ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা: ১১৭


  
 ভাবনা: আটশো তেরো
 ………………………………………………………
  
 এক। তরু দত্ত সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি আমার খুব প্রিয় একজন লেখক চিন্ময় গুহর অসামান্য সৃষ্টি ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ পড়বার সময়। আমার সম্প্রতি কেনা বইগুলির মধ্যে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘Toru Dutt: Collected Prose and Poetry’ বইটিও আছে। যাঁদের আমরা গ্রেট হিসেবে চিনি, তাঁদের মধ্যে দুই ধরনের ব্যক্তি আছেন। মেধাবী ও প্রতিভাবান। চেষ্টা করলে মেধাবী হওয়া যায় হয়তো, তবে চেষ্টা করলেই প্রতিভাবান হওয়া যায় না। তরু দত্ত ছিলেন প্রতিভাবান বা জিনিয়াস। মাত্র ২১ বছরের জীবনে তিনি যা সৃষ্টি করে গেছেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর! ইন্টারনেট ঘেঁটে তরু দত্তকে নিয়ে কিছু লিখবার চেষ্টা করেছি।
  
 প্রথম বাঙালি হিসেবে ফরাসি ভাষায় উপন্যাস লেখার কৃতিত্বটি তাঁর। তিনিই প্রথম বাঙালি লেখিকা, যিনি ইংরেজিতে ‘বিয়াংকা অর দ্য ইয়াং স্প্যানিশ মেইডেন’ নামে উপন্যাস লিখেছেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি বিভিন্ন ফরাসি কবিতা, কাব্যসমালোচনা, প্রবন্ধ, বক্তৃতা ইত্যাদি ইংরেজিতে অনুবাদ করতে শুরু করেন। অনেক পৌরাণিক চরিত্রকে তিনি সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, যার মধ্যে ‘সাবিত্রীর উপাখ্যান’, ‘ধ্রুবোপাখ্যান’, ‘রাজর্ষি’, ‘লক্ষ্মণ’, ‘সীতা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর সৃষ্টি রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ছুঁয়ে গেছে অনেক জায়গাতেই। তাঁর অনূদিত কবিতা, মৌলিক কবিতা, উপন্যাস, চিঠিপত্র বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ, যা প্রসিদ্ধ ইংরেজ কবি স্যার এডমন্ড উইলিয়াম গোসসহ বিভিন্ন গবেষকের ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। ফরাসিতে লেখা তাঁর ‘ল্যো জুর্নাল দ্য মাদমোয়াজেল দার্ভের’ উপন্যাসটি বাংলায় অনূদিত হয়, যার ভূমিকা লেখেন প্রণম্য সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র। ‘অ্যানসিয়েন্ট ব্যালাডস অ্যান্ড লিজেন্ডস অব হিন্দুস্তান’ হলো সংস্কৃত সাহিত্য থেকে তাঁর অনুবাদ ও অভিযোজনের সংগ্রহ, যা প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতে ইংরেজি ভাষায় লেখা কবিতার ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। তাঁর চিঠিপত্রের সংগ্রহটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘লাইফ অ্যান্ড লেটারস অব তরু দত্ত’ নামে।
  
 প্রায় সত্তর থেকে আশি জন ফরাসি কবির কবিতার ইংরেজি অনুবাদ---যেগুলির মধ্যে তিনি অনুবাদ করেন ১৫৬টি ও তাঁর বড়ো বোন অরু দত্ত করেন ৮টি, তাঁর নিজের লেখা ১টি কবিতা, মোট ১৬৫টি কবিতার সংকলন ‘অ্যা শিফ গ্লিন্ড ইন ফ্রেঞ্চ ফিল্ড’ প্রকাশিত হওয়ার পরের বছরেই মাত্র ২১ বছর বয়সে এই অসম্ভব প্রতিভাময়ী অথচ নিতান্ত স্বল্পায়ু বাঙালি কবি তরু দত্ত যক্ষ্মায় মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখ্য, এই বইটিই তরু দত্তের জীবদ্দশায় প্রকাশিত একমাত্র বই। বইটির সবচাইতে বিখ্যাত কবিতা ‘আওয়ার ক্যাসুরিনা ট্রি’ ভারতবর্ষে হাইস্কুলের ইংরেজি কারিকুলামে পাঠ্য। কবিতাটি এতটাই বিখ্যাত যে সেটা নিয়ে বিশ্বজুড়ে চর্চা চলে এখনও৷ তাঁর কলকাতার রামবাগান বা বাগমারির কোনও প্রাসাদোপম বাড়ির ক্যাসুরিনা গাছ নিয়ে এই কবিতা লিখেছিলেন অকালপ্রয়াত কবি। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলেন। তার আগে ফ্রান্সের নিস শহরেও ছিলেন অনেক দিন৷ কীভাবে তাঁর বাড়ির বাগানের ওই ক্যাসুরিনা গাছ তাঁকে ইউরোপের নানা শহরে, সৈকতে তাড়া করে ফিরত, কবিতায় তা-ই তুলে ধরেছেন তরু৷
  
 তাঁর বড়ো বোন অরু দত্ত-ও বেঁচে ছিলেন মাত্র ২০টি বছর। তরু ও অরু মিলে বেশ কিছু ফরাসি কবিতা অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজিতে৷ তরু দত্তের ফরাসি ভাষার প্রতি দখল প্রভাবিত করেছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর মতো ব্যক্তিত্বকেও৷ অরু ও তরু দত্ত---এ দুই বাঙালি কন্যার নাম ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যে একসময় একনিঃশ্বাসে উচ্চারিত হতো, অনেকটা ইংরেজি সাহিত্যের শার্লট ও এমিলি ব্রন্টি বোনদ্বয়ের মতো। স্বল্পায়ু ও কালগ্রাস---এ দুটো জিনিস প্রধান ভূমিকা নিয়েছে অরু দত্তের সাহিত্যকর্মকে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর সাহিত্যকর্ম বা কাব্যকৃতির বড়ো একটা অংশ ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে বা ছোটো বোন তরু দত্তের নামে প্রকাশিত হয়েছে, যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্ভব হয়েছে এ ভুলটা পরবর্তীতে শুধরে নেওয়া। অনেক সমালোচকের মতে, অকালপ্রয়াতা অরুর কবিতা অনেক ক্ষেত্রে তরুর চেয়েও সরস। এই দুই বোনের একটি মাত্র ভাই অবজু দত্ত-ও স্বল্পায়ু ছিলেন, তিনি মারা যান মাত্র ১৪ বছর বয়সে।
 ফরাসি ও ইংরেজিতে তরুর ব্যুৎপত্তি রীতিমতো বিস্ময়কর ও অবিশ্বাস্য, বলছেন গবেষকেরা। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যদি বিদেশি ভাষায় সাহিত্য রচনার জন্য বাঙালি হিসেবে অগ্রণী পুরুষ হন, তবে নারীদের মধ্যে ছিলেন তরু দত্ত। স্বল্পায়ু জীবনে যা যা-কিছু করেছিলেন, তা এখনও বিস্ময়ের উদ্রেক করে গবেষকদের মনে। বাংলা, ইংরেজি, ফরাসি ও সংস্কৃত ভাষার পাশাপাশি জার্মানও জানতেন তরু দত্ত।
  
 দুই। কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা একইসঙ্গে অতিযোগ্য ও অতিউদ্ধত। ওঁদের নিয়ে আমরা অনেকেই খুব অস্বস্তিতে থাকি। ওঁদের মনে ঠিক জায়গা দিতে পারি না, তবু চোখে জায়গা না দিয়ে পারি না। গল্প করবার সময় ওঁদের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলাটাকে 'নৈতিক দায়িত্ব' ভাবি, অথচ ওঁদের কাজগুলি লুকিয়ে লুকিয়ে হলেও না দেখে থাকতে পারি না। আমরা ওঁদের হেইটার, আমরা ওঁদের ফলোয়ার; অতএব আমরা ওঁদের ফ্যান।
  
 অহংকার জিনিসটা কেবল তাঁদেরই মানায়, যাঁরা অহংকারটাকে 'ক্যারি' করতে পারেন। অযোগ্যরা অহংকার করলে দেখতে ছাগলের মতো লাগে; রাস্তাঘাটেই অসংখ্য দেখতে পাবেন ওরকম ছাগলদের।
 এই পৃথিবী কেবল সক্ষমদের অহংকার মেনে নেয়।
  
 ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো ছেঁড়া জিনস পরলে ওটার নাম দেবেন 'স্টাইল'।
 আর আমি ছেঁড়া জিনস পরলে আমাকে ডাকবেন 'ফইন্নির পুত'!
  
 হুবহু একই টিশার্ট। আমার গায়ে দেখলে বলবেন, ওটার দাম বড়োজোর এক-শো টাকা; আর লিওনেল মেসির গায়ে দেখলে বলবেন, ওটার দাম কমপক্ষে এক হাজার ডলার।
  
 ইউ হ্যাভ টু বুঝতে হবে, হোয়াই দিস কোলাবেরি কোলাবেরি কোলাবেরি ডি! না বুঝতে পারলে স্প্রাইট দিয়ে ভিজিয়ে মুড়ি খেতে হবে। কিস্‌সু করার নাই, ডিয়ার বাইয়া!!
  
 তিন। আত্মবিশ্বাস কী?
  
