বহু ধারা, এক নদী

পৃথিবীতে যতগুলি ধর্ম পালিত হয়, সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হয়, তাদের মধ্যে মিলের চাইতে অমিল‌ই বরং বেশি। তাদের মধ্যকার এমন পার্থক্য বুঝি কিছুতেই দূর করা সম্ভব নয়। যুগে যুগে বহু ঋষি, নবী, পয়গম্বর, সাধু, সুফি, ধর্মসংস্থাপক এসেছেন, এবং যুগের দাবি ও প্রয়োজনমতো নীতি ও উপদেশ দিয়ে গেছেন। সেসব নীতি, ধর্মোপদেশ এবং তা পালন করার জন্য কিছু কর্মধারার সমাবেশ সাধারণত ধর্ম নামে পরিচিত। এ সকল ধর্ম যখন প্রথম প্রচারিত হয়, তখন তাদের প্রধান ভিত্তি ছিল উদারতা, মানবপ্রেম, সত্যনিষ্ঠা ও জনসেবা। কিন্তু কালক্রমে ধর্মের এই ভিত্তিমূল শিখিল হয়ে গেল এবং আচারঅনুষ্ঠান‌ই হয়ে পড়ল ধর্মের প্রধান অঙ্গ। বিভিন্ন ধর্মের আচারপদ্ধতির মধ্যে সামান্য সামান্য যেসব পার্থক্য তৈরি হলো, তা মানুষকে ধর্মমত সম্পর্কে অনুদার ও সঙ্কীর্ণ করে তুলল। একসময় সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিরোধ আরম্ভ হলো। এই বিরোধ ধীরে ধীরে মানববিদ্বেষ তথা জাতিবিদ্বেষে পরিণত হলো।




উদার ভিত্তি শিথিল হয়ে যাওয়ায় এক ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তি অপর ধর্মে বিশ্বাসীকে ভ্রান্ত ও বিপথগামী বলতে শুরু করল। সে তার নিজের ধর্মকেই একমাত্র শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে ঘোষণা করে দিল। এই প্রকার তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্বের একচেটিয়া অধিকারবোধ হতে উদ্ভূত হলো ধর্মের দোহাইয়ে লড়াই, জেহাদ, ক্রুসেড, যার সব‌ই মূলত মারামারি ও কাটাকাটি। ধর্মের এমন সব ব্যাখ্যা প্রচারিত হতে লাগল যে, তাতে মনে হলো, বিদ্যমান ধর্মসমূহের মধ্যে মূলগত কোনো সাদৃশ্য নেই, আছে শুধু পার্থক্য ও অপর ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তিকে অনন্ত নরকে প্রেরণ করার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা। বর্তমান অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সাধারণ মানুষের মনে হতে পারে, পৃথিবীর ধর্মগুলি পরস্পরেরবিরোধী, তাদের উদ্দেশ্য ও আদর্শ একেবারেই ভিন্ন, আর সে ভিন্নতা সমাধানের অতীত।




পরিস্থিতি দেখলে মনে হয়, নিজের ধর্ম বাদে অন্য যে-কোনো ধর্মকেও শ্রদ্ধা করা, সম্মান দেখানো এবং ভালো বলে স্বীকার করা ঘোরতর অন্যায় ও স্বধর্মের বিরুদ্ধাচরণ। কিন্তু এটাই কি ধর্মের শেষ কথা? ধর্মে ধর্মে সমন্বয় কি কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়? বিশ্বের সকল ধর্মকে একই সঙ্গে ও একই নিঃশ্বাসে মঙ্গলময় ও কল্যাণকর বলে বিশ্বাস করা যায় না? কোনো ধর্ম গ্রহণ না করেও কি তার সারসত্য ও মূলতত্ত্বগুলিকে হৃদয়ে ধারণ করা যায় না? অন্য ধর্মের দর্শন নিয়ে জানা ও তা নিয়ে আলাপ করা কি অন্যায়? একটু ধীরভাবে ও উদারচিত্তে বিভিন্ন ধর্মের গভীর পরিচয় লাভ করলে এমন সমন্বয় নিশ্চয়ই সম্ভব, যদি অন্তরে সদিচ্ছা ও সুবিবেচনা থাকে।




