টুকরো আলাপ

 

 ১. আমরা অধিকাংশ মানুষই, মগজ দিয়ে যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তার বেলায় ভুল করে আবেগ, অর্থাৎ মনের কথা অনুযায়ী সিদ্ধান্তটা নিই; আর যেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায় বাস্তবতাকেও দূরে সরিয়ে রেখে শুধুই মনের কথার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সেই বেলায় মগজ দিয়ে ভেবেচিন্তে সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটা নিই!
  
 ২. শুনেছি, দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা স্বামী-স্ত্রী মিলে যদি তাজমহল বানাতে না পারে, তবে তাদের আলাদা হয়ে যাওয়াতে কোনও সমস্যা নেই। সোজা কথা, তাদের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার আসলে কোনও কারণই নেই। আবার কেউ কেউ তো সম্পর্কের ঠ্যালায় নিজের অথবা দুজনেরই ক্ষতি করে বসে! ওরকম হলে ব্রেকআপ কিংবা ডিভোর্স দেওয়াটা হয়ে দাঁড়ায় রীতিমতো “ফরজে আইন”!
  
 এখানে আমি সত্যি সত্যিই তাজমহলকে ভেবে কথাটা লিখিনি। হয়তো দুজন মানুষের মধ্যে একজন খুব মেধাশক্তিসম্পন্ন মানুষ এবং অন্যজন একদমই সাধারণ কেউ। এখানে যে সাধারণ, সে যদি তার অসাধারণ পার্টনারের পাশে সারাজীবনের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তাহলেই কিন্তু দুজন মিলে দারুণ একটা তাজমহল বানানো হয়ে গেল!
  
 ৩. আমরা আমাদের আশেপাশে নানান ধরনের প্রেম, বিয়ে কিংবা লিভটুগেদার-করা মানুষজন দেখতে পাই। দেখতে পাই তাদের দুঃখ-সুখের টানা-পোড়েন, শুনতে পাই তাদের একত্রিত হওয়ার কথা কিংবা বিচ্ছেদের গল্প। কিন্তু, আমাদের আশেপাশে এমনও কিছু কিছু প্রেম-ভালোবাসা আছে, আমরা যেগুলোর খবরই জানি না। সেগুলি মানুষদুটোর ভালোবাসা কিংবা আলাদা হওয়ার গল্প নিয়ে কাউকে কিছু বলে না। ওরা বিচ্ছেদের গল্প আর বলবে কী! আসলে এ ধরনের ভালোবাসার সম্পর্কে সাধারণত বিচ্ছেদ ঘটেই না।
  
 এ ধরনের ভালোবাসা সাধারনত দেখা যায় মানসিকভাবে খুব পরিপক্ব দুজন মানুষের মধ্যে। আপনি কোথাও তাদেরকে হাত ধরে ঘুরে বেড়াতে দেখতে পাবেন না, ছবিতেও একসাথে দেখতে পাবেন না। অবাক লাগল? সংখ্যায় খুব খুব কম হলেও এমন প্রেম-ভালোবাসা সত্যিই এখনও টিকে আছে। ওরকম যারা, তারা স্বর্গীয় ভালোবাসার স্বাদ নিতে নিতে কাউকে কিছু বলার কিংবা দেখানোর সময়ই তো পায় না! লোকদেখানো প্রায় ঘটনাতেই মেকি অনেক বিষয় মিশে থাকে। আমরা সাধারণ মানুষেরা কখনওই এতটা ভাগ্যবান হতে পারি না বিধায় এমন ভালোবাসার দেখাই পাই না। তাই বিশ্বাস করি না যে সত্যিকারের ভালোবাসা এমনও হতে পারে! নিজেদের প্রেম নিয়ে শোঅফ করার স্বভাব যাদের, তারা কখনওই প্রকৃত ভালোবাসার খোঁজ পাবে না, এটাই তো স্বাভাবিক!
  
 ৪. যে পুরুষ খাবার, পরনারীপ্রীতি, সফল পুরুষের প্রতি ঈর্ষামিশ্রিত ক্রোধ আর অবৈধ প্রণয়াকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে এবং যে নারী শাড়ি, স্বর্ণ, গীবত আর লোভ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে, তেমন দুই ধরনের মানুষের মহামানবের তালিকায় নাম লেখানোটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। ঘাঁটলে দেখা যায়, মহামানবের তালিকায় পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা খুবই কম!
  