 আপনি যা পারেন, তা যেন এতটাই ভালো পারেন যে ওটি নিয়ে কথা বলবার সময় লোকের কাছে সেটি অহংকারের মতো শোনায়।
  
 আমার এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'মাইক্রোসফট এক্সেল-এর কোন কোন কাজটা তুমি পারো না?' সে উত্তরে বলেছিল, 'এক্সেল-এ যা যা করা যায় না, আমি শুধু সেগুলিই পারি না। এক্সেল-এর সীমাবদ্ধতাই আমার সীমাবদ্ধতা।'
  
 বুঝুন, একটা কাজ কতটা ভালো পারলে ওরকম করে বলা যায়! একে অহংকার বলে না, আত্মবিশ্বাস বলে। যে কোনও কাজই এতটা ভালো পারে না, যতটা ভালো পারলে তাকে সে কাজে হারানো কঠিন, সে কিছুতেই ওরকম করে ভাবতে পারার মজাটা টের পাবে না। তার পক্ষে কারও আত্মবিশ্বাস হজম করাটা ভীষণ কঠিন, তাই সে আত্মবিশ্বাসকে অহংকার ভাবে।
  
 অহংকার পতনের মূল নয়, বরং অহেতুক অহংকারই পতনের মূল।
  
 ভাবনা: আটশো চৌদ্দ
 ………………………………………………………
  
 এক। যেদিন থেকে আমরা কাঁদতে ভুলে যাই, সেদিন থেকেই আমাদের অনন্ত দুঃখের শুরু। হ্যাঁ, একসময় আমরা খুব করে চাইলেও কাঁদতে আর পারি না। চোখের জল বাড়ে আর বেড়েই চলে, বেরোতে কিছুতেই পারে না। জমাট-বাঁধা অশ্রুর চাইতে ভারী আর কী আছে এ পৃথিবীতে! সে অশ্রু বয়ে চলবার বাধ্যতার চাইতে দুর্ভাগ্য আর হয় না!
  
 প্রিয় মানুষটি ছেড়ে চলে গেলে, প্রিয় পোষা প্রাণীটি মরে গেলে, এমনকী ফ্রেমে-বাঁধানো প্রিয় ছবিটি ভেঙে পড়ে গেলেও একদিন আমাদের চোখে জল আর আসে না। বাড়লে বয়স অশ্রু শুকোয়।
  
 হাত ফসকে পড়ে প্রিয় মগটি ভেঙে গেলেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম যে আমরা, সে আমরাই জীবনের সবচাইতে বড়ো স্বপ্নটিও টুং করে ভেঙে গেলে কেমন জানি আর কাঁদতে পারি না। ভাঙা-ডানায় ভর করে পাখি আর কতদূরই-বা উড়তে পারে!
  
 প্রিয় খেলনা-পুতুলটি কেউ ছুঁলেও ছোটোবেলায় যে আমরা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাতাম, একসময় সে আমরাই প্রিয় মানুষটি চোখের সামনেই অন্যের হাত ধরে চলে গেলেও কাঁদতে আর পারি না। আমরা আবিষ্কার করে ফেলি, অন্য এক দেহখাঁচায় নিজের জীবন কখনও থাকে না।
  
 আমাদের এই নিঃস্পৃহতার শুরু হতে বেশি সময় লাগে না। অনেক কিছু নিয়েই একসময় আমাদের আর কিছুই এসে যায় না। অনেক তীব্র অনুভূতি ক্রমেই ভোঁতা হতে থাকে। অনেক বিশ্বাস ক্রমেই হারাতে থাকে। অনেক ক্রোধ ক্রমেই দমে যেতে থাকে।
  
 ছোটোবেলায় আমরা বড়ো হয়ে যাবার স্বপ্ন দেখি। বড়ো হয়ে যাবার পর আমরা ছোটো হতে না পারার ব্যর্থতায় আফসোসে মরি। বয়স আমাদের শেখায়, কাঁদতে না পারাটাও একটা ব্যর্থতা।
  
 জীবন এরকমই। আমরা বড়ো হতে থাকি, আমাদের দু-চোখে সমুদ্র কাঁপতে থাকে অবিশ্রান্ত---জলের সেই গভীর স্রোত কেউ দেখতে পায় না। চোখ পুড়ে যায়, তবু পোড়া দু-চোখে শ্রাবণ আর নামে না। আমাদের দিনের যাপন বাড়ে, সাথে বাড়ে কষ্টের যাপন।
  
 কখনও কখনও আমরা অনেক দিন পর পর হঠাৎ করেই মধ্যরাত্রির নিথর অন্ধকার ভেদ করে ডুকরে কেঁদে উঠি। কেন এমন হয়?
  
 এর কারণ যে কী, তা আমরা নিজেরাও ঠিক বুঝতে পারি না। কে আমাদের ছেড়ে গেল, আমাদের কী ভেঙে গেল, আমাদের বুকের মধ্যে কোথায় পুড়ে খাক হয়ে গেল . . . অনেক ভেবেও এসবের কোনও উত্তর মেলে না যদিও, তবু অনুমান করতে পারি, অনুভব করতে পারি, আমাদের ভেতরের মানুষটা রোজ একটু একটু করে মরে যাচ্ছে। সে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটার জন্য বড়ো মায়া হয়। নিজেরই জন্য এই যে মায়া, এ মায়া বড়ো বিশুদ্ধ, বড়ো অকৃত্রিম, বড়ো নিভৃত।
  
 হয়তোবা, সেই পরমবিশ্বস্ত বন্ধুটির জন্যই রাত্রির সমস্ত নৈঃশব্দ্য ভেঙে দৃশ্যত অকারণেই আমরা হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। কেঁদে ফেলতে পারলে বুকটা হালকা হয়। নিজের মৃত্যুতেও কাঁদতে জানে না যে, সে যতটা মানুষ, ততোধিক একটুকরো ভারী পাথর!
  
 আমরা যাদের দেখে মানুষ ভাবি, তাদের অনেকেই আসলে একেকটি জ্যান্ত পাথর।
  
 দুই। যতদূর জানি, বাংলায় বেদের যা-কিছু অনুবাদ পাওয়া যায়, সেগুলির মধ্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রমেশচন্দ্র দত্ত, সত্যব্রত সামশ্রমী, শ্রীঅরবিন্দ, দুর্গাদাস লাহিড়ী, স্বামী জগদীশ্বরানন্দ প্রমুখের অনুবাদই শ্রেষ্ঠ। পরিতাপের বিষয়, এই অনুবাদগুলি সহজলভ্য নয়। অবশ্য, ভালো কিছু সবসময়ই খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়।
  
 বাংলায় সমগ্র বেদের অনুবাদ এখন পর্যন্ত হয়নি; বেদের কিছু সংহিতার অনুবাদ হয়েছে মাত্র। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহায়তায় এই মহাকর্মযজ্ঞে হাত দিয়েছেন রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ। ওঁরা ৬০ খণ্ডে সমগ্র বেদের অনুবাদ প্রকাশ করতে কাজ করে চলেছেন। ইতোমধ্যেই ৪৪টি পর্ব প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে বোধ হয়। (এই তথ্যটিতে ভুল থাকতে পারে। থাকে যদি, শুধরে দিলে কৃতজ্ঞ হব।)
  
 আজ আমার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের ধর্মদর্শন সেকশনে আরও কিছু বই যুক্ত হলো। বেদের প্রকাশিত সব পর্ব পাইনি, ওঁরা এনে দেবেন জানালেন।
  
 বইকেনার ব্যাপারে আপনাদের একটু সাহায্য করি। যে কয়েকটি সংস্থা থেকে প্রকাশিত ধর্মদর্শনের (ধর্মচর্চার কিংবা ভক্তিরসের নয়) প্রায় বই-ই চোখ বুজে কিনে ফেলা যায় বলে আমার অভিজ্ঞতা:
  
 ঋষি শ্রীঅরবিন্দের পন্ডিচেরি আশ্রম
 উদ্বোধন কার্যালয় ও রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অব কালচার
 গীতাপ্রেস, গোরক্ষপুর
 মতিলাল বানার্সিদাস পাবলিশিং হাউস
  
 শুক্লযজুর্বেদ থেকে উদ্ধৃত করে শেষ করছি: যদ্ভদ্রং তন্ন আসুব। এর অর্থ: যা শুভ চিন্তা, তা আমাদের কাছে আসুক।
  
 তিন। সাধারণত তিন ধরনের মানুষের বিষাদ আমাদের স্পর্শ করে:
  
 এমন কারও বিষাদ, যার বিষাদের জন্য আমরা দায়ী
 এমন কারও বিষাদ, যার বিষাদের সাথে আমাদের বিষাদের মিল আছে
 এমন কারও বিষাদ, যে আমাদের প্রিয় মানুষ
  
 বাকিদের বেলায় আমরা শুধু দুঃখ পাবার অভিনয় করি। বেশিরভাগ মানুষই অন্যের বিষাদে বরং বিরক্ত কিংবা খুশি হয়। বিষাদ খুব দামি জিনিস, তাই বিলিয়ে না বেড়ালেই ভালো।
  
 কিছু কিছু চরম পর্যায়ের নিষ্ঠুর মানুষ আছে, প্রথম ধরনের বিষাদটিও যাদের ছোঁয় না। ওদের জন্য বিষাদগ্রস্ত হয়ে থাকবার চাইতে বড়ো মূর্খামি আর হয় না। আপনার বিষাদে এমন ধরনের মানুষ জিতে যায়।
  
 চার। বাঁচবার প্রয়োজনে, যখন যেমন পরিস্থিতি জীবনে আসে, তখন সেটিকেই গ্রহণ করে ফেলতে পারলে ভালো। এতে শান্তি-স্বস্তি মেলে সহজেই। যদি গ্রহণ করে নেওয়াটা সম্ভব না হয়, তবে সে পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায় মুহূর্তকে মেনে নিয়ে মুহূর্তকেই সবচাইতে ভালোভাবে কাজে লাগানোর কৌশলটি রপ্ত করে নিলে অনেক সুবিধে। যে মুহূর্তকে মনে বা মেনে নিতে পারছি না, সেটি জীবনে আর কখনও ফিরে না-ও আসতে পারে। হয়তো সামনের প্রতিটি মুহূর্তই বর্তমান মুহূর্তের চাইতে বাজে। কে জানে! আমরা যেন মাথায় রাখি, মৃত্যু খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। যদি সামনের মুহূর্ত আসবার আগে মৃত্যু এসে পড়ে, তবে এই মুহূর্তকে সহজ মনে গ্রহণ করতে না পারবার ব্যর্থতা নিয়েই মরতে হবে। মস্তিষ্ক থেকে মৃত্যুভাবনা সরিয়ে রাখলেই জীবন থেকে মৃত্যু সরে থাকে না।
  
