বিষের পেয়ালা ছুড়ে ফেলার পর

সেইদিন শুধু বেঁচে ছিলাম বলে, আজকে আমি আপনাদের সামনে কথা বলতে পারছি। কেউ যখন আমায় জিজ্ঞেস করে, ভাই, লাইফে সবচেয়ে বড়ো ব্যাপারটা কী, বড়ো সাফল্যটা কী? অনেক টাকা-পয়সার মালিক হওয়া? বড়ো বড়ো চাকরি করা? সফল হওয়া?...তখন আমি ছোট্ট করে বলি, লাইফে সবচেয়ে বড়ো সাফল্য হচ্ছে: বেঁচে থাকা! আর কিছু নয়, শুধু বেঁচে থাকলেও, নিজেকে কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখলেও অনেক কিছু হয়।




ওই সময়ে যেটা হয়েছিল, আমার মতো করে বাঁচতে আমার নিজের কোনও সমস্যা ছিল না, কিন্তু লোকজন আমাকে পাত্তা দিত না। আমি সেই মানুষ, যে মানুষটার ফোন তার ক্লাসমেইটরাও ধরত না! বিলিভ ইট অর নট!




আমার পোস্টিং তখন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে; আমার এক বন্ধু গিয়েছিল আমার ওখানে বেড়াতে। আমি তাকে বললাম, দোস্ত, তোর মনে আছে, আমি একসময় ফোন করলে কেউ ধরত না? সে বলে কী, বাদ দে, বন্ধু! পুরোনো জিনিস তো থাকেই, পুরোনো অনেক ব্যাপার থাকে। জীবন তো আর পুরোনো জিনিসে আটকে থাকে না রে!




হ্যাঁ, আমিই সে মানুষটা, যার ফোন তার ক্লাসমেইটরা ধরত না। কেন ধরত না? ওরা বোধ হয় ভাবত, ওর ফোন ধরার কী আছে? সে তো কিছু করছে না, সে তো অনার্স‌ই এখনও কমপ্লিট করেনি! আমি কিন্তু আমার বন্ধুদের চাইতে প্রায় তিন বছর পর অনার্স কমপ্লিট করেছি, কারণ আমার তো ইচ্ছেই ছিল না অনার্স কমপ্লিট করার! সবার গ্রাজুয়েশন শেষ হবার পর, আড়াই এবং তিন বছরের মাঝামাঝি একটা সময়ে, পুরোপুরি তিন বছর পর নয়, তার একটু আগে আমি অনার্স শেষ করি।




কোন‌ও একটা গেটটুগেদার হচ্ছে, সুশান্ত পালকে কেউ কখনও ফোন করে বলেনি যে, তুই আয়, আমরা এখানে বসছি। না, বলেনি; কখনোই না, নেভার! আমি ফোন দিলে ওরা কেটে দিত। টেক্সট পাঠাতাম, কেউ কখনও রিপ্লাই করত না। এই ব্যাপারগুলো আমাকে খুব কষ্ট দিত। আর তখন আমার বাবা-মায়ের ব্যাপারটা ছিল আরও কষ্টের।




আত্মীয়স্বজনের অবস্থা তো বোঝেন‌ই, দুটো ভালো কথা বলতে পারে না, কিন্তু খারাপ কথা বলতে খুব পারে। মানে দুইটা ভালো পরামর্শ কেউ দেবে না, কিন্তু আজেবাজে কথা বলার বেলায় ভীষণ ওস্তাদ, সবাই বসে থাকে খোঁচা মারার জন্য। কষ্টের দিনগুলোতে পাশে থাকে যারা, ওদের গুনতে হাতের একটা আঙুলও লাগে না! তো আত্মীয়স্বজনরা আমার বাবা-মায়ের কাছে এসে এসে বলত, ও তো পুতুল বিক্রি করে! পুতুল বিক্রি করার মানে হচ্ছে, আমার গিফটের দোকান ছিল, আমি গিফটের দোকানদার। আরও বলত, ও তো পুতুল বেচে, পুতুল বেচার জন্য কি আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হয় নাকি? ও কি এইভাবেই লাইফটা কাটিয়ে দেবে নাকি? আপনাদের খারাপ লাগে না? এমনও বলত আমার মাকে যে, আপনার লজ্জা করে না, দিদি, যে আপনার ছেলে কিছু করে না?




