বাংলায় লেখা: এক

১। আমরা লিখি ‘লেখা’, 'লিখা' নয়। তবে এর হাত ধরে ‘লেখব’ হবে না, ‘লিখব’-ই হবে। একই ব্যাপার ‘শেখা, শিখব’-র বেলাতেও।




২। সংস্কৃত তদ্ধিত প্রত্যয় দানীম্ যুক্ত হয়ে গঠিত হয় ইদানীম্/ইদানীং, তদানীম্/তদানীং; এ থেকে ইদানীন্তন ও তদানীন্তন। অতএব, এই 'দানীম্' প্রত্যয়ের দীর্ঘ ই-এর কারণেই ‘ইদানীং’-এর ‘ইদানিং’ হয়ে ওঠার কোনো কারণ নেই। ‘ইদানীং’ শুদ্ধ, ‘ইদানিং’ ভুল।




৩। ‘আগামীকাল’ শুদ্ধ, ‘আগামিকাল’ ভুল। সমাসবদ্ধ পদ বিধায় আলাদা করে ‘আগামী কাল’ লেখাও যায় না। একইভাবে, গতকাল, পরবর্তীকাল ও বিগতকাল।




৪। বাংলা ধ্বনির স্বাভাবিক স্বরসঙ্গতির প্রবণতায় পরবর্তী [ই]-এর প্রভাবে পূর্ববর্তী [অ্যা] রূপান্তরিত হয় [এ] ধ্বনিতে। তাই 'খেলে' [খ্যালে], কিন্তু 'খেলি' [খেলি]; 'ব্যস্ত' [ব্যাস্তো], 'ব্যক্ত' [ব্যাক্তো], কিন্তু 'ব্যক্তি' [বেক্তি], 'ব্যতিক্রম' [বে_], 'ব্যতিহার' [বে_], 'ব্যষ্টি' [বে_], 'ব্যভিচার' [বে_]; এভাবেই 'এক' [অ্যাক্], কিন্তু 'একটি' [এক্টি]।
এখন প্রশ্ন হলো, কাব্যিক অসমাপিকা ক্রিয়া 'ব্যাপিয়া'-র উচ্চারণ এই নিয়মে [বেপিয়া] হওয়া উচিত, কিন্তু সাধারণত [ব্যাপিয়া] উচ্চারণ করা হয়। 'তব নির্মল নীরব হাস্য হেরি অম্বর ব্যাপিয়া', এই গানের পঙ্‌ক্তিতে তো [ব্যাপিয়া] উচ্চারণই শুনতে পাই। শুধু 'ব্যাপী' ('ব্যাপিয়া'-র রূপভেদ) হলে কী উচ্চারণ হওয়া উচিত? ('ব্যাপী'-র উচ্চারণ অবশ্য [ব্যাপি]।)
লক্ষণীয়, 'ব্যাপিয়া'-তে [এ] উচ্চারণ হয়তো কখনো ছিল, তা বোঝা যায় 'ব্যেপে' শব্দের এ-কার থেকে। 'বাদল-বাতাস ব্যেপে (আমার) হৃদয় উঠিছে কেঁপে' স্মর্তব্য।
পুনশ্চ, 'ব্যাপ্তি' উচ্চারণ কিন্তু নিঃসংশয়ে [ব্যাপ্তি], [বেপ্তি] নয়। তাহলে কি কেবল য-ফলা ও য-ফলা আ-কারের মধ্যে একটা ধ্বনিগত প্রভেদ স্বভাবতই আছে?
দেখা যাক।
ব্যক্তি-কে [বেক্তি] যখন শুনেছেন, এবং সম্ভবত বলেনও, তখন বাকিগুলোও শোনা এবং বলা যেতে পারত। অনেকে ব্যথিত-কে [বেথিতো]-ও শোনেনি, কিন্তু জগন্ময় মিত্র গাইছেন, 'দুঃখশোকে ব্যথিত [বেথিতো] চিতে নাই-বা দিলে সান্ত্বনা'; চাইলে এক্ষুনি ইউটিউব থেকে দেখে নিতে পারেন। যেখানে বাংলা ধ্বনির একটা সাধারণ প্রবণতা বিবেচ্য, সেখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কোনো নির্ণায়ক হতে পারে না। এবং আবারও বলছি, ক্রিয়াপদ এবং আরও বিচিত্র শব্দে এ প্রবণতা বিদ্যমান।