 আমরা যেন আগামীকালের জন্য নয়, বরং আজকের জন্যই বাঁচি। আগামীকাল কেমন হবে কিংবা আদৌ জীবনে তা আসবে কি না, তা কে বলতে পারে! দূর থেকে দেখে অনেক কিছুই মনে হয়। ভাবনায় বা অনুমানে অনেক কঠিন জিনিসকে সহজ মনে হয়। প্রকৃত অবস্থাটি আগে থেকে জানা যায় কি সত্যিই? আমরা কঠিনকে সহজ করি, সহজকে কঠিন করি; এর ফলে দুটোই আমাদের হাত ফসকে যায়।
  
 ভেবে দেখুন, ঠিক আজকের এই মুহূর্তে বেঁচে-থাকা অসংখ্য মানুষ আগামীকালটি আসবার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। এই মুহূর্তে, ওই মুহূর্তে, তার পরের মুহূর্তে হাজারো মানুষ মরছে, মরবে। সেখানে আপনি আমি যে কেউই থাকতে পারি। মানুষ মৃত্যুর সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করে নিজেকে বাদ রেখে। হয় অমন করলে! মহাকালের সেই তালিকায় কে কখন ঢুকে পড়ে, কে জানে! এই লেখাটি এইটুক পর্যন্ত পড়তে যতটুক সময় খরচ হলো, ততটুক সময়ে কোথাও-না-কোথাও কেউ-না-কেউ আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। জীবিতদের তালিকাটি বড়ো ক্ষণস্থায়ী। আমরা জানিই না কখন আমাদের ডাক হঠাৎ করেই চলে আসবে। কাল যে সকালটি আসবে, তা আমি দেখবই দেখব, এমন প্রত্যয়কে পরোয়া যে করে, তার নাম মৃত্যু নয়, তার নাম স্বপ্ন। স্বপ্নের চাইতে মৃত্যু অনেক বেশি ক্ষমতাধর।
  
 আমরা কালকের আশায় আজকের দিনটি নষ্ট করি। পরশুর স্বপ্নে আজকের আনন্দটি মাটি করি। জীবন যে কখন হুট করেই ধূলি-ছাই হয়ে যায়, কে-ইবা তা অনুমান মাত্রও করতে পারে, বলুন! জন্মের দায় মেটাতে প্রতিটি মুহূর্তেই জন্মাতে হয়। মুহূর্তেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবার মানেই হলো জন্মের সুখ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে বাঁচা। বাকির স্বপ্নে নগদ সুখ এভাবেই হারায়।
  
 আমরা মৃত্যুর সময় কষ্ট বেশি পাই? না কি বাঁচবার সময়? এটির উত্তর নিশ্চিত হয়ে দিতে কেউই পারে না। যদি প্রথমটি সত্য হয়, তবে বাঁচবার সময়ে নিজেকে কষ্টে রেখে দেবার কী মানে! যদি পরেরটি সত্য হয়, তবে নিজের হাতেই সে কষ্টকে বাড়িয়ে তুলবার কী মানে! জীবনের এই রহস্যে অবগাহন করতে গিয়ে প্রতিটি মুহূর্তকেই উদ্‌যাপন করে হেসে খেলে গেয়ে নেচে জীবন পার করবার নামই বেঁচে থাকা। মুহূর্তকে সুন্দর করে তুললেই জীবন সুন্দর হয়ে ওঠে। হতেও তো পারে, ঠিক এই মুহূর্তের অর্থই পুরোটা জীবন!
  
 হয় যদি কালকের সকালটি এ জীবনে আর আসবে না, তবে সেই সকালে চোখে মাখব বলে এত লক্ষ-কোটি শিশিরবিন্দুর সঞ্চয় কীসের অর্থ বহন করে? বরং আজই দু-চোখ মেলে দেখে নিই ফুলটি অমন করে ফোটে কীভাবে, পোষা বেড়ালের কপালের কালো দাগটি কত মায়া জাগায়, ঘাসের উপর খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দু-হাত মেলে আকাশ ছুঁতে কেমন লাগে! আহা, কত কত মানুষের বাঁচবার সাধ আছে, সাধ্য নেই! আর আপনি আমি কিনা বাঁচবার সাধ্য আছে, সাধটুকু তবু মনে ঘেঁষতেই দিচ্ছি না! কোনও মানে হয়! সুস্থতার চাইতে বড়ো ঐশ্বর্য আর কী আছে! এমন একটি অপার সৌভাগ্যও দিব্যি ভুল মেরে বসে আছি, আর ভাবছি তো ভেবেই চলেছি: এখানে নয়, অন্য কোথাও; এই মুহূর্তে নয়, আরেক মুহূর্তে!
  
 প্রতিটি মুহূর্তে কানের ঠিক পাশ দিয়ে এক বার করে মৃত্যু ছুটে যায়, টের পাই না। টের পাবার আগেই বাঁচবার সমস্ত দায় মিটিয়ে ফেলবার নামই জিতে যাওয়া। সময় গড়ায় আর আমাদের ঘাড়ে মৃত্যুর ঘন নিঃশ্বাস ক্রমেই আরও ঘন হতে থাকে। কারও জীবনে এর চাইতে বেশি বা কম কিচ্ছু আসে না কখনওই।
  
 ভাবনা: আটশো পনেরো
 ………………………………………………………
  
 এক। এই দেশে ফাজিল লোকজনের অভাব নাই। নিজের পরনে লুঙ্গিই নাই, আপনাকে শিখাতে আসবে কীভাবে প্যান্টের বেল্ট বাঁধতে হয়!
  
 দুই। আমরা ইদানীং বড়ো হয়ে যাচ্ছি।
  
 আমাদের চোখে চোখ রেখে কেউ নিখুঁত অভিনয়ে মিথ্যে বললেও আমরা সব বুঝেও মাথা নাড়তে নাড়তে ফিক্‌ করে হেসে বলি, হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন!
  
 বড়ো হয়ে গেলে অন্যকে মিথ্যে বলবার স্বাধীনতা দিতে জানতে হয়। এমনও হতে পারে, যে মিথ্যেতে আমাদের কিছুই এসে যায় না, আমরা সে মিথ্যেকে ক্ষমা করে দিই।
  
 দিনের পর দিন যে মানুষটি আমাদের ঠকিয়ে যাচ্ছে, সে মানুষটিকে বুঝতেই দিই না যে তার এই প্রতারণা আমরা ধরতে পারছি অনেক দিন ধরেই। কোনও প্রতিবাদ না করেই ওকে বলে দিতে পারি, না না, তুমি কাউকে ঠকাতেই পারো না! এরকমটা হতেই পারে না!
  
 সত্যিই বড্ড বড়ো হয়ে যাচ্ছি আমরা! আমাদের ঠকানো বাদে যার জীবনে আর তেমন কোনও অর্জন বা প্রাপ্তি নেই, তাকে জিতিয়ে দিতে আমরা শিখে গিয়েছি।
  
 মানুষটা এখন আর ভালোবাসে না জেনেও তার বলা ‘ভালোবাসি!’র প্রত্যুত্তরে নিয়ম করে আমরা ‘আমিও ভালোবাসি!’ বলতে পারি গলা না কাঁপিয়েই!
  
 বড়ো হয়ে যাচ্ছি বলেই আমরা জেনে গিয়েছি, ভালো আর বাসে না যে, তার সাথে ভালোবাসা নিয়ে এর চাইতে বেশি বাক্যব্যয় করা চলে না।
  
 আমরা ক্রমেই বড়ো হচ্ছি, আর নিজেকে নিজেরই ভেতরে হারিয়ে ফেলছি।
  
 আমরা অভিনয় করতে শিখে যাচ্ছি। জীবনটা ঝামেলায় ঝামেলায় কাটানোর মতো অতটা বড়ো নয়। আমরা এখন নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে জানি। আমি যা, তা সবাইকে দেখিয়ে বেড়ানোর মানেই হচ্ছে জীবনে দুঃখ বাড়ানো। এটা আমরা এখন খুব ভালো করে বুঝতে পারি।
  
 কেউ আর আমাদের হারিয়ে ফেলে না। আমরাই আমাদের হারিয়ে বসে থাকি!
  