এক ধর্মকে অন্য ধর্ম হতে যত‌ই পৃথক ও পরস্পরবিরোধী বলে মনে করি না কেন, তাদের গভীর তলদেশে একটা মধুর ঐকতান ও অনাবিল স্বচ্ছধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছে। প্রত্যেক ধর্মের মূল মূল শিক্ষা ও আদর্শের মধ্যে কতগুলি বিষয়ে এমন একটা সামঞ্জস্য ও আদর্শিক সংহতি রয়েছে যে, তার কারণে এক ধর্মকে অন্য ধর্ম হতে পৃথক ভাবা যায় না। তাই বিবেক ও বুদ্ধি দিয়ে নিবিড়ভাবে ভেবে দেখতে হবে, বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে যেসব পার্থক্য ও বিভেদ দেখা যায়, সেগুলিই কি ধর্মের মূলনীতি? না কি তাদের মধ্যে গভীরতর যে-সকল সাদৃশ্য ও সাযুজ্য রয়েছে, বরং সেগুলিই ধর্মের মূলনীতি?




পার্থক্য বহু আছে, আর তা এত পরিস্ফুট ও পরিদৃশ্যমান যে, মনে হবে ধর্মসমন্বয়ের কথা উঠতেই পাবে না। মুসলমান মূর্তিপূজা করে না, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো মূর্তি গড়ে না, নিরাকার উপাস্যের আরাধনা করে, তাদের খাদ্যাখাদ্যের বিচারপদ্ধতিও স্বতন্ত্র। খ্রিস্টান যিশুকে ঈশ্বরের পুত্র মেনে নিয়ে ঈশ্বরের মতোই তাঁর উপাসনা করে, তাদের খাদ্যাখাদ্যের বিচার আরেক ধরনের, উপাসনাপদ্ধতিও আলাদা। হিন্দুরা মূর্তিপূজা করে, ঈশ্বর মানবদেহ ধারণ করে থাকেন, এই তত্ত্বে বিশ্বাস করে; তাদের মতে, সকল মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের অংশ আছে, তাদের খাদ্যাখাদ্যের বিচার মুসলমান ও খ্রিস্টানদের থেকে আলাদা। বাইরে দেখে মনে হবে, এই তিনটি ধর্মের মত ও পথ একেবারেই পৃথক, এদের মধ্যে মিলন ও সমন্বয় পুরোপুরি অসম্ভব ও অকল্পনীয়।




কিন্তু এই ধর্ম তিনটির প্রধান শিক্ষণীয় বিষয়গুলি আলোচনা করলে দেখা যাবে, তাদের মূলগত আদর্শ ও দর্শনের মধ্যে কোনো ধরনের পার্থক্য নেই। তিনটি বিষয়ে সব ধর্মই একমত:




প্রথমত, এদের প্রত্যেকেই বিভিন্ন নামে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। কোনো ধর্মই নাস্তিকতাকে সমর্থন করে না। ঈশ্বর আছেন, তিনিই বিশ্বনিয়ন্তা, তিনিই সর্বক্ষমতার অধিপতি, মানুষের ভালো-মন্দ ও জীবন-মরণের তিনিই একমাত্র কর্তা—এটা প্রত্যেকেই বিশ্বাস করে মনে-প্রাণে এবং সমস্ত অন্তর দিয়ে ঈশ্বর-উপাসনার প্রয়োজনীয়তায় বিশ্বাস করে। নিয়মিত উপাসনা ও প্রার্থনা ছাড়া তাঁর সান্নিধ্যলাভ করা সম্ভব নয়। পথ বহু, কিন্তু গন্তব্য সেই একই স্থান: ঈশ্বর বা আল্লাহর নৈকট্য। এ বিষয়ে সকল দলই একমত।




দ্বিতীয়ত, মানুষ সৃষ্ট জীব হলেও তার একটা আত্মা আছে। সেই আত্মা অবিনশ্বর, সে কারণে মানুষ এক দিক দিয়ে অমর। তার মূলসত্তার বিনাশ হয় না, দেহের শেষ হলেই সব শেষ হয় না। আত্মা বয়ে যায় অবিনশ্বরভাবে।