৫। উনিশ, উনত্রিশ, উনচল্লিশ… এভাবে উননব্বই পর্যন্ত সবগুলো তদ্ভব। (বানানে উ হবে, ঊ হবে না।) এগুলোর (ক্রমবাচক) তৎসম রূপ হলো যথাক্রমে ঊনবিংশ, ঊনত্রিংশ, ঊনচত্বারিংশ… এভাবে ঊননবতি। (বানানে ঊ হবে, উ হবে না।) উ এবং ঊ-এর ব্যবহার লক্ষণীয়। তদ্ভব শব্দে উ, তৎসম শব্দে ঊ।




৬। 'বিষফোড়া' বনাম 'বিষফোঁড়া'
'গোদের উপর বিষফোঁড়া', না কি ‘গোদের উপর বিষফোড়া’?
শরীরে যন্ত্রণাদায়ক যেটা হয়, সে বস্তুটি 'ফোড়া', 'ফোঁড়া' নয়। 'ফোঁড়া' শব্দটি এসেছে ফুঁড়্-ধাতু (বিদ্ধ করা) থেকে। ‘ফোঁড়া’ হচ্ছে ‘ফুঁড়া’-র কথ্য রূপ। তাই গোদের উপর বিষ-ফোঁড়া হবার কোনো কারণ নেই, ফোড়া-ই হবে।
আরেকটা মজার জিনিস দেখা যাক। বিস্ফোটক থেকে সরাসরি এসে কথা ছিল 'বিস্ফোড়া' বা 'বিসফোড়া' হবার, সেখানে যে 'বিষ' চলে এল এবং একপ্রকার অর্থবহ হলো, সেটাই folk etymology; মানে লোকের মুখে মুখে মূল শব্দটা এমন একটা রূপ নিল, যা বলতে ও বুঝতে লোকের ভালো লাগে বা সুবিধে হয়।




৭। রা বা রে সম্বোধন হিসাবে ব্যবহৃত হয় না, এমনটা কেউ কেউ বলে থাকেন। "হ্যাঁ রা! সারাদিন কোথায় ছিলি?" আবার "হ্যাঁ রে! তুই কি খেলা দেখতে যাবি?" --- এমন সম্বোধন শুনেছি বই-কি! (খেয়াল করুন, ‘বৈকি’ নয়, বইকি বা বই-কি।) এমনকি (এমনকী নয়, এমনকি) "হা রা, হা রে" সম্বোধনও উচ্চারণভেদে শুনেছি।




৮। উচিৎ-কে শুদ্ধ করে 'উচিত' লিখতে হবে, কিন্তু ভবিষ্যৎ, জগৎ, হঠাৎ ইত্যাদি-তে ৎ হবে। শব্দের শেষে 'ঞ্জ' লেখা বিধেয়, কারণ বাংলায় 'ন্জ' বলে কোনো যুক্তবর্ণ নেই। স্পঞ্জ, ব্রোঞ্জ ইত্যাদি ইংরেজি থেকে গৃহীত শব্দগুলি বহুকাল থেকে ঞ্জ দিয়ে লেখা হয় (যদিও ইংরেজি উচ্চারণের খাতিরে তাদের লেখা উচিত ছিল স্পাঞ্জ, ব্রঞ্জ/ব্রঞ্জ়)। একই নিয়মে ‘আঙ্কেল’ লিখতে হবে, ‘আন্কেল’ নয়।




