দ্বিতীয় কবর (দ্বিতীয় অংশ)



প্রথমে ভেবেছি, হয়তো আমার কোথাও ভুল হচ্ছে, এ হতেই পারে না, কী করে সম্ভব!? আমি যাকে ভাবছি, এ সে হতেই পারে না। আরে, অ্যাই কেতুর বাপ, পেছনে দ্যাখো! এবার আর সইল না, ঘুরে তাকিয়ে যা দেখলাম, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না! এ কী দেখলাম আমি। হতবাক হয়ে তাকিয়েই রইলাম, কিছু বলার শক্তি নেই আমার। এর মধ্যে স্যার এসে পড়লেন। নিজেকে কোনওরকমে সামলে সামনে তাকালাম। একে একে স্যার পরিচয়পর্ব শেষ করলেন, ক্লাসরুটিন, নিয়মকানুন সব বললেন, প্রথম দিনে পাঠ্যবই না পড়িয়ে বেসিক কিছু কথা বললেন, পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞান দিলেন। পর পর দুটো ক্লাস শেষে আমাদের ছুটি হলো, বের হয়েই বললাম, তুমি এখানে?! কীভাবে? কখন? কার সাথে? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এখনও!


সুধা হেসে বলল, কী ভেবেছিলে? বোলপুর ছেড়ে এসে আপদের হাত থেকে রক্ষে মিলবে ভেবেছ? তা তো হবে না, এত সহজে তোমাকে একলা ছেড়ে দেবো না। তোমাকে জ্বালাতে এখানেও এসে হাজির হলাম। কথাগুলো শুনে সুধাকে অনেকটা সহজ মনে হলো, কিছুটা স্বস্তি পেলাম। একটু সহজ গলায় বললাম, তুমি কেমন আছ, সুধা? কোনওরকম অভিমান, অনুযোগের ভূমিকা না পেড়ে সে বলল, এতদিন যা-ই ছিলাম, এখন থেকে ভালো থাকব।


তুমি কেমন আছ, সৌরভ? ওর মুখে এত মিষ্টি কথা শুনতে আমি অভ্যস্ত ছিলাম না, তাই যেন হজম হচ্ছিল না। কেমন যেন দিবাস্বপ্ন দিবাস্বপ্ন ঠেকছিল সব। আস্তে করে বললাম, হ্যাঁ, ভালো।
তা এখানে কীভাবে এলে? আর তুমি যে প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হলে, শুনলাম না তো!
সুধা হেসে বলল, সেসব পরে হবে’খন, আগে বলো, আন্টি, আঙ্কেল আর খুশবু কেমন আছে? দেখছি না যে?
এই তো আছে সবাই ভালো, পাশেই একটা পার্কে ঘুরতে গেছে। চলে আসবে এক্ষুনি। চলো, বরং আমরা যাই, কিছুটা সময় ভালো কাটবে!
সুধার পাশে হাঁটতে কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে, এত আশ্চর্য অনুভূতি আমার আগে কখনওই হয়নি।
মা সুধাকে দেখেই আনন্দ গদগদ! আরে, সুধা মা যে! তুমি এখানে কী করে? আর কাউকে তো দেখছি না, তুমি একা এসেছ নাকি?
না, আন্টি, আমি আমার বোনের বাসায় এসেছি। আপু-দুলাভাই নিয়ে এসেছে, কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজের নাকি খুব নামডাক, তাই এখানেই ভর্তি হলাম। আব্বুর শারীরিক অবস্থা তো জানেনই, এখন আর চলে না ঠিকমতো।
হুম, বুঝলাম। তা থাকবে নাকি আরও কিছুক্ষণ আমাদের সাথে? গল্প করি?
সুধা এই প্রস্তাবে বেজায় খুশিই হলো মনে হচ্ছে, কথাটা মুখ থেকে পড়ার আগেই রাজি হয়ে গেল।
আমরা সবাই কচি কচি সবুজ ঘাসের উপর সেদিনের আনন্দবাজার’টা বিছিয়ে গোল হয়ে বসলাম।
হ্যাঁ, কী যেন বলছিলে, তা তোমার মায়ের শরীর এখন কেমন?
জি আন্টি, আছে একরকম। মা হাঁটাচলা খুব একটা করতে পারেন না, একজন ধরলে তবেই হাঁটতে পারেন। নিয়মিত চেকআপ, মেডিসিন নিতে হয়।


একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে সুধা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কেমন একটা অসহায়ত্ব আর বিষণ্ণতা ঘিরে ধরল ওকে। মায়াবী মুখখানি কীরকম মলিন হয়ে গেল!
আমার ভালো লাগছিল না এসব আলাপচারিতা। কিন্তু কিছুই বললাম না, শুনে রইলাম। প্রিয় মানুষটার মুখে সবই যেন অমৃত মনে হয়!


আম্মু আবারও জিজ্ঞেস করল, তা ওঁদেরকে কি বোলপুরেই রেখে এসেছ?
না, সেখানে আর কার ভরসায় রেখে আসব! এখানে আপু-দুলাভাই আছেন, দায়সারাভাবে হলেও একটু-আধটু খেয়াল রাখেন...বলেই কেমন গম্ভীর হয়ে গেল সুধা।


ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন যেন গোলমেলে ঠেকছিল, সুধার বড়ো বোনের কথা আমি খুব একটা শুনিনি, তবে মাঝে পালিয়ে যাবার পর খুব হইচই পড়ে গিয়েছিল আমাদের পাড়ায়। সুধার দুলাভাইকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিল, তখন আন্টি-আঙ্কেল রাজি হননি। ছেলেকে দেখে কথাবার্তা বলে মোটেও পছন্দ হয়নি ওঁদের। উনি কেমন একটা মিচকে শয়তান টাইপের শুনেছিলাম। ওর দুলাভাইয়ের নাম সম্ভবত রাজীব।


খুশবু এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল, সুধাকে উদাস দেখে বলেই ফেলল, কেন সুধাবু? দায়সারা হতে যাবে কেন? তোমার মা-বাবা মানে তো ওঁরও মা-বাবা, আর তোমাদের এত টাকাপয়সা থাকতে ওঁর কাছেই-বা কেন থাকছ সবাই?


একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সুধা আবার বলা শুরু করল, বলি কি আর সাধে, দুলাভাইয়ের শুধু আমাদের টাকার প্রতি ভালোবাসা আছে, আমাদের প্রতি নয়! সেবার আব্বু হঠাৎই স্ট্রোক করে বসলেন, আমরা সবাই দিশেহারা হয়ে হসপিটালে নিয়ে গেলাম। রাজীব ভাইয়াও সঙ্গে ছিলেন, স্ট্রোক করার কুড়ি মিনিট আগে ওঁর সাথে আব্বু শেষ বার কথা বলছিলেন; কী নিয়ে, তা আর জানতে পারিনি। হসপিটালে যখন রাজীব ভাইয়া আব্বুকে দেখতে গেলেন, তখন আব্বু ওঁকে দেখে আরও উত্তেজিত হয়ে গেলেন, কিছু একটা বলতে চাইছিলেন, কিন্তু তখন আব্বু কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না, এমনকী হাত-পা’ও নাড়াচাড়া করতে পারতেন না।


আমরা সারাক্ষণই আব্বুর আশেপাশে থাকতাম, কিন্তু যখন রাজীব ভাইয়া আসতেন, তখন ‘ডাক্তার দেখবেন’ বলে আমাদেরকে সরিয়ে দিতেন। আমি এক বারও দেখিনি ডাক্তারবাবু আব্বুকে দেখতে! কয়েক দিন পর দেখলাম যে আব্বু মোটামুটি হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারেন, নিজে খেতে পারেন, বার বার আমাকে ইশারায় বলছিলেন, লেখার জন্য ওঁকে খাতা আর কলম এনে দিতে, কিন্তু রাজীব ভাইয়া কিছুতেই দিতে দিতেন না। বাড়ি ফেরার পরও আব্বুকে একা ছাড়তেনই না, এখন অবশ্য আব্বু আর আগের মতো খাতা-কলম দিতে বলেন না, কিন্তু রাজীব ভাইয়াকে তিনি প্রচণ্ড ঘেন্না করেন, সেটা আমি বেশ বুঝতে পারি।


