প্রাণ যখন জীবন হয়ে ওঠে/ চতুর্থ অংশ


১৫১। লোকে নিজের দোষ কৌশলে লুকিয়ে রাখলেও অন্যের দোষ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, এমনকী খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করতে বেশ পারদর্শী। যাদের দেখলে সাধু সাধু লাগে, ওদের বেশিরভাগই একেকটা ভণ্ড শয়তান!
১৫২। যদি আপনি বরাবরই স্পষ্টবাদী হন, তবে কখনও একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে পারেন। এতে কিছু মানুষের আসল চেহারা চিনতে পারবেন। একদিন খুব বিনয়ের সাথে, নম্রস্বরে কথা বলে দেখুন তো কী হয়! দেখবেন, কিছু লোক আপনার এই বিনয়কে দুর্বলতা ধরে বসে থাকবে, এবং আপনাকে ইচ্ছেমতো আক্রমণ করতে শুরু করে দেবে! এদেশে ভদ্রলোকের সংখ্যা খুবই কম, বেশিরভাগ মানুষই বিনয় ব্যাপারটা ডিজার্ভই করে না! নিজেকে সেইফ রাখার জন্য হলেও কিছু ফেইক অ্যারোগ্যান্স দেখাতেই হয়! আমি প্রকৃত অর্থে বিনয়ী বহু মানুষকেও খুব উদ্ধত আচরণ দেখাতে দেখেছি। সাধারণত মানুষ ভালোবাসার চাইতে ভয়কে সমীহ করে বেশি।
১৫৩। লোকে মুখে মুখে যতই বলুক, মনের সৌন্দর্যই বড়ো সৌন্দর্য, ঠিকই আলু, পটল, টম্যাটোর মতো বিয়ের পাত্রীর বেলায়ও বড়ো গুণ হিসেবে বাহ্যিক সৌন্দর্যকেই মুখ্য সৌন্দর্য ধরে।
১৫৪। অনিয়ম যখন নিয়ম হয়ে যায়, তখন সেই অনিয়মের নিয়মকে পালটাতে গেলেও অনেক অনিয়মের সৃষ্টি হয়। তার চাইতে বরং ভালো, সেই অনিয়মের নিয়ম মেনেই কাজ চালিয়ে নেওয়া।
১৫৫। কখনও কখনও সন্ধ্যা নামার আগেই ভরদুপুরে সূর্য ডুবে যায়। সেই দুপুরগুলি বড়ো দীর্ঘ হয়। তবে অমন দুপুরের শেষে সূর্যের আলো খুব ঝলমল করে জ্বলে! আলোটা দেখা অবধি অপেক্ষা করতে জানলে আলো এলে বড়ো ভালো লাগে!
১৫৬। গুছিয়ে মিথ্যা বলতেই সবচাইতে বেশি প্রতিভার দরকার পড়ে। এটা মস্ত বড়ো একটা আর্ট। অনেক বড়ো অবস্থানের মানুষের পাশাপাশি অবস্থানহীন মানুষও এমন আর্টের চর্চা নিয়মিতই করে থাকেন।
১৫৭। ‘ভুল ধরা’ ও ‘ভুল ধরিয়ে দেওয়া’, এই দুইয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। নিন্দুকেরা ভুল ধরবে খুঁত বের করতে, আর শুভাকাঙ্ক্ষীরা ভুল ধরিয়ে দেবে ভুল শুধরে দিতে। যখন কেউ আপনার ভুল নিয়ে কথা বলে, যখন দেখে নেবেন, তার আসল উদ্দেশ্যটা কী? আপনাকে ছোটো করে নিজেকে জাহির করা? না কি আপনার ভুল দেখিয়ে দিয়ে আপনাকে শোধরানোর সুযোগ করে দেওয়া? প্রথম ধরনের ব্যক্তিকে গলাধাক্কা মেরে জীবন থেকে বের করে দিতে একসেকেন্ডও চিন্তা করার কোনও দরকার নেই।