৯। later - লেইটা(র)
letter- লেটা(র)
latter- ল্যাটা(র)
অংশত (partially), অন্তত (at least), আইনত (legally), আপাতত (for the time being), ইতস্তত (hesitantly, this way and that), উভয়ত (on both sides), কার্যত (practically), চতুর্থত (fourthly), জ্ঞানত (knowingly), তৃতীয়ত (thirdly), দৃশ্যত (apparently, visibly), দ্বিতীয়ত (secondly), পূর্ণত (completely), প্রত্যুত (on the contrary), প্রথমত (firstly), প্রধানত (principally), প্রসঙ্গত (in the context thereof, by the way), ফলত (consequently, as a result), বশত (under the influence of), বস্তুত (in reality), বাহ্যত (externally), বিশেষত (particularly), মুখ্যত (chiefly), মূলত (mainly), সম্ভবত (possibly), সর্বত (entirely), স্পষ্টত (clearly), স্বতঃ (spontaneously), স্বভাবত (by nature), সাধারণত (generally), রাগত (angrily)
উপরের প্রতিটি শব্দেই আছে সংস্কৃত তদ্ধিত প্রত্যয় তসিল্, যার ইল্ লুপ্ত হয়, তস্ (তঃ) থাকে। আধুনিক বানানে আমরা অন্তিম বিসর্গ বর্জন করি, তা না হলে শব্দগুলির বানান হত 'অন্ততঃ' ইত্যাদি।
প্রাতিপদিক অংশে যেসব পদ দেখতে পাচ্ছি, তার মধ্যে বাংলা প্রয়োগে নির্ভেজাল বিশেষ্য বলা চলে এদেরকে: অংশ, অন্ত, আইন, কার্য, জ্ঞান, দৃশ্য, বস্তু, স্বভাব, রাগ। তসিল্ প্রত্যয়যোগে সবকটিই (‘সবক’টি’ না লিখে আমরা ‘সবকটি’ লিখব, কেননা ঊর্ধ্বকমা বর্জন করতে হবে যথাসম্ভব।) পরিণত হচ্ছে ক্রিয়াবিশেষণে এবং বাক্যগঠনে অত্যন্ত কার্যকর শব্দ হয়ে উঠছে। ক্রিয়াবিশেষণ রূপটি দেখাবার জন্য প্রতিটির একটি করে ইংরেজি করেছি মোটামুটি।
বাংলায় বিশেষ্য থেকে ক্রিয়াবিশেষণ তৈরি করতে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষণ+অনুসর্গের সাহায্য নিতে হয়, যথা historically বোঝাতে হয় 'ঐতিহাসিকভাবে' বা ওইরকম কিছু লিখে, theoretically বোঝাতে 'তাত্ত্বিকভাবে', 'তত্ত্বগত দিক থেকে' জাতীয় শব্দবন্ধ তৈরি করতে হয়। এতে ভাষার প্রবাহ কিছুটা হোঁচট খায়, সংক্ষিপ্ততা ঘায়েল হয়। হয়তো তসিল্ প্রত্যয়ের সৎপ্রয়োগ দ্বারা আরও নির্ভার ও সূক্ষ্মাগ্র শব্দ তৈরি করা যেতে পারে---এটা ভেবে দেখার মতো বিষয়। ক্রিয়াবিশেষণ শব্দভাণ্ডারের রুদ্ধশ্রেণি (closed class) নয়, বরং মুক্তশ্রেণি (open class)---চাইলেই তা ইচ্ছে ও প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়ানো যেতে পারে; সুতরাং এ নিয়ে চিন্তা করা যেতেই পারে।




১০। সর্বত আলাদাভাবে লেখা যায়, যদিও আমরা সর্বতোভাবে, সর্বতোমুখ, সর্বতোভদ্র ---এমন চেহারাতেই দেখতে অভ্যস্ত! “সর্বত মন গল রাধে বিনোদিনী রায়/ বৃন্দাবনের বংশীধারী ঠাকুর কানাই”