 যা আমাদের দরকার নেই, যা আমাদের ভালো লাগে না, যা আমাদের কোনও ক্ষতি করছে না---এই তিন নিয়ে ভাববার সময় আমাদের ধীরে ধীরে কমে আসে। বড়ো হতে থাকলে এরকম হয়।
  
 নিজে বাঁচা ও অন্যকে বাঁচতে দেওয়া---এর বাইরে ধর্মের আর কোনও অর্থ মাথায় আনবার সময়ই আমাদের আর হয় না। যা আমাদের খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখে অন্য কারও ক্ষতি না করেই, তার নামই ধর্ম। এর বাইরে আর যা-কিছুই থাকুক না কেন, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর নাম 'অফুরন্ত অবসর'। আমরা খুব স্পষ্ট করে বুঝতে পারি, অন্যকে নরক বা জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের কেউ দেয়নি। অন্যের যে কাজের ফল আমাকে ভোগ করতে হচ্ছে না, হবেও না, তা নিয়ে ভাববার নাম বেকারত্ব। বেকারত্বের দিনগুলি আর বড়ো হয়ে ওঠার দিনগুলি---একই নয়।
  
 তিন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাভারত-এর যে অনুবাদটির উপর ভরসা রাখতেন, সে অনুবাদটি গভীর ভাবনার দাবি রাখে।
  
 মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ৩৫ বছর বয়সে মহাভারত-এর বঙ্গানুবাদ, টীকা ও ব্যাখ্যায় হাত দিয়ে সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় ৩০ বছর পর সে সম্পাদনা শেষ করলেন মূল শ্লোকসহ ১৫৯ খণ্ডে, ‘মহাভারতম্’ নামে। এমন একাগ্রতার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সেই পাণ্ডিত্যপূর্ণ অনুবাদটি রবীন্দ্রনাথের নিত্যসঙ্গী হবে, এটাই কাঙ্ক্ষিত।
  
 বিশ্ববাণী প্রকাশনী থেকে ৪৩ খণ্ডে প্রকাশিত এই অনুবাদটি বহুদিন আগে সংগ্রহ করেছিলাম। আপনাদের সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে করল।
  
 এই সুযোগে জানিয়ে দিই, ইংরেজি ভাষায় মহাভারত-এর সবচাইতে সমাদৃত অনুবাদটি হলো, কে এম গাঙ্গুলি অনূদিত The Mahabharata of Krishna-Dwaipayana Vyasa, ১৮ খণ্ডে প্রকাশিত।
  
 চার। কাউকে নিমন্ত্রণ করবার আগে জেনে নিন, তিনি কী খেতে পছন্দ করেন। আপনি যা খেতে পছন্দ করেন, তা খেতে পছন্দ তিনি না-ও করতে পারেন। যার অ্যালার্জির সমস্যা, তার জন্য গলদা চিংড়ির সাত পদের তরকারির চাইতে ডাল-আলুভর্তা উপাদেয় খাবার। এইটুকু বুদ্ধি মাথায় না থাকলে আপনার অর্থ, সময় ও শ্রমের অপচয় বাদে আর কোনও লাভ হবে না। বোনাস হিসেবে আপনি একজন বিরক্তিকর ও বেআক্কেল লোক হিসেবে পরিচিত হবেন।
  
 পাঁচ। মানুষের সাথে কথা বললে নিজের সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পারা যায়। এই যেমন, আপনি হঠাৎ একদিন জানতে পারলেন, আপনি নিয়মিতভাবে প্যাথিডিন নেন। এবং, ইনজেকশনটি শরীরে পুশ করবার পর আপনি কী কী করতে থাকেন, তা নিয়ে মার্কেটে অনেক মুখরোচক গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যেগুলির একটিও আপনি আগে জানতেন না।
  
 আপনি জানলেন, আপনার জ্ঞান বৃদ্ধি পেল। এরপর আপনি বাসায় ফিরে আয়নার সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আপনার সারাশরীর তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোন‌ও ফুটো বা চিহ্ন দেখতে পেলেন না, যেখান দিয়ে আপনি ইনজেকশনটা পুশ করেছিলেন। অতঃপর আপনি ওদের কাছে গেলেন, যাদের কাছ থেকে আপনি জীবনে প্রথম জানতে পেরেছেন যে আপনি প্যাথিডিন নেন। ওরা আপনাকে পেয়ে সবাই মিলে গণধোলাই দিল, কেননা একজন মিথ্যাবাদী ড্রাগ-অ্যাডিক্টেড মানুষকে সুস্থজীবনে ফিরিয়ে আনাটা সবার‌ই পবিত্র দায়িত্ব। মারের চোটে আপনি বলতে বাধ্য হলেন, জি ভাইয়েরা, আমি প্যাথিডিন নিই। আপনাদের সবার সামনে ওয়াদা করলাম, আর কখনও নিব না।
  
 আপনাকে সঠিক পথে ফেরানোর এই সাফল্য ওদের মুখ উজ্জ্বল করে দিল। যে আপনি কখনও একটা সিগারেটও খাননি, সে-ই আপনিই সবার কাছে ইয়াবা, প্যাথিডিনসহ বিবিধ মাদকে আসক্ত একজন মানুষ হিসেবে পরিচিত হয়ে গেলেন। আপনি মাদক গ্রহণ করতেন, এটাই সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।
  
 চোখ-কান খোলা রাখলে নিজের সম্পর্কে অনেক বিস্ময়কর ও উদ্ভট তথ্য জানা যায়। আমাদের নিয়ে অন্যরা এমন এমন অদ্ভুত সব কথাবার্তা বিশ্বাস করে ও ছড়ায়, যা জানতে পারলে আমরা ওদের দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে ভাবতাম...ভাই রে ভাই, এসব যে করিস, টাকা পাস এসব করে!?
  
 পাঁচ। সম্প্রতি কেনা কিছু বইয়ের ছবি আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম।
  
 সহিহ-আল-বুখারি থেকে প্রাসঙ্গিক টীকাসমৃদ্ধ তাফসিরে আল-তাবারি, তাফসিরে আল-কুরতুবি এবং তাফসিরে ইবনে-কাসির তাফসিরের নির্যাস, ৯ খণ্ডে প্রকাশিত 'দ্য নোবেল কোরান' গ্রন্থটি বিশ্বব্যাপী সবচাইতে অধিক সমাদৃত তাফসিরসমূহের অন্যতম। এই তাফসিরটি মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমোদিত এবং সৌদি সরকারের ব্যবস্থাপনায় প্রতি বছর হজ পালনকারীদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়। উল্লেখ্য, কিং ফাহাদ কমপ্লেক্স ফর দ্য প্রিন্টিং অব দ্য হলি কোরান প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর দশ মিলিয়ন কপি 'দ্য নোবেল কোরান' ছাপায়। ছবির বইগুলির মধ্যে এই তাফসিরটিও আছে।
  
 বইকেনার আনন্দ আপনাদের সাথে শেয়ার করিনি অনেক দিন ধরেই। সিভিল সার্ভিসে ৯ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে কেনা বইগুলির ছবি আপনাদের সাথে শেয়ার করার পর মনে হলো, ওই পোস্ট থেকে অনেকেই উৎসাহিত ও উপকৃত হয়েছেন। বেশ কিছু মেইল ও মেসেজ পেয়েছি যেগুলিতে মাঝে মাঝে আমার কেনা বইয়ের ছবি শেয়ার করবার অনুরোধ ছিল। একটি ভালো বইয়ের নাম জানতে পারা নিঃসন্দেহে একধরনের সৌভাগ্য। কেনার আগে কোনও ব‌ই সম্পর্কে অন্যান্য পাঠকের মূল্যায়ন কয়েকটি সাইট থেকে পড়া যায়, সেগুলির মধ্যে আমার সবচাইতে পছন্দের সাইটটি: গুডরিডস।
  
 আনন্দ---ভাগ করলে বাড়ে!
  
 ভাবনা: আটশো ষোলো
 ………………………………………………………
  
 এক। ৩-৬-১২ থেকে ৩-৬-২১। নয় বছর কাটল, দশম বছরের শুরু। হ্যাঁ, ঠিক নয় বছর আগে আজকের এই দিনে চাকরিতে জয়েন করেছিলাম। সেদিন একজন নোবডি থেকে সামবডি হওয়ার দিকে আমার যাত্রাটা শুরু হয়েছিল।
  
 খেয়াল করেছেন, ৩০তম ব্যাচের জয়েনিং ডেটটা খুব চমৎকার না!
  
 বইকেনা আগের চাইতে অনেক কমিয়ে দিয়েছি, তা-ও প্রতিমাসেই গড়ে মোটামুটি ৬০-৭০টা বই কেনা হয়ে যায়ই! নিজেকে খুশি রাখতে মাত্র যে দুই-একটা বুদ্ধি আমার জানা আছে, সেগুলির একটি হচ্ছে এই বইকেনা। কিনে রেখে দিই, পড়া খুব একটা হয় না। আমার লাইব্রেরিতে কম-বেশি ৭ হাজার বই আছে, প্রতিদিনই নতুন নতুন বই জমে যাচ্ছে, মাথায় তেমন কিছু জমছে না যদিও। তবু বই কিনে একটু একটু আফসোস কমাই। একটি পছন্দের বই কিনতে না পারার দুঃখ কয়েক-শো মৃত্যুর সমান!
  
 আজকের দিনটাকে উদ্‌যাপন করার জন্য নিজেকে কয়েকটি বই উপহার দিলাম; দর্শনের। বইগুলি কিনে খুব শান্তি পেয়েছি। আমি সাধারণত আমার সংগ্রহে-থাকা বইয়ের ছবি শেয়ার করি না, কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগে! তবে আজ শেয়ার করতে ইচ্ছে করল।
  
 দুই। আপনি যদি কারও সম্পর্কে তার অগোচরে খারাপ কথা বলেন, এবং সে পরবর্তীতে কখনও তা জানতে পেরে মনে কষ্ট পায়, তবে সৃষ্টিকর্তা তার অন্য একটি কষ্ট দূর করে দেবেন কিংবা কমিয়ে দেবেন। তার প্রতি আপনি যে অন্যায়টি করলেন, সে অন্যায়ের ফলাফল হিসেবে স্রষ্টা তার কিছু ভুল ক্ষমা করে দেবেন। কেন তিনি এই কাজ করবেন? এর কারণ, সে নতুন যে কষ্টটি পেল, সেটি তার প্রাপ্য ছিল না। ফলে তার প্রাপ্য একটি কষ্ট দূর করে দিলে কিংবা কমিয়ে দিলে নিঃসন্দেহে ন্যায়বিচার বা ভারসাম্য স্থাপিত হয়। কিন্তু যেহেতু তার প্রাপ্য কষ্ট সরিয়ে বা কমিয়ে দিলে অন্য কারও সাথে অন্যায় হলেও হতে পারে, সেহেতু স্রষ্টা তখন তার কষ্ট বা শাস্তিটি আপনার নিয়তির খাতায় লিখে রাখবেন, কেননা এই পুরো ব্যাপারটির জন্য আপনিই দায়ী।
  
