দ্বিতীয় কবর (প্রথম অংশ)



পড়াশোনা করতে ভালোবাসতাম, ক্লাসে সবসময়ই মোটামুটি ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলাম। স্কুলজীবন থেকেই স্বপ্ন ছিল, বড়ো হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাব। তবে মফস্বল শহরে থেকে এই স্বপ্নদেখাটা একটু বেশিই আকাশছোঁয়া মনে হতো।


মা-বাবার প্রথম সন্তান ছিলাম আমি। মা সবসময়ই দায়িত্ববান হতে শেখাত আর বলত, বড়ো সন্তানদের হজমশক্তি থাকতে হয় ভালো; দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, অন্যায়-অবিচার, অপমান এরকম অনেক কিছুই তাদের নীরবে গিলতে হয়। তবে আমি ছিলাম বেশ রাগী, আমার মধ্যে প্রচণ্ড আত্মসম্মানবোধ আর জেদ কাজ করত। আমরা আর্থিক দিক থেকে বেশ সচ্ছল ছিলাম, বাবা বোলপুরে একটা চাকরি করতেন; আমি, মা, আর আমার ছোটো বোন বোলপুরে বাবার সাথেই থাকতাম।


আমার বোন পড়ালেখায় অতটা ভালো ছিল না, ও আমার তিন বছরের ছোটো ছিল; দেখতে ভীষণ মিষ্টি, তাই আদর করে বাবা নাম রেখেছিলেন খুশবু! বাড়ির বড়ো আপুরা যখন বলে, আমিও নাকি দেখতে মিষ্টি একটা ছেলে, তখন তা শুনে লজ্জা পেতাম। আমার নামটাও বাবাই রেখেছিলেন, সৌরভ।


বাবা স্বভাবতই সুগন্ধি জিনিস ভালোবাসতেন, তাই আমাদের দুই ভাই-বোনের এমন নাম-রাখা।


২০০৪, ফেব্রুয়ারি।


আমি তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। খুব তোড়জোড় করে পড়াশোনা চলছে; লক্ষ্য, সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়া। আমার উপর সবার অনেক বিশ্বাস, তা কিছুতেই ভাঙতে দেওয়া যাবে না, এমন একটা চিন্তা মাথায় রেখে এক এক করে সবকটা পরীক্ষা শেষ করলাম।


শেষ দিন পরীক্ষা দিয়ে এসে আমি টানা আঠারো ঘণ্টা ঘুমিয়েছিলাম! আমাদের টেস্ট পরীক্ষার পর থেকে এসএসসি পরীক্ষার শেষ পযর্ন্ত প্রতিদিনই আমি একটা রাতের শেষপ্রহরের তিন ভাগের এক ভাগ সময় ঘুমোতাম। আমার শরীর, মন, এমনকী চোখদুটোও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। বিছানায় শুয়ে প্রথমেই স্কুলে কাটানো গোটা পাঁচ বছর চোখের সামনে ভেসে উঠল। কত স্মৃতি, কত মুহূর্ত, কত-না প্রহর সেখানে কেটেছে; বিশেষ করে শেষ দু-বছরের স্মৃতি বারে বারে মনে ভেসে উঠতে লাগল! অনেক কিছু বুঝতে শিখেছি, মানুষ চিনতে শিখেছি, বাস্তবতার সাথে পরিচয়টাও সেরে নিয়েছিলাম। আমার ক্লাসে মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ছিল সুধা, দ্বিতীয় বলতে প্রাক্তন প্রথম।


ক্লাস এইটে সে প্রথম ছিল, আমি দ্বিতীয়। জেএসসি পরীক্ষায় আমরা দু-জনই এ-প্লাস পেয়েছিলাম, কিন্তু বৃত্তি আমি পেয়েছিলাম, ও পায়নি; তাই ক্লাস নাইনে স্বাভাবিকভাবেই আমি প্রথম, ও দ্বিতীয়। ব্যাপারটা ও কোনওভাবেই মেনে নিতে পারেনি। বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হবার পর, কয়েক দিন ক্লাসে সুধা আমার সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করত, সবসময় আমাকে অপমান করার সুযোগসন্ধানে থাকত। আমার সাথে তার প্রতিযোগিতা চলত রীতিমতো বেদম হারে। তার সাথে কিন্তু আমার কোনও প্রতিযোগিতা ছিল না! আমি ওকে ওরকম চোখে দেখতামই না কখনও। কিন্তু সুধা আমাকে মোটেও সহ্য করতে পারত না।