১১। খুব কনফিউজিং একটা ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা যাক।
বাক্যে নামপদ বা ক্রিয়াপদের পরে ব্যবহৃত -ই এবং -ও . . . (১) প্রত্যয়, (২) বিভক্তি, (৩) পদাশ্রিত নির্দেশক, না (৪) অন্য কিছু?
দেখা যাক।
বাংলায় 'ই' এবং 'ও' নামে দুটি প্রত্যয় আছে বটে, কিন্তু যে '-ই' এবং '-ও'-এর কথা বলা হচ্ছে, ওরা প্রত্যয় নয়। শব্দমূল বা ধাতুমূলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রত্যয় নতুন শব্দ গঠন করে। এখানে তা হচ্ছে না। নামপদ বা ক্রিয়াপদের অর্থ অবিকৃত থাকছে, কেবল তাতে নানা রকমের জোর পড়ছে বা দ্যোতনা যুক্ত হচ্ছে।
এ দুটিকে বিভক্তিও বলা যাবে না। শব্দ বা ধাতু বিভক্তিযুক্ত হয়ে পদ হিসেবে বাক্যে বসার পরেই 'ই' বা 'ও' লাগানো হচ্ছে দরকারমতো। এরা না বোঝাচ্ছে কারক, না বোঝাচ্ছে ক্রিয়ার কাল।
পদাশ্রিত নির্দেশকও এরা নয়। পদাশ্রিত নির্দেশক সাধারণত বিশেষ্য বা সংখ্যাবাচক বিশেষণের পরে বসে বর্ণিত ব্যক্তি বা বস্তুর রূপ বা প্রকৃতিকে নির্দেশ করে। 'ই' বা 'ও' কিন্তু ক্রিয়াপদের পরেও বসে। যেমন: তুমি তো সেই যাবেই চলে। তাকে দেখিওনি, চিনিও না।
তাহলে '-ই' বা '-ও'-কে কী বলব? আমার উত্তর: অব্যয়। এদের ভাবপ্রকাশক অনন্বয়ী অব্যয় বলা যেতে পারে হয়তো। '-ই' ব্যবহৃত হয় নিশ্চয়ার্থে, আধিক্যে, কৈবল্যে। আমি যাবই, যতই বলো না কেন, রামই পারবে ইত্যাদি।
সংস্কৃতের 'হি' এবং 'এব' অব্যয়দুটির কাজ বাংলায় '-ই' দিয়ে চালাই আমরা। ত্বং হি প্রাণাঃ শরীরে (তুমিই শরীরে প্রাণ), সত্যমেব জয়তে (সত্যই জয়লাভ করে)। অন্যদিকে '-ও' যে শুধু সংযোজক অব্যয়, তা নয়; এমনকি, অধিকন্তু, পর্যন্ত, মোটেই ইত্যাদি অর্থেও এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শিবেরও অসাধ্য; তুমিও যেয়ো; সে কালও আসেনি; আমি জানিও না, চিনিও না।
সংস্কৃতে 'অপি' দিয়ে যা বোঝানো যায়, বাংলায় '-ও' দিয়ে তা বোঝানো যেতে পারে। রামাদপি হি তং মন্যে ধর্মতো বলবত্তরম্। রামের চেয়েও…। এখানে অনন্বয়ী অব্যয় হিসেবে '-ও' যে ভাবপ্রকাশ করছে, সেটি এই: 'এমনকি’ রামের চেয়ে ভরত ধর্মে বলীয়ান।
আরও বলি। 'অনিল-ই যাবে।' এরকম না লিখে আমরা লিখি ‘অনিলই যাবে।’ তবে সেই/সে-ই, তাই/তা-ই, এই/এ-ই এসবের মধ্যে একটু পার্থক্য আছে।
সাধারণভাবে, হাইফেন (ও ঊর্ধ্বকমা) নিতান্ত প্রয়োজন না হলে লেখায় ব্যবহার না করলেই ভালো। 'দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক / তবে তাই হোক' (তা-ই) এবং "তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর" (তাই)। এই দুই তাই-এ সূক্ষ্ম প্রভেদটা বোঝাই যদি, তবে সহজ করে বোঝালে বলতে হয়, তাহাই-এর অর্থ যেখানে থাকবে, সেখানে ‘তা-ই’; সুতরাং/অতএব (so)-এর অর্থ বোঝালে হবে ‘তাই’। একইভাবে ‘ইহাই’ অর্থে ‘এ-ই’, বাকি সব ক্ষেত্রে ‘এই’; ‘সেই সময় আমি ওখানে ছিলাম না।’, কিন্তু ‘ব্যাপারটা সে-ই কেবল জানত।’
আরেক জায়গায় অসুবিধে হয়, তা হলো ‘যে’। এক্ষেত্রে সহজ বুদ্ধি হচ্ছে, নিতান্ত ঠেকে না গেলে ‘যে’-এর পরে হাইফেন দেওয়ার দরকার নেই। যদি এমন হয়, ‘যে’-এর ঠিক পরের শব্দটিকেই যে ‘যে’ দ্বারা নির্দেশ করা হচ্ছে, তা বোঝানো মুশকিল, তখন সেই শব্দ আর ‘যে’-এর মাঝে একটা হাইফেন দেওয়া যেতে পারে।
এখন আমাদের আলোচ্য -ই, -ও বিষয়ক কিছু আভিধানিক ও অন্যান্য তথ্য পেশ করি। বাংলাভাষার বিশিষ্ট অভিধানগুলি, যেমন যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সংসদ‌ এগুলিকে অব্যয় বলে স্বীকার করেছেন। প্রসিদ্ধ ব্যাকরণলেখক বামনদেব চক্রবর্তীও তা-ই করেছেন। সুনীতিকুমারও ভাষাপ্রকাশ-এ এদের সম্বন্ধ বা সংযোগবাচক অব্যয়ের মধ্যে রেখেছেন। ‘চলন্তিকা’ এদের কোনো শ্রেণিভুক্ত করেননি।
-ই যে হি থেকে, তা নিয়ে কারও মতভেদ নেই। (থাকবেই-বা কেন, প্রাচীন বাংলাসাহিত্যেই তো 'চলত হি অঙ্গুলি চাপি' প্রভৃতি পাওয়া যায়।) অপি থেকে যে -ও, তা-ও সকলেই স্বীকার করেন, কেবল হরিচরণ বলেন, ওটা চ থেকে। (এই ফাঁকে শিখিয়ে দিই: তাও, না কি তা-ও? ‘তবুও/তবু এলে না?’-কে লেখা যায়, ‘তাও এলে না?’ ‘সেটাও/সেটিও কি দেখিয়ে দিতে হবে?’-কে লিখব, ‘তা-ও কি দেখিয়ে দিতে হবে?’)
এবারে আসি অক প্রত্যয় প্রসঙ্গে। শিক্ষক, পরীক্ষক, জনক। এগুলো ণিজন্ত হয়ে তবে এই অক প্রত্যয় নিয়েছে, এইরকম বলা হয়। রঞ্জ্ থেকে রজক ও রঞ্জক শব্দদ্বয়ের তফাত লক্ষ করলে এটা বোঝা যায়।
বল্ ধাতু ণিজন্ত হতে পারে কি? এর অর্থ মনিয়র উইলিয়ামস দিচ্ছেন to breathe, to live. সেই অর্থ থেকে কি বলক-এ পৌঁছোনো যায়? কৌমুদী-তে নেই, পাণিনীয়ম্-এ নেই, ভাষাপ্রকাশ-এ উল্লেখমাত্র আছে। হরিচরণে কৃষক শব্দের পাশে বন্ধনীতে ছোঁয়াটুকু আছে। এইটুকু প্রমাণের ভিত্তিতে কি এত বড়ো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়?
আরও সমস্যা, 'বলক' বলে একটা শব্দই আছে অভিধানে, দুধ ইত্যাদি জ্বাল দেবার সময় উথলে ওঠা। তাহলে নতুন একটা 'বলক' আনতে চাইছি কেন? স্বার্থে ক ধরলে বলক-এর অর্থ দাঁড়াবে emphasis বা বলবিশেষ, emphasizer নয়। তবে সব থেকে বড়ো কথা, নতুন শ্রেণি তৈরি করার সময় ভেবে দেখা দরকার পদের সুনির্দিষ্ট শ্রেণির মধ্যে পদটি খাপ খায় কি না। -টা, -টি সেরকম কোনো শ্রেণিতে খাপ খাচ্ছিল না, তাই পদাশ্রিত নির্দেশক শ্রেণিটি গঠন করার প্রয়োজন হয়েছিল। যে পদগুলিকে এতকাল অব্যয় হিসেবেই ধরা হচ্ছিল, অব্যয়ের ওপর নিতান্ত খড়্গহস্ত হয়ে না উঠলে তাদের জন্য নতুন শ্রেণি বানাবার তেমন মানে আছে বলে মনে হয় না। অব্যয় অস্বীকার করে যদি নিত্যনতুন শ্রেণি বানিয়ে খেসারত দিতে হয়, তাহলে অস্বীকার করাটাকেই বিচক্ষণতা বলা চলে কি না প্রশ্ন ওঠে।
এগুলি যে অব‍্যয়পদ, সে-কথা এখন অবিসংবাদিত। সব অভিধানে এবং মান‍্য ব‍্যাকরণগ্রন্থে 'ই' এবং 'ও'-কে অব‍্যয় বলা হয়েছে। 'ই' এসেছে মূলত সংস্কৃত হি থেকে, 'ও' অপি থেকে। হরিচরণ যে চ থেকে এসেছে বলেছেন, মনে হয় উনি তখন সংযোজনমূলক (conjunction) 'ও'-এর কথা ভেবেছিলেন। চক্রবৎ পরিবর্তন্তে সুখানি চ দুঃখানি চ। (চ: সুখ ও দুঃখ।) কিন্তু আমাদের আলোচনা অনন্বয়ী ভাবপ্রকাশক অব‍্যয় নিয়ে। সেখানে অপি-ই হওয়া উচিত। তবে সেটা বড়ো কথা নয়। বাংলায় বা সংস্কৃতে প্রত‍্যয়, বিভক্তি বা পদাশ্রিত নির্দেশক বাদে বাক‍্যে প্রযুক্ত সব শব্দ পাঁচটি পদের মধ‍্যে পড়বে।
ইংরেজিতে অব‍্যয়ের তিনটি ভাগ আগেই করা আছে, বাংলায় অব‍্যয়ের মধ‍্যে বিভাগ ও উপভাগ আছে। তার কোনও একটি লাগসই হলে খামোখা আলাদা সংজ্ঞা উদ্ভাবন করার দরকার কী? তবে বর্ণনা আরও নির্দিষ্ট করার জন‍্য অব‍্যয়ের মধ‍্যে একটি উপনাম যে তৈরি করা যেতেই পারে। বলক একটি অপ্রচলিত শব্দ, তার ব‍্যুৎপত্তিও প্রশ্নাতীত নয়, সেটি দিয়ে এই দুটি অব‍্যয়কে বোঝাতে গেলে সরল না হয়ে ব‍্যাপারটা আরও জটিল হবে বলে আশঙ্কা হয়।