১৫৮। রক্ত আর বীর্য যদি জীবনেরই উৎস হয়, তবে কী করে জীবনের এই দুই উৎস অপবিত্র হয়? পবিত্রতা ও অপবিত্রতার অনুভূতিটা পুরোপুরিই বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতা থেকে সৃষ্টি।
১৫৯। স্রষ্টা কখনও আলাদা করে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সৃষ্টি করেননি, তিনি মানুষই সৃষ্টি করেছেন। জাতপার্থক্যটা আমরা নিজেরাই তৈরি করেছি। যদি কারও জন্য অন্য ধর্ম পালন করাটা মঙ্গলজনক হতো, তবে স্রষ্টা তাকে সেই ধর্মের কোনও ঘরেই পাঠাতেন। তবু খোদার উপর খোদকারি করে ধর্মান্তরিত হতে বলে যারা, তাদের চাইতে মূর্খ ও অধার্মিক আর কে আছে! স্রষ্টা যদি সবই জানেন, তবে তিনি তো নিশ্চয়ই এটাও জানেন, বাঁচার সময়ে কে কীভাবে বাঁচবে এবং মৃত্যুর পরেই-বা কে কোথায় যাবে! যদি স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসই করে থাকি, তবে এসব নিয়ে বলার বা মতামত দেবার আমরা কে?
১৬০। কিছু মানুষ সুখী হয় নিজে সুখে থাকলে এবং একইসঙ্গে অন্যে দুঃখে থাকলে। এরকম মানুষ সুখী হয় খুবই কম। এদের মধ্যে এমন মানুষও আছে, যারা নিজে তেমন সুখে না থাকলেও চলে, কিন্তু অন্যকে দুঃখে থাকতে ওদের দেখতেই হবে! অন্যের সুখ নষ্ট করতে নিজের জীবনের কিছু সুখ বিসর্জন দিতে পর্যন্ত রাজি থাকে ওরা! পরিচিত সবার ছেলেই রেজাল্ট খারাপ করেছে বলে নিজের ছেলের খারাপ রেজাল্ট করার ব্যাপারটাকে তেমন একটা গায়ে লাগান না, এরকম মানুষের সংখ্যা কম নয়!
১৬১। অধস্তন ব্যক্তির সাথে আপনার ব্যবহারই আপনার আসল পরিচয়। যার সঙ্গে আপনার ভালো ব্যবহার করার দরকার নেই, তার সঙ্গে আপনার আচরণটা কেমন, সেটাই দেখার বিষয়। বসের সঙ্গে বিনয় দেখায় না কে? সেখানে কেবলই বাধ্যতা থাকে, পরিচয় নয়। ওই চাকরিতে না থাকলে বসকে 'স্যার'-এর বদলে 'ভাই' সম্বোধন করলে অসুবিধে কোথায়? ব্যক্তিকে কেউ 'স্যার' ডাকে না, ব্যক্তির চেয়ারটিকেই ডাকে। তাই অফিসের ভেতরকার সব আচরণের মধ্য দিয়েই ব্যক্তির প্রকৃত চেহারা ঠিক চেনা যায় না।
১৬২। জিতে গেলে মানুষকে যতটা চেনা যায়, তার চাইতে অনেক বেশি চেনা যায় সে হেরে গেলে। জিতে গেলে মানুষের পা অনেক ধরনের শেকলে আটকে যায়, কিন্তু হেরে গেলে সে হয়ে যায় আগের চেয়েও মুক্ত। তখন মানুষের আসল চেহারাটা বুঝতে সুবিধে হয়। জিতে-যাওয়া মানুষের চেহারা বোঝার চাইতে হেরে-যাওয়া মানুষের চেহারা চেনা সহজ।