সুধা দেখতে ছিল ক্লাসের মেয়েদের মধ্যে সব থেকে মায়াবিনী, অন্তত আমার চোখে। সুন্দরী বলতে সবাই যা বোঝে, লম্বা-ফরসা হতে হবে, আমি কিন্তু মোটেও ওরকম ভাবতাম না। সুধা লম্বা ছিল না, তবে ফরসাই ছিল, তার চোখে-মুখে একধরনের মায়া জড়ানো ছিল। এক বার তাকালে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করত। এমন মায়াবিনী হরিণীর সাথে কেউ কি আর লাগতে যায়! তবে আমি তার চক্ষুশূল ভাবতেই আমার খুব অসহায় অসহায় লাগত।


যখনই সুযোগ পেত আমাকে অপমান করার, দুটো কড়া কথা শোনাতে ছাড়ত না সে। আমাদের ধর্মের স্যার ছিলেন বেজায় রাগি আর খুব কড়া নিয়মের মানুষ। তাঁর নাম ছিল আজমল স্যার, তিনি যেমন লম্বায় ছিলেন প্রায় ছয় ফুট ছুঁই ছুঁই, তেমন ছিল তাঁর লাল লাল বড়ো বড়ো চোখ। তাঁকে সবাই ভয় পেত, আমরা তাঁর নাম দিয়েছিলাম আজরাইল স্যার! স্কুলে থাকতে স্যারদের একেকজনের একেকটা নাম দেওয়াটা প্রায় আর্টের মতোই চর্চা হতো। ওদিকে স্যাররাও ছেড়ে দিতেন না, ছাত্রদের প্রত্যেকের অবস্থান বা শারীরিক গঠন অনুযায়ী আদুরে আদুরে সব নামে ডাকতেন! আমার এক বন্ধু চশমা পরত, ক্লাসে ও-ই ছিল একমাত্র। তাই বিজ্ঞানের স্যার ওর নাম দিয়েছিলেন কানাবাবা! আমিও অবশ্য রেহাই পাইনি, আমাকে ডাকত কেতুর বাপ! একদিন হয়েছে কী, সুধা হঠাৎ দাঁড়িয়ে আজমল স্যারকে বলল, ও কিছু বলতে চায়। অনুমতি পেয়ে একটা চিরকুট হাতে এগিয়ে স্যারকে দিল।


সবাই স্যারের দিকে তাকিয়ে, স্যার উচ্চস্বরে পড়া শুরু করলেন, ‘তুমি খুব মিষ্টি, সুধা; ইয়ে মানে, দেখতে আর কি! তবে আমাদের পাড়ার আসুদার দোকানের মাখাসন্দেশের থেকে বেশি নও! তোমাকে যত দেখি, দেখতেই ইচ্ছে করে, তবে হয়েছে কী, মাখাসন্দেশ দেখলেই খেতে ইচ্ছে করে! তুমি না অনেক দয়ালু, আর তালগাছ সাইজের বিশাল মনের একটা মেয়ে, তো আসার সময় আসুদার দোকান থেকে আমার জন্য সেরখানেক মাখাসন্দেশ নিয়ে আসতে পারো না? সে যা-ই হোক, তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা কোরো, কারণ ভবিষ্যতে আমাদের ছেলেপিলেদের পড়াতে হবে না, বলো!? আর হ্যাঁ, আমাদের গুনে গুনে ডজনখানেক বাচ্চা হবে, তুমি আর আমি মিলে মোটামুটি একটা ফুটবল টিম বানিয়ে ফেলব, কেমন? আচ্ছা, ঠিক আছে, তুমি তাহলে ভালো থাকো!
No more today…I’m waiting for Asudaar dokaner makhasondesh!