১২। 'খেলাচ্ছলে', 'ব্যাটাচ্ছেলে', 'হতচ্ছাড়া', 'মাত্রাছাড়া', 'ব্যাটাছেলে', এই সবকটি সমাসবদ্ধ শব্দেই অন্ততপক্ষে একটি পদ অতৎসম। তবু 'খেলাচ্ছলে', 'ব্যাটাচ্ছেলে' ও 'হতচ্ছাড়া'-য় 'চ্ছ' হলো একেবারে যেন খাঁটি সংস্কৃত সন্ধির নিয়ম মেনে, কিন্তু 'মাত্রাছাড়া'-য় তা হলো না। তেমনি, 'ব্যাটাছেলে' শব্দেও তা হচ্ছে না (এবং তা ভাব এবং প্রয়োগও 'ব্যাটাচ্ছেলে'-র থেকে ভিন্ন)।
'মাত্রাছাড়া' ও 'ব্যাটাছেলে' শব্দে সন্ধি না হবার ধ্বনিবিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা কী হতে পারে?
'মাত্রাছাড়া'-য় কি 'ত্র' এই যুক্তব্যঞ্জন বাধা হয়ে দাঁড়াল? আর ‘ব্যাটাছেলে’-তে অর্থ বদলে অন্য শব্দ হলো এবং তা সমাসবদ্ধ হলেও সন্ধির নিয়মে হয়নি বলেই কি এমন?




