জীবন যখন ফুরিয়ে যায়



প্রায়ই বিষণ্ণতায় ভোগে যারা, সে মানুষগুলির বসবাস নরকের কাছাকাছি। ক্যানসার যেমনি ধীরে ধীরে পুরো শরীরটাকেই কাবু করে খেয়ে নেয়, বিষণ্ণতাও ঠিক তেমনি পুরো মস্তিষ্ককেই ক্রমশ ধ্বংস করে দেয়। বেঁচে থাকে যারা, সেইসব মানুষ আদতে শারীরিক সুস্থতায় নয়, বরং মানসিক শক্তির জোরেই বাঁচে। মানুষ মূলত মনের শক্তিতেই বাঁচে।


মনের শক্তি ফুরিয়ে নিঃশেষ হয়ে গেলে দেহের শক্তি যতই প্রবল হোক না কেন, মানুষ তখন আর মানুষের মতো করে বাঁচতে পারে না। বিষণ্ণতায় ভুগতে-থাকা মানুষেরাও অনেকটা এরকমই। অচেনা কোনও কীট বিষণ্ণ মানুষের মগজের প্রতিটি কোষ যেন নির্দয় রাক্ষসের মতো চিবিয়ে চিবিয়ে খায়!


এমন মানসিক যন্ত্রণার মাত্রাটা যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন মানুষ তা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকে মরিয়া হয়ে। কেউ কেউ তখন হুট করে আত্মহত্যার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। মানুষ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিজেকে শেষ করে দেওয়ার জন্য নেয় না, অসহ্য যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচার জন্যই নেয়। জীবনের মায়া সবারই আছে। বাঁচতে সীমাহীন কষ্ট হয় বলেই কেউ কেউ আর বাঁচতে চায় না।


বিষণ্ণতায় ভোগে যারা, ওরা আসলে এর কোনও সমাধান চায় না। সমস্যার সমাধান ওরা নিজেরাই জানে, তবে মানতে পারে না। কেউ এসে সমাধান দিতে চাইলেই বরং ওরা বিরক্ত হয়। মানুষ কেবলই শোনাতে চায়, শুনতে কেউ চায় না। এ জগতে দুঃখের সমাধান দেওয়ার মানুষের কোনও অভাব নেই, দুঃখের কথা শোনার মানুষের বড়ো অভাব।


আমি এ পর্যন্ত ৭৬ জন বিষণ্ণ মানুষকে আত্মহত্যার পথ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছি। এ কাজটা ভয়াবহ রকমের কঠিন! এর পেছনে অনেক শ্রম ও সময় দিতে হয়। কাজটা করতে ধৈর্য ধরার ও সহ্য করার অসীম ক্ষমতা লাগে। আমার অভিজ্ঞতা বলে, বিষণ্ণতার সময় মানুষ এমন কাউকে পাশে চায়, যে তার কথাগুলি মন দিয়ে চুপচাপ শুনবে, তার দুঃখ একটু হলেও বোঝার চেষ্টা করবে, তার যন্ত্রণা যাকে সামান্য হলেও ছোঁবে। সে তখন সহানুভূতিশীল কারও সঙ্গ চায়, সময় চায়। তার ভুলগুলি নিয়েই বার বার কথা বলে, এমন কাউকে সে চায় না। পৃথিবীর সবচাইতে বোকা মানুষটিও নিজের ভুলের হিসেব একটু হলেও রাখে। বিষণ্ণ মানুষ তার ভুলের ফিরিস্তি শুনতে চায় না। বিষণ্ণতার সময় দয়ালু কোনও মানুষের সাহচর্য পেলে উদ্ভূত জটিল সমস্যাগুলির জট একটা একটা খুলতে থাকে।


বিষণ্ণ মানুষ শুধুই একটা হাত চায়, যে হাতটা তার চোখের দিকে দয়ার্দ্র দৃষ্টি ছুড়ে বলবে, হাতটা ধরো! কিচ্ছু হয়নি, ওঠো!
বিষণ্ণ মানুষ শুধুই একটা কাঁধ চায়, যে কাঁধটা তার নিঃশ্বাসের দূরত্বে এসে মায়াভরা কণ্ঠে বলবে, এই নে, কাঁধে মাথা রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদ তো ইচ্ছেমতো!
বিষণ্ণ মানুষ শুধুই একটা কান চায়, যে কানটা তাকে একটুও জাজ না করার শর্তে রাজি থেকে বলবে, তোমার কী হয়েছে? আমাকে সব খুলে বলো! আমি আছি তোমার পাশে!
বিষণ্ণ মানুষ শুধুই একটা প্রশস্ত বুক চায়, সে বুকটা তার আস্থার জায়গায় নিজেকে মেলে ধরে বলবে, ভয় পেয়ো না! আজ থেকে এটাই তোমার ঘর, মন, জানালা, আশ্রয়, প্রশ্রয় সমস্ত কিছুই!