 ৫. আমরা প্রেম বা রিলেশনশিপে থাকাকালীন মনে করি, আমার সামনে বসে-থাকা মানুষটির প্রধান কাজ হচ্ছে আমার সবকিছুর প্রশংসা করা। এক্ষেত্রে দুটো ব্যাপার ঘটে।
  
 এক। সারাদিন ঘুরে ফিরে একই প্রশংসা শুনতে শুনতে, কারুর কারুর ক্ষেত্রে, নিজের খারাপ দিকগুলো আর চোখেই পড়ে না।
 দুই। প্রশংসা সত্যিকারের হলেও, সারাদিন একই ধরনের কথা শুনতে শুনতে সামনের মানুষটির প্রতি একসময় বিরক্তি চলে আসে।

 ৬. হাসিমুখে, সুন্দর জীবন যাপন করে গেলে দেখবেন, অনেকেই শুধু আপনার ওই হাসির কারণেই আপনার শত্রু হয়ে বসে আছে। অথচ এই আপনিই যদি দুঃখী দুঃখী চেহারা করে, গরিবি হালের পোশাকআশাক পরে, মুখটা ঢ্যাঁড়শের মতন বানিয়ে আপনার ওই সকল আত্মীয়ের কাছে গিয়ে নিজের কষ্টের কথা ঠিকভাবে বলতে পারেন, তবে দেখবেন, তারা আপনাকে ভালোবাসা দিয়ে বুকে টেনে নিচ্ছে। এমনও হয় যে, আপনার দুঃখের কথা শুনে শুনে খুশি হওয়ার লোভে আপনার সেই আত্মীয় আপনার অতীতের বড়ো কোনও অপরাধের খবর পর্যন্ত লুকিয়ে রাখতে প্রস্তুত থাকে!
  
 এরকম কেন হয়? আমরা নিজেদের সুখে থাকার চেয়েও অনেক বেশি এনজয় করি অন্যের কষ্টে থাকাটাকে। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, আমরা মোটামুটি সবাই নিজেকে সুপিরিয়র ভাবতে পছন্দ করি। আমার ভাই আমার সামনে নিচু হয়ে আছে, এমন দেখলে কী যে ভীষণ সুখ আমার! কী করে নিজের ভাইয়ের ভালো-থাকাটা আমি ‘মাথা পেতে’ মেনে নেব!?
  
 ভালো কথা, অফিসের কলিগদের মধ্যেও এরকম কাহিনি হরহামেশাই দেখতে পাবেন। কলিগের সুখ সহ্য করতে পারে, এমন মানুষ যে পরম বন্ধু!
  
 ৭. সৃজনক্ষমতাসম্পন্ন কোনও মানুষের জন্য যেমন ফেইসবুকই হচ্ছে নিজেকে মেলে ধরার অন্যতম সুবিধাজনক প্লাটফর্ম, তেমন সৃজনীশক্তিহীন মানুষের জন্যও ফেইসবুকই হচ্ছে নিজেকে মেলে ধরার অন্যতম বিপদজনক প্লাটফর্ম। যে পারে, সে করে দেখায়। যে পারে না, সে করে দেখাতে চেয়ে সবার সামনে ধরা খায়! ফেইসবুক না থাকলে আমরা অনেক লোকের নানান অক্ষমতা সম্পর্কে জানতেই পারতাম না!
  
 ৮. ভালোবাসার মানুষের চাইতেও সেই মানুষটা বেশি দামি, যার সাথে আপনার আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো; যে মানুষটা আপনাকে বোঝে, অর্থাৎ আপনার প্যাশনকে বোঝে; যে মানুষটা আপনার রাগ বোঝে অথবা বোঝে আপনার চুপ করে থাকার ভাষাটাও। এরকম একজন মানুষকে জীবন থেকে হারিয়ে যেতে দিতে হয় না। ভালোবাসার মানুষের চেয়েও ভালো বোঝাপড়ার মানুষটা আমাদের জীবনে বেশি প্রয়োজন। ভালো তো অনেকেই বাসে, বোঝে আর ক’জন!
 'আমি তোমাকে ভালোবাসি', এর চাইতে অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী অনুভূতি হলো, 'আমি তোমাকে বুঝতে পারি'।