বাবা এতক্ষণ সুধার কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলেন; একসময় বলে উঠলেন, তা তোমার সুমি আপু কিছু বলে না? ও কি এসব কিছুই দেখে না?


আর বলবেন না আঙ্কেল, রাজীব ভাইয়ার সাথে বিয়ে হবার পর থেকেই সুমি আপু কেমন যেন পালটে গেল। সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাজীব ভাইয়া, উনি যদি দিনকে রাত বলেন, সুমি আপুও তা-ই বিশ্বাস করেন। মা-বাবা, এমনকী আমার কথাও তার নাকি বিশ্বাস হয় না, আমরা কেউই নাকি ওর সুখ সহ্য করতে পারি না! বলেই কেঁদে উঠল সুধা! আর চেপে রাখতে পারল না।


আমার পুরো দুনিয়া যেন উলটেপালটে গেল, বুকের ভেতরে চিনচিনে ব্যথা টের পাচ্ছিলাম। যে সুধা অমন বাঘিনীর মতো গর্জন করে উঠত, চোখ দিয়ে যার আগুনের ফুলকি বের হতো, সেই চোখে অসহায়ত্ব, সেই চোখ অশ্রুভেজা! আজ তার সমস্ত গর্জন যেন দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়েছে! এই সুধাকে আমার ভীষণ বেমানান ঠেকল!


আম্মু সুধাকে সান্ত্বনা দিয়ে কাছে টেনে নিল। আব্বু বলে উঠল, সুধা, তুমি এক কাজ করো, ওঁদের দু-জনকে একদিন বাইরে হাঁটতে নিয়ে এসো নির্জনে, ওঁদের ভালো লাগবে। তখন নাহয় ব্যাপারটা খোলসা করে নিয়ো। এভাবে জীবন চলতে পারে না, সন্দেহের একটা আবছা কুয়াশায় দিনের আলো কখনওই ফোটে না।


সে আমি অনেক বার চেষ্টা করেছি, কিন্তু হয় সুমি আপু, নাহয় রাজীব ভাইয়া পাশাপাশিই থাকে, আর আমাদেরকে বাইরে কারও সাথে কথা বলতেও নিষেধ করেছেন ওঁরা। আমি যাই এবেলা, বড্ড দেরি হয়ে গেল!


সৌরভ, বাবা, যা তো, ওকে এগিয়ে দিয়ে আয়। আমরা স্টেশনে তোর জন্য অপেক্ষা করব, একথা বলে আম্মু, খুশবু আর আব্বু উঠে গেলেন।


আমি আর সুধা ধীরপায়ে এগিয়ে চললাম। কারও মুখেই কোনও কথা নেই।
- আমায় তুমি ক্ষমা করেছ, সৌরভ?
হঠাৎই সুধা ব্যাকুলকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠল।
- ধ্যাৎ পাগলি! ওসব কি আর মনে রাখতে আছে? সে আমি কবেই ভুলে বসে আছি! আর আমি কখনও তোমাকে অপরাধীর চোখে দেখিনি।
বলতে গেলে চোখ বন্ধ করেই গড়গড় করে কথাগুলো বলে গেলাম।
সুধা হেসেই ফেলল আমার কাণ্ড দেখে।
- হ্যাঁ বাবা, বুঝেছি বুঝেছি! অত মহান সাজতে হবে না। ক্ষমা চেয়েছি বলে ভেবে নিয়ো না, আমি তোমাকে পছন্দ করি!
এইটুকু বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল সুধা। আমার ভারি লজ্জা লাগল। এত সুন্দর গুছিয়ে বলার পরও সুধা পাত্তাই দিল না! ভেবেছিলাম, হয়তো আবেগঘন হয়ে আমার হাতটা ধরে বলবে, সৌরভ, আমি সত্যিই লজ্জিত, তুমি খুব ভালো মনের একটা ছেলে! তা না, পুরো উলটো কাহিনি গাইল! বড্ড রহস্যময়ী নারী তুমি, সুধা! কথাটা, না, মানে ইয়ে...মনে মনেই বললাম আর কি!


হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে ডাকল, সুধা...!
এই যে মহারানি! এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? সেই কখন থেকে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছি! সুধা গোমড়ামুখে আমাকে আস্তে করে বলল, ইনিই রাজীব ভাইয়া...দেখলাম, ভদ্রলোক সুঠাম দেহের, লম্বাচওড়া, দেখতে সুপুরুষ বটে। আমায় দেখে বললেন, কে হে যুবক? আমাদের পাশের বাড়ির চাচাতো ভাই, স্কুলে থাকতে আমরা একসাথে পড়েছি। ও খুব মেধাবী ছাত্র, এখন প্রেসিডেন্সিতেই পড়ে, আজ হঠাৎ দেখা হয়ে গেল...এত ভালো ভালো কথা বলবে সুধা আমার সম্পর্কে, ভাবতেই শিউরে উঠলাম! হ্যান্ডশেক করে আমি স্টেশনে ফিরে এলাম।


বাসায় আসার পর থেকেই আমার মনটা সুধার কাছেই পড়ে রইল। আজকে সুধার সব কথা কেমন যেন খটকা লাগছিল, আর ওর জন্য ভীষণ মন পুড়ছিল। ইচ্ছে করছিল, কিছু একটা ম্যাজিক করে ওর সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারতাম যদি! ওর বর্ণনার রাজীব আর আমার দেখা রাজীবকে কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। ভদ্রলোককে দেখে একমুহূর্তের জন্যও ওরকম কিছু মনে হয়নি।


অবশ্য বাবা প্রায়ই বলে, পৃথিবীতে মানুষ নামের প্রাণিটাকে চেনা খুব সহজ---চোখ বন্ধ করে আর খোলা রেখে; এই দুই নীতির বাইরে যদি যাও, তাহলে সারাজীবন সাধনা করেও মানুষ নামের প্রাণিটাকে চিনতে পারবে না!


ভাবনার একপর্যায়ে খুশবু পেঁচিমুখী এসে ঢুকল। কী রে দাদা, অত কী ভাবনা চলছে শুনি? সুধাবু কি তাহলে ফাইনালি তোর মগজে বাসা বেঁধেছে? হুম হুম, বল বল! বলেই হেসে লুটিয়ে পড়ল।
সাধে কি আর তোকে প্যাঁচা বলি, বাঁদর! আবার পাকনামো শুরু হয়ে গেছে না তোর? দেবো মাকে সব বলে...আজকে যে আমায় প্রেমিক খুঁজে দিতে বলেছিলি!
অ্যাই দ্যাখ, ভালো হবে না কিন্তু! কথায় কথায় একদম ভয় দেখাবি না! বলেই গাল ফুলিয়ে ফেলল, ওকে আরও মিষ্টি লাগছিল। আহা, আমার ছোট্ট পরীটা!
তোকে নিয়ে আমার সবসময় কেমন একটা ভয় হয় রে!
কেন দাদা? এই কথা বললি কেন!?
না, এমনি। আমার সুন্দরী, মিষ্টি বোনটাকে আবার কোন রাজকুমার এসে নিয়ে যায়! তখন ঝগড়া করব কার সাথে?
ধুরো দাদা! তুইও না! আমি বিয়েই করব না, সারাজীবন তোর ঘাড়ে পেতনি সেজে চেপে বসব!
কই তোরা দুই বাঁদর? খেতে আয়!