১৬৩। যে কাজে আপনি সফল হতে চান, সে কাজে অন্যরা কীভাবে সফল হয়েছে, তা জানার চেয়ে জরুরি হচ্ছে, সে কাজে অন্যরা ঠিক কী কী কারণে বিফল হয়েছেন, তা জেনে রাখা, যাতে সেগুলি খুব সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলা যায়। তবে এখানে এটাও মনে রাখা জরুরি যে যে পথে চলে একজন সফল হয়েছেন, ঠিক সে একই পথে চলেই আরেকজন চরম ব্যর্থ হতে পারেন। সাফল্যের কোনও সর্বজনীন সূত্র নেই। একেক জন একেক পথে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছোয়।
১৬৪। সাফল্য আপনাকে যা শেখাবে, ব্যর্থতা আপনাকে তার দশ গুণ বেশি শিখিয়ে দিয়ে যাবে। মানুষ জীবনে সফলভাবে এগোয় মূলত ব্যর্থতার উপর ভর করে করেই।
১৬৫। যদি আত্মহত্যার ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা না থাকত, তবে পৃথিবীর অনেক মানুষই বেঁচে থাকত না। ধর্মের এই সৌন্দর্যটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। মানুষ বাঁচতে চায় না বলে আত্মহত্যা করে না, বাঁচতে চেয়েও পারে না বলে আত্মহত্যা করে।
১৬৬। মানুষ তার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো লেখাপড়ার পেছনেই খরচ করে ফেলে। বাকি সময়গুলো অন্যদের সুখী করার দায়িত্বপালনে নষ্ট করে। মানুষ যাদের সুখী করতে গিয়ে নিজের সুখ বিসর্জন দেয়, তারাই তাকে ভুল বোঝে সবার আগে! নিজের মতো করে নিজের জন্য সময় কাটাতে পারে না বলেই মানুষ অসুখী হয়ে বেঁচে থাকে।
১৬৭। যদি আপনি ঠিক হয়ে থাকেন, তাহলে ব্যাখ্যার কোনও প্রয়োজন নেই। যদি আপনি ভুল হন, তাহলে ব্যাখ্যার কোনও মানেই হয় না। এ কারণেই খুব দায়ে না পড়লে নিজেকে কখনওই এমন কারও কাছে ব্যাখ্যা করবেন না, যার কাছে ব্যাখ্যা দিতে আপনি বাধ্য নন।
১৬৮। কাঁদতে হয় একা একা। এরকম একলা কান্না মানুষকে মনের দিক থেকে শক্তিশালী করে তোলে। যার সম্পর্কে আপনি পুরোপুরি নিশ্চিত নন, তার সামনে কাঁদার মানেই হলো, নিজেকে বিপদে ফেলে দেবার আয়োজন করা।
১৬৯। মানুষটির কথায় আপনি হেসেছেন, এর মানে, আপনি তাকে পছন্দ করেন। তার কথায় আপনি কেঁদেছেন, এর মানে, আপনি তাকে ভালোবাসেন। মানুষ ভালোবাসার মানুষের কথা ভাবতে গিয়েও চোখে জল এনে ফেলে! সব কান্নাই কষ্ট থেকে আসে না, পৃথিবীর সুন্দরতম কান্নাগুলি আসে ভালোবাসা থেকে।
১৭০। যেদিন আপনি বুঝতে পারবেন, আপনি আর কাউকে ভালোবাসেন না, কিংবা খুব ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ভালোবাসতে পারছেন না, তার অর্থ হলো, বয়স যত কমই হোক, আপনার মধ্যে মানসিক বার্ধক্য নেমে এসেছে। কারও জন্যই ভালোবাসা অনুভব করতে না পারার চাইতে বড়ো অসহায়ত্ব আর হয় না।
১৭১। মানুষ বক্তার চেয়ে শ্রোতাকেই বেশি ভালোবাসে, অথচ সবাই পুরোদমে বক্তাই হতে চায়! আমরা যদি চাই, সবাই-ই আমাদের শুনুক, তবে কেন আমরা ধরেই নিচ্ছি, ওরাও আমাদের মতো করেই চায় না?
