মাইয়া-মানুষ

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ দেখি, ফোনে আট-দশ’টা মিসড-কল। দুটো মায়ের, তিনটে ভাবির, একটা ভাতিজির, আরেকটা আননৌন নম্বর থেকে আসা কল। 




দেখেই বুকটা ধড়ফড় করা শুরু করল। আমি এখন বাসে, খুব জরুরি কাজে ঢাকা যাচ্ছি। এটা তো বাসার সবাই জানে। তবুও একসাথে এত ফোন কেন করতে হচ্ছে? মেসেজ পাঠিয়ে রাখলেই তো হয়। কোনোদিনই এদের কাণ্ডজ্ঞান আর হবে না। ফোনটা আবার চেক করে দেখি, প্রায় এক ঘণ্টা আগে একটা মেসেজও এসেছে, আমার চোখে পড়েনি। কেন জানি না, মেসেজটা পড়ার আগ্রহবোধ করছি না। আমার মন বলছে, বাসায় খারাপ কিছু হয়েছে। যদি হয়েই থাকে, তবে আমাকে জানিয়ে আর কী লাভ? আমি তো অনেক দূরে, প্রায় সাভার পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছি।




বেশ কিছুক্ষণ পর মেসেজটা চেক করলাম। ভাতিজি লিখেছে, ‘ফুপি, তোমার রহমান চাচা বেঁচে নেই আর। বাদ মাগরিবে জানাজা, তুমি জলদি এসো। ’




ওহ্‌! এইটুকু ব্যাপার? মানুষ তো মারা যাবেই, এত নাটকের কী আছে, ভাই!? তা ছাড়া সে আমার চাচাই তো, বাবা তো আর নয়!




নিজেকে এইটুকু বলতে গিয়ে একটা ধাক্কা খেলাম। রহমান চাচা নেই! আমার রহমান চাচাটা আর নেই? বাবা চলে যাবার পর থেকে এই চাচাকেই আমি বাবা বলে মানতাম। আমার বাবা আর নেই! আমি তবে আজ থেকে এতিম!




কেন জানি, আমি কোনোভাবেই কাঁদতে পারছিলাম না। অনেক বেশি শোকে অবশ্য আমার এমন হয়। আমি সেসময় খুব স্বাভাবিক হয়ে যাই, মাথা আরও বেশি ঠান্ডা হয়ে যায়।




আমি বাসের কনডাক্টরকে বললাম, আমাকে নামিয়ে দিন, আমি যাব না। 




- ক্যান, আফা? এইহানে কই নামবেন? একটু সামনেই সাভার বাসস্ট্যান্ড। ওইহানে নামলে বাস পাইতে আফনের সুবিধা হইব। 
- ঠিক আছে।




আমি নেমে গেলাম সাভার স্ট্যান্ডে। রাস্তা পার হতে গিয়ে দেখলাম, এক লোক পুরনো বই বিক্রি করছে। আমি ঘেঁটে ঘেঁটে সব দেখলাম। ওগুলো সবই আমার বাসায় আছে, তবুও দেখছি। ইচ্ছে করেই সময় নষ্ট করছি। কেন করছি, জানি না। দোকানের এককোনায় দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছি, চকলেট খাচ্ছি। আমাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, আমার সবচাইতে প্রিয় মানুষটির মাত্র কিছুক্ষণ আগে মৃত্যু হয়েছে। 




আমি ব্যাগপত্র নিয়ে সাভার থেকে চন্দ্রার গাড়িতে উঠলাম। 




বগুড়া যাবার কোনও ডিরেক্ট বাস পেলাম না, তাই চন্দ্রার বাসেই উঠে গেলাম। কিংবা এ-ও হতে পারে, আমি আসলে মনে মনে চাইছিই দেরি করে ফিরতে। আমি বুঝি না, মরা-বাড়িতে ফিরবার তাড়া মানুষের কেন থাকে? আর সবচাইতে কাছের মানুষের লাশ দেখবার জন্য কেন মানুষ এত ভিড় করে! এই রে, ‘লাশ’…এত সহজেই বলে ফেললাম? গলা তো কাঁপল না, চোখে তো পানি এল না!




