বৃষ্টি আর নামে না



দিন-তারিখ মনে নেই, কিংবা জানাতে চাইছি না। আম্মুর সাথে আগের দিন রাতে অনেকটা রাগ করেই না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। মনটা ভীষণ খারাপ ছিল, তাই বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হয়েছিলাম। অটোতে উঠলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর হঠাৎ পেছন থেকে একটা গাড়ি এসে ধাক্কা দিল। চোখের পলক ফেলার আগেই বাইরে ছিটকে পড়লাম। সেই মুহূর্তে মনে হলো, শরীরের হাড়-পাঁজর সবই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল। তখন সম্ভবত সকাল সাড়ে আটটা।


আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় সদর হাসপাতালে। দুই দিন হাসপাতালে রাখার পর ডাক্তার এক্সরে করে জানতে পারেন, আমার মেরুদণ্ডের নিচের দুইটা হাড় ভেঙে গেছে। আর পিঠের পুরো অংশে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। আমার পরিবারকে বলা হয়, দ্রুত এর অপারেশন করা না হলে ধীরে ধীরে মেরুদণ্ডটা বাঁকা হয়ে যাবে। আর হাঁটতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম। সদর হাসপাতাল থেকে আমাকে নেওয়া হয় পিজি’তে। তবে ওখানে অপারেশন করতে অনেক দেরি হবে, তাই আমাকে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল-এ ভর্তি করানো হয়। যেদিন ভর্তি করায়, তার পরদিনই অপারেশনের তারিখ। যত দেরি হবে অপারেশন করতে, আমার যে-কোনও একটা পাশ পুরোপুরি প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ার ভয় তত বেশি, তাই ডাক্তার আমার বাবা-মা’কে মানসিকভাবে শক্ত হতে বললেন।


সকাল নয়টায় আমাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। নিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমি একটা কথাই ভেবে ভেবে মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছিলাম না যে অপারেশনের পর আমি হাঁটতে পারব তো? অপারেশনের সময় আমাকে অনেক রক্ত দিতে হয়। আমার ভাইয়া পাগলের মতো রক্ত খুঁজে বেড়িয়েছে। আমি ভাবছিলাম, সারাজীবনই মানুষের জন্য এত ছুটেছি, অথচ আমার জন্য ওদের কেউই এক ব্যাগ রক্ত দিল না। হাসপাতালের সামনে রাস্তার উপর ভাইয়া দীর্ঘসময় বসে ছিল অসহায়ের মতো। পরে অনেক খুঁজে ভাইয়ার এক বন্ধু ব্লাডডোনার খুঁজে পায়। যিনি আমাকে রক্ত দিলেন, তাঁকে আমি চিনতামই না। বিপদের সময় যাঁকে পাশে পাওয়া যায়, তাঁকে আমরা, প্রায় সময়ই, চিনিই না। আর যাদের চিনি, তাদের কাউকেই তখন খুঁজেও পাওয়া যায় না। অবশ্য এমনও হতে পারে, আমি মানুষের উপকার না করলে হয়তো সৃষ্টিকর্তা সেই ব্লাডডোনারকে মিলিয়ে দিতেন না।


তখন ছিল রমজান মাস। আমার আব্বু-আম্মু রোজা রেখে সারাদিন হসপিটালে পড়ে থাকত। আমাকে সকালে অপারেশন রুমে নেওয়া হয়েছিল আর বের করা হয় বিকেল পাঁচটায়। ইফতারের পর আমাকে বেডে আনা হয়। হসপিটাল থেকে আমাকে যেদিন রিলিজ দিল, সেদিন যখন আমাকে হুইলচেয়ারে করে নিয়ে আসা হয়, তখন আমার আম্মুর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। আম্মু দু-চোখ ভরা জল নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। টানা চার মাস শুধু বেডে শুয়ে ছিলাম। সেই চার মাস আমি অনুভব করতে পারি যারা হাঁটতে পারে না, তাদের কষ্টটা। অসুস্থ মানুষের কষ্টটা অসুস্থ না হলে কিছুতেই বোঝা সম্ভব নয়। গলা ভেঙে যাওয়ায় আমি একসময় টানা সাত দিন কথা বলতে পারিনি। এর আগ পর্যন্ত আমি জানতামই না যে কথা বলতে না পারলে অতটা কষ্ট লাগে! হসপিটালের বেডে শুয়ে শুয়ে আমার মনে হতো, এ পৃথিবীতে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকার চাইতে যন্ত্রণার আর কিছু নেই।