তৃতীয়ত, জীবসেবা—এ বিষয়ে কোনো ধর্মই ভিন্ন মত পোষণ করে না। জীবসেবা সকল ধর্মেরই একটা সারশিক্ষা। এই জীবসেবার ব্যাপারে মানুষে মানুষে কিংবা ধর্মে ধর্মে কোনো বিরোধ বা দূরত্ব নেই, মানুষ হিসেবে বাঁচতে গেলেই সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য জীবসেবা করতে হবে। মুসলমান নামাজ পড়ে কার জন্য? আল্লাহর উদ্দেশ্যেই তার সকল উপাসনা, সকল সাধনা সমর্পিত হয়। খ্রিস্টান ও হিন্দুও সেই এক‌ই উদ্দেশ্যে পূজা, যাগযজ্ঞ, উপাসনা করে থাকে। সকল উপাসনার শেষ নিবেদন ঈশ্বর বা আল্লাহ, এতে ধর্মে ধর্মে কোনো পার্থক্য নেই। যেখানে মূল উদ্দেশ্যে তথা গন্তব্যে পার্থক্য নেই, সেখানে পথ ও পদ্ধতির বিভিন্নতা বড়ো কথা নয়। এক‌ই গন্তব্যে ভিন্ন পথে চলে পৌঁছলে অসুবিধে কোথায়?




সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বাহ্যিক পার্থক্যটা কেবলই আচার, খাদ্যাখাদ্যের বিচার ও উপাসনার পদ্ধতি নিয়ে। কিন্তু মূল লক্ষ্য সকলেরই এক।




উপরের তিনটি দিকের একটাও বাদ দেওয়া চলে না। দিলে কেউই কোনো ধর্মের অন্তর্গত থাকতে পারবে না। কিন্তু আচার, অনুষ্ঠান, পদ্ধতি, পথ ইত্যাদির বেলায় তেমন কড়াকড়ি নিয়ম নেই। দৈনন্দিন জীবনে আমরা হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান কত আচারপদ্ধতিই তো বাদ দিয়ে থাকি, দরকারবোধে পরিবর্তন করি, কখনো কখনো অবহেলা পর্যন্ত করি, কিন্তু উপরের তিনটি বিষয়কে অপরিবর্তনীয় নীতি বলে সকলেই স্বীকার করে নিই এবং একথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি যে, ওই তিনটি বাদ দিলে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হব এবং ধর্মদ্রোহী হয়ে যাব। আচারে অবিশ্বাসী মানুষকে আমরা পশু বলি না, বরং স্রষ্টার সৃষ্ট জীবের প্রতি দয়ামায়াহীন মানুষকেই পশুর সাথে তুলনা করি।




সুতরাং প্রশ্ন ওঠে, যদি মূলতত্ত্ব বিষয়ে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে পার্থক্য না থাকে, তবে ধর্মের সমন্বয় কেন সম্ভব হবে না? যেসব পার্থক্যকে সাধারণ লোক ভীষণ গভীর বলে মনে করে, দেখা গেল, তা আদৌ গভীর নয়, এমনকি মৌলিকও নয়, বরং সততার সাথে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, তা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। এমন বহু মুসলমান আছে, যারা নিয়মিত নামাজ পড়ে না; বহু খ্রিস্টান আছে, যারা গির্জায় নিয়মিত যায় না এবং বহু হিন্দু আছে, যারা পূজাপার্বণ পালনে তেমন উৎসাহী নয়। কিন্তু এ কারণে তো কেউ তাদের ধরে-বেঁধে ধর্মের গণ্ডি থেকে বের করে দেয় না। এর কারণ, আচারপদ্ধতি নিয়ে বাইরে যতই ঝগড়াবিবাদ করুক না কেন, লোকে মনে-প্রাণে বোঝে যে ওগুলি অপরিহার্য কিছুই নয়, মূলনীতিই ধর্মের আসল বস্তু। তা ছাড়া ধর্মাচরণ যার যার নিজস্ব বিষয়। মানুষ নরকে যায় নিজে ধর্ম পালন না করলে; অন্যে ধর্ম পালন না করলেও তার স্বর্গে যেতে অসুবিধে হবার কথা নয়।




তাই এ কথা আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, ধর্মের মূলনীতিতে দৃঢ় থেকে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা অসম্ভব ব্যাপার নয়। একটা কথা লক্ষ করতে হবে, যখন ধর্ম-সমন্বয়ের কথা বলি, তখন তার অর্থ এ নয় যে, প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম হঠাৎ পরিত্যাগ করে একটিমাত্র ধর্ম গ্রহণ করবে। বরং সমন্বয় বলতে এটা বুঝি, নিজ নিজ ধর্মে বিশ্বাসী থেকেই পরস্পরের সাথে এমনভাবে মিলতে হবে যেন পার্থক্যের কারণে মানুষের সাথে মানুষের কোনোরূপ বৈরী ভাব না জাগে, উদারভাবে প্রত্যেকেই যেন একে অপরকে দেখতে শেখে। এই উদারতার কারণে ও ক্রমবিবর্তনের ফলে কালক্রমে মানুষ পরস্পরের সাথে এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে যাবে যে, তার ফলে মনে হবে, সকলেই যেন একই ধর্মের সেবক, একই আদর্শের পৃষ্ঠপোষক ও একই পথের পথিক। এভাবে চললে বিভিন্ন ধর্মের সেবকদের মধ্যে এমন একটা সংহতি গড়ে উঠবে, এমন একটা সামঞ্জস্য চলে আসবে যে মনে হবে, সমগ্র মানবজাতি এক মহাধর্মের অন্তর্গত হয়ে গেছে। নিজধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব ও পরধর্মের অসারত্ব প্রচার সেদিন বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষের মূল পরিচয় মুসলমানত্ব, হিন্দুত্ব, বৌদ্ধত্ব বা খ্রিস্টানত্ব না হয়ে কেবলই মনুষ্যত্ব হবে।