১৩। অধ্যাপক রমাপ্রসাদ দাস তাঁর 'ভাষার বনিয়াদ' বইয়ে বিশেষ নজর দিয়েছেন 'অমুক' ও 'তমুক' শব্দদ্বয়ের উপর। এই শব্দদুটি বেশ মর্যাদার সঙ্গে বিরাজ করে বাঙালির লেখায় ও মুখের কথায়; অন্য অনেক ভাষায় এ জাতীয় শব্দের এত জোরালো উপস্থিতি নেই। এই সূত্রে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, এরা কেন বাংলা ব্যাকরণে সর্বনামের তালিকায় স্থান পাবে না?
এই পর্যবেক্ষণ চমৎকার ও প্রশ্নটি সঙ্গত বলে আমার মনে হয়েছে। সত্যিই তো, সর্বনামের প্রচলিত তালিকায় তো 'অমুক', 'তমুক'-কে দেখি না। এর সঙ্গে আমি যোগ করতে চাই 'ইয়ে' শব্দটিকে। এরও সর্বনাম প্রয়োগ আছে। বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর নাকি 'ইয়ে'-র অভ্যেস একটু বেশিই ছিল। ভক্তিপ্রসাদ মল্লিক বা পূর্ণিমা সিংহ, না কি হারীতকৃষ্ণ দেব, কারও লেখায় পড়েছিলাম যে 'ইয়ের কাছ থেকে ইয়েটা নিয়ে ইয়েকে দিয়ে আসবি।' গোছের বাক্য তাঁর মুখে বিরল ছিল না।
অর্থবহ শব্দ না হলে শ্রেণিনির্দেশ করাও মুশকিল। 'ইয়ে' বিশেষণ হতে পারে, 'লোকটা কেমন জানি ইয়ে।', বিশেষ্য হতে পারে, ‘আজ ওর নাম কী, 'ইয়ে' এসেছিল।', এভাবে অনেক কিছুই হতে পারে। এটা একটা বহুবাচক গোঁজ শব্দ, যার অস্তিত্ব গোঁজ থেকে খোঁজ-এর তালিকায় আসার সময় হয়ে গেছে বহু আগেই।