বাসে উঠে কোন সিটে বসব, সেটা নিয়ে ভাবছিলাম। হ্যাঁ, সত্যিই! আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো দুশ্চিন্তার সময়গুলোতে কী যেন এক অদ্ভুত কারণে আমার মাথা খুব ঠান্ডা হয়ে যায়, সারাশরীর শিথিল হয়ে যায়। মনের এমন একটা অবস্থা হয়, যেন আসলে কিছুই হয়নি। 




উঠেই ডান দিকের দ্বিতীয় সিটটাতে ব্যাগ রাখলাম। বাসের ভেতরে যাত্রীদের অনেক ভিড়। হবেই তো, লোকাল বাস বলে কথা! তার সাথে ভিড় বাড়াচ্ছেন হকাররাও। আমি যেই বসতে যাব, বাঁ-দিকের চার নম্বর সিটে দেখি, একটা মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। একেবারে বাচ্চা মেয়ে। বয়স কত আর হবে? সর্বোচ্চ নয়, এর চেয়ে বেশি হতেই পারে না! ওকে কাঁদতে দেখে আমি নিজের সিট থেকেই ইশারায় ওকে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে, কারণ ওটা কোনও স্বাভাবিক কান্না ছিল না। মেয়েটি শুধুই কাঁদছে, বলতে পারছে না কিছুই। মেয়ের বাবা-মা কনডাক্টরের সাথে ভাড়া নিয়ে ক্যাচালে ব্যস্ত, নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে যেটা স্বাভাবিক আর কি! তারা দু-জন মেয়ের দিকে এখনও তাকাতেই পারেনি।




আমি সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম, মেয়েটি কাঁদছে, আর বাসের একদম পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা একজন লোকের দিকে বার বার করে তাকাচ্ছে। আমি লোকটার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। হাত দিয়ে সে অদ্ভুত কায়দায় তার ঠোঁট বাঁকাচ্ছিল, আর একটু পর পর খুবই বিশ্রীভাবে মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছিল। আমার কেন জানি না, তাকে দেখেই হুট করে মনে মনে সন্দেহ হলো। কী সন্দেহ হলো বুঝতে পারছেন? মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত নারীরা হয়তো এরই মধ্যে বুঝতে পেরে গেছেন ঘটনা কী!




যারা বোঝেননি, তাঁদের বলছি, শুনুন। ওই লোকটি বাচ্চা মেয়েটার শরীরের কোথাও খারাপভাবে স্পর্শ করেছে। কেন করেছে জানেন? আমি ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছি একটা একটা করে। মিলিয়ে নিন।




১. সে নিম্নবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে, তার পোশাক দেখেই সেটা বুঝে নেওয়া যায়। মেয়েটির বাবা-মা এবং সে, এই তিন জন মিলে চাপাচাপি করে দুই সিটে বসে যাবেন বিধায় মেয়েটির বাবা ভাড়া মেটানোর জন্য অনেকক্ষণ ধরে দরাদরি করছিলেন। পঞ্চাশ টাকা ভাড়া বাঁচাতে যে বাবা-মা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, তাদের মেয়ে নিশ্চয়ই পাবলিক প্রোপার্টি! ওর গায়ে হাত না দিয়ে উপায় আছে রে, ভাই!?




২. বাচ্চামেয়েটা ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে! হা হা হা! ওইটুকু বাচ্চা আর কাকে কী বলতে যাবে! আর ওর কথা কেউ বিশ্বাসই-বা কেন করতে যাবে!




৩. আরে, ও তো ‘মাইয়া-মানুষ’! ওকে তো এসব সহ্য করেই বড়ো হতে হবে! এতে অবাক হবার কী আছে, বুঝলাম না তো!