১৭২। পৃথিবীর সবার মা-বাবা’ই যদি সৎ, দয়ালু, শ্রেষ্ঠ ভালোমানুষ হয়, তাহলে জগতের এত এত পাপ, অন্যায়, অনিয়ম করে কার মা-বাবা?
১৭৩। একটি গভীর নীরবতা শত শত তীব্র চিৎকারের চেয়েও অনেক বেশি কোলাহলের জন্ম দেয়। যেখানে একটিও বর্ণ নেই, সেখানেই বসে কথার বিস্তীর্ণ মেলা!
১৭৪। জগতে এক ‘আমি’ ছাড়া বাকি সবাই খারাপ! এরকম করে ভাবতে জানাটাও অনেক বড়ো একটা ব্যাপার! অতটা মানসিক অসুখ নিয়েও বেঁচে থাকা যায়!
১৭৫। প্রায় সময়ই, সম্পর্কের মধ্যে অর্থের বিষয় ঢুকে গেলে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। যার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখাটা জরুরি, তার সঙ্গে কখনও অর্থের একটিও হিসেব রাখতে হয় না। এক অর্থের কারণেই অনেক ভালো সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। যার মধ্যে আর্থিক স্বচ্ছতা নেই, তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা খুব কঠিন।
১৭৬। কী পেলে তুমি খুশি হবে, তা জানতে চাইলে প্রথমেই তোমার একাকিত্বকে জয় করো। যে মানুষটা একা ও অসুখী, সে হয় একাকিত্বের কারণে অসুখী, কিংবা এমন একটা কারণে অসুখী, যে কারণটা খুঁজে বের করতে হলে সবার আগে নিজেকে একাকিত্ব থেকে মুক্তি দিতে হবে। একাকিত্ব মানুষকে এতটাই অন্ধ করে দেয় যে মানুষ তখন খুব সাধারণ বিষয়গুলিও আর সহজে দেখতে পায় না।
১৭৭। জীবনের প্রতিটি পর্বের সুখানুভূতি সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা। সুতরাং জীবনের পূর্ণ স্বাদ পেতে চাইলে আগে প্রতিটি মুহূর্ত ঠিক যেমন, তেমন করেই একে গ্রহণ করতে শিখতে হয়। এখানে কোনও জাজমেন্ট চলে না, উচিত অনুচিত-এর হিসেব চলে না। জীবন যেমন, তেমনই...শেষপর্যন্ত!
১৭৮। যারা নিজেকে সঙ্গে নিয়ে চলে না, তারা সবসময় সব পরিস্থিতিতেই অসহায়। মানুষ পুরো পৃথিবীসুদ্ধ মানুষকে সঙ্গে রেখে চলতে চায়, অথচ নিজেকেই নিজের সঙ্গে রাখতে ভুলে যায়। গোটা পৃথিবীকে পেয়েও কী লাভ যদি নিজেকেই হারিয়ে বসে থাকি?
১৭৯। যখন সমস্যাগুলো একান্ত আমার নিজের কারণেই সৃষ্ট, তখন অন্যের কাছে সেগুলির সমাধান খোঁজা বোকামি। প্রায় মানুষই অন্যের সমস্যার কথা শুনে শুনে স্রেফ মজা নেয়। আমরা যেন মাথায় রাখি, এ পৃথিবীর মোটামুটি কারুরই আমার নিজের সমস্যায় কিছুই এসে যায় না। যদি সে-ও আমার সমস্যার সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। আর যদি না থাকে, তবে সত্যিই, আমার মৃত্যুতেও তার কিছুই এসে যায় না। তার জায়গায় আমি থাকলেও একই কথাটা খাটত। বিনা মূল্যে বা বিনা কারণে কেউ কাউকে কোয়ালিটি টাইম দেয় না। যারা দেয়, তাদের কাছ যা পাওয়া যায়, ওটাকে ঠিক 'কোয়ালিটি টাইম' বলা যায় না।
১৮০। ছেলেরা তার ভালোবাসার মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখতে ভালোবাসে। মেয়েরা সব বুঝেও তার ভালোবাসার মানুষের কাছে বোকা হয়ে থাকতে ভালোবাসে। এই জিতটা আসলে ভালোবাসার, যদিও দুই পক্ষই মনে মনে ভাবে, আমি জিতেছি!