আমাদের আশেপাশেই আছে এরকম অনেকে। আসুন, আমরা ওদের কথাগুলি একটু শুনি, দীর্ঘশ্বাসটুকু একটু অনুভব করি, বুকের মধ্যে ওদের চেপে ধরে চুপচাপ বসে থাকি কিছুক্ষণ! ওদের জন্য যদি এইটুকু করতে পারি, তবে দেখব, ওদের সকল বিষণ্ণতা গলে গিয়ে অশ্রু হয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের বুকের জমিন। বিষণ্ণ হয়ে থাকে যারা, ওদের মূল কষ্টটা হচ্ছে, ওরা খুব চেষ্টা করেও প্রাণ খুলে কাঁদতে পারে না। আমরা যদি ওদের আনন্দে কিংবা নির্ভরতায় কাঁদাতে পারি, তবে ওদের বিষণ্ণতা অনেকটাই কমে যায়। ইচ্ছেমতো কাঁদতে পারলে বুকের পাথরগুলি এক এক করে বেরিয়ে যায়। মানুষ তার পাশে এমন কাউকে চায়, যার সামনে বিনা কুণ্ঠায় কাঁদা যায়। বন্ধুত্ব গ্রহণ করার মানুষ তো অনেকেই পায়, অশ্রু গ্রহণ করার মানুষ পায় ক’জনে?


হয়তো এই ছোট্ট কাজটা আমাদের বিবেচনায় কিছুই নয়। তবে আমাদের এই সামান্য কাজ একটা জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে। একটু আন্তরিক সময়, দুটো দয়ার্দ্র কথা, কিছুটা নির্ভরতা ও আশার স্পর্শ---একজন বিষণ্ণ ব্যক্তির জন্য এসবের চাইতে বড়ো ওষুধ, বড়ো উপকার আর হয় না।


আজ আমাদের খাবারের অভাব নেই, ওষুধের অভাব নেই, আশ্রয়ের অভাব নেই, পোশাকের অভাব নেই; আজ আমাদের শুধুই দয়ালু মানুষের অভাব। আজ আমাদের সবই আছে, শুধু মানুষের মতো মানুষ নেই। আজ আমরা বড়ো গরিব হয়ে গেছি!


আমাদের ছোটো ছোটো কিছু নিঃস্বার্থ কাজ আমাদের মনের অজান্তেই একজন মানুষকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়। আমাদের এই সামান্য চেষ্টাটুকুই তাকে বাঁচতে সাহস জোগাবে, স্বপ্ন দেখার কারণ দেখাবে। আমাদের সারল্যমাখা হাসির জাদুকরি রেশেই মানুষটা হাসার শক্তি পাবে, নতুনভাবে উঠে দাঁড়ানোর জন্য খুঁটিটা খুঁজে পাবে। এ অনেক বড়ো পুণ্যের কাজ! পৃথিবীর সকল তীর্থ ঘুরেও একটা মানুষকে বাঁচানোর পুণ্য অর্জন করা যায় না।


আমাদের খুব কাছেই অথচ আড়ালে হয়তো এমন অনেকেই আছে, যারা অনেক দিন ধরেই নীরবে ধুঁকে ধুঁকে মরছে আর প্রতিনিয়তই ভাবছে, ‘অনেক হয়েছে! আর পারছি না! এবার আমি সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাই!’ এমনও হতে পারে, মানুষটা আমাদের নিজের ঘরেই আছে, আমরা কখনও টের পাইনি। সে চলে যাওয়ার পর টের পেয়ে আর কোনও লাভ হবে না। যে মানুষটা বেঁচে থাকতে আমরা তার কষ্টের দাম দিই না, সে মানুষটা চলে যাওয়ার পর কষ্ট পেয়ে অমন করে কেঁদে কী হয়!


আসুন, ওদের পাশে দাঁড়াই। আমাদের অবসর থেকে ওদের জন্য একটু সময় রেখে দিই। নিজের সমস্ত ইগোকে ঝেড়ে ফেলে অসীম ধৈর্য ও সহনশীলতা নিয়ে ওদের নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় কথাগুলিও মনোযোগী শ্রোতা হয়ে শুনি। একটা প্রাণ বাঁচানোর পুণ্যে আমাদের অনেক বড়ো পাপও তখন কেটে যাবে। রাতের ঘুমটা ভালো হবে, দিনের যাপনটা স্বস্তির হবে।