৪. মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের আত্মসম্মানবোধ অনেক ক্ষেত্রে এতটাই বিশ্রী রকমের বেশি যে, ওরা গায়ে হাত দেওয়া, উলটাপালটা আকারে-ইঙ্গিতে যৌন কিংবা মানসিক নির্যাতন করা, এমনকী ধর্ষণের মতন ঘটনাও নিজের বাড়ির কোনও মেয়ের সাথে ঘটলে মাথা পেতে নেয়, একটুও রা করে না! কারণ এসব শুনলে মানুষ কী বলবে!? তাই এই দুই শ্রেণির মেয়েরা এসব ক্ষেত্রে ভিকটিম হয় বেশি। যদিও এই দুই শ্রেণির মেয়েরাও ইদানীং সমানতালে মুখ খুলছে, প্রতিবাদ করছে, তবু তাদের সংখ্যা এখনও খুব কম।




তো যেখানে ছিলাম। একজন মধ্যবিত্ত তরুণী হবার সুবাদে আমি এসবের সাথে অনেক আগে থেকেই পরিচিত। এখন আমার কাছে এসব ডালভাত।




ও, ভালো কথা! এখানে আরও কিছু প্রশ্নের জবাব আমি নিজে থেকেই দেবো, যেগুলো অনেকের মাথাতেই ঘুর ঘুর করছে, আমি জানি!




এসব ক্ষেত্রে একটা বিশাল সংখ্যক লোকের একটা মুখস্থ-করা প্রশ্ন আছে। ‘অত মেয়ে থাকতে তোমার সাথেই কেন এমন হয়!’ এমনকী যেই মেয়ের সাথে কখনও এরকম কোনও ঘটনা ঘটে, দেখা যায়, তার নিজের মা-বাবা অব্ধি তাকে এই একই প্রশ্নটা করে!




এবার নিজের কথায় আসি। 




কেন ওর গায়েই হাত দিল, আমার গায়ে কেন দিল না? আমি একটু স্পষ্ট স্বরে এর ব্যাখ্যা দিই, কেমন? ছোটো ও বড়ো আপুরা, শুনে রাখুন, না জানা থাকলে জেনে রাখুন। ধন্যবাদটা পরে দেবেন।




১. প্রথমত আমার পোশাক। আমি ওয়েস্টার্ন টাইপের একটা ড্রেস পরা ছিলাম। এরকম জামা-পরা মেয়ের গায়ে হাত দিলে সে চুপচাপ বসে কাঁদবে না, সেটুকু অন্তত এই টাইপের ছেলেরা, মানে ‘শুয়োরের বাচ্চারা’ বুঝে নেয়। এটা আমার জন্য বিরাট এক সুবিধা। আমাকে পড়াশোনা ও কাজের সুবাদে অনেক জায়গায় ছোটাছুটি করতে হয়। জিনস-টিনস কিংবা অন্য কোনও বিদেশি পোশাক-পরা কোনও মেয়ে দেখলে এরকম অমানুষগুলো সাধারণত দূরে থাকে।




২. দ্বিতীয়ত আমার কথা বলা। আমি সবসময় এরকম পাবলিক প্লেসগুলোতে ড্রাইভার, কনডাক্টর কিংবা পাশের সিটে বসা পুরুষের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলি। কোনও কারণে বাসে কোনও সমস্যা হলে, ‘পুরুষমানুষ উঠে চেঁচাবে।’ এই নীতিতে আমি বিশ্বাসী নই। আমি নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে জোরগলায় নিজের সমস্যার কথা জানাই।




৩. আমি কোথা থেকে উঠেছি, কোথায় যাচ্ছি, এসব তথ্য আমি কখনওই কাউকে দিই না এবং অপ্রয়োজনে কিংবা কাজের বাইরের কোনও টপিক নিয়ে বাসে, ট্রেনে কিংবা অন্য কোনও পাবলিক প্লেসে কোনও নারী বা পুরুষের সঙ্গে একটিও কথা বলি না।




৪. এবার আসি আমার মোক্ষম হাতিয়ারে। সততার শিক্ষা নিয়ে বড়ো হওয়া আমার জন্য এই ‘মোক্ষম হাতিয়ার’টি হাতে তুলে নেওয়া খুব কঠিন ছিল। আমি আমার সাথে সবসময় একটা নকল আইডি-কার্ড রাখি। হ্যাঁ, ভুয়া-বানানো একটা কার্ড, যেখানে একজন হাই-প্রোফাইল নারীর আইডিতে শুধু আমার নাম আর ছবি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের একজন স্টুডেন্ট মাত্র, এক স্টুডেন্ট-আইডি ছাড়া তো আর বিশেষ কোনও পরিচয় আমার থাকার কথা না। ওই আইডি-কার্ড দেখলে কেবল ঘিলুওয়ালা কোনও পুরুষমানুষের পক্ষেই বোঝা সম্ভব যে ওটা ফেইক।




