ভালোবাসা যেভাবে বাঁচে

 ভালোবাসা নিয়ে আমার আগের যে অভিজ্ঞতা, সেটা খুব একটা সুখকর কিছু নয়। ওটা ভালোবাসা ছিল না কি না জানি না, তবে ওটার সুখের কিছুই ছিল না, এইটুকু জানি। ওটা যে ভালোবাসা ছিল না, তার একটা কারণ হলো, ওটা আমাকে তেমন একটা সুখ দেয়নি। ভালোবাসা তো শুরুতে সুখ দেয় বলেই জানি। ওটা শুরুতেও যন্ত্রণা দিয়েছে, শেষেও যন্ত্রণা দিয়েছে।
  
 দেখুন, ভালোবাসা জিনিসটা কোনও রকেট সায়েন্স নয়, ভালোবাসা এলেও বোঝা যায়, না এলেও বোঝা যায়। মাঝে মাঝে সবই ঠিকঠাক থাকে, তবু কী একটা জানি কিছুতেই মিলে না। এই না মিললে তো ভালোবাসাই হয় না! এটাকে ওরা ভাইব বলে বোধ হয়।
  
 কিন্তু এখন ব্যাপারটা অন্য রকমের। তোমার সঙ্গে থাকতে আমার ভালো লাগে। আমি নিজের মতো করে থাকতে পারি। আমাকে অভিনয় করে থাকতে হয় না, নিজেকে চোর চোর লাগে না। খুবই স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করি। আমি যা নই, তা দেখাতে হয় না তোমার সামনে। তুমি সামনে থাকলেও, আমি যা যা পছন্দ করি না কিংবা পছন্দ করি না, তা তা নিঃসংকোচে বলে ফেলতে পারি।
  
 তোমার সামনে আমি আদিখ্যেতা করতে পারি, ন্যাকামো করতে পারি, ঢংও করতে পারি। কোনও কিছুই ভেবেচিন্তে করতে হয় না। ডায়েটে আছি, তখনও তোমার সামনে বসে পুরো একটা পিৎজা খেয়ে সাবাড় করে ফেলতে পারি, কিংবা ফুলপ্লেট কাচ্চি-বিরিয়ানি! তুমি আমাকে এটা নিয়ে কিছুই বলো না, এটা আমার ভালো লাগে। উলটো তুমি চাও, আমি যেন যা মন চায় খেয়ে ফেলি!
  
 এমন নয় যে, আমরা সারাদিনই কথা বলি। তোমারও নিজের একটা জীবন আছে, আমারও আছে। দু-জনই দু-জনের জীবন নিয়ে অনেক বিজি থাকি। তুমি যখন পাশে থাকো না, তখন আমার তোমাকে ফোন করতে ইচ্ছে করে। তুমি কী করছ, তুমি খেয়েছ কি না, তোমার মনের খোঁজখবর সবই জানতে ইচ্ছে করে। আমার ভালো লাগে তোমার সঙ্গে কথা বলতে, তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে।
  
 দু-জনেরই আলাদা জীবন থাকা খুবই দরকার সম্পর্কের জন্য। এমন নয় যে, আমার পেছনে লেগে থাকাই তোমার একমাত্র কাজ। আমার বেলাতেই তা-ই। এতে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধটাও টিকে থাকে। যে সম্পর্কে সম্মান নেই, শুধুই ভালোবাসা আছে, সে সম্পর্ক আগে পরে ভেঙে যায়।
  
 সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল ব্যাপারটাই হচ্ছে বোঝাপড়া। যারা পরস্পরকে বোঝেই না, তাদের একসঙ্গে থাকার কোনও দরকার নেই বলেই আমি মনে করি। একসঙ্গে থাকা বলতে আমি সম্পর্ক রাখা বুঝিয়েছি। আমি জানি, তোমার নিজের একটা জগত আছে, সেই জগতে থাকতেও তোমার ইচ্ছে করে। তখন আমি তোমাকে ঘাঁটাই না, তোমাকে তোমার মতো করে থাকতে দিই। তুমি মাঝে মাঝে কিছুই বলো না, একদমই চুপ করে থাকো। এইসব অস্বাভাবিক কিছুই নয়। মানুষের চুপ করে থাকতে ইচ্ছে করতেই পারে! আমারও এরকম হয়।
  
 যখন তুমি কিংবা আমি দীর্ঘসময় চুপ করে থাকি, তখন আমাদের যে-কোনও একজন অ্যাডাল্ট জোকস বলতে শুরু করে, কিংবা বানিয়ে বানিয়ে হাসির কোনও ঘটনা বলে। এরপর দু-জনই হেসে গড়াগড়ি খাই। আমাদের মধ্যে এই যে বন্ধুত্বটা, এটাই আমাদের সম্পর্কটা চমৎকারভাবে টিকিয়ে রেখেছে।
  
 সম্ভবত, এই যে আমরা পরস্পরকে এতটা ভালো করে বুঝতে পারি, সে কারণেই আমরা দু-জন দু-জনের নীরবতা কিংবা ব্যক্তিগত পৃথিবীটা নিয়ে ভাবি না। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজেদের কাজ আছে। তোমার কাজ নিয়ে আমি একটুও মাথা ঘামাই না, আমার কাজ নিয়েও তুমি একটুও মাথা ঘামাও না। আমরা ধরে নিয়েছি, আমার কাজ তুমি বোঝো না, তোমার কাজ আমি বুঝি না। এবং, এ নিয়ে আমাদের একটুও মাথাব্যথা নেই। পার্সোনাল একটা স্পেস প্রত্যেকেরই খুব খুব দরকার!
  
 আমরা জানি, যা-ই ঘটুক না কেন, আমরা একসঙ্গে আছি ও থাকব। তোমার দুঃখ ও ভয় সবই আমার, আমার দুঃখ ও ভয় সবই তোমার। আমরা একে অপরের ভাগ নিতে জানি।
 দু-জন দু-জনকে সকালে শুভ সকাল কিংবা রাতে শুভ রাত্রি না পাঠালেও আমরা এটা নিয়ে কেউই কিছু মনে করি না। রাত তিনটে অবধি জেগে গল্প করতেই হবে, ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন করতেই হবে, পরস্পরের গতিবিধির উপর নজিরদারি করতেই হবে এইসব ছেলেমানুষি আমাদের মধ্যে একদমই নেই।
  
 আমরা এরকমই। আমরা এরকম থেকেই ভালো আছি। এর নাম কি ভালোবাসা নয়? এ যদি ভালোবাসা না-ও হয়, তাতেও আমাদের আপত্তি নেই। আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই, সেখানে ভালোবাসা থাকলে ভালো, না থাকলেও আমাদের বেশ চলে যাবে। আমরা একে অপরকে সম্মান করি, আমরা পরস্পরের ব্যক্তিজীবনকে হাসিমুখে মেনে নিতে জানি। দিনশেষে, ভালোবাসায় বাঁচার চাইতে ভালোভাবে বাঁচাটা বেশি জরুরি।