 অন্য কারও সম্পর্কে খারাপ কথা বললে কিংবা ক্ষতি করার চেষ্টা করলে আপনি নিজেই কষ্ট বা শাস্তির মুখোমুখি হবেন। এটা প্রকৃতিরই বিচার। আপনি হাজারো চেষ্টা করলেও সেই পরিণতি এড়াতে পারবেন না। আপনি শাস্তি ভোগ না করলেও আপনার চোখের সামনেই আপনার সন্তান বা প্রিয় কেউ বিনা দোষে শাস্তিটি ভোগ করবে। আপনি যার সম্পর্কে খারাপ কথা বলেন কিংবা যার ক্ষতি করার চেষ্টা করেন, স্রষ্টা তার কিছু পাপ ক্ষমা করে দিয়ে আপনার পাপ বাড়িয়ে দেবেন। সেই বাড়তি পাপের শাস্তি মৃত্যুর আগেই আপনাকে অবশ্যই পেতে হবে। এখন সিদ্ধান্ত আপনার।
  
 তিন। আপনি যে মানুষটিকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে পারেন বিনা কুণ্ঠায়, সে মানুষটিই আসলে আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষ।
  
 যে মানুষটির চোখে চোখ রেখে বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে চলা সমস্ত কথা কোনও জড়তা ছাড়াই গড়গড় করে বলে দিতে পারেন, সে মানুষটির উপরেই আপনি সবচেয়ে বেশি ভরসা রাখেন।
 কখনও কখনও খেয়াল করবেন, বুকের ভেতর এক মস্ত বড়ো ব্যথার পাহাড় জমে আছে, কিন্তু চোখে জল আসছে না একটিও ফোঁটা, ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সারামুখে লেপটে আছে শতাব্দীপ্রাচীন শব্দহীনতা।
  
 এমনটা কেন হয়? কাঁদবার জন্য একটি বিশ্বস্ত বুক এবং মন খুলে কথা বলবার জন্য একজোড়া সহজ চোখ অনেক হাতড়েও কিছুতেই খুঁজে পাই না বলেই এমন হয়।
  
 অমন কাউকে পাই না বলে আমরা দিনের পর দিন বুকের ভেতর কষ্টের বড়ো বড়ো পাথর জমিয়ে রেখেও দিব্যি ঘুরে বেড়াই। সেইসব পাথর জমতে জমতে ক্রমশ এক পাহাড় তৈরি করে ফেলে। আমাকে দেখা যায়, অথচ আমার চেয়ে অনেক অনেক উঁচু ভেতরের পাহাড়টা আর দেখা যায় না। দেখা যায় না বলেই আমরা ঠিক চিনে উঠতে পারি না, আমাদের চোখের সামনে হেঁটে-চলা জলজ্যান্ত মানুষগুলির মধ্যে কে মৃত আর কে জীবিত।
  
 জমিয়ে-রাখা কথা কিংবা জমাট-বাঁধা ব্যথা কখনওই ভেতরে চেপে রাখতে নেই। এই দুটো জিনিস যত চেপে রাখা হয়, ভেতরটায় ততোধিক ভয়ংকর যন্ত্রণা হতে থাকে। যদি কারও সাথে ঝগড়া করে হলেও নিজেকে হালকা করে নেওয়া যায়, তবে তা-ই করে ফেলাটা ভালো। হ্যাঁ, এ জীবনে এমন একজন মানুষ লাগে, যার উপর মনের সমস্ত রাগ ও দুঃখ ঝেড়ে ফেলা যায়। যদি আপনার এমন একজন ভালোবাসার মানুষ থাকে, যার সাথে আপনি মনের সুখে ঝগড়া করতে পারেন না, তবে আমি বলব, বোধ হয় আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে; সে মানুষটি আপনাকে ভালোই বাসে না!
  
 জীবনে এমন একটি বুকের প্রয়োজন হয়, যে বুকটা ইচ্ছেমতো কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়া যায়। এমন দুটি চোখ এ জীবনে লাগে, যে চোখে তাকিয়ে সব কথা বলে ফেলে নিজেকে হালকা করে দেওয়া যায়। যার সাথে অভিনয় করে চলতে হয় না, নিজেকে নিজের মতো করেই যার সামনে মেলে ধরা যায় বিনা দ্বিধায়, তাকেই বলে প্রিয়জন; বাকিরা কেবলই প্রয়োজন কিংবা অপ্রয়োজন।
  
 কখনও কখনও, আমরা নিজেরাও ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, কে আমাদের কাছের মানুষ, কোন বুকটা আমাদের পরম নির্ভরতার বুক। নিজেকে তখন বড্ড অসহায় ও ব্যর্থ মনে হতে থাকে। যার সবই আছে, অথচ বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদবার মতো একটিও মানুষ নেই, তার আসলে কিছুই নেই। সে এ পৃথিবীর দরিদ্রতম মানুষ!
  
 যদি কখনও আবিষ্কার করেন, এমন কাউকে কাছে পেয়ে গেছেন, যাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেলতে পারছেন, তাহলে ধরে নিন, আপনি আপনার জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে পেয়ে গেছেন। সেদিন থেকে, আপনার জীবনে এমন একজন মানুষ আছে, যাকে বিশ্বাস করা যায়, যার কাঁধে আপনার জীবনের ভারটা সঁপে দিয়ে নিজেকে পালকের মতো নির্ভার করে ফেলা যায়। সেই মানুষটিকে কোনও কিছুর বিনিময়েই হারাতে দেবেন না। কখনওই না! হোক সে বন্ধু, প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা, মা-বাবা, ভাই-বোন,---তাকে কাছে রেখে দেবেন। এজন্য যদি কোনও কিছুর সাথে বোঝাপড়া করতে হয় তো তা-ই করবেন।
  
 নিজেকে ভালো রাখতে গিয়ে যদি এমন কোনও সম্পর্কে থাকতে হয়, যে সম্পর্কটি অসংজ্ঞায়িত কিংবা নামহীন, তা-ও ভালো! স্বীকৃতির চাইতে সুস্থতা জরুরি। যারা আপনাকে ভালো রাখতে পারে না, তারা কে কী বলল, ওতে কিছুই এসে যায় না।
  
 পুরো পৃথিবীর চাইতেও দামি সম্পদটি হচ্ছে নিজের ভালো-থাকা। যে আপনাকে ভালো রাখতে পারে না বা চায় না, তাকে ভালো আপনি বাসতেই পারেন, তবে তার সাথে সারাজীবন থেকে যাবার সিদ্ধান্ত না নিলেই ভালো। ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকবার চাইতে ভালোরাখার মানুষের সাথে থাকাটা সুখের ও স্বস্তির।
  
 চার। : ভাই, আপনি কুত্তা পালতেন?
 : না, ভাই, পালতাম না। তবে একসময় একটা কুত্তা আমারে পালত। সে এখন পালে আরেক জনরে।
 : ধুউর মিয়া, এইগুলা কী কন?
 : সত্য কথা কই রে, ভাই! এ জগতে কেউ কেউ কুত্তা পালে, আর কাউরে কাউরে কুত্তায় পালে। সবই কপাল!
  
 ভাবনা: আটশো সতেরো
 ………………………………………………………
  
 এক। পৃথিবীর যে কয়েকটি যন্ত্রণা বাধ্য হয়ে মুখ বুজে সহ্য করতে হয়, তার মধ্যে একটি হলো, বাবা-মা’কে চোখের সামনে বুড়িয়ে যেতে দেখা।
  
 শক্ত যে হাতদুটো আমাদের এই পৃথিবীর হাল ধরতে শেখায়, ধীরে ধীরে একসময় সে হাতদুটোই চোখের সামনে নরম হতে শুরু করে।
  
 যে বাহুতে টুক করে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তাম, একসময় সে বাহুরই চামড়া কুঁচকে যায় দেখতে দেখতেই।
  
 যে মানুষটি ছোটোবেলায় সোজা হয়ে হাঁটতে শিখিয়েছেন, একসময় সে মানুষটিই চোখের সামনেই কুঁজো হতে শুরু করেন।
  
 আমার চোখে, পৃথিবীর কঠিনতম দৃশ্যগুলির একটি হলো, বাবা-মা’কে চোখের সামনে বৃদ্ধ ও অসুস্থ হতে দেখা।
  
 আমরা যত বড়ো হই, বাবা-মা’য়েরা ততই বুড়িয়ে যায়। একদিন কোনও এক অসময়ে আবিষ্কার করি, আমাদের যাঁরা হিরো বানিয়েছেন, সেই সুপারহিরো দু-জন একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছেন মহাযাত্রার দিকে।
  
 এইসব টুকরো টুকরো সত্য আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু কিছুতেই যেন মানতে পারি না।
  
 আমরা নিজেদের শত মৃত্যু ও মৃত্যুযন্ত্রণাও সহজে মেনে নিতে পারি, তবু---
 পৃথিবী ভেঙেচুরে যায় তো যাক, সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাক, ওলটপালট হয়ে যাক গ্রহ-উপগ্রহ ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, তবু বাবা-মা আমাদের ছেড়ে যাবেন, অসীম মৃত্যুযন্ত্রণার সামান্যটুকুও ওঁদের শরীর ছোঁবে, এমন ভাবনা আমাদের মাথাতেই আসে না কখনও, এই অমোঘ বোধটা আমরা কেউ মেনেই নিতে পারি না। কিছুতেই না! কোনওভাবেই না!
  
 দুই। আপনার কোনও কথা আমার মনমতো না হলে আমার রাগ বা হাসি পায় না, তার বদলে আমি সাধারণত আপনার বক্তব্য বা মতামতটি নিয়ে ভাবতে শুরু করি। এমনকী একেবারেই আমার ধারণা ও অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে চলে যায়, এরকম কিছু শুনলেও আমি প্রতিবাদ না করে বরং চুপচাপ চিন্তা করি, আপনি আসলে কী বলতে চাইছেন কিংবা যা বলতে চাইছেন তা কতটুকু সত্য। আমি তো আর আপনার অন্নদাতা নই যে অপ্রিয় সত্য বলবার ‘অপরাধ’-এ আপনাকে ফাঁসিতে ঝোলাব!
  
