অহেতুকী কৃপা চেয়ে

সেদিন যেভাবে দেখা দিয়ে কৃতার্থ করলে, অত আশান্বিত করলে, আজ সেভাবে দেখতে গিয়ে কৃতকার্য হচ্ছি না। একেবারে নির্জনে, গোপনে, অন্ধকারের মধ্যে তোমাকে দেখতে গিয়ে, ধরতে গিয়ে মন তোমাতে মজছে না। এই অন্ধকার সরিয়ে দিয়ে তুমি যে তোমার বিশ্বরূপ ধীরে ধীরে দেখাচ্ছ, স্মরণ করিয়ে দিচ্ছ, তাতেই বরং তৃপ্তি হচ্ছে। আমি অজ্ঞানী, ভোলা, নিদ্রালু, আর তুমি সর্বজ্ঞ, চির স্মৃতিশীল, অনিদ্র থেকে আমার কাছে, ধীরে ধীরে, নানা বেশে আছ। আমার জন্যে তুমি যে ব্যস্ত, তারই পরিচয় দিচ্ছ, আমার হৃদয় চাইছ, এই দেখেই তোমার দিকে আকৃষ্ট হচ্ছি।




তোমার এই আত্মপরিচয় দান, আমার জন্যে তোমার ব্যস্ততা, তোমার কৃত আমার যত্ন সারাদিনই তো চলে। আমার হৃদয় যদি সরস হতো, আমার যদি উজ্জ্বল প্রেমানুভব-শক্তি থাকত, তবে আমি সারাদিনই তোমার সঙ্গিত্ব অনুভব করতাম, সারাদিনই প্রেমে মজে থাকতাম, সারাদিনই শান্তি-সুখ ভোগ করতাম। তাহলে আমার জীবনব্যাপী চেষ্টা সার্থক হতো। আমি শান্তির উৎস, বলের উৎস আবিষ্কার করে চিরসুখী, চিরকর্মী, চিরসেবক হতাম, আর এই শান্তির উৎস, বলের উৎস জগতের লোককে দেখিয়ে কৃতার্থ হতাম।




কিন্তু আমার তো সেই প্রেমানুভব নেই। আমি তোমার প্রেম-ব্যস্ততা শুষ্ক চোখে দেখি, শুষ্ক হৃদয়ে চিন্তা করি, আর দেখার ফল বন্ধুদের বলি, সময়ে সময়ে প্রবন্ধের আকারে লিপিবদ্ধ করি। সময়ে সময়ে তোমার প্রেমদর্শনে আমার হৃদয় গলে যায়, আমার অশ্রুপাত হয়, কিন্তু সেই গলা ভাব, সেই অশ্রুপাত বেশিক্ষণ থাকে না। আমার হৃদয়ে স্থায়ী প্রেমের সঞ্চার হয়নি। আমি হৃদয় দিয়ে তোমাকে আঁকড়ে ধরতে পারিনি।




মুহূর্তের জন্যে তোমাকে ধরি, আবার ছেড়ে দিই। মুহূর্তের জন্যে তোমার চরণে মাথা রাখি, আবার দেখি, তোমার চরণ থেকে আমার মাথা সরে পড়েছে। এই অবস্থা থাকলে জীবন শান্তিময় হবে না, শান্তিতে মরতেও পারব না। এই অবস্থায় উপরে কী করে উঠি, তা-ও বুঝতে পারছিনে। তুমি আমাকে বার বার দেখিয়ে দিচ্ছ যে আমার সমুদয় সাধনচেষ্টার মধ্যে একটা নিজের কর্তৃত্ববোধ রয়েছে, যা আমার সমুদয় চেষ্টা বিফল করে দিচ্ছে। 




তোমার সর্বময়ত্ব-বোধের দ্বারা, নিজের অকিঞ্চনত্ব-অনুভব দ্বারা সেই কর্তৃত্ববোধ দূর করতে শত চেষ্টা করছি। কিন্তু তা তো এখনও দূর হচ্ছে না। দূর না হলে তোমার সঙ্গে স্থায়ী যোগ স্থাপিত হবে না, তা-ও বুঝতে পারছি। এখন এই বাধা কেমন করে দূর হয় বলো। তুমি বার বার বলেছ প্রার্থনাকে সম্বল করতে। তা-ইবা পারছি ক‌ই? সাংসারিক গণনায় মনে হয়, জীবনের স্রোতে ফিরবার সময় আর নেই। কিন্তু তোমার কৃপার দিকে তাকালে সবই সম্ভব বলে মনে হয়। আমি অসহায় হয়ে তোমায় কৃপার শরণাপন্ন হই। তুমি আমাকে নতুন করে ব্যাকুল প্রার্থনায় দীক্ষিত করো।




প্রার্থনার মধ্যেও কর্তৃত্ববোধ ঢোকে। মনে হয়, আমার প্রার্থনার বলে তোমাকে নামিয়ে আনব। ব্যাকুল প্রার্থনার শক্তিও আমার নেই। তোমার অহেতুকী কৃপাই আমার সম্বল, আমার আশার স্থল। সময়ে সময়ে যে তোমার কৃপার স্পর্শ পাই, আবার তা থেকে বঞ্চিত হই, এর মধ্যে কোনও হেতু দেখি না। হেতু খুঁজতেও যাব না। তোমার অহেতুকী কৃপায় আমার জীবনে তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক, তোমার প্রেমরাজ্য স্থাপিত হোক, এ-ই আমার কাতর প্রার্থনা।