ধর্মকে যারা উদার দৃষ্টিতে দেখে থাকে, তারা সবসময়ই বিশ্বমানবতার ভিত্তিতে ঐক্যকে বড়ো করে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এই ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য তারা নিরলসভাবে সাধনা করে যায়। সব ধর্ম যে মূলত ও কার্যত এক এবং একই কারণ ও একই কেন্দ্র হতে তাদের সৃষ্টি, তা প্রত্যেক ধর্মশাস্ত্র স্বীকার করে। ইসলাম বলছে, প্রত্যেক দেশের জন্য আল্লাহ পয়গম্বর বা ধর্মোপদেষ্টা প্রেরণ করেন। আর এই পয়গম্বরগণ যে ধর্ম প্রচার করেন, তার নাম ইসলাম (বা শান্তি)। কেবল হজরত মুহম্মদের প্রচারিত ধর্মই যে ইসলাম, তা নয়। বিভিন্ন দেশে যে-কোনো ধর্ম, যা ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত মহাপুরুষদের দ্বারা প্রচারিত হয়েছে, তা-ও ইসলাম। এ বিচারে, হিন্দু ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, ইহুদি ধর্ম, শিখ ধর্ম, জৈন ধর্ম সব‌ই ইসলাম ধর্ম; অর্থাৎ ইসলামের মূল দর্শন অনুযায়ী, ভিন্ন ধর্মবিশ্বাস এবং ধর্মবিশ্বাসীদের প্রতি অসহিষ্ণু হ‌ওয়ার কোনো সুযোগ‌ই নেই।




কুরআন এ বিষয়ে বলছেন, "প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য উপদেষ্টা ও পথপ্রদর্শক পাঠিয়েছি।" (১৩:৭) আর-এক জায়গায় আল্লাহ বলছেন, "এমন কোনো জাতি ছিল না, যার জন্য পয়গম্বর বা তত্ত্ববাহক পাঠাইনি।" (৩৫:২৪) তিনি আরও বলেছেন, "নিশ্চয়ই তোমার পূর্বে পয়গম্বর পাঠিয়েছি—কতগুলির নাম তোমার কাছে বলেছি এবং কতগুলির নাম বলিনি।" (৪০:৭৮) ইসলামের আর-একটি শিক্ষা এই যে, আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত সকল পয়গম্বরকে বিশ্বাস করতে হবে। যে-কোনো দেশের স্রষ্টা কর্তৃক প্রেরিত মহাপুরুষগণ ইসলামের ধারক ও বাহক—এই নীতিতেও মুসলমানকে বিশ্বাসী হতে হবে। অন্য ধর্মের বেলাতেও তা-ই, অর্থাৎ সেগুলিও বিশ্বধর্মের সমর্থক এবং সব ধর্মের মূল আদর্শকে সত্য ও অকৃত্রিম বলে স্বীকার ও বিশ্বাস করে। আচার, ব্যবহার ও বহিরাঙ্গনের জাল ভেদ করে ধর্মের অন্তরদেশে প্রবেশ করলে বোঝা যাবে, অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো সকলের মধ্যেই ঐক্য ও সংহতির ধারা স্বচ্ছন্দ গতিতে প্রবাহিত হচ্ছে।




হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের মূল শিক্ষণীয় বিষয়গুলি এক ও অভিন্ন, এটা বুঝতে পেরেই বহুদিন আগে অবিভক্ত ভারতবর্ষে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধনের চেষ্টা হয়েছিল। মুসলিমরা যখন প্রথম ভারতবর্ষে এল, তখন হিন্দুদের আচার-ব্যবহার দেখে ওরা মনে করেছিল, ওইটুকুই বুঝি হিন্দুত্ব, এর বাইরে আর কিছু নেই। (বাইরে থেকে দেখে ভাসাভাসা জ্ঞানের উপর বিচার করতে গেলে এরকম মনে হ‌ওয়াটাই স্বাভাবিক, সবার‌ই হয় এমন।) কিন্তু ধীরে ধীরে যখন ভারতীয় ভাষা, বিদ্যা ও সংস্কৃতি তাদের আয়ত্ত হতে লাগল, তখন তারা বুঝল, হিন্দু ধর্মের আসল বস্তু আচার-বিচার বা বহিরাবরণ নয়, তারও গভীর তলদেশে এমন একটা আদর্শ আছে, যা ইসলাম হতে বেশি পৃথক নয়। মহাত্মা আলবেরুনি-সহ আরও মুসলিম পণ্ডিত ব্যক্তি অনেকটা অসাধ্যসাধন করে হিন্দুদর্শন ও হিন্দুধর্ম নিয়ে গবেষণা করতে লাগলেন। তখন মুসলমানের কাছে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির মূলতত্ত্ব ও অন্তর্নিহিত ঐক্যের কথা প্রকাশিত হয়ে গেল।




আলবেরুনির পর বহু হিন্দু ও মুসলমান পণ্ডিত এই দুই ধর্মের সমন্বয় সাধনের জন্য অনেক আলোচনা ও চেষ্টা করেন। আমরা অনেকেই মনে করি, আকবরই বুঝি তাঁর প্রবর্তিত ও প্রচারিত দীন-ই-ইলাহী বা ঈশ্বরের ধর্ম-এর মাধ্যমে সর্বপ্রথম এই সমন্বয়ের বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর‌ও বহু আগে আলবেরুনি যে পন্থা নিৰ্দেশ করেছিলেন, তা অনেকেই অনুসরণ করেছেন। আকবরের পর মহাত্মা দারাশিকো সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে খুবই আন্তরিকভাবে এই ধর্ম-সমন্বয়ের চেষ্টা করেছিলেন। এ কারণেই তাঁকে ধর্মান্ধতার যূপকাষ্ঠে আত্মবলি দিতে হয়েছিল। তিনি বহু সংস্কৃত গ্রন্থ ফারসিতে অনুবাদ করিয়েছিলেন এবং নিজেও কতগুলি অনুবাদ করেছিলেন। হিন্দুদর্শনের আকর উপনিষদের ফারসি অনুবাদ তাঁর অক্ষয়কীর্তি। তিনি এতেই ক্ষান্ত হননি, হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের তুলনামূলক আলোচনা করে একটি মূল্যবান গ্রন্থ লিখেছিলেন। সেই গ্রন্থের নামই বলে দেয়, তিনি সেই যুগেই প্রকাশ্যভাবে ধর্ম-সমন্বয়ের চিন্তা করেছিলেন। তাঁর এই গ্রন্থের নাম 'মাজমা-উল-বাহরাইন', অর্থাৎ 'দুই সাগরের মিলনকেন্দ্র'। এই গ্রন্থে তিনি হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের কতগুলি আদর্শকে বিচার করে দেখিয়েছেন, শত পার্থক্য সত্ত্বেও সেগুলি মূলত এক। কিন্তু ঘাতক দারাশিকোর আবদ্ধ ব্রতকে বহুদিনের জন্য পণ্ড করে দিল।




এমন ধরনের আলোচনামূলক রচনা দ্বারা হঠাৎ করেই কোনো সমন্বয় নিশ্চয়ই হয়ে যেত না, কিন্তু তাতে জনসাধারণের মনের সংকীর্ণতা, নীচতা ও ধর্মান্ধতা দূর হয়ে যেত এবং তারা ধীরে ধীরে একসময় বুঝত, সব‌ই মূলত এক। তখন পরস্পরের সাথে মেলামেশার অধিকতর সুযোগ তৈরি হতো। এভাবেই একদিন সত্যি সত্যি দুই সাগরের মিলন বা সমন্বয় ঠিক‌ই হয়ে যেত। কিন্তু নানা প্রকারের বাধা এসে পথরোধ করে দাঁড়াল।