 আমার মধ্যে একধরনের অজ্ঞতার ভয় বা উত্তীর্ণতার ইচ্ছে কাজ করে যা আমাকে আপনার ও আপনাদের কাছ থেকে কোনও একটি বিষয় নিয়ে জেনে নিতে উৎসাহ দেয়। আমি খুব শ্রদ্ধা নিয়েই আপনার চিন্তা সম্পর্কে জানতে চাই, যদি তা আমার চিন্তার উলটোপথেও হাঁটে, তবুও চাই। ওতে আমার একটুও কষ্ট হয় না, এমন নয়। তবে যত কষ্টই পাই, আমি নিজের সাথে, নিজের কাজের সাথে মীমাংসা ও বোঝাপড়া করবার সুবিধার্থে বিরুদ্ধমত নিয়ে বুঝতে ও ভাবতে পছন্দ করি। যদি সত্যটা জেনে ও বুঝে আপনি আমার সমালোচনা করেন কোনও কিছুর প্রতি রাগ ও অনুরাগ না রেখে, তবে আপনার কুৎসিততম ভর্ৎসনাও আমি মাথা নত করে মেনে নেব।
  
 তবে যদি দেখি, কেউ আমার কাজ নয়, বরং ব্যক্তি আমাকে নিয়েই মাতামাতি করছেন, কখনওবা আমার সম্পর্কে এমন সব কুৎসা রটানোর চেষ্টা করছেন যা আদৌ সত্য নয়, কিংবা কারও কাছ থেকে শুনে বা নিজে অনুমান করে আমার সম্পর্কে ভুল কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছেন, তখন তাঁকে নিয়ে আমার মধ্যে তীব্র উপহাস ও রাগের অনুভূতি তৈরি হয়। আপনি আমাকে নিয়ে যতটা অনুমান করেন, আমি আমাকে নিয়ে ততোধিক ধারণা রাখি। আমার সম্পর্কে আমার ধারণা আপনার অনুমানের চাইতে অভ্রান্ত। অপ্রিয় সত্য সহ্য করা যায়, কিন্তু অপ্রিয় মিথ্যা সহ্য করার মতো সময় আমার হাতে নেই, কিংবা সেই সময়টা হাতে থাকলেও আমি এমন কাউকে দেবো না যে লোকটা আমার জন্য মোটেও প্রয়োজনীয় নয়। আর আমি দেখেছি, গায়ে পড়ে উপদেশ বা পরামর্শ দিতে আসে যারা, ওদের বেশিরভাগই মূলত নিজেকে জাহির করে আমাকে লো ফিল করাতেই আসে। যে আমাকে লো ফিল করায়, সে কখনওই আমার জীবনের জন্য জরুরি কেউ নয়।
  
 হ্যাঁ, অপ্রিয় মিথ্যাও আমি সহ্য করি, মুখ বুজে সহ্য করতেই হয়, যখন আমার সম্পর্কে সে মিথ্যাটি আমার বস বলেন কিংবা এমন কেউ বলেন যাকে আমার দরকার। বসের মিথ্যাচার ও বিষোদ্‌গার সহ্য করা চাকরিরই একটা অংশ। এই যেমন ধরুন, আমি যেখানে সারাজীবনে একটা সিগারেটও খাইনি, সেখানে যদি আমার বস বা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনও ব্যক্তি আমাকে ইয়াবাখোর হিসেবে রায় দিয়ে মনে মনে জিতে যান, তবে সেখানে আমার একটুও আপত্তি থাকবে না। পাগলের সুখ তো মনে মনে, সেই পাগলকে খেপিয়ে কী লাভ! সক্ষম জেতে সত্যে, অক্ষম জেতে মিথ্যায়।
  
 আমার কাজ নিয়ে সৎসমালোচনা গ্রহণ করতে আমি সব সময়ই প্রস্তুত, কেননা ওতে আমারই লাভ বেশি---নিজেকে শুধরে নিতে পারি। কিন্তু আমাকে কিংবা আমার পেশাগত, ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা যে-কোনও অবস্থান নিয়ে আপনার ক্রোধ, ঈর্ষা বা বিষোদ্‌গার নেবার মতো ধৈর্য বা সময় আমার সত্যিই নেই। নিজের মনের উপর একটা উটকো লোকের মিথ্যা বয়ানের প্রভুত্ব সহ্য করব বা করতে হবে, অতটা দুর্বল আমি নই। তা ছাড়া কেবল অপদার্থরাই সমালোচনা করতে গিয়ে নিন্দা করে ফেলে। অপদার্থদের সাহচর্য মেনে নিলে নিজেকেও ওদের জায়গায় দেখাটা ক্রমেই অনিবার্য হয়ে ওঠে।
  
 তিন। অনেকসময় প্রচুর চেষ্টা করেও মানুষ ব্যর্থ হয়, আবার তেমন একটা চেষ্টা না করেও কেউ কেউ সফল হয়। প্রশ্নটা মূলত ব্যর্থতা আর সাফল্যের, সচেষ্ট কিংবা নিশ্চেষ্ট থাকবার নয়। সাফল্যের দেখা পেয়ে গেলে অতীতের চেষ্টাশূন্যতাও আদর পায়, অথচ ব্যর্থ মানুষের অধ্যবসায়ের কথা কেউ বলেও না পর্যন্ত!
  
 চার। সুখ ও ভালোবাসা, এই ব্যাপারদুটো ভীষণ ভীষণ আপেক্ষিক।
  
 এক লোক সিগারেটের পর সিগারেট ফুঁকে অদ্ভুত রকমের স্বস্তি পায়, আরেক লোক ঠিক একই জিনিসের ধোঁয়াও সহ্য করতে পারে না।
  
 যে চোরটি লোকের চোখে অপরাধী, চরম জঘন্য এক চরিত্র, সেই একই ব্যক্তি কারও চোখে তার প্রাণের মানুষ, কারওবা কাছে দেবতাতুল্য শ্রদ্ধেয় পিতা, সন্তান, ভাই।
  
 যে মানুষটি প্রতিদিনই কারও বকাঝকা ও দুর্ব্যবহার সহ্য করে, সেই একই ব্যক্তির জন্য কেউ একজন রোজ রোজ গোপনে অশ্রু ঝরায়।
  
 পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের আবেগ, অনুভূতি আলাদা আলাদা রকমের। প্রতিটি অনুভূতি ও তার প্রকাশ আপেক্ষিকতার বিচারে ভিন্ন ঘরের।
  
 আপনি যে মানুষটিকে আপনার সবটা দিয়ে ভালোবাসেন, সে মানুষটিই হয়তো আপনাকে নয়, অন্য কাউকে তার সবটা দিয়ে ভালোবাসে। আপনি বুঝতেই পারছেন না, কেন আপনার ভালোবাসার একটুও দাম মানুষটি দেয় না। নিখাদ ভালোবাসাকে মূল্যহীন হয়ে থাকতে দেখলে তা নীরবে মেনে নেওয়া সহজ নয়। মজার ব্যাপার, সে মানুষটি যাকে তার সবটা দিয়ে ভালোবাসে, সে হয়তোবা ভালোবাসে অন্য একজনকে। ফলে আপনার ভালোবাসার মানুষটিও আপনার মতোই সংশয়ে ঘেরা এক ওয়েটিং-রুমে অনন্ত অপেক্ষায় বসে আছে। পৃথিবীতে এই ব্যাপারটি বড্ড জটিল, গোলমেলে, অমীমাংসিত এক রহস্য।
  
 তবুও তো মানুষ ভালোবাসে, তবুও তো বাঁচবে বলে পৃথিবীর সব যুক্তির গায়ে থুতু ছিটিয়ে মানুষ সুখ খুঁজে বেড়ায়।
  
 পাওয়া না পাওয়ার হিসেবে, সুখ-অসুখের জাঁতাকলে ক্রমেই পিষ্ট হয়ে গোটা একটা জীবন কখন যে নষ্ট হয়ে যায়, তা আমরা টেরই পাই না।
  
 জীবনের কোনও এক শেষ সন্ধেবেলায় এসে আমরা হঠাৎ আবিষ্কার করি…হায়, এ জীবনে তো কিছুই পেলাম না!
  
