বারোমারি তীর্থ

শেরপুরের বারোমারি মিশনের বার্ষিক তীর্থটি হয় প্রতি বছর অক্টোবরের শেষ বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার। এবারের তীর্থে আমার থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। গারো আদিবাসী সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ আমাকে বন্ধুর মতো করে গ্রহণ করেছেন, কোনও ধরনের স্বার্থ ছাড়াই তাঁরা আমাকে মন থেকে ভালোবাসেন। তাঁদের আতিথেয়তা ও আন্তরিকতার সত্যিই কোনও তুলনা হয় না। তাঁদের সারল্য দেখলে আপনার খুব ভালো লাগবে।

মিশনের দুই জন ফাদারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব চমৎকার। অল্প পরিচয়েই তাঁরা আমাকে আপন করে নিয়েছেন। গত বার‌ও তাঁদের আমন্ত্রণে লাঞ্চ করেছি, অনেক গল্প করেছি। তাঁরাও গারো সম্প্রদায়ের। তাঁদের এবং আমার কিছু গারো বন্ধুর আমন্ত্রণে অফিসশেষে গতকালের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। আজ‌ও আছি।

গতকালের অনুষ্ঠান বিকেল চারটা থেকে শুরু হয়ে রাত সাড়ে বারোটা অবধি চলে। বিশপ, আর্চবিশপ, কার্ডিনাল মহোদয় থেকে শুরু করে অন্যান্য ফাদার, ব্রাদার এবং সিস্টাররা সারাদেশ থেকে আগত তীর্থযাত্রী ও অতিথিদের আপ্যায়ন করেছেন হৃদয়ের সমস্ত উষ্ণতা ছড়িয়ে দিয়ে।

নির্দিষ্ট কোনও ধর্মের অনুসারীদের জন্য নয়, বরং পৃথিবীর মানুষের শান্তিকামনা করে অনুষ্ঠানের সমস্ত প্রার্থনা ও আচার আবর্তিত হয়েছে এবং হচ্ছে। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের এ এক মহা মিলনমেলা! মাতা মারীয়ার স্ট্যাচ্যুকে ঘিরে সন্ধ্যার পর মিশনের পুরো পাহাড়ি এলাকায় মোমবাতি হাতে হেঁটে গেছেন কয়েক হাজার মানুষ। তাঁদের আত্মা থেকে উৎসারিত হয়ে চলছিল মানবতার জন্য শান্তিপ্রার্থনা। বড়ো অপূর্ব সেই দৃশ্য! চোখে না দেখলে কোনও বর্ণনা, ছবি কিংবা ভিডিয়ো থেকে তা বোঝা যাবে না।

তীর্থক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে জমে উঠেছে অপূর্ব এক মেলা। হাজার হাজার মানুষের সমাগম সেখানে। অথচ কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলা নেই, অপ্রীতিকর হ‌ইচ‌ই নেই। দুই শতাধিক পুলিশ মোতায়েন ছিল অনুষ্ঠানস্থলে। অ্যাডিশনাল এসপি হান্নান ভাই, সিনিয়র এএসপি আফরোজা আপু, সজল দাদাসহ অনেক প্রিয় মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল এই উপলক্ষ্যে। ডিসি মহোদয় এবং এসপি মহোদয়ের সার্বক্ষণিক মনিটরিং ছিল চোখে পড়ার মতো। রাত দুইটা অবধি ঘোরাঘুরি করেছি মেলায়। অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে, আলাপ হয়েছে। একটি লোকাল মিডিয়ার সঙ্গে কথাও বলেছি।

সুপার দাদা, মিন্টু দাদা, লিপা দিদি, আমার প্রিয় সহকর্মী সজীব, ফাদার তরুণ, ফাদার জীবনসহ গারো আদিবাসী সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ সেই প্রথম দিন থেকেই আমাকে মুগ্ধতার বন্ধনে বেঁধে রেখেছেন। তাঁদের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা।

এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশই আমাদের বাংলাদেশ। আমরা ঠিক এরকম একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই। এর বাইরে যা-কিছু, তা আমাদের নয়, আমাদের সংস্কৃতির নয়। তা-কিছুকে বাংলাদেশি হিসেবে আমরা লালন করি না, পালন করি না। আমরা কে কোন ধর্মের, তার চাইতে অনেক বড়ো পরিচয়: আমরা এই দেশের মানুষ, আমরা এই মাটির ভূমিপুত্র।