খুঁজিগড়া গ্রামে একদিন

আপ্যায়নে ছিল বাংলা কলা এবং ডাবের জল।

শেষ কবে এত অল্প আয়োজনে এতটা তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছি মনে পড়ে না।

এর বেশি কিছু জোগাড় করতে তাঁরা পারেননি। বাড়িতে ছিল না। বিশ্বাস হচ্ছে না? না হলেও এটাই সত্যি। আমাদের চোখের আলোতে অনেক আঁধার আজ‌ও ধরা পড়ে না।

হ্যাঁ, এই দেশে এখনও এমন প্রান্তিক মানুষের খোঁজ পাবেন। গতকাল ঠিক এরকমই একটা গ্রামে গিয়েছিলাম। বিজয়পুরের সাদামাটির পাহাড় দেখতে গিয়ে কিছু সাদামনের মানুষের দেখা পেলাম।
আমি মানতে চাই না চাই, আমাকে অনেক মানুষ ভালোবাসেন। এই ভালোবাসার উৎস নিয়ে আমি পুরোপুরি না জানলেও, এই ভালোবাসার অস্তিত্ব নিয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই।

বিজয়পুরের জিরো পয়েন্ট থেকে ঘুরে এসে সোমেশ্বরী নদীর পাড়ে নৌকোয় ওঠার ঠিক আগমুহূর্তে অন্তর নামের খুব চমৎকার একটা ছেলে হন্যে হয়ে ছুটে এল। আমি বিজয়পুরে আসব জেনে সে তার বন্ধুকে বলে রেখেছিল, সুশান্তদাদা নৌকা থেকে নামলে আমাকে ফোন করে জানাস।

বন্ধুটি ঘাটে অপেক্ষায় ছিল, আমাকে নামতে দেখে অন্তরকে জানাল। কয়েক জায়গা ঘুরে বিজিবি ক্যাম্পের সামনে এসে আমাকে খুঁজে পেল। সে হাজং আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। কথায় কথায় আদিবাসী সংস্কৃতির প্রতি আমার আগ্রহের কথা জানতে পেরে তার গ্রামে যাবার জন্য নিমন্ত্রণ করল। আমিও সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম।

বিজয়পুর অপূর্ব এক জায়গা। বিভিন্ন স্পট ঘুরে সন্ধের সময় অন্তরের গ্রামে গেলাম। নেত্রকোণার দুর্গাপুর সীমান্তবর্তী কুল্লাগড়া ইউনিয়নের খুঁজিগড়া গ্রাম। গ্রামে ৬৫টি হাজং পরিবারের বসবাস। গ্রামের লোকজন ভীষণ গরিব। জীবন ওদের কেবল আঘাত‌ই করে গেছে। আমরা যখন ভালো থাকার আয়োজনে শশব্যস্ত, ওরা তখন বেঁচে থাকার প্রয়োজনে দ্বিধান্বিত।

খুব‌ই অল্প সময়ের নোটিশে হাজং আদিবাসী সম্প্রদায়ের কয়েকটি মেয়ে রঙিন পাথিন পরে ঐতিহ্যবাহী নৃত্যের জন্য তৈরি হয়ে গেল। "পাথিন" হাজং আদিবাসী সম্প্রদায়ের নারীদের পোশাক। কোনও ধরনের রিহার্সাল ছাড়াই খুব চমৎকার করে নাচল আমাদের সম্মানে। গানের সুরের সঙ্গে নাচের তালের এমন সারল্যমাখা সমন্বয় কালকের সন্ধেটিকে করে তুলেছিল ঝলমলে! সেই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধে কী যে মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে ফেলল...

বিরিশিরি কালচারাল একাডেমিতে খুব গোছানো পরিপাটি হাজংনৃত্য হয়তো উপভোগ করতে পারতাম, তবে সেখানে এমন আন্তরিক গ্রামীণ আবহ, তার সঙ্গে শিল্পীদের কাঁচাপায়ের পাকাখুশি কতটা পেতাম জানি না। সহজ স্বাভাবিকতা বড়ো আনন্দ দেয়। খুব সরলমনে মিশতে জানে যারা, তাদের সাহচর্য পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। কোনও প্রাপ্তি, কোনও হিসেব, কোনও প্রত্যাশা মাথায় না রেখেই বন্ধুর মতন সঙ্গ দিতে পারে, এমন কারও খোঁজ পেলে আমি যেন মোমের মতন গলে যাই...আমি সহজ মানুষের পায়ে পায়ে ঘুরি।
খুঁজিগড়া গ্রামের অধিবাসীদের আন্তরিকতা আমার মনে থাকবে। অন্তর হাজং আমাকে যে সম্মানটা দেখিয়েছে, তা ছিল একদমই স্বার্থশূন্য...হৃদয়মথিত। হাজংদের সারল্য, আন্তরিকতা, আতিথেয়তা আমার মধ্যে অসীম মুগ্ধতার জন্ম দিয়েছে। আদিবাসী মানুষগুলি আজ‌ও মানুষের ভালোবাসায় বিশ্বাস করে। নাচের পরিবেশনাশেষে গ্রামের অধিবাসীদের সঙ্গে গল্প করে নির্মল আনন্দ পেয়েছি।

অনেক জাঁকালো আয়োজনের কথা হয়তো ভুলে যাব, কিন্তু কালকের দামি আয়োজনটির কথা আমার মনে থাকবে। বিরিশিরি এসেছি আমার প্রিয় সহকর্মী সজীবের নিমন্ত্রণে। এই সহজ মানুষটি গারো আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। ওঁর কল্যাণেই গারো সংস্কৃতির সাথে পরিচয় হয়েছিল, এবার অন্তরের আন্তরিক নিমন্ত্রণে হাজং সংস্কৃতির সাথে কিছুটা পরিচয় হলো। সামনে আরও হবে, এই আশা মনে।

দুর্গাপুর-কলমাকান্দা আমার মনে গভীর ভালোবাসার রেখাপাত করেছে। নানান উপচারে প্রকৃতি এখানে নিজেকে মেলে ধরেছে। নিজের আত্মার সঙ্গে কিছুটা সময় গল্প করতে এখানে এসে ঘুরে যান, ভালো লাগবে। এখানকার মানুষের ভালোবাসা এবং সরলতা আপনাকে মুগ্ধ করবেই করবে! তৃপ্তির নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি বাজুক সবার প্রাণে...

(এই ভ্রমণ নিয়ে আরও লেখার ইচ্ছে রইল।)