ইতি,
কেতুর বাপ


পুরো ক্লাসের সবাই সশব্দে হেসে উঠল, আজমল স্যার হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘দাঁত বের করা হচ্ছে আবার, পিটিয়ে সবকটাকে এক্ষুনি যমের দুয়ারে পাঠাব! বজ্জাত ছেলেপিলের দল, স্কুলে এসে এসব করা! এদিকে আমি একেবারে হতভম্ব, এসবের বিন্দুবিসর্গও জানি না! পরিণতির কথা চিন্তা করে আমার কলিজা শুকিয়ে শুঁটকিপ্রায়, প্রাণ বেরিয়ে যাবার জোগাড়!


- অ্যাই সৌরভ, দাঁড়াও তো দেখি, বাছাধন আমার! কথাটা কানে লাগতেই তালা লেগে গেল মনে হলো! কোনওমতে উঠে দাঁড়ালাম, দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও আমার নেই।
- এতক্ষণ যা পড়লাম, তা কি সত্যি?
আমি কিছু বলার আগেই সুধা কান্নাকাটি জুড়ে দিল...
- স্যার, ও সবসময়ই আমাকে এভাবে বিরক্ত করে, উলটাপালটা কথা লেখে; যখনই সুযোগ পায় আমাকে অপমান করতে ছাড়ে না! আমি আর নিতে পারছি না, স্যার!


যে অভিযোগগুলো ওর ব্যাপারে আমার করার কথা, সেই অভিযোগগুলোই কিনা সে আমার ব্যাপারে কী অবলীলায় করে যাচ্ছে! আমি যেন আকাশ থেকে সবে টুপ করে মাটিতে পড়লাম, এমনধারা কথা যেন আমার বাপের জন্মে, ইয়ে, না, মানে আমার জন্মেও শুনিনি!


স্যার ধমকে উঠলেন, সুধা এবার চুপ করে গেল। আমাকে আবারও জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো? কথা কানে যাচ্ছে না? সুধা যা যা বলল সব সত্যি কি না? আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, ঢোঁক গিলে কোনোমতে বললাম, না স্যার, বিশ্বাস করুন, আমি এই বেঞ্চ ছুঁয়ে, ধর্মবই হাতে নিয়ে বলছি, স্যার, এসবের কিছুই আমি জানি না, এসব আমি করিনি। বিশ্বাস না করলে আপনার পাপ হবে, পাপ! পুরো ক্লাস স্তব্ধ হয়ে গেল আমার কথা শুনে, আমি নিজেও একটু হড়কে গেলাম! এই রে, কীসব বলে ফেললাম, আজ আর রক্ষে নেই! কিন্তু আমার কথা শুনে আজমল স্যার হো হো করে হেসে উঠলেন। আমি চমকে, থমকে, চিন্তায়, ভয়ে…আর মেলাতে পারছিলাম না কিছুই, কী হচ্ছে এসব আমার সাথে! আমি কি জেগে আছি? এই ঘটনাগুলো আদৌ ঘটছে তো? না কি ঘুমিয়ে আছি? না কি আমি স্বর্গে আছি, অতিসুখে উলটাপালটা দেখছি সব!


হাসি থামিয়ে স্যার আমার কাছে এসে মাথায়, গালে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বললেন, হ্যাঁ রে, তুই এত বোকা কেন রে? এত সরল হলে চলবে কী করে? আমাদের লজ্জাবতী কেতুর বাপ! ক্লাসের সবাই হেসে খুন। আমি অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম শুধু। আমরা সবাই তোমাকে চিনি, সৌরভ; এ চিরকুট তোমার লেখা নয়। আর যা-ই হোক, এই ধরনের কাজ তুমি করতেই পারো না! বিগত চার বছর ধরে তোমাকে আমরা দেখে আসছি। স্যারের কথাগুলো শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি, গড়গড় করে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। আমার উপর এত বিশ্বাস দেখে আমি সত্যিই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম।