১৮১। মাঝে মাঝে কিছু পূর্বঅভিজ্ঞতা এবং সময় তোমাকে নিষ্ঠুর হতে বাধ্য করবে। যার জীবন সরলপথে চলেনি, তার কাছে নিষ্ঠুরতা সহজ ও স্বাভাবিক। যদি তুমি তোমার জীবনে আমার মতো এতটা ধাক্কা ও লাথি ইতোমধ্যেই খেয়ে না থাকো, তবে অনুগ্রহ করে আমাকে জীবনের লেকচার দিতে এসো না। আমি যে স্কুলের সিনিয়র ক্লাসের মাস্টার, তুমি সে স্কুলের জুনিয়র ক্লাসেও কখনও বসোনি!
১৮২। পৃথিবীতে কিছু বিষয়ের একমাত্র সমাধানই হচ্ছে, ‘এর কোনও সমাধান নেই।’, যা কিনা তোমাকে বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিতে হবে! যার সমাধান নেই কিংবা সমাধান থাকলেও সেটি খুঁজতে গেলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু জীবন থেকে হারাতে হবে, তার সমাধান যতই খুঁজবে, ততই সময় নষ্ট হবে ও দুঃখ বাড়বে। এ পৃথিবীতে কোনও কিছুই তো অপরিহার্য নয়, তাহলে একটা বিষয় নিয়ে এমন মাথা খারাপ করে ফেলার কী মানে আছে?
১৮৩। মানুষের আবেগের মূল্য নির্ধারণের শক্তি টাকারও নেই! তাই যারা টাকার মাপে মানুষ মাপে, তাদের কাছে ভুলেও নিজের আবেগ দেখাতে যাবেন না। কিছু লোক এতটাই পথের ফকির যে ওদের কাছে এক টাকা বাদে আর কিচ্ছু নেই। ওরকম যারা, তাদের ধারেকাছেও নিজের আবেগের ঝুলিহাতে ভুল করেও ঘেঁষবেন না, ঘেঁষলে অনেক দুঃখ পাবেন।
১৮৪। যে জিনিস যত বেশি অমূল্য, তা জেতার মূল্য তত বেশি। তাই, খুব কষ্ট করতে হচ্ছে, অমুক অমুক তো ঘুমোচ্ছে---আমি কেন এত খাটব, এত যন্ত্রণা চুপচাপ মেনে নিই কী করে, এ ধরনের কথাবার্তা বলে বা ভেবে কোনও লাভ নেই। বেশি পেতে চাইলে বেশি দিতে হয়, এই নিয়মের বাইরে কেউই যেতে পারে না।
১৮৫। যতটা পারা যায়, নিজেকে নিজের পছন্দের হয়ে ওঠাটা খুবই জরুরি। যে মানুষ, সে নিজে যেরকম আছে, তা-ই পছন্দ করে না, তার পক্ষে নিজের জন্য বাঁচা কিংবা নিজেকে সম্মান করা খুবই কঠিন। যে তার কাজ ও অবস্থানকে ভালোবাসে, তার কাছে জীবনটাকে সহনীয় ও সুন্দর মনে হয়।
১৮৬। যারা বলে, সময় কাটে না, ধরে নিতে হবে, তাদের জীবনে ভালোলাগার বা ভালোবাসার তেমন কোনও কাজ নেই। থাকত যদি, তবে সেই কাজের পেছনেই জীবনের অনেকটা সময় অনায়াসেই কাটিয়ে দিতে পারত তারা। সৃষ্টিশীল মানুষের হাতে সময়ই তো থাকে না! বসে-শুয়ে কাটানোর সময়ও ওরা একধরনের অপরাধবোধে ভোগে এই ভেবে যে, এই সময়টাতে কিছু-না-কিছু তো সৃষ্টি করতে পারতাম!