গায়ে হাত-দেওয়া শুয়োরগুলোর আর যা-ই থাকুক, মাথায় ঘিলু অন্তত নেই, আর কলিজায় সাহসও নেই। হতে পারে, শালাদের কিছু সার্টিফিকেট আছে। আরে, আমার ওই আইডির মতন ভুয়া সার্টিফিকেটও বানানো যায়। ফার্মগেটে, নীলক্ষেতে গেলেই পাবেন, ভূরি ভূরি! এই দেশে ভাই সবই হয়! সবচাইতে বড়ো কথা, সার্টিফিকেট দিয়ে কাউকে বিচার করার মতন বলদামি আশা করি কেউ করবেন না। শুয়োরের বাচ্চারা দামি সার্টিফিকেট পেলেও শুয়োরের বাচ্চাই থাকে!




এবার বলুন, ভাইয়াদের কারুর কি আমার কথায় হাসি পেল? আমাকে প্রতারক মনে হলো? আপনাদের সমস্ত হাসি আর বিশ্বাস নিজের পকেটেই ঢুকিয়ে রাখুন, কেমন?




তো হ্যাঁ, আপুরা, যা বলছিলাম, আমি এভাবেই নিজেকে সেইফ-জোনে রাখার চেষ্টা করতাম, এখনও করি। আমিও নিজেকে পুরোপুরি সেইফ বলতে পারি না, কিন্তু অন্য অনেকের তুলনায় আমি সেইফ। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ফ্যামিলির যারা, তাদের তো আর বাসে যাতায়াত করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও অপশন হাতে থাকে না।




আমি বুঝলাম, এই মেয়েটা মুখে কিছুই বলবে না, কোনও প্রতিবাদই ওকে দিয়ে হবে না।




আমি একটা বুদ্ধি বের করলাম। নিজের সিট থেকেই জোরে জোরে চিৎকার শুরু করলাম, কান্না জুড়ে দিলাম। যাকে বলে ন্যাকা-কান্না আর কি! অভিনয়ও অনেকসময় যুদ্ধের অব্যর্থ হাতিয়ার হয়ে ওঠে।




‘মেয়েদেরকে কী পেয়েছেন আপনারা?’ ‘কী ভাবেন, আমি চুপ করে থাকব? কক্ষনো না!’




আমি ওর ঘটনা নিজের ঘাড়ে নিলাম, আমি নিশ্চিত ছিলাম, ও কিছুই স্বীকার করবে না লোকের ভয়ে। নারীদের এত বছরের লালিত অভ্যাসচক্র, আমি একদিনে কী করে ভেঙে দিই বলুন?




আমার ওরকম চ্যাঁচামেচি শুনে ড্রাইভার গাড়ি থামালেন। সামনের সিটের ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে, ম্যাডাম? অ্যানিথিং রং?’




এবার দেখি, আপনারা বলুন তো, আমাকে কেন ম্যাডাম ডাকলেন উনি? ‘অ্যাই মেয়ে, কী হয়েছে?’ কিংবা ‘আপু, আপনি এভাবে চেঁচাচ্ছেন কেন?’ এসব কেন বললেন না? জি, ঠিকই ধরেছেন, আমার বেশভূষা, প্রতিবাদ করার সাহস, আর ওরকম বোল্ড অ্যাটিটিউড-এর কারণে। এসব আয়ত্ত করতে না পারলে, পুরুষের চোখে ওই মেয়েটির মতন ‘মেইড’-ই থেকে যেতে হবে, কেউ কথা আর শুনবে না! এই বাংলাদেশে ‘ম্যাডাম’ হলেই শুধু লোকে কথা শোনে। এটাই আমার প্রিয় দেশটির নিয়ম হয়ে গেছে। মেইড কেবল মেইড-ই এদেশে, মানুষ নয়।




আমি সঙ্গে সঙ্গেই পেছনের ওই লোককে দেখিয়ে উত্তর দিলাম, উনি আমার গায়ে হাত দিয়েছেন। ওদিকে ওই ‘শালা’ তো আমার কথায় পুরোই হতভম্ব! ও ভাবতেই পারেনি, এমন কিছুও ঘটতে পারে! সে জলদি ছুটে এল!




