যে কাল’টা আসবে না কাল

অভি,




আমি খুব গোলমেলে স্বভাবের মানুষ। তুমি এটা আগে জানতে না। তুমি জানতে, আমি খুব স্থির, নম্র আর স্বল্পভাষী। তাই না?




আসলে আমি পরিস্থিতি আর মানুষ বুঝে স্থির। নম্র তো আমি কোনোভাবেই নই। আর আমি কতটা স্বল্পভাষী মানুষ, তা তো তুমি জানোই! হি হি হি...যা ভেবে কাছে এসেছিলে, তার কিছুই মিলছে না, তাই না?




আচ্ছা, ভালোবাসা কি কোনও অংক যে মিলতেই হবে? তুমিও তো ঘড়ির কাঁটার সাথে তোমার সময় মেলাতে পারো না, গোসল করতে বেশি সময় নাও; এমনকী আমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করি যে জিনিস, সেই সিগ্রেটই তোমার প্রিয়! কই অভি, আমি তো এসব জানার পর তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইনি!




যাকে ভালোবাসি, সে মানুষটা যদি খুন করেও বাড়ি ফেরে, তাকে কি সেইবেলা আমি ভাত না খাইয়ে ক্ষুধার্ত রেখে শাস্তি দিতে পারব? পারব না, অভি। একজন খুনির শাস্তি হবে, হওয়াই উচিত। কিন্তু খুনের সাজা দেবে আইন-আদালত। খুনের মতন বড়ো অপরাধের শাস্তি তো আর না খাইয়ে রাখা না! আমি অন্তত তা-ই বিশ্বাস করি।




ঠিক তেমনি, কেউ যদি অস্থির স্বভাবের আর বাচাল প্রকৃতির হয়, তবে এটার শাস্তি হিসেবে নিশ্চয়ই তুমি তাকে জীবন থেকে বের করে দেবে না, তাই না? এমনও তো হতে পারে, মানুষটা শুধু তোমার সামনেই অমন। হতে পারে না, অভি? আরে, ভালোবাসলে তো খুনিকেও ক্ষমা করে দেওয়া যায়, আর তুমি আমার এইটুকু অস্থিরতা সইতে পারো না?




আমরা নিজেদেরই অজান্তে অনেকটা রাস্তা একসাথে পাড়ি দিয়েছি, সময় পার করেছি অনেক সুখ-দুঃখের ভেলায়। এখন বুঝি, যেটাকে হয়তো তোমার কাছে সময় কাটানো মনে হতো, সেই ছোট্ট ছোট্ট ব্যাপারগুলোর সমষ্টিই আমার জীবন! তুমি যে ব্যাপারগুলোকে হেসে হেসে উড়িয়ে দিতে পারো, আমি সেই ব্যাপারগুলো মনে করে কান্নাকাটি করেও বুকটা হালকা করতে পারি না! একেই বোধ হয় বলে নারী আর পুরুষের ভালবাসার তফাত।




তোমার মতন গোছানো একজন মানুষ আমি এই একত্রিশ বছরের জীবনে দুটো দেখিনি। তুমি যখন আমার হাতটা ভালো করে ধরার জন্য আমার চুড়িগুলো খুলে দিতে, সেসময়টাতেও দেখতাম, তুমি কী চমৎকারভাবে জোড়া মিলিয়ে মিলিয়ে চুড়িগুলোকে গুছিয়ে রাখছ!




এখনও চোখ বন্ধ করলে আমি সেই দিনটা স্পষ্ট করে দেখতে পাই। আরে, ওইদিনই তো...




আচ্ছা, থাক। এত রাতে ওসব মনে করতে চাই না, এমনিতেই মাথাটা ধরে আছে।




আর, ওই যে তোমার অমন শুদ্ধ বাংলায় লেখা চিঠিগুলো! কোন‌ও মানুষের লেখাতেও নাকি অত প্রেম ঝরতে পারে! আহা...!




তুমি নিশ্চয়ই জীবনটা গুছিয়ে নিয়েছ, না? হ্যাঁ, সেটাই তো উচিত!




কিন্তু দ্যাখো, জীবনের হিসেব তো অনেক পরেরই কথা, দিন-রাতের নিয়মটাই তো আমার গোলমেলে! এই রাত দেড়টায় চুলোয় চা বসিয়েছি। কী হবে ঠিক সময়ে না ঘুমোলে? আমি সকাল সকাল উঠেই-বা কী করব! নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছি আজকাল। আমিও চা আর নিকোটিনের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছি...অথচ তুমি আমাকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলে! হায় সময়!




আমার সামনে ফিরোজা রঙের গাদোয়াল শাড়িটা আর তার সাথে মেলা থেকে কেনা পাথরবসানো বড়ো টিপজোড়া। এখন‌ই পরব ভাবছি।




না, থাক, চোখে জল আসছে। আমিও কীসব বাচ্চাদের মতন একা একাই কথা বলি!




থাক, চা-টা ফেলেই দিই! সকালে উঠতেই হবে।




এই যে ভালো-আছি দেখানোর প্রতিযোগিতা, ওতে তো জন্মের পর পরই নাম লিখিয়েছি। চাইলেও আর ফিরে আসার রাস্তা নেই। জানো, এসব প্রতিযোগিতায় কেউ জেতে না, এক জনও না। শুধুই শোঅফ করে আর জুয়াখেলার মতন ভাবতে থাকে, কাল আমিই জিতব! অথচ সেই কালটা কিন্তু কখনও আসবেই না!