১৮৭। ব্যক্তিস্বাধীনতা পাবার আগে শালীনতা আয়ত্ত করা উচিত, নয়তো ব্যক্তিস্বাধীনতা বিপদ ডেকে আনতে পারে। শালীনতা কী? এটা হচ্ছে নিজেকে এমনভাবে প্রকাশ করা, যাতে নিজেই সেই স্টাইলটা ক্যারি করতে পারে ও আশেপাশের মানুষ তা যেভাবেই নিক না কেন, তা-ও ক্যারি করার কায়দা জানা থাকে।
১৮৮। আমরা আসলে আরও বড়ো বড়ো কষ্টের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেবার জন্যই প্রস্তুত হচ্ছি। সুখের মানে হচ্ছে, কষ্টকে সহ্য করতে শিখে যাওয়া। দুঃখ আসলে কমে না, আমাদের মানিয়ে নেবার ক্ষমতাটাই শুধু বাড়ে। মেনে ও মানিয়ে নিতে জানলে কষ্টকেও সুখের মতো লাগে। এই বিবেচনায় সুখ ও কষ্ট, দুই-ই আপেক্ষিক। আমার কাছে যা সুখ, তা-ই হয়তো আপনার কাছে কষ্ট।
১৮৯। আমাদের সাহস আমাদের সবচেয়ে বড়ো যোগ্যতা, আমাদের ভয় আর সন্দেহ আমাদের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা। যা কিংবা যাকে ভয় করি, তার কিছুই হয় না; যা কিংবা যাকে সন্দেহ যাকে করি, তার কিছুই হয় না। মাঝখান থেকে কেবল মনের শক্তি কমে গিয়ে নিজেরই ক্ষতি হয়।
১৯০। তোমাদের কাছে কী জবাব দেবো, সে নিয়ে আমার মোটেও মাথাব্যথা নেই। আমি যে নিজেকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পাই! পুরো পৃথিবীর কাছেও আমি মাথা নত করতে রাজি, যদি নিজের কাছে মাথাটা উঁচুই থাকে। আমার কাছে জেতার মানেই নিজের কাছে জিতে যাওয়া। এর জন্য যা যা হার আমাকে মানতে হয়, সেসব মেনে নিতে আমার কোনও আপত্তি নেই।
১৯১। ভারসাম্যহীনতা সব কিছুর সৌন্দর্যই নষ্ট করে দেয়। হাত বাড়ালেই যা পাওয়া যায়, তা সবসময়ই হাত বাড়িয়ে নেওয়া ঠিক নয়। হাত বাড়ালেও যা পাওয়া যায় না, তা হাত বাড়িয়ে নেবার জন্য নিজের সমস্ত কিছু বিসর্জন দেওয়াও ঠিক নয়। দুই ক্ষেত্রেই চরম মূল্য দিতে হতে পারে।
১৯২। অনেকের উপকার করার প্রবল ইচ্ছে আছে, কিন্তু ক্ষমতা নেই। অনেকের উপকার করার উপযুক্ত ক্ষমতা আছে, কিন্তু ইচ্ছে নেই। উপকার করতে চাইলে উপকার করতে পারার মতো ক্ষমতা ও ইচ্ছে, দুই-ই জরুরি। তবে বেশিরভাগ মানুষই অন্যের উপকার না করে প্রার্থনা করছে বলে দাবি করে। ওটা করাটা, অপেক্ষাকৃত সহজ, আর না করলেও তা প্রমাণ করার কোনও উপায়ই নেই---ফলে নিরাপদও।
১৯৩। অন্যের প্রতি প্রত্যাশা যার যত কম, অন্যকে ভালোবাসার ক্ষমতা তার তত বেশি। যে ভালোবাসা প্রত্যাশার দাবি রাখে, তা যতটা ভালোবাসা, ততোধিক হিসেব। ভালোবাসে যে, সে তো ভালোবাসতে ভালো লাগে বলেই ভালোবাসে। যাকে ভালোবাসে, তার তো ভালোবাসতে ভালো না-ও লাগতে পারে, তাই না? ভালোবাসা তো আর কোনও ব্যাবসা নয় যে দেবার বদলে পেতেই হবে!