১৪। ক্রিয়াপদ হল-তে ও-কার দিতে হবে, এটা শঙ্খ ঘোষের সুচিন্তিত মত। তাঁর দৃষ্টান্ত সত্ত্বেও, আমার মনে হয়, একটা নীতি মেনে বানান (বিশেষত ক্রিয়াপদের) লেখা ভালো, দেখতে যেমনই লাগুক। ‘হল’ না লিখে ‘হলো’ লিখব, কারণ ‘হল’ শব্দের ভিন্ন একটি অর্থ আছে, কিন্তু ছিল বা দিল লিখব, কেননা এতে কোনো গোল বাধে না। একই যুক্তিতে হব লিখলেও দেব লেখা যায় না, দেবো লিখতে হয়।
এ নিয়ে অনেক উদাহরণ আছে, যেমন ‘হয়’ লিখলে ঘোড়া মনে হতে পারে, ‘আয়’ লিখলে উপার্জন মনে হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে একথাও ঠিক, নিতান্ত ছাগল না হলে ওরকম কারও মনে হয় না। যেমন ইংরেজিতে I bow to you শুনে কারও মনে হয় না, আমি ধনুক-টনুক নিয়ে কোনো সর্বনেশে কাণ্ড করছি। মূল কথাটা হল, এই আলোচনাগুলোর ভিত্তি হবে morphology ও phonology, ‘গুলিয়ে-যাবে’টা arbiter হতে পারে না।
সহজ করে বলছি। অর্থবিযুক্ত ব্যাপার নয়, তবে এখানে উচ্চারণের একটা ব্যাপার আছে। যে ক্রিয়াপদ 'হল' দেখে লাঙল ভাববে, যার বাংলা উচ্চারণ 'হল্', তার তো সমস্যাটা আলাদা, ইংরেজি bow (বাও) ও bow (বো) যেমন। ‘হল’ শব্দের উচ্চারণটাই হো’লো’, তাই কনফিউশন তৈরি হলে (যেটা ‘আয়’, ‘হয়’ ইত্যাদি ক্রিয়াপদের বেলায় হয় না।) ‘হলো’ করে দেওয়াই সমীচীন, যে কারণে আমরা ‘দেব’-কে (দেবতা) করে দিই ‘দেবো’। ক্রিয়াপদে ‘হত’ (খুন) না লিখে ‘হতো’ লিখছি একই কারণে।




১৫। শব্দটি সাঙ্গোপাঙ্গ, এর কোনো বিকল্প হয় না। অনেকে অন্যমনস্কভাবে ভিন্ন বানান লিখতে পারেন, সম্পাদনার ফাঁক গলিয়ে ছাপায় তা টিকেও যেতে পারে; কিন্তু সেগুলিকে গুরুত্ব দেওয়া যায় বলে মনে হয় না। তবে আদ্যপ্রান্ত আর আদ্যোপান্ত একই রকম প্রহেলিকা সৃষ্টি করে।
‘আদ্যপ্রান্ত’ বলে কোনো শব্দ আছে কি না জানি না। এটা তো দ্বন্দ্বসমাস, আমরা যে 'প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত' বোঝাতে চাই, সে অর্থ কি এটা বহন করে? সাঙ্গপাঙ্গ/সাঙ্গোপাঙ্গ তবু উচ্চারণের ব্যাপার, কিন্তু ওটা তো অন্য কিছু। 'সাঙ্গোপাঙ্গ'-এর বেশ একটা শাস্ত্রীয় প্রয়োগও আছে, যেমন সাঙ্গোপাঙ্গ বেদ।




(চলবে . . . )