একদিন খুব তেষ্টা পেয়েছিল। আম্মু রুমে ছিল না। অনেক ডাকাডাকি করি, আম্মু শুনতে পায়নি। আমি এক গ্লাস পানি আমার বেডের পাশের টেবিল থেকে আনার চেষ্টা করি, কিন্তু আনতে গিয়ে আমি বেড থেকে নিচে পড়ে গেলাম। একা একা ওঠার অনেক চেষ্টা করেও সেদিন উঠতে পারিনি। চার মাস পর আমি ধীরে ধীরে আম্মুর হাত ধরে একটু হাঁটা শুরু করি। প্রতিদিনই আম্মু আমার দুই পা মালিশ করে দিত যাতে পায়ে কোনও সমস্যা না থাকে। ছয় মাস পর আমি পুরোপুরি হাঁটতে শুরু করি কারও হাত না ধরেই। তবে ডাক্তার বলে দিয়েছিল, চার বছর পর আবার একটা অপারেশন করতে হবে। এর কারণ, আমার পিঠে রড দেওয়া হয়েছিল, যাতে করে রডের জন্য আমার মেরুদণ্ডটি সোজা থাকে এবং ধীরে ধীরে ভাঙা হাড়দুটো জোড়া লাগে। তারপর থেকে সেই ভাঙা মেরুদণ্ড নিয়ে জীবন কাটতে থাকে। বড্ড স্থবির সে জীবন!


ডাক্তার আমাকে চলাফেরা করতে একদমই বারণ করে দিয়েছিলেন। আমাকে দুই বছর পড়াশোনায় গ্যাপ দিতে বলা হয়েছিল, কেননা পড়াশোনা করার জন্য একটু হলেও তো স্কুল-কলেজে আমাকে যেতে হবে, গাড়িতে উঠতে হবে। তবে আমি তা শুনিনি। নিজের জীবনের সাথে লড়াই করে বাঁচতে হবে, সেটা খুব ভালো করেই বুঝে ফেলেছিলাম। জীবন কত-কী যে একদম ধরে ধরে বুঝিয়ে দেয়! জীবন নিজেই জীবনকে চেনায়!


আমি ঠিক সময়েই এইচএসসি পাশ করি। ভার্সিটিতে ভর্তি হই। পড়ালেখার পাশাপাশি একটা অনলাইন বিজনেস শুরু করি। আমি ম্যানেজমেন্টের স্টুডেন্ট, বিজনেস ব্যাপারটা ভালোই বুঝি। তার পাশাপাশি একটা ক্যাডেট ভর্তি কোচিং-এ ক্লাস নেওয়া শুরু করলাম। এর মাঝে একদিন রিকশা করে বাসায় আসার পথে রিকশা থেকে পড়ে যাই, যার ফলে আমার পিঠে অনেক ব্যথা পাই। পিঠের ব্যথা বাড়লে ডাক্তার দেখানো হলো। এমআরআই করার পর ডাক্তার জানতে পারেন, পিঠে যে রড দেওয়া হয়েছিল, তার একটা স্ক্রু ভেঙে গেছে রিকশা থেকে পড়ে যাওয়ার কারণে। এর ফলে সমস্যা দেখা দিয়েছে অনেক। আমাকে বিএসএইচ-এর যে ডাক্তার অপারেশন করেছিলেন, তিনি তখন সেখানে ছিলেন না, অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিলেন। আমরা খোঁজ নিয়ে ওখানেই যাই।