সুধা যা ভেবেছিল, তার উলটোটা হওয়াতে রাগে-দুঃখে গজগজ করতে লাগল। রাগলে যে ওকে আরও মায়াবী দেখায়, সে হয়তো একথা জানেই না! এদিকে আমার কেন জানি না ওর উপর একটুও রাগ হচ্ছিল না! স্যার সুধাকে ডেকে বললেন, দেখো সুধা, তোমার ব্যাগে এই চিরকুট কে রেখেছে আমি জানি না, আর হয়তো তুমিও দেখোনি। সৌরভের নাম লেখা থাকলেও হাতের লেখা যে সৌরভের নয়, তা আমি বুঝতে পেরেছি। তা ছাড়া আমাদের সৌরভ খুব ভালো একটা ছেলে, ও এসব করবে না। যাও, গিয়ে নিজের জায়গায় বসো। সুধা মুখ ফুলিয়ে বিড়বিড় করতে করতে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়ল।


সেদিনের ঘটনায় আজমল স্যার সম্পর্কে আমার যত ভুল ধারণা ছিল, তা একেবারে ভেঙে গিয়েছিল। মানুষটাকে বাইরে থেকে দেখে এতদিন ভুল ভেবে এসেছিলাম, বাইরে যতটা কঠিন ভেতরটা ততটাই নরম।


এরপর থেকে প্রায়ই বন্ধুরা সুধার নামে আমাকে খেপাত, বাইরে রাগ দেখালেও শুনতে আমার ভেতরে ভেতরে ভালোই লাগত। আহা! মায়াবিনী সুধার ডজনখানেক বাচ্চার বাবা হিসেবে নিজেকে কল্পনা করতে কতই-না সুখ পেতাম তখন!


এদিকে এসব কথা আবার খুশবুর কানেও গেছে। যদিও মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ে, কিন্তু আচার, ব্যবহার, চলাফেরা দেখলে মনে হতো, সে আমার বড়ো! আমার বোন দেখে সুধা আবার খুশবুকে এড়িয়ে চলত, খুশবু ওসবকে গায়ে মাখত না, আবার সুধার সাথে কখনও নিজ থেকে কথাও বলত না, কোনও প্রয়োজন হলেও না। ওকে বলেছিলাম, কী রে, তুই সুধাবুর সাথে কথা বলতে পারিস না? আমাদের বাড়িতে এসে তোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, তুই একবার কথা বললেই তো পারিস।


বাঃ রে, আমার বয়েই গেছে! সুধাবু কখনও আমায় ডেকেছে? কথা তো অনেক দূরের ব্যাপার! আর যে আমার ভাইকে অপমান করে, সম্মান দেয় না, আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ করে, তার সাথে আমি কথা বলতে যাব কোন সুখে!? আমার প্রতি খুশবুর এই স্বার্থপর ভালোবাসা দেখে চোখ ছলছল করে উঠল, আমার ছোট্ট পরীটা কত বড়ো হয়ে গেছে, বুঝতে শিখে গেছে! আমার আম্মু আবার সুধাকে ভীষণ পছন্দ করত, প্রায়ই সুধাদের বাড়িতে ওর মায়ের সঙ্গে গল্প করতে যেত। সুধা আর ওর মা’ও আমাদের বাড়িতে আসত, তবে শুধু প্রয়োজন হলে তবেই!


এসব স্মৃতিচারণ করতে করতে একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।


এসএসসিতে বোর্ড-ফার্স্ট হলাম। রেজাল্ট হাতে পাবার পর আমার সাথে আনন্দে মেতেছিল সবাই, শুধু এক সুধা ছাড়া! ভীষণ রকমের কষ্ট পেল সুধা। আমার বন্ধু অয়নও ওর থেকে এগিয়ে ছিল, কিন্তু অয়নের প্রতি তার এতটুকুও অসন্তোষ দেখলাম না, হিংসে তো পরের কথা! যা-ই হোক, সব একপাশে ফেলে রেখে সেদিন প্রথম বারের মতো আমি সুধার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম! দীর্ঘ পাঁচ বছর কেটে গেল, কিন্তু পাঁচ মিনিটের জন্যও সুধার সাথে আমার কথা হয়নি, অথচ প্রতিনিয়ত অসংজ্ঞায়িত এক যুদ্ধ যেন নিয়তির সাথে বাঁধা ছিল! যার সাথে দু-দণ্ড কথাই বললাম না, সে-ই কিনা আমার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী! মা-বাবা ঠিক করল, আমাকে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি করানো হবে, আমরা কলকাতায় শিফট করব।


