ডিভোর্সের ভিন্ন নেপথ্য

অনেক মেয়েকেই ডিভোর্সের পর জীবন এলেমেলো করে ফেলতে দেখেছি। দেখেছি, কেউ কেউ ভয়াবহ ডিপ্রেশনে চলে যায়, কেউ কেউ রাত-দিন কাঁদে, কারুর সাথে কথা বলে না, ঠিক করে খায় না; কেউ কেউ আবার জেদের বসে হুট করেই কাউকে বিয়ে করে ফেলে। আবার কেউ কেউ সুইসাইডের চেষ্টাও করে, যাদের মধ্যে গুটিকয়েক মানুষ সফলও হয়ে যায়!




আমার ডিভোর্সের পর আমি যে যন্ত্রণা পাইনি, তা নয়, তবে আসলে আমি অবাকই হয়েছিলাম বেশি। অনেক অনেক দিন আমাকে ঘুমের জন্য ঘুমের ওষুধের সাহায্য নিতে হয়েছে, মনকে বোঝাতে কাউন্সেলিং নিতে হয়েছে। কেবলই মনে হতো…এটা কী করে সম্ভব! ও আর আমি এত বছর পর আলাদা হয়ে যাব! এখন ডিভোর্সের পর বাবা-মা’কে, ফ্রেন্ডদের, প্রতিবেশিদের, শত্রুদের, কলিগদের কী বলব!




তেমন কোনও কারণ ছাড়াই মিউচুয়ালি আমরা আলাদা হয়েছি।… এত বড়ো কঠিন সিদ্ধান্তের পেছনের এই মামুলি কারণটা কি কেউই বিশ্বাস করবে? দু-জনের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা থাকার পরও অন্য অনেক কারণে মিউচুয়ালি যে ব্রেকাপ কিংবা ডিভোর্স হতে পারে, এটা বোঝার মতন পরিপক্ব সমাজ তৈরি হতে, এটা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে নেবার মতন সাহসী হতে সমাজের আরও অনেক সময় লাগবে।




তা লাগুক গে। সেটা সমাজের মানুষের ব্যাপার। তারা দেরি করে স্মার্ট হতে চাইলে আমার কিছুই বলার নেই। ছোট্ট একটা জীবন, আমি খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনাকে অ্যাক্সেপ্ট না করে নিজেকে মানসিকভাবে পিছিয়ে রাখতে পারব না। ভাই, আমি হিসাববিজ্ঞানের ছাত্রী! সবকিছুই আমি ডেবিট, ক্রেডিট দিয়ে ভাবি।




তবে আমি কখনোই ব্যাখ্যা-দেওয়া টাইপের মানুষ ন‌ই। কেন আলাদা হলাম, কেন আরেকটু সময় দেখলাম না, কেন বিচার-সালিশ বসালাম না, এসব নিয়ে নিজেও ভাবি না, অন্য কেউ ভাবতে গেলেও আগেভাগেই তাকে সীমানা দেখিয়ে দিই। এমনকী আমার প্রেম করে বিয়ে করা প্রাক্তন স্বামীকেও আমি জিজ্ঞেস করিনি যে কেন সে সেপারেশনটা চাইছে। আরে, জোর করে কেউ সংসার টেকায়? হ্যাঁ, ঘর টেকায় মানুষ জোর করে, হাতে-পায়ে ধরে; কিন্তু সংসার তো অন্য কিছু। ঘর আর সংসার, এই দুই আমার চোখে মোটেই এক জিনিস নয়।




সংসার হচ্ছে সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে উথলে-পড়া দুধের কেটলিতে চা-পাতা ছেড়ে দেবার মতন সুন্দর কিছু, সংসার হচ্ছে নিজেরা চুপচাপ পাশাপাশি বসে থেকেও কথা বলার মতন অনিন্দ্যসুন্দর ঘটনা, সংসার হচ্ছে একটা সবুজ পাতা থেকে আরেকটা সবুজ পাতায় চুয়ে পড়া পানির মতন শৈল্পিক ব্যাপার। আর নিজেদের শাড়ি-পাঞ্জাবি-বিছানার চাদর ম্যাচিং করে ‘বাধ্য হয়ে’ সোশ্যাল মিডিয়াতে ছবি পোস্ট করা হচ্ছে ঘর করা, বাচ্চার মুখের দিকে চেয়ে নিজেদের দিকে তাকানোর কথা ভুলে যাবার নামই হচ্ছে ঘর করা, পার্টনারের চাকরি কিংবা ব্যাবসাসূত্রে পাওয়া লাক্‌জারিয়াস লাইফটা হারিয়ে ফেলার ভয়ে ভালোবাসার ভান করে যাওয়া হচ্ছে ঘর করা।




আমি ‘ঘর করতে’, সোজা বাংলায় বলতে গেলে রেজোয়ানের ‘ভাত খেতে’ সংসার শুরু করিনি। আমি ভালোবেসে সংসার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। রেজোয়ান স্বভাবে, আদর্শে, দর্শনে এমনকী ধর্মেও আমার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। তবুও আমার মনে হয়েছিল, ওর ঘামের দুর্গন্ধ আমি সহ্য করে নিতে পারব, কারণ ওকে রক্ত-ঝরানো পরিশ্রম করতে আমি দেখেছি, আমি রেজোয়ানের জন্য রাত জেগে ওর বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় চোখ খোলা রাখতে পারব, কারণ ওর চোখে আমি স্বপ্নকে লালিত হতে দেখেছি, আমি ওর খুব মনখারাপের দিনগুলোতে ছায়া হয়ে দাঁড়াতে পারব, কারণ আমার ভয়াবহ খারাপ সময়ে সে আমাকে শিখিয়েছে আগলে রাখা কাকে বলে!




তো আমরা একজন আরেকজনকে আগলে রেখেছি বলেই বুঝতে পেরেছি যে এখন কোথাও একটা আলগা দেওয়াটা খুব জরুরি। আমরা একজন অন্যজনের মনের স্পর্শকাতর জায়গাগুলো বুঝি, সম্মান করি, এবং একজন অন্যজনকে মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করি বলেই দু-জনে মিলে এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি।




ভালোবেসে বিয়েও যেমন স্বাভাবিক, ভালোবাসা থাকতে থাকতেই আলাদা হয়ে যাওয়াটা আরও বেশি স্বাভাবিক ও সুন্দর, অন্তত আমার চোখে। ভালোবাসা থাকতে থাকতেই আলাদা হয়ে গেলে সেপারেশনের পর ভালোবাসাটা অন্তত টিকে থাকে, আর ভালোবাসা ফুরিয়ে যাবার পর আলাদা হয়ে গেলে সেপারেশনের পর আর কিছুই টিকে থাকে না। ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখার চাইতে সুন্দর ব্যাপার আর কী আছে!