১৯৪। ভালোমানুষদের একটা সহজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে, খারাপ মানুষের কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করা। এ কারণেই ভালোমানুষ খুব দ্রুতই বিরক্তিকর হয়ে ওঠেন। এ পৃথিবীর বেশিরভাগ মনভোলানো ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের মানুষই মানুষ হিসেবে খারাপ।
১৯৫। বাহ্যিক দৃষ্টিতে সবচাইতে কঠিন মনের পেছনে প্রায়ই সবচাইতে নরম মনটি থাকে। মানুষ কঠিন হয়, কেননা জীবন তাকে বাধ্য করে। নরম মানুষদের পিষে ফেলার লোকের কোনও অভাব নেই।
১৯৬। যতক্ষণ না বদমায়েশি করতে শিখবে, ততক্ষণ বদমায়েশি সহ্য করতে হবে। ভালোত্বের দাম দেয়, এমন মানুষ হাতেগোনা। প্রায় ছোটোলোকই সবাইকে নিজের মতো ছোটোলোক ভাবে, এবং ওরকম ভাবনা থেকে ক্রমাগত ছোটোলোকি করে। নিজে ছোটোলোক হন না হন, ছোটোলোকদের সঙ্গে অত বিনয় দেখালে সারাজীবনই কাটবে ছোটোলোকি সহ্য করতে করতে।
১৯৭। প্রথমে ওরা নীরবে আমাদের সংস্কৃতিতে ওদের নিজস্ব বীজ বপন করবে, অতঃপর গাছ হয়ে আমাদের মাঝেই তাদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তার করবে। আমরাও একদিন নিজস্ব সংস্কৃতি হারানোতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ব। তখন দেখব, অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও কেবল লাঠিতে ভর করে চলতে পারলেই আমরা খুব খুশি!
১৯৮। আমি আমার নোংরা কাপড়চোপড় চোখের সামনে না রাখলে ভুলেই যাই যে ওগুলো ধুতে দেওয়া প্রয়োজন---ঠিক তেমনি সব কিছু!
১৯৯। নিজেকে অন্যের সামনে দুর্বলভাবে প্রকাশ করা নিজেকে অসম্মান করার সমকক্ষ। তবে যদি এমন হয় যে ওরকম দুর্বলভাবে প্রকাশ করাটা অভিনয়েরই একটা অংশ, যে অভিনয় নিজেকে জেতায় বা ভালো রাখে, তবে অমন দুর্বলতা সবলতারই নামান্তর। এ পৃথিবীতে অনেক অসুস্থ মানসিকতার মানুষ আছে, যারা অন্যকে দুর্বলভাবে প্রকাশিত হতে দেখলেই আনন্দ পায়। যদি ওরকম কারও কাছ থেকে কিছু আদায় করার থাকে, তবে দুর্বলতার ওরকম সফল মঞ্চায়নে অসুবিধে কোথায়?
২০০। মানুষ ভুল করে সিদ্ধান্ত নেবার পরিপক্বতার অভাবে। ভুল করার পর যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেগুলো কিন্তু সঠিক! তা থেকেই প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসে। জীবনের শুরুতে খুব বড়ো কোনও ভুল করার সবচাইতে বড়ো সুবিধে হলো, জীবনের মাঝে ও শেষে ছোটো ছোটো ভুল নিয়েই আরামে জীবন কাটানো যায়।