপূর্ণভাবে এক হয় না।