আমাদের দেশ এত দুর্ভাগা একটা দেশ, যেখানে ব্যাবসা করাকে এখনও 'কিছু করে না!' মনে করা হয়! তো যা-ই হোক, ওতে আমার কোনও অসুবিধা ছিল না। ওরা যখন আসত বাসায়, আমি গিয়ে যখন সালাম দিতাম হাসিমুখে, ওরা কেমন কেমন করে জানি তাকাত! তখন একটু খারাপ লাগত আর ভাবতাম, কী রে ভাই, আমি কি চুরি করেছি নাকি? এমন করছে কেন ওরা? আমি তো তার খাইও না পরিও না, তবুও এমন করে কেন? আমার কোচিং সেন্টার আছে, ব্যাবসা আছে, শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ আছে; আর্থিকভাবে তো আমি যথেষ্ট বিত্তবান একজন মানুষ!




তা-ও আমি কেয়ার করতাম না। কিন্তু আমার বাবা-মা যখন কাঁদত ওদের বাঁকা বাঁকা কথা শুনে, তখন খুব কষ্ট পেতাম; বিশেষ করে আমার বাবার চোখে জল দেখে...বাবা খুব গম্ভীর মানুষ, মানে কখনও অমন কাঁদে-টাদে না, কোনোকিছু নিয়েই অভিযোগ করে না! আমি আমার বাবার চোখে জল দেখেছি, আমার মায়ের চোখে জল দেখেছি! আমার ছোটো ভাই, বিভিন্ন কটূক্তি সহ্য করতে হতো তাকেও, ওর বন্ধুবান্ধবরা ওকেও শোনাত অনেক কিছুই!




এ পৃথিবীতে আপনি যখন দেখবেন, আপনার বাবা-মা কান্না করছে এবং সে কান্নার জন্য আপনি দায়ী, তার চেয়ে কষ্টের আর কোনোকিছুই হয় না। তখন আমি ভাবলাম, এই যে আমি একটা মানুষ, যে মানুষটার জন্য তার বাবা কান্না করে, মা কান্না করে, যে কাউকেই মুখ দেখাতে পারে না, সে মানুষটার‌ও বেঁচে থেকেই-বা কী হবে? যার ফোন কোন‌‌ও বন্ধুবান্ধব ধরে না, যার কোন‌ও পাত্তা নেই সমাজের কোথাও, সে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও কোনোকিছুই হবে না; তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আত্মহত্যা করব! অনেক অনেক কেঁদেছি, অনেক কষ্ট থেকে এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি।




আপনারা আমার দুঃখের গল্পগুলো জানেন না! শুধু সুখের দিনগুলো দেখেছেন, এই আর কি! যা-ই হোক, অসীম কষ্টে আর অনুশোচনায় অনেক কান্নাকাটি করলাম তখন। তো চট্টগ্রামে রাসায়নিক পদার্থ বিক্রি করে এমন দোকান আছে, সেখান থেকে বিষ কিনেছি, কোনও একভাবে বুদ্ধি করে। একটা চায়ের কাপে বিষটা ঢেলেছি। সন্ধ্যেবেলা; ঘরের দরজা বন্ধ করলাম। পাশের রুমে আমার মা ঘুমাচ্ছিল। আমার মাথায় কাজ করছে, এখন‌ই আমি বিষ খেয়ে ফেলব। তো বিষ যখন হাতে নিলাম, তখন দেখি, সারাশরীর কাঁপছে, আর আমি পাগলের মতো কান্না করছি। চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ছে। শব্দ করছি না, কারণ মা শুনে ফেলবে পাশের রুম থেকে।




কী করব কী করব! এইটা কি খেয়ে ফেলব? আর আমার তো আসলে লাইফে আগের কোনও এক্সপেরিয়েন্স ছিল না; এ জীবনে এটাই আমার প্রথম আত্মহত্যা! যার ফলে আমি আসলে বুঝতেই পারছিলাম না, কী করব! আমার মাথায় প্রথম চিন্তা এসেছিল, এই বিষটা যদি খেয়ে ফেলি, আর তখন যদি সত্যি সত্যি মরে যাই, তখন কী হবে?! যারা মাঝেমধ্যে আত্মহত্যা-টত্যা করে, আত্মহত্যা করতে ওদের তেমন অসুবিধে হয় না, কিন্তু আমি তো এর আগে কখনোই আত্মহত্যা করিনি! আত্মহত্যার করার সিস্টেম একটাই...অত না ভেবে এটা করে ফেলতে হয়। এত চিন্তাভাবনা করলে আসলে কিছুই হয় না।