: আমি কখন আপনার গায়ে হাত দিলাম?
: দিয়েছিস, কুত্তার বাচ্চা!
: তুই-তোকারি করে কথা বলছেন কেন? হয়তো বাসে ওঠার সময় গায়ে ধাক্কা লেগেছে। আরে, বসুন তো, ম্যাডাম! সব জায়গায় মহিলা হবার সুযোগ নেবেন না। আর আপনি এরকম ম্যাডাম মানুষ, এই পাবলিক বাসে কী করেন? বাপের, না হলে জামাইয়ের প্রাইভেট-কারে করে গেলেই তো কারও ছোঁয়া আর লাগে না। যত্তসব জমিদার ওঠে বাসে! অ্যাই ড্রাইভার, গাড়ি টান দাও। মহিলামানুষ শব্দ করল, আর মাঝরাস্তায় গাড়ি থামায়ে দিলা। যাও, আগাও!
: না, বাস স্টার্ট দেবেন না। আমি চিৎকার করে বললাম, অ্যাই শুয়োরের বাচ্চা, আমার গায়ে হাত দিলি কেন তুই?
: আমিই গায়ে হাত দিয়েছি, তার প্রমাণ আছে? আপনারা কেউ দেখছেন?




সবাই মাথা নাড়িয়ে না বলল। এবার ওই ইতরটা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আবারও বাঁকাহাসি ছুড়ে দিয়ে সেই আদ্যিকালের প্রশ্নটিই করল!




ওই যে বললাম, মাথায়ও যে ‘মাল’ থাকতে পারে, মাথায় গু নিয়ে ঘোরা শুয়োরগুলো তো আর সেটা জানে না। এরা অপরাধও করে বাংলাবইয়ের মুখস্থ-করা পাতার মতন। রোজ রোজই এক ধরনের অন্যায়! ক্রাইমের বেলাতেও কোনও ক্রিয়েটিভিটি নাই বাঙালি শালাগুলোর মাথায়। এরা হাগার জন্য খায়, খাওয়ার জন্য হাগে। কোনও কারণ ছাড়াই জন্ম নেয় কুলাঙ্গারদের ইতিহাসের পাতা ভারী করতে। ওদের বিরুদ্ধে সাধারণত কেউ কিছু বলেই না, তাই ওদেরও মুখস্থ কিছু ছলাকলার বাইরে আর যেতে হয় না।




এই প্রশ্নের উত্তর একটা মেয়েমানুষ সবার সামনে দাঁড়িয়ে জীবনেও বলবে না ভেবে ও জিজ্ঞেস করল,




: ম্যাডাম, কোথায় হাত লেগেছে বলুন? আমি আপনার ঠিক কোন জায়গায় টাচ করেছি?
: তুই আমার বুকে হাত দিয়েছিস, কুত্তার বাচ্চা, আমার বুকে!




আমি স্পষ্ট উচ্চারণে ঠান্ডাগলায় এটুকু বললাম।




এইবার নীরবতা ভাঙল। একজন ভদ্রমহিলা নিজের মুখে এটা বলেছে, এ-কথা যেন কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না! এটা শুনে প্রথমে বাসের অন্য সবার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। ঘোর কাটতেই ওই ‘শুয়োরের বাচ্চা’র উপর বাসসুদ্ধ লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কেউ স্যান্ডেল দিয়ে, কেউ বেল্ট দিয়ে, কেউ কেউ হাত দিয়েই ওকে ইচ্ছেমতো রামধোলাই দিল।




আমি ওই মেয়েটিকে ইশারায় আমার কাছে ডাকলাম। দেখলাম, মেয়েটি যেন মুহূর্তেই বদলে গেছে, ও যেন ঠিক আমার মতনই কোনও বন্ধুর খোঁজ করছিল বহুকাল ধরে। স্বাচ্ছন্দ্যে হেঁটে সে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। ওদিকে ওই শালার তো প্রায় দম যায় যায় অবস্থা! বাসের কনডাক্টর ওকে টেনে-হিঁচড়ে আমার সামনে আনল। বলল, ‘তুই ম্যাডামের পা ধরে মাফ চাইবি!’