এই কথা শোনার পর সমস্ত আনন্দ যেন একনিমিষেই মাটি হয়ে গেল। শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত সবকিছু ছেড়ে, আমার খেলার বন্ধুদের ছেড়ে, সুধাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে! কীভাবে থাকব, কী করব! কিছুই যে চিনি না কলকাতা শহরের! তার চেয়ে বড়ো কথা, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছেলেমেয়েরা কি আমার সাথে মিশবে? আমি মফস্বলের গ্রাম্য এক ছেলে! এসব ভেবে ভেবে মাথা যেন পাথর হয়ে গেল, নিজেকে আর কিছুতেই ধরে রাখতে পারলাম না, একটি বার সুধাকে দেখার জন্য, কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে পড়লাম।


সুধার বাড়ির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, ও যা মেয়ে, আর আমাকে তো একদণ্ডও নিতে পারে না! যদি কথা বলতে যাই, না জানি আর কতভাবে আমাকে অপমান করবে! এদিকে মন কিছুতেই বুঝতে চাইছে না, জোর করে আমাকে সুধার সামনে নিয়ে ফেলল! আমাকে দেখেই ভেবেছিলাম তেড়ে আসবে, কিন্তু সুধা শান্তপায়ে এগিয়ে এসে বলল, চলে যাচ্ছ বুঝি? সেই কলকাতা শহরে! যাবেই তো, অত ভালো রেজাল্ট করলে এখন কি আর আমাদের গেঁয়ো ভাত মুখে রচবে তোমার!? তা যেখানেই থাকো, আমাকে অভিশাপ দিয়ো না যেন, এত কষ্ট যে তোমার ঝুলিতে পুরে দিলাম!


সুধার কথাগুলো শুনে এবার আমার রীতিমতো হৃদযন্ত্র বন্ধ হবার উপক্রম! সুধার কণ্ঠে যেন অভিমান সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ল! কী বলা উচিত ভেবে না পেয়ে বলে বসলাম, তোমার নোটস লাগলে আমাকে বোলো, কেমন? আমার কথা শুনে সুধা প্রচণ্ড রেগে গেল! ফাজিল ছোকরা, আসছে আমার বিদ্যাসাগর নোটস দিতে! বলি, তোমার কি বুদ্ধিসুদ্ধি কোনও কালেই হবে না, এমন গাধাই থেকে যাবে চিরটা কাল? ইচ্ছে করছে, টেনে দুটো চড় বসাই গালে! কথাগুলো বলতে বলতে ওর চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়তেই একদৌড়ে ঘরে চলে গেল! আমার আর সাহস হয়নি যে শেষ বারের মতো ওকে ডাকি।


শূন্যদৃষ্টি নিয়ে ফিরে এলাম ঘরে, বিছানায় গা এলিয়ে পড়ে রইলাম ঘণ্টাখানেক। ওদিকে আমাদের কলকাতা যাবার সব জোগাড়যন্তর শুরু হয়ে গেছে। খুশবু ভীষণ খুশি, সারাবাড়ি মাথায় করে ঘুরছে। একের পর এক আমাদের সব আত্মীয়স্বজন এসে দেখা করে যাচ্ছে, মিষ্টি খেয়ে যাচ্ছে, প্রশংসা করে যাচ্ছে, বাসায় গাদায় গাদায় উপহার জমছে। এতসব আয়োজন আমার কেন জানি অসহ্য লাগছিল। আর অল্প কিছু সময় মাত্র, এরপর ছুটি। এই বোলপুরের মেঠোপথ, সেই জলাধার, বিশাল মাঠ, স্কুলের ছোটো ছোটো ক্লাসরুম, আসুদার মাখাসন্দেশ, নির্জন রেলপথ, রহস্যময়ীর এক মায়াজাল, সব কিছু থেকে আমার ছুটি!