সে বাধা আজও আছে যদিও, তবু তা বেশিদিন থাকবে না, তা-ই বোধ হচ্ছে। একদিন সমন্বয় আসবে, আসাটা আজ সময়ের দাবি। দারাশিকো, রামমোহন, রামকৃষ্ণ, সৈয়দ আহমদ, কেশবচন্দ্র যে কাজের সূচনা করেছিলেন, তা কত দিনে সম্পন্ন হবে বলতে পারব না, তবে কাজ থেমে নেই, তা চলছে, ধীর গতিতে হলেও একদিন এ কাজ শেষ হবে। সেদিন মানুষে মানুষে বিদ্বেষের বদলে ভালোবাসা থাকবে।




আবারও বলছি, ধর্ম-সমন্বয়ের মানে ধর্ম পরিত্যাগ করা নয়। উদার ভিত্তিতে ধর্মের মূল আদর্শের উপর দাঁড়িয়ে থেকে পরস্পরের সাথে সম্ভাব, মিলন ও একতার ফলে যে অবস্থার উদ্ভব হবে, তাকেই বলি ধর্ম-সমন্বয়। এই অবস্থা আনতে হলে ধর্মের বহিরাবরণ, আচার-অনুষ্ঠান এবং নানান চুলচেরা বিচার ও বিশ্লেষণ না করে বরং যে মূলসত্য ও মূলআদর্শের উপর সকল ধর্ম প্রতিষ্ঠিত, তার উপর বেশি জোর দিতে হবে। সৃষ্টিকর্তায় ঐকান্তিক বিশ্বাস ও জীবসেবাই হবে সকলের প্রধান ব্রত। এই ব্রত নিয়ে সকলেই একই লক্ষ্যে এগিয়ে চলবে, একইভাবে কাজ করবে, একই গতিতে চলবে। প্রত্যেকের ধর্মমতকে উদার দৃষ্টিতে দেখতে হবে, ধর্ম বিষয়ে আক্রমণাত্মক মন্তব্য, লেখা বা আলোচনা পুরোপুরি পরিহার করতে হবে। গায়ের জোরে, ভয় বা প্রলোভন দেখিয়ে, চাপ দিয়ে অপরকে স্বধর্মে দীক্ষিত করার নীতি থেকে সরে আসতে হবে শান্তির স্বার্থে। ধর্মগত ও সংস্কৃতিগত মিলনভিত্তিক ভালো ভালো গ্রন্থ লিখে সেগুলির বহুল প্রচার করতে হবে এবং সাধারণ লোকের দৃষ্টি এই বিষয়টির প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে। একই পরিবারের বিভিন্ন সন্তান রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে যেমন ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে থাকে, ঠিক তেমনি মানুষ যদি ধর্ম নিয়ে ভিন্ন মত ও পথের অনুসারী হয়, তবে তাতে যেন কোনোভাবেই বাধা দেওয়া না হয়। তাকে যেন বলা না হয় যে, সে ভুল পথে আছে, অমুক পথে না এলে তার পুরো জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে।




ধর্মকে সব ধরনের রাষ্ট্রীয় ব্যাপার হতে পৃথক করতে হবে, ধর্মপালন ও ধর্মাচরণ হবে নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার (এবং সভ্য সমাজে তা-ই হ‌ওয়া উচিত)। এটার উপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা যাবে না। আচার-অনুষ্ঠান অপেক্ষা নৈতিক ভিত্তির উপর বেশি জোর দিতে হবে। নিজে শান্তিতে থাকতে হবে অন্যকে শান্তিতে থাকতে দেওয়ার মধ্য দিয়েই। এভাবে যদি বিভিন্ন সম্প্রদায় চলতে থাকে, তবে অনায়াসে ধর্ম-সমন্বয় সম্ভব হবে, তার ফলে কোনো ধর্মই লোপ পাবে না, বরং দিনদিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতে থাকবে। একে অন্যের পেছনে লেগে না থেকে সকলেই নিজ ধর্ম পালনের প্রতি মনোনিবেশ করবে, এর ফলে সাম্প্রদায়িক রেষারেষি, বাদানুবাদ থাকবে না, মিলন-সদ্ভাব-সম্প্রীতি-সহযোগিতার ফলে এক অপূর্ব ধর্ম-সমন্বয় হয়ে যাবে; জড়বাদিতা, নাস্তিকতা ('বাহ্যিক ধর্মাচরণ' বা rituals-এর অনুপস্থিতি অর্থে নয়), সংশয়বাদ, বস্তুতান্ত্রিকতা ও ধর্মহীনতার আক্রমণ হতে ধর্ম সেদিন সম্পূর্ণরূপে মুক্তি পাবে, মানবাত্মারও মুক্তি হবে।