এবার আমি ওকে ওরই বাঁকা-হাসিটা ফেরত দিলাম, আর চোখ বড়ো করে ইশারা দিলাম মেয়েটার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে। তখন সে শুধু ওই মেয়েরই না, ওর বাবা-মা’য়েরও পা ধরে ক্ষমা চাইল। বাসের সবাই এই ঘটনায় মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল। আমি বললাম, মার খেয়ে আসলে মাথা ঠিক নেই বেচারার। হা হা হা!




বাস থেকে নেমে যাবার সময় সে আরও এক বার এদিকে তাকাল। আমি কিছু বলতে যাব, তখনই বাচ্চামেয়েটি বলে উঠল।




: ক তুই! আর কারও গায়ে হাত দিবি?
: ……………………………
: ক, আর কখনও এইগুলা করবি?
: মাফ…মাফ…




শালা এতটাই মার খেয়েছে যে, মাফ ছাড়া আর কিচ্ছু বলতে পারছিল না। ওইটুকু বলতেও ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল।




: যা, এইবার ছাইড়া দিলাম! তয়, তোর মতন কুত্তার বাচ্চাগো আমি আর ছাড়মু না। যা, নাম! এহনি নাইমা যা, জানোয়ার কুনহানকার!




বাসের সবাই এবার একসাথে হাততালি দিল। কেন দিল, সেটা আমি জানি না। তবে এটুকু বুঝলাম, সিস্টেম পালটাতে না পারলেও, শুরুটা আমি ঠিকমতোই করতে পেরেছি। সবার জীবনেই সবসময় এই শুরু করাটাই কঠিন। আমি যে কবে এতটা সাহসী হয়ে গিয়েছি, নিজেই বুঝলাম না। হয়তো আমার শোক এভাবেই ক্রমশ শক্তিতে পরিণত হয়েছিল।




নিজের সিটে হেলান দিয়ে বসতেই আবার রহমান চাচার কথা মনে পড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। এখন কেন জানি না, খুব হালকা লাগছে। আমি কত্ত বড়ো হয়ে গিয়েছি! কী কাণ্ডটাই না আজ ঘটালাম! চাচা আজ বেঁচে থাকলে, এই ঘটনা শুনে আমাকে বলতেন, ‘মেয়ে তো নয়, একটা বাঘিনী হয়েছে আমার ভাতিজি!’




আমি যাচ্ছি আমার পিতৃতুল্য চাচার লাশের কাছে।




আচ্ছা, বাসটা এত জলদি জলদি কেন যাচ্ছে? আমার তো কোনও তাড়া নেই। আমি চাচার লাশ দেখব না। তাই চাইছি, রাস্তায় আমার অনেক দেরি হোক…অনেক অনেক অনেক দেরি হোক!




আমি বাড়ি ফিরে একদম স্বাভাবিক থাকব। একটুও কাঁদব না। রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে দু-কাপ চা বানিয়ে চাচার রুমে গিয়ে বসব। আজকের গল্পটা চাচাকে বিস্তারিত বলব। চাচা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলবেন, ‘আমার মায়ের কত্ত সাহস! কী কাণ্ডটাই না করেছে আজকে! আমার আর চিন্তা নেই রে! এখন থেকে আমাকে ছাড়াও তুই ঠিক চালিয়ে নিতে পারবি!’




আমি চাচার বুকে লাফিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদব, আর বলব, তুমি কোত্থাও যাবে না, তুমি আজীবন বেঁচে থাকবে! নইলে দুনিয়া জয়-করা এইসব গল্প আমি আর কাকে বলব?