ভোর পাঁচটায় আমরা কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিলাম। আমার বন্ধুরা সবাই এল, কিন্তু আমার চোখ শুধু সুধাকেই খুঁজে ফিরছে, ওর মুখটা হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। শুধু মনে হচ্ছিল, কে বলেছে অত পড়তে? এত ভালো রেজাল্ট না করলেও হতো, আর কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজটাই-বা থাকার কী দরকার ছিল? আমাদের বোলপুর কম কীসে? এখানে হলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত!? বুঝি না বাপু, এত পড়ে কী হবে!? আমার দেখা সব স্বপ্ন যেন ওই একটা মুখের কাছে নতজানু হচ্ছে! আসলে যখন হারানোর সময় আসে, মানুষ তখনই চায় আঁকড়ে ধরতে। যখন চাইলেই আঁকড়ে ধরা যেত, ইচ্ছেডানায় রঙিন সুতোয় দিগন্তজুড়ে ঘুড়ি ওড়ানো যেত, তখন মানুষ ঠিকমতো নাটাই ধরতেও অবহেলায় ভুলে যায়।


কলকাতায় আমরা তিনকামরার একটা বাসা ভাড়া করলাম। আমি, মা আর খুশবু মিলে ছোট্ট বাসাটাকে সাজিয়ে ফেললাম। ঠিক যেন বাবুইপাখির বাসা! সন্ধেবেলা আমি আর বাবা হাঁটতে বের হলাম, আবছায়ায় অচেনা একটা শহর যেন রূপকথার রাজ্যের মতো ঠেকছিল। আমি বিস্ময়ে বিমূঢ়! ছোট্ট বোলপুর যেন কলকাতার এক ক্ষুদ্রকায় গলি! কয়েকটি দোকান ঘুরে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আমরা আটটা নাগাদ ফিরে এলাম। রাতের খাবারের পর সবাই গল্প করতে বসলাম। মা-বাবা ভীষণ খুশি আমাকে নিয়ে, খুশবুকে মা বার বার আমার কথা বলে বলে খোঁচা দিচ্ছিল।


হ্যাঁ রে, তুই কি একটু মন দিয়ে পড়াশোনাটা করতে পারিস না? দ্যাখ, তোর দাদা কত্ত ভালো রেজাল্ট করল! আমাদের পুরো বোলপুরে সবাই তোর দাদাকে নিয়ে গর্ব করে, কত উপহার দিল সবাই, কাল কত বড়ো নামি কলেজে পড়তে যাবে! আর তুই সারাদিন সাজগোজ করিস আর বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়াস! কবে যে একটু বুঝতে শিখবে এই মেয়ে!


হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি বুঝেছি, আর তোমার ছেলের গান গাইতে হবে না, ওসব পড়ালেখা আমি অত করতে পারব না। বড়ো হয়েছি, দেখতেও তো সুন্দরী, কয়দিন পর রাজকুমার একটা পছন্দ করে বিয়ে করে নিব নে! কথাগুলো বলেই খুশবু আর দাঁড়াল না, মুখ বেঁকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। বাবা হেসেই অস্থির, শোনো তোমার মেয়ের কথা! আর তুমিও না, মেয়েটা যখন চাইছে না, ওকে পড়তে অত জোর করো কেন? ওর যতদূর ইচ্ছে পড়বে, আর নাহলে বিয়ে দিয়ে দিব। মা আর কিছু বলল না।


বিছানায় অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করেও ঘুমোতে পারলাম না। কাল কী হবে, কীভাবে যাব, নতুন কলেজ, নতুন নতুন মুখ, ভিন্ন পরিবেশ! এমন নানান উত্তেজনাভরা চিন্তায় আমি অস্থির হয়ে রইলাম।


সকালবেলা খুশবু ডেকে ঘুম থেকে তুলল। ঝটপট রেডি হয়ে নাস্তা সেরে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম। খুশবু লালপেড়ে শাড়ি পরেছে, ওকে ভীষণ সুন্দর লাগছিল, ঠিক যেন লক্ষ্মীপ্রতিমা! আমার ছোট্ট পরীটা কত বড়ো হয়ে গেছে! কী রে দাদা, বললি না যে আমায় কেমন লাগছে? খুশবুর কথায় টনক নড়ল, চিন্তার জগত থেকে অবসর নিয়ে বললাম, একদম বাজে প্যাঁচার মতন দেখাচ্ছে তোকে! ইসস্‌সিরে, তোর সাথে বের হলেই আমার স্টাইলের ফালুদা হয়ে যাবে রে! ওমা, কী পেতনির মতো লাগছে দ্যাখো!