 আবার এক গোধূলিবেলায় কিংবা মেঘভাঙা জোছনায় ঠিকই বুঝে যাই…এ জীবনে সুখ ও দুঃখের অনুভূতি প্রকৃতপক্ষে কতগুলি শূন্যের পাশাপাশি সজ্জায় তৈরি এক দুর্বোধ্য ধাঁধা ছাড়া আর কিছু নয়।
  
 ভাবনা: আটশো আঠারো
 ………………………………………………………
  
 এক। জীবনের শেষে এসেও মানুষ যেখানে ভালোবাসা খুঁজে পায় না, সেখানেও, লোকে ভালোবাসাকে দিতে ও নিতে প্রত্যক্ষ করতে ঠিক চায় না। চায় না কেন, তার উত্তর জানতে চাইলে সেইসব দিনগুলির দিকে তাকিয়ে দেখতে হবে, যে দিনগুলি ওরা কাটিয়েছে কেবলই ভালোবাসাহীনতায়। ভালোবাসা পায় না যে, সে অন্যের ভালোবাসা পাওয়াটা তেমন সহ্য করতে পারে না।
  
 এই ভালোবাসা ব্যাপারটি গোটা জীবনের জন্য, না কি ক্ষণিকের, সে আলাপে যাবার চাইতে বরং ভাবি, আদৌ গোটা জীবনের স্থায়িত্ব নিয়ে আমরা সত্যিই জানি কি না। এক মহাকালই জানে যা, তা নিয়ে ক্ষণকালও ব্যয় করার কী-ইবা মানে! মেনে নেবার বেলাতে কার্পণ্য যার যত বেশি, জীবনের যাপনে কিছু অহেতুক বিষাদ ও আফসোস অনুভব করবার প্রস্তুতি নিতে হয় তাকে তত বেশি।
  
 কাল সন্ধ্যায় বইয়ের দোকানে যে মেয়েটিকে দেখে মুগ্ধ হয়েছি, কথা বলতে ইচ্ছে করেছে, সে তার চোখ দিয়ে সম্মতিটুকু, মানে মুখোমুখি কিছুসময় বসে থেকে দু-জন দু-কাপ কফি খাওয়া যেতেই পারে, এমনটা বুঝিয়ে দেবার পরেও, আমরা সর্বসমক্ষেও বসে গল্প করতে পারিনি। আমরা কফির ধোঁয়ায় উষ্ণতার বদলে পাপ খুঁজতে শিখেছি।
  
 আমরা বাঁধন বলতেই পুরো জীবনের বাঁধনই বুঝি। অথচ পুরো জীবনের মানেটা যে কী, আমরা তা-ই ঠিক বুঝতে পারিনি আজও। যে মুহূর্তে মুহূর্তের দাবিটা মেটাইনি বলে দুঃখ পেলাম, সে মুহূর্ত কি জীবনের বাইরের কোনও মুহূর্ত? দিনশেষে, এই প্রশ্নটি তো থেকেই যায়।
  
 আমরা ভাবতে পছন্দ করি, আমরা তো পরস্পরের নই! নই-ই যখন, তখন আর কীভাবেই-বা বসে থাকি অমন মুখোমুখি? এ পৃথিবীতে কোন দুই জন মানুষ পরস্পরের হয়ে ওঠে, তা কে কবে কোথায় জানতে পেরেছে হয়ে যাবার আগে, এমনকী হয়ে যাবার পরেও বুঝেছে ওটুক, তা ঘেঁটে দেখতে আমরা চাই না স্ফুট কিছু ভুল-কণ্ঠস্বরের কারণেই। মানুষ কখনও কারও হয়ে যায় না, মানুষ মূলত নিজেরই থেকে যায় আমৃত্যু।
  
 বন্ধুত্ব কিছু ভালোবাসার দাবি রাখে যদিও, তবু ভালোবাসা একটুও বন্ধুত্বের দাবি রাখে না যে সমাজে, সে সমাজে মনের উষ্ণতা ছড়িয়ে দেবার মধ্যে যে কেবলই নিষ্কলুষ ইচ্ছে বা টান থাকতেও পারে, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, অতটুকু ঠিক বোঝেও না বোধ হয়। অবোধ ও নির্বোধের সমাজে বোধের আলাপ করতে চাওয়াটাও বড্ড অসুবিধের ব্যাপার। অমন আলাপ শুরু হবার আগেই কণ্ঠরোধের ইশতিহার হাতে চলে আসে চটজলদি।
  
 কারও সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে থাকতে চাইলেই সারাজীবন শারীরিক সামীপ্যে বা পাশাপাশি থেকে যেতে হয়, এরকম অদ্ভুত রকমের বিশ্বাস যেখানে প্রকট, সেখানে মানুষে মানুষে বিশ্বাস ও ভালোলাগার ভিত্তিতে সংক্ষিপ্ত কিংবা দীর্ঘ, কোনও আলাপচারিতাই হয়ে ওঠে না!
  
 আলাপচারিতায় ভালোবাসা থাকতেই হবে কেন? নিছকই ভালোলাগায় যে আলাপচারিতা, তাকে দূরে সরিয়ে রাখতেই হবে কেন? এসবের উত্তর খুঁজতে আমরা তেমন যাই না। যাই না বলেই আমরা বন্ধনের নামে কেবলই একটা শেকল পাই, মানুষ আর পাই না। আমাদের ঘরবসতি ও বোঝাপড়া শেকলের সাথে, মানুষের সাথে নয়। আমাদের অর্জিত উত্তরাধিকার বলতে কেবলই শেকল পরবার ঐতিহ্য ও অভ্যস্ততা, অন্ধ থাকবার আমেজ ও আয়েশ। পরবারই নয় কেবল, পরাবারও; থাকবারই নয় কেবল, রাখবারও!
  
 যাকে ভালো লাগে কিংবা এইমাত্রই লেগেছে, তার সাথে একটু সময় খরচ করা যেতেই পারে কোনও কিছুরই প্রত্যাশা না রেখেই। এর নাম ব্যক্তির সত্য।
  
 যাকে ভালো লাগে কিংবা এইমাত্রই লেগেছে, তার সাথে একটু সময় খরচ করা যেতেই পারে এই ভালোলাগাটা আজীবন টিকিয়ে রাখার শর্ত রেখে। এর নাম সমাজের সত্য।
  
 যাকে ভালো লাগে কিংবা এইমাত্র লেগেছে, তার সাথে একটু গল্প করা যেতে পারে কি পারে না, তা নিয়ে আমরা কে কী ভাবি, কিংবা যা-ই ভাবি, তা যেভাবেই ভাবি না কেন, কিংবা এসবের কিছুই যদি আমাদের মাথায় না-ও আসে, তবু যা হবার তা-ই হবে, এবং সেই হবার সুখ বা দুঃখ বর্তমান সময় ও প্রেক্ষিত নির্ধারণ করে দেয় খুব কমই। এর নাম জীবনের সত্য।
  
 কাউকে কারুর ভালো লাগল কেন, তা নিয়ে ভাবতে গিয়ে যদি কেউ সেখানে পাপ খুঁজে পায়, তবে তার চাইতে বড়ো পাপী আর কে আছে! পাপীরাই বেশি বেশি পাপ খুঁজে বেড়ায়। পাপীরাই চোখে পাপ দেখে বেশি।
  
 কারও সাথে জীবন কাটানোর শর্তই যদি হয় ভালোলাগার একমুখিতা, তবে সে শর্তের নাম ভালোবাসাও নয়, বিশ্বস্ততাও নয়, সেটি কেবলই এমন এক সামাজিক চুক্তি, যে চুক্তি ব্যক্তির মন কিংবা জীবনের একটিও সত্যের তোয়াক্কা করে না। আর করে না বলেই সহজে ভাঙে।
  
 ব্যক্তির, সমাজের ও জীবনের---এই তিন সত্যের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে যে বিন্দুতে এসে, তার নামই বেঁচে-থাকা। আর এই বিন্দুর নামই হচ্ছে, মুহূর্তের সত্য। মুহূর্তের সত্য ধারণ করা ও মেনে নেওয়া যার কাছে যত শক্ত, জীবনের অর্থটাও তার কাছে তত জটিল।
  
 আমরা পাপ খুঁজে চলি কেবলই শরীরে, অথচ সমস্ত পাপের বসত, আবাদ ও বিকাশ তিনটিই হয় মনে।
  
 দুই। একাকিত্ব দু-রকমের:
  
 পছন্দের মানুষটিকে পাইনি বলে একাকিত্ব
 পছন্দের মানুষটিকে পেয়েছি তবু একাকিত্ব
  
 দ্বিতীয়টি বেশি যন্ত্রণার।
  
 সত্যি বলতে কী, কাউকে পাওয়া না-পাওয়া দিয়ে একাকিত্ব মাপা সম্ভব নয়। অমুককে পেলেই এ জীবনে আর কোনও দুঃখ থাকত না, এমন ভাবনা মাথায় আসে যাদের, তাদের বলি, দু-জন মানুষ পরস্পরকে পেয়ে যাওয়ার আগে ও পরে এক‌ই রকমের মানুষ থাকে না।
  
 পেয়ে গেলে মানুষ বদলে যায়।
  
 তিন। আমার যে কয়েকটি লেখা পড়ার সাহস আমি নিজেই পাই না, সেগুলির একটি 'কবির মৃত্যু ও পুনর্জন্ম প্রসঙ্গে'। মনীষা মাইতির নির্মাণে এই কবিতার আবৃত্তি আপলোড করব আজ রাত ৯টায়। আমার ইউটিউব চ্যানেলে, ফেইসবুক পেইজে। আইডিতে ও গ্রুপেও শেয়ার করব নিশ্চয়ই।
  
 বিপদে পড়লে আশেপাশের মানুষের চেহারা ও ভূমিকা কেমন হয়, ঠিক তা নিয়েই আমি এ কবিতায় লিখেছি।
  
 এই কবিতার সাথে আমার তীব্র আবেগ জড়িয়ে আছে। এখানে কবির জীবনে যা যা ঘটেছে, আমার নিজের জীবনেও অবিকল তা-ই তা-ই ঘটেছে। এই কবিতাটি পড়লে মানুষ সম্পর্কে আপনার মধ্যে যেমন ধারণা তৈরি হবে, মানুষ মূলত তেমনই। বিপদে পড়লে এটা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। ওইসময় পাশে 'তথাকথিত বিশ্বস্ত' কাউকে পাবেন না; তার চাইতে বড়ো কথা, যারা আপনার পাশে ছিল বন্ধুর বেশে, তাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারা তখন দেখতে পাবেন।
  
 নৃশংসতার উৎসবে প্রায় মানুষই হয় নিজে অংশ নেয়, নতুবা নীরবে উপভোগ করে। অন্যকে পদদলিত ও নির্যাতিত দেখবার নেশা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। মানুষের ওরকম চেহারা খুব স্পষ্টভাবে দেখে ফেলেছি বলেই লোকের স্তুতি বা নিন্দা আমাকে তেমন স্পর্শ করে না। আমি বুঝে গিয়েছি, আমরা মূলত অপ্রয়োজনীয় মানুষজন নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকি।
  
