প্রকৃতি যখন ডাকে…

যখন জার্নিতে থাকি, তখন যদি প্রকৃতি ডাকে, এবং সেই ডাক মৃদু থেকে তীব্র, তা পেরিয়ে তীব্রতর পর্যায়ে চলে যায়, তবে সেই মুহূর্তে মনে হতে থাকে, কেউ যদি এখন অনুগ্রহ করে তাঁর টয়লেটটি আমাকে কিছু সময়ের জন্য ধার দিতেন, তবে আমি বিনা দ্বিধায় হাসিমুখে আমার নিজের লেখা প্রিয় কবিতাটি তাঁর নামে লিখে দিতাম। এতে তিনি খুশি হতেন কি না জানি না, তবে এই স্বত্বত্যাগ মোটেও ছোটো কোনও ঘটনা নয়---অন্তত আমার চোখে, কেননা নিজের সম্পত্তি লিখে দেওয়া কঠিন কিছু নয়; তবে সৃষ্টি লিখে দেওয়া অবশ্যই কঠিন, কেননা তা লিখে দিতে চাইলে নিজের সৃষ্টি থাকতে হবে, যা এ পৃথিবীতে হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন মানুষের থাকে।

তো যা বলছিলাম। কেন নিজের লেখা কবিতা সেই সহৃদয় ব্যক্তির নামে লিখে দিতাম, তা জানাই। কবিতাটি লিখে আমি সেই সময় যে শান্তি পেয়েছিলাম, এবং তাঁর টয়লেটটি ধার পাবার স্বপ্নে বিভোর আমি যে শান্তির আশায় ছটফট করছি, এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য খুব সামান্যই, অন্তত পরিস্থিতির তীব্রতা বিবেচনায়। সৃষ্টিবেদনা ও ত্যাগতাড়না, দুই-ই মোটামুটি একই রকমের অনুভূতির জন্ম দেয়।

তখন আমি সুনামগঞ্জে। আমার অতিপ্রিয় নীলাদ্রি লেকের ধারে যা যা আছে ঘুরে ঘুরে দেখছি। হঠাৎ করেই প্রকৃতির চাপ অনুভব করলাম। সেই চাপ চেপে রাখতে পারার পর্যায়টি লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে আমাকে চুপসে দিতে লাগল ক্রমাগত। প্রকৃতির অমন অপূর্ব লীলাভূমিতে প্রকৃতির চাপ সামলানোর পবিত্র দায়িত্ব সেই সময় প্রকৃতির হাতেই ন্যস্ত ছিল, তবে সেই দায়িত্বটুকু পালন করতে সায় দেবার মতন সাহস কিংবা অবস্থান কোনোটাই আমার ছিল না। অগত্যা সমস্ত লাজলজ্জা ও কুণ্ঠা ঝেড়েছুড়ে কাছেই এক গৃহদ্বারের দ্বারস্থ হলাম। লাজুকতা ধরে রাখবার চাইতে চাপমুক্ত হ‌ওয়াটা অধিক জরুরি, কেননা লজ্জাশরমের ব্যাক‌আপ কপি থাকলেও পরনের ওই প্যান্ট ও অন্তর্বাসের কোনও ব্যাক‌আপ কপি আমার সঙ্গে ছিল না। হায়, ডায়াপারের দিন শেষ তো দুঃখের দিন শুরু!

সৌভাগ্যক্রমে সেই ঘরের মালিকের ছেলেটি আমাকে চিনত। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সেই উদার ছেলেটি আমাকে দেখেই আবেগে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরল; আর তার আবেগমথিত ঔদার্যের চাপে ও ঠ্যালায় আমার অবস্থা আরও বেগতিক ও করুণ হয়ে গেল! দাদা, আপনি আজ খেয়ে যাবেন, আপনি আজ আমাদের বাসায় থাকবেন, আমি আপনার অনেক বড়ো ফ্যান, আপনাকে আমি অনেক ভালোবাসি, আমার জীবনে আপনার অবদান অনেক...ইত্যাদি ইত্যাদি জাতীয় খেজুরে আলাপ জুড়ল যখন, তখন আমার চিৎকার করে বলতে মন চাইল, ভাই শিম্পাঞ্জি, এই মুহূর্তে তোর বাসার টয়লেটের কাছে আমার প্রিয়তমার সমস্ত শারীরিক ভালোবাসাও তুচ্ছ! তবু...আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার!!!

লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেললাম, ভাই, আমি আর পারছি না! টয়লেটটা কোন দিকে? তার অগাধ ভালোবাসার প্রকাশ এভারেস্টের চূড়ায় গিয়ে ঠেকল তখনই, যখন আমি গৃহস্থ শান্তিনিকেতনে প্রবেশের ঠিক আগ মুহূর্তে ছেলেটি তার তরুণপ্রাণের আন্তরিক উচ্ছ্বাসে উদ্‌বেলিত হয়ে বলেছিল, দাদা, আমাকে এখন‌ই একটু বাইরে যেতে হচ্ছে জরুরি একটা কাজে। আপনি টয়লেটে ঢোকার আগে একটা সেলফি তুলতে চাইছিলাম! দাদা, এটা আমি ফেইসবুকে প্রোফাইল পিকচার করব! আপনাকে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসি!

এদিকে আমার মনে ক্রমাগত বেজেই চলেছে ক্রন্দন হাহাকার...আম্মু, তুমি আমাকে এই নিষ্ঠুর বেআক্কেল মানুষগুলোর পৃথিবীতে আনলে কেন কেন কেন...?! আনলেই যদি, তবে কেন টয়লেট করতে শেখার আগেই আমাকে নুন খাইয়ে মেরে ফেললে না, আম্মুউউউ...!?

না, সে কথা রাখেনি। একটার কথা বলে সে তার নিজের হাতে এবং আমার হাত দিয়ে ছয়টা সেলফি তুলল ও তোলাল। অতিকষ্টে বিরক্তি চেপে রেখে প্রকৃতির চাপে পিষ্ট চেহারাসুরত ফুটো করে অসহায় ঝকঝকে দাঁতগুলো বের করে পোজ দিতে দিতে এবং নিজেকে নিম্নাঙ্গের পেশির কসরতের উপর ভর করিয়ে করিয়ে বিকৃত অবয়ব গিলতে গিলতে ও লাফাতে লাফাতে নিজেকে মোটিভেশন দিচ্ছিলাম...উপায় নেই, গোলাম হোসেন, উপায় নেই!

সেলিব্রিটিগিরির-মায়েরে-বাপ জাতীয় তীব্র চেতনায় গুরু নিম্নচাপে যে সেলফির জন্ম দিয়েছিলাম, তা ভাইটির লাইকোদ্দেশ্য কতটুকু পূরণ করতে পেরেছিল জানি না, তবে এটা আরও এক বার নিশ্চিতভাবে বুঝে নিয়েছিলাম, কিছু পেতে চাইলে কিছু দিতেই হয়। বিনা সেলফিতে নাহি দিব সূচ্যগ্র প্রশান্তি! হয় আমার রাস্তায় আসো, নয় তোমার রাস্তায় হাগো!

আমি সেই ছেলেটির কাছে ঋণী। ভালোবাসা তো এ জীবনে অনেকেই দিল, শান্তি দিল ক'জন‌‌ই-বা!? ভাইয়া, আপনাকে অনেক ভালোবাসি, আপনার সব স্পিচ শুনি, আপনার সব লেখা পড়ি, আমাকে একটু অমুক পরামর্শ দেন...তমুক মোটিভেশন দেন...সমুক কাজে দেখা করার/কথা বলার সুযোগ দেন! এইসব নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বাহার দেখে আমি সত্যিই খুশিতে নাচতে থাকি এবং গলা ছেড়ে গাইতে থাকি...বলো বলো, আরও বলো, লাগছে মন্দ নয়!! একসমুদ্র ভালোবাসা পাবার চাইতে বিকাশে-নগদে-রকেটে-প্লেনে দশটাকা পাওয়াও বেশি কাজের। ভালোবাসা দিয়ে কী ঘোড়ার ডিমটা হয়, যদি তা শান্তি না দেয়?! কাউকে নিজের বুকে জায়গা দেওয়া তো সহজ, তবে তার প্রয়োজনের সময় তাকে নিজের টয়লেটে জায়গা দেবার নাম‌ই টুরু-লাভ! তাই আপনাদের এইসব ফাও ভালোবাসার ভিড় ঠেলে আমি সেই ভাইটিকে খুঁজে বেড়াই, যে আমাকে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল। তাকে আমি কোন‌ও কবিতায় রাখিনি, ওসব ছোটোখাটো জায়গা তো নির্বোধ প্রেমিকাদের প্রবোধ দেবার জন্য সৃষ্ট; তাকে আমি এই হৃদয়ের নিগূঢ়তম প্রকোষ্ঠে রেখেছি!