আর অমনিই সে মুখ ফুলিয়ে আমার চুল টেনে কয়েকটা ছিঁড়ে ফেলল। দাঁড়া, এবার খামচি বসাচ্ছি! নচ্ছাড়, বাঁদর! আমায় দেখতে প্যাঁচার মতো লাগছে, না?! আর কী যেন বললি, ও...পেতনির মতন, না!? মেরে তক্তা বানাব তোমায়, পাজির হাড্ডি কোথাকার!


আমাদের দুই ভাই-বোনের এই টম অ্যান্ড জেরি গেইম সারাদিনই চলে...তোরা দুই ভাই-বোন কোনওদিন আর মানুষ হবি না, হাড়মাস জ্বালিয়ে মারল আমার! এক্ষুনি থাম, নইল দুইটাকে তালা মেরে ঘরেই রেখে যাব, আর প্রেসিডেন্সিতে যাওয়া লাগবে না তোমাদের। মায়ের হুংকার শুনে দু-জনেই ভদ্র, সভ্য, বাধ্য বাচ্চার মতন বাবা-মা’র পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। দেখলাম, আমাদের কাণ্ড দেখে বাবা খুব হাসছে!


প্রেসিডেন্সি কলেজে আজ প্রথম দিন। আমি ভীষণ উদ্‌বিগ্ন, আর একটু ভয় ভয়ও লাগছিল। কত বড়ো কলেজ আর কী সুন্দর! দ্যাখ দাদা, কত কত ছেলেমেয়ে! খুশবুর আনন্দ দেখে কে! আমায় কানে কানে বলল, কী রে দাদা, এই সুন্দরী সুন্দরী মেয়েগুলোর প্রেমে পড়ে যাসনে যেন! আর শোন, আমার জন্য মিষ্টি দেখে একটা ছেলেবন্ধু খুঁজে দিবি, কেমন? তাই নাকি! দাঁড়া, মাকে বলছি সব! এত পাকনা তুই হয়েছিস কবে! দেবো না কানটা মলে, তখন মিষ্টি ছেলের ভূত নেমে যাবে ঘাড় থেকে! আমাদের এই খুনসুটি দেখে মা-বাবা খুব হাসেন, আমাদের দেখেই যেন তাঁদের সব সুখ। এই যে প্রশান্তি বাবা-মা’র মুখে দেখি, তা হাজার জন্মের ভাগ্য। কথাগুলো ভাবতেই সব ক্লান্তি, ভয় উবে গেল, নিজের ভেতরে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। ভালোবাসায় ভরা আমার ছোট্ট পরিবারটা আমার শক্তি, এদের ছাড়া আমি এক মুহূর্তও বোধ হয় বাঁচতে পারতাম না। ক্লাসের ঘণ্টা বাজতেই চমকে উঠলাম।


ক্লাসের সময় হলে আমি ক্লাসে চলে যাই, মা-বাবা আর খুশবু কাছের একটা পার্কে চলে যায়। নানান ভাবনা মাথায় নিয়ে ক্লাসে পা রাখলাম। এত বড়ো ক্লাসরুমে চোখ বোলাতেও কেন জানি সাহসই পাচ্ছিলাম না। সবাই নিজেদের মতো গল্প করছিল। আমি আস্তে করে দুটো ছেলের পাশে গিয়ে বসলাম। হঠাৎই পেছনে থেকে কে যেন ঘাড়ে টোকা মারল। ভেবেছিলাম, তাকাব; কিন্তু সাহস হয়নি, বহুদিনের চেনা একটা গলার স্বর যেন কানে এল!


(চলবে...)