সকালে ঘুম ভাঙতেই প্রথম সুধার কথা মনে পড়ল। শুভসকাল-টা লিখে পাঠাতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল। লিখলাম ঠিকই, সেন্ডও করব, কিন্তু ওর ফোন নম্বরটা যেন কী? মনেই পড়ছে না...আরেহ! আমি ওর ফোন নম্বর তো নিলামই না কখনও! ভোলার প্রশ্ন আসছে কেন! ওকে এতটাই কাছের ভেবে ফেললাম যে মনেই হলো না, এই সামান্য একটা ফোন নম্বর আমার কাছে থাকবে না! আজ মনে করে অবশ্যই এবং অতিঅবশ্যই ওর ফোন নম্বর চাইব। যদিও এখনই বেশ বুঝতে পারছি, প্রথম দিন কথা আর দ্বিতীয় দিন ফোন নম্বর চাওয়া, আমার মতন মুখচোরা ছেলের পক্ষে সম্ভব নয়!


কলেজে পা রেখেই আমার চোখজোড়া সুধার মুখ খুঁজতে শুরু করে দিল, আর মনে মনে সুপ্ত প্রতিভাগুলো উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল...


ওগো সুধা, তোমার অজানা কতশত কথা,
হৃদয়গহীনে বিরহগাথা!
তুমি যে মায়াবিনী,
মধুমাখা শ্যামাঙ্গিনী!
এ মনে জাগে বাসনা,
ওগো কল্পলতা কামিনী!
তুমি যদি চাও,
করিব তোমায় অর্ধাঙ্গিনী!


ধ্যাৎ! শ্যামাঙ্গিনী হতে যাবে কেন? সুধা তো ফরসাই! কী এক অবস্থা! ঠিকঠাক মতো দুটো লাইনও গড়তে জানি না! সারাজীবন কেতুর বাপ হয়েই থাকতে হবে মনে হচ্ছে!


- এই যে সৌরভবাবু, কী নিয়ে এত মশগুল আপনি?
- আরে! সুধা যে! তুমি কখন থেকে এখানে আছ?
- এই তো মিনিট পাঁচেক! তোমাকেই দেখছিলাম। তা ভেলা ছাড়াই কোথায় ভাসছিলে, হুঁ!?
- ও কিছু না...এই এমনি! ক্লাস শুরু হতে এখনও ঢের বাকি, জারুল গাছটার নিচে বসি গিয়ে, চলো।
ইসসসস্‌! সুধা কী যে হ্যাংলা ভাববে আমাকে! আমি আস্ত একটা হাঁড়িকাঠের ঢেঁকি!
জারুল গাছে ফুল এসেছে, দুটো হলদেপাখি বসে আছে, ঠিক যেন আমি আর সুধা!
- এই পাখিদুটোর নাম কী বলো তো?
- হবে হয়তো হলদে পাখি-টাখি কিছু একটা!
- আহারে বেচারা, আজকাল পাখিও চেনে না!
বলেই সুধা হেসে কুটিকুটি; ওগুলোকে বউ-কথা-কও নামে ডাকে।
- বাহ্! খুব সুন্দর নাম তো। ঠিক তোমার মতন!
- কী কী? শুনতে পাইনি। আবার বলো।
- না না, কিছু না! চলো, ক্লাসে যাই।
আরেকটু হলেই হয়ে যেত, এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম! আমি দ্রুতপায়ে ক্লাসে চলে এলাম। যেতে যেতে পেছন থেকে শুনলাম, সুধা বলছে...
- না না, কিছু না! ঢং! ইচ্ছে করছে, টেনে এখুনিই দু-ঘা দিই! পাজির হাড্ডি একটা, লজ্জাবতীলতা আমার! উফফফফফ্‌! এটাকে যে কী করতে মন চাইছে আমার! ধুত্তোরি ছাই! ভাল্লাগে না! বেরসিক বুইড়া! কবে যে একটু বলতে-টলতে শিখবে কে জানে!