কিছু হয় কি হয় না, সে কথায় পরে আসি। তো ভাবলাম, ধুর, আমি তো মরতেই চাইছি, চট করে খেয়েই ফেলি! তখন আবার ভাবলাম, আমি যদি বিষটা খাই, এর পরের দৃশ্যটা কী হবে? আমি যতটা সহজে কথাগুলি বলছি এই সময়ে, ওই সময়ে এতটা সহজ ছিল না এইসব মেনে নেওয়াটা। এর পরের দৃশ্যটা কী হবে, ভাবলাম। অনেকে মন খারাপ করবে, আমার মা প্রচুর কান্নাকাটি করবে। আমার বাবা একজন আইনজীবী, উনি কোর্ট থেকে একদৌড়ে বাসায় চলে আসবেন। আমার ছোটো ভাই টিউশনি করতে গিয়েছে, সে-ও চলে আসবে। বাবা-মা কান্না করবে, ছোটো ভাই যখন দেখবে, ওরা কান্না করছে, তখন সে-ও ওদের সঙ্গে জয়েন করবে কিছুক্ষণ ভেবে-টেবে। কান্নাকাটি ব্যাপারটা সংক্রামক।




আমার এখন মনে পড়ে, ওই সময়ে আর কার‌ও মুখ আমাকে বিচলিত করেনি শুধু একটা মুখ বাদে, মুখটা হচ্ছে আমার মায়ের মুখ। আমার মা অঝোরে কান্না করছে আমি মারা গিয়েছি বলে, কিন্তু আমার মৃত্যুর কারণের জন্য তো আর আমার মা দায়ী নয়! আমি লাইফে কিছুই করতে পারলাম না, এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ালাম, সময় নষ্ট করলাম। এসবের জন্য তো আমার মা দায়ী না, কোনোভাবেই না! আমি কেন তাকে শাস্তি দিচ্ছি তবে?




এই যে জীবনটা, এই জীবনটা তো আমার মায়ের দেওয়া, তার অর্জন; এটাকে আমি কেন নিজের হাতে নষ্ট করব? তখন মনে হলো, আচ্ছা, ঠিক আছে, আমার বন্ধুবান্ধব জীবনে অনেক কিছু করেছে, অনেকদূর চলে গেছে। আমি আজ‌ও কিছু করতে পারলাম না। ওরা সমাজের এক-একটা ব্রাইট স্টার, সুপারস্টার, হিরো... মানলাম। আমি কখনোই তাদের মতো কোনোকিছু করতে পারব না, লাইফে কোনোকিছুই হতে পারব না। সমাজের আর দশটা উজ্জ্বল মানুষ...আর দশটা উজ্জ্বল মানুষ যেভাবে করে বাঁচে, আমি সে উপায়ে কখনও বাঁচতে পারব না। ঠিক আছে। আমি তাহলে একজন অনুজ্জ্বল মানুষ হয়ে বেঁচে থেকে দেখিই না কী হয়! আমাকে কেউ কখনও চিনবে না, কেউ কখনও পাত্তা দেবে না, ওদের মতো চাকরি-বাকরি আমি কখনও পাবো না, কোনোকিছুই করতে পারব না এ জীবনে! সব মেনে নিলাম, কিচ্ছু লাগবে না আমার... আমি শুধু বেঁচে থাকব!




আপনাদের বলি, সেইদিন শুধু বেঁচে ছিলাম বলেই আজ আমি আপনাদের সামনে কথা বলতে পারছি। এ কারণেই আমাকে কেউ যখন জিজ্ঞেস করে, ভাই, লাইফে সবচেয়ে বড়ো ব্যাপারটা কী? বড়ো সাফল্যটা কী? অনেক টাকা-পয়সার মালিক হওয়া? বড়ো বড়ো চাকরি করা? সফল হওয়া?...ওসব শুনে আমি ছোট্ট করে বলি, লাইফে সবচেয়ে বড়ো সাফল্য হচ্ছে: যে-কোন‌ও মূল্যে বেঁচে থাকা! শুধু বেঁচে থাকলেও অনেক কিছু হয়!