 উৎসাহী পাঠকদের জন্য কবিতাটির লিংক প্রথম কমেন্টে দিয়ে দিলাম।
  
 ভাবনা: আটশো উনিশ
 ………………………………………………………
  
 এক। যে মানুষটি বন্ধুদের দলে খিলখিল করে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেয়ে গড়িয়ে পড়ে, সে প্রাণোচ্ছল মানুষটিই হয়তো ঘরে ঢুকে লাইট বন্ধ করে বালিশে মুখ চেপে ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
  
 যে মানুষটি ‘আরে দোস্ত! এত চিন্তা করে কী হবে! খাও – দাও - ফুর্তি করো, দুনিয়াটা মস্ত বড়ো! জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা!’ বলে-টলে অন্যকে সান্ত্বনা দেয়, সে মাই-ডিয়ার-টাইপ মানুষটিই হয়তো প্রতিরাতে অ্যান্টি-ডিপ্রেশন ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমায়।
  
 যে মানুষটির সদাহাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখে মনে একরাশ আফসোস নিয়ে ভাবি, ‘ইস্‌! যদি ওর মতো সুখী হতে পারতাম!’ সে ফুর্তিবাজ মানুষটিই হয়তো কড়া ঘুমের ওষুধ ছাড়া একরাতও ঘুমোতে পারে না।
  
 আমরা একজন মানুষের ঠিক ততটুকুই দেখি, যতটুকু সে দেখায়।
  
 এর বাইরে মানুষের সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের বড়ো একটা পৃথিবী থাকে, যেটার খোঁজ আমরা সত্যিই জানি না, কখনও জানতেও পারি না। এক সে-ই জানে, সে যে আসলে কী! বাকিরা বড়োজোর অনুমান করে।
  
 যে মানুষটি কথায় কথায় অকথ্য অশ্রাব্য অভব্য ভাষায় গালিগালাজ করে, সে দুর্মুখ মানুষটিই হয়তো ঘরে ফেরার পথে রাস্তার পা-ভাঙা অসহায় কুকুরটিকে রোজ এক প্যাকেট বিস্কুট দিয়ে যায়।
  
 যে মানুষটির গায়ে আমরা দুম্‌ করে নির্দয় নির্মম নিষ্ঠুর তকমা সেঁটে দিই, সে বাজে মানুষটিই হয়তো পিঁপড়ে দেখলে এমনভাবে পা মাড়ায় যাতে পিঁপড়ের গায়ে আঘাত না লাগে।
  
 যে মানুষটিকে কখনও নিজের সন্তানকেও ঠিকমতো আদর করতে দেখিনি, সে নিঃস্পৃহ মানুষটিই হয়তো পাড়ার কুকুরটি মরে গেলে বুক ফাটিয়ে হাউমাউ করে কাঁদে।
  
 প্রতিটি মানুষেরই কোনও-না-কোনও চমৎকার দিক থাকে, যার খোঁজ আমরা কখনওই পাই না। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই এক জন দেবতা বাস করে। মানুষ বাইরে এক, ভেতরে আরেক। মানুষ আদতে মিশ্র বৈশিষ্ট্যের প্রাণী।
  
 একটা মানুষ কখনওই শত ভাগ খারাপ হয় না, আবার শত ভাগ ভালোও হয় না।
  
 পৃথিবীতে এমনও অনেক মানুষ আছে, যারা অনেকটা নারকেলের মতো---উপরে শক্ত খোলস, ভেতরে টলটলা জল।
  
 মানুষ মূলত নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে ভালোবাসে; কখনওবা বাধ্য হয়।
  
 মানুষ চায়, তাকে অন্যরা তার শব্দে নয়, বরং কর্মেই বুঝে নিক; চায়, কেউ তার বাহ্যিক শক্ত আবরণটা ভেঙে ভেতরের নরম মানুষটাকে আবিষ্কার করুক।
  
 তবুও, দিনশেষে প্রতিটি মানুষই অনাবিষ্কৃত থেকে যায়। এজন্যই আমরা, যে হাসে, তাকে সুখী ভাবি। অথচ, পৃথিবীর বেশিরভাগ হাসিই সুকৌশলে ব্যবহৃত হয় সবচাইতে নিখুঁত মুখোশ হিসেবে!
  
 দুই। আমি বিশ্বাস করি, শিশুদের ওদের নিজের মনের মতোই বাড়তে দেওয়া উচিত। ওদের কোনও কাজেই আমাদের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। তাই আমি যখন আমার বাসার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখি, শিশুরা মনের আনন্দে গাড়ির উপর উঠে লাফাচ্ছে, আমার চোখের সামনেই পার্ক-করা গাড়িতে কাদা ছুড়ছে ইচ্ছেমতো, তখন ওদের আমি কিছুই বলি না। আমার কাছে হাজারটা দামি গাড়ির চাইতেও একটা শিশুর মনের খুশির দাম অনেক বেশি। তা ছাড়া, ওই গাড়িটা তো আর আমার নয়, শিশুগুলিও তো অন্য লোকের!
  
 তিন। কিপটে লোকের সাথে চলার চাইতে বড়ো শাস্তি আর হয় না!
  
 হে ঈশ্বর! যারা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, তাদের সবার বরকেই হাড়কিপটে করে দাও!
  
 চার। মূর্খ, এইজন্যই মূর্খ যে, সে মূর্খ বলে কখনোই লজ্জিত নয়।
  
 এক জন মূর্খ বরাবরই চায় আরেক জন হৃদয়বান মূর্খ, যে তাকে সবসময়ই তোয়াজ করবে; যেমন আমি।
  
 পাঁচ। চুল পেকে গেলে চুলের রং সাদা হয়ে যায়। সেই সাদা রঙের চুলের দিকে তাকিয়ে আমাদের মন খারাপ হতেই পারে---হওয়াটাই স্বাভাবিক, এমনকি এই চুল পেকে যাওয়ার ব্যাপারটা আমরা মন থেকে গ্রহণ করতে চাইতে না-ই পারি! কিন্তু তাতে কী এসে যায়? চুল পেকে গেছে, দিনশেষে এটাই তো সত্য, তাই না? বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, আপনার মন বা মেজাজ খারাপ হলেও আপনার পাকা চুল কাঁচা হয়ে যায় না।
  
 তবে হ্যাঁ, মন-মেজাজ ভালো করতে আমরা সেই সাদা চুলে রং করতে পারি। ওতে সাদা চুল হয়ে যাবে কালো, লালচে, বাদামি, কিংবা আমাদের পছন্দের যে-কোনও রঙের। তা দেখে আমাদের মনটা খুশি খুশি হয়ে উঠলেও পাকা চুল কিন্তু পাকাই থেকে যাবে, কাঁচা আর হবে না। তখনও আমাদের মাথায় পাকা চুলই থাকবে, এবং তা হচ্ছে কালো, লালচে বা বাদামি রঙের পাকা চুল। কেউ মাইন্ড করলেও তার চুল-পাকা কখনও বন্ধ হয় না। রাগী লোকের চুলও পাকে, শান্ত লোকের চুলও পাকে। হয়তো ঝামেলা এড়ানোর জন্য রাগী লোকের রং-করা পাকা চুলের দিকে তাকিয়ে তার সামনে সবাই ওটাকে কাঁচা বলে রায় দিয়ে দেয়! ভালো কথা, কেবল রাগীরাই নয়, নির্বোধরাও এই 'বিশেষ সম্মান'টা পায়!
  
 কালো রঙের পাকা চুল আর কালো রঙের চুল এক জিনিস নয়। মেনে নিতে পারলেও সত্য সত্য, মেনে নিতে না পারলেও সত্য সত্যই!
  
 ছয়। যে গোরু দুধ দেয়, আমরা সেই গোরুকেই লাথি মারি। যে গোরু দুধ দেয় না, সে গোরু আমাদের লাথি খায় না।
  
 এটাই আমাদের জাতিগত ঐতিহ্য।
  
 গোরু তবু দুধ দিয়েই যায়, কেননা এক দুধ দেওয়া বাদে আর তেমন কিছুই সে করতে পারে না। এটা তার মহানুভবতা নয়, এটাই তার বৈশিষ্ট্য। হ্যাঁ, এ কারণেই তার নাম গোরু। এবং, সে সারাজীবন গোরুই থেকে যায়।
  
 সাত। গোচারণভূমিতে সিংহের গর্জনের নিরাপত্তা আশা করাটাও বোকামি। গোরুরা গুলি ছুড়তে পারে না বটে, তবু গোরক্ষকরা তো পারেন!
  
 আট। আগাছা কেটে পরিষ্কার করবার সময় ভুলবশত দু-একটা ভালো গাছও কাটা পড়তেই পারে। তবু আগাছা কেটে ফেলাই ভালো।
  
 আমি মনে করি, কানা মামার চেয়ে নাই মামাই ভালো। তবে যদি সেই কানা মামার কাছ থেকে প্রাপ্তির ব্যাপার-স্যাপার থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। আমরা তো বুঝিই, যে গরু দুধ দেয়, সে গরু লাথি মারলেও সমস্যা নাই, তা সহ্য করাই যায়।
  
 আপনি কাউকে লাত্থি মারবেন কোনও কারণ ছাড়াই, আর সে আপনাকে বলবে, লক্ষ্মীসোনা, জাদুর কণা! লাথি মারতে কে করসে মানা! আয় সোনা, বুকে আয়!... আপনার মাথায় এটা আসে কীভাবে? মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবার‌ই আছে, তবে বেয়াদবি বা বিরক্ত করবার স্বাধীনতা কারুর‌ই নেই। এ পৃথিবীতে কোথাও বেয়াদবের কোনও ছাড় নেই।
  
 যে আপনাকে বিরক্ত করে, লাথিই তার প্রাপ্য, যদি তার সাথে আপনার বাধ্যতার সুতোয় বাঁধা কোনও সম্পর্ক না থাকে।