সুধার কাছ থেকে পালিয়ে কেন এসেছি তখন! সাহসই কেন হলো না ওর চোখে চোখ রেখে বলতে, তুমি ঠিক হলদেপাখিদুটোর মতোই সুন্দর, প্রেমময়ী! হয়তো ওর স্বাভাবিক সান্নিধ্য হারিয়ে ফেলার ভয় কাজ করেছিল। এভাবেই চিরটা কাল যদি ওর কাছাকাছি থাকতে পারতাম! নাহয় সে নাই-বা এল আমার ঘরের অংশীদার হতে, বিকেলের এককাপ কফিতে ওর ঠোঁটদুটো নাই-বা ভেজালো, পূর্ণিমায় স্বপ্নগুলো একসাথে নাই-বা সাজালাম, বৃষ্টিশেষে রংধনুটা নাহয় এবেলা নাই-বা আঁকলাম, আলতাপায়ে নুপূর ও নাহয় একাই পরে নেবে, তাতে কী! ভালো তো বেসেই ফেলেছি! এইটুকু নাহয় পরমযত্নে তুলে রাখব!


ক্লাসে বসেই কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, স্যারের পড়ানোর দিকে আমার কোনও মনই নেই! ক্লাসশেষে আর সুধার জন্য অপেক্ষা করতে মন চাইছিল না, ওর সাথে দেখা না হলেই যেন বাঁচি!


- আরে এই! পালাচ্ছ কোথায়? পেছনে দ্যাখো একটি বার! আরে বাবা, আমাকে দেখতে বলছি না, তোমার ছোট্ট পরীটাকে তো দেখতে পারো!
চমকে উঠলাম! খুশবু? ও এইসময় এখানে কেন?
- দাদা, দ্যাখ, তোকে নিতে চলে এসেছি। আমার বাচ্চা-দাদাটা কি আর একা একা বাড়ির পথ ধরতে জানে?
বলেই দু-জনে ঝরনার জলের কলকল শব্দে হেসে উঠল।
- তোর খুব ডানা গজিয়েছে, না রে? পেঁচিমুখী বাঁদর কোথাকার!
আজকেও খুশবু শাড়ি পরে, হাতে কাচের চুড়ি পরে, চুলগুলো পিঠের বাঁকে এলিয়ে দিয়েছে। অপূর্ব লাগছে আমার ছোট্ট বোনটাকে!


- চল না দাদা, সুধাবুকে নিয়ে আমতলায় ফুচকা খেয়ে আসি!
- কী হে...আমাকে রেখেই খাবে নাকি!? আজকে আমি খাওয়াই তোমাদের, চলো সবাই!
পেছনে ফিরে দেখি রাজীব সাহেব! আমি, খুশবু, সুধা সবাই অবাকদৃষ্টিতে তাকিয়ে!


- হ্যাঁ রে দাদা, ইনি কে? দেখতে তো বেশ!
- দেবো এক থাপ্পড়। আস্তে বল, শুনতে পাবে। ইনি সুধার দুলাভাই, রাজীব সাহেব।


- ভাইয়া, আপনি এখানে? কখন থেকে?!
- এই তো বেশিক্ষণ না, তা কেমন আছেন, সৌরভবাবু? ওকে তো ঠিক চিনলাম না!
- ও আমার ছোটো বোন খুশবু।
- বাহ্ বাহ্! খুবই ভালো। ভাই-বোনেতে বেশ মিল আছে দেখছি। তা কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?
- জি, থাকার কথা অষ্টম শ্রেণিতে, কিন্তু আমি নবম শ্রেণির ছাত্রী।
- তুমি খুব মজা করে কথা বলতে জানো দেখছি। ভালো ভালো। চলো, তোমাকে ফুচকা খাওয়াই।
অগত্যা যেতেই হলো সবাইকে। খুশবু বেশ খুশি। সেদিন প্রথম খুশবু আর রাজীব সাহেবের পরিচয় হলো।


(চলবে...)