তিনি সব রিপোর্ট দেখে বললেন, রডটা চার বছর পর্যন্ত রাখার কথা ছিল। তবে এখন যেহেতু ভেঙে গেছে, সেহেতু এটা আর রাখা যাবে না। রাখলে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হবে। তিন বছর যখন হয়েছে, তখন অপারেশন করে রড বের করে ফেলতে হবে। ভাঙা হাড়দুটো অনেকটা জোড়া লেগেছে, তবে মেরুদণ্ড কিছুটা বাঁকা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আমি কোভিডের মধ্যেও ডিসেম্বরে হাসপাতালে ভর্তি হই। অপারেশনের আগের দিন কোভিড টেস্ট করানো হয়। রিপোর্ট নেগেটিভ আসে।


আমার জীবনে একজন ভালোবাসার মানুষ ছিল। সে ছিল সলিমুল্লাহ মেডিক্যালের ডাক্তার। আমার আদরের ‘ডাক্তারসাহেব’ একজনই ছিল। সে আমার পরিবারকে অনেক বলেছিল সলিমুল্লাহ মেডিক্যালে অপারেশন করাতে, কিন্তু আমার আব্বু রাজি হয়নি, কারণ আব্বু আমাদের সম্পর্কটা মেনে নেয়নি। আমার অপারেশনের আগে সে আমাকে অনেক বারই বিয়ের কথা বলেছিল। কিন্তু অনেক বুঝিয়েও আমি পেরে উঠিনি আমার পরিবারের সাথে। আমার পরিবার তাকে কিছুতেই মেনে নিতে চায় না। আমার অপারেশনের দিন সকালে তার হসপিটালে আসার কথা ছিল। আমার হসপিটালে ভর্তির চার-পাঁচ দিন আগে তার বন্ধুদের সাথে কক্সবাজারে একটা ট্যুরে যাওয়ার কথা ছিল। আমি তাকে যেতে অনেক বারণ করেছিলাম। সে আমার অমন ছটফট-করা চোখের জল উপেক্ষা করে শীতলকণ্ঠে বলেছিল, আমাকে যেতে হবে। আমি ওদের কথা দিয়েছি।


মানুষটাকে খুব অচেনা লাগতে শুরু হয়েছিল অনেক আগেই, সেটাই আজ সত্যি হলো। মানুষটা সবসময়ই ভাবত, আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাব কবে? যার মেরুদণ্ডটাই ভাঙা, তার সাথে সারাটা জীবন কী করে কাটাব? মানুষটার চোখের দিকে তাকালেই আমি বুঝতে পারতাম, তার মন ক্রমেই অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে। আমাকে ওরা সকালে অপারেশন রুমে নিয়ে যাচ্ছিল যখন, তখন আমি প্রচণ্ড দম বন্ধ-করা কান্নায় ভেঙে পড়ি। বার বারই মনে হচ্ছিল, আমার মানুষটা কখন আসবে? হাতে ক্যানোলা পরানো অবস্থায় অন্য হাতে ফোন রেখে আমি ওকে কল করেই যাচ্ছিলাম। অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়ার পরও কল করা বন্ধ করিনি। কিন্তু সে আমার একটা কলও ধরল না। আমি মরে যাচ্ছি, এটাও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু আমি যার জন্য বেঁচে আছি, সে আমাকে অবহেলা করছে, এটা মেনে নেওয়া কঠিন।


সে কক্সবাজারে বন্ধুদের সাথে আনন্দ-ফুর্তিতে ব্যস্ত ছিল হয়তো। ঠিক ওই সময়ে তার ভালোবাসার মানুষটা মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে, সেদিকে তার খেয়ালই নেই। সুখের জোয়ারে ভাসছে সে। যখন ঠিক সকাল এগারোটা, তখন আমি তাকে শেষ কলটা দিই দু-চোখ অশ্রুতে ভাসিয়ে। খুব ইচ্ছে করছিল তার কণ্ঠটা একটু শুনতে। তার পরও আর একটু সময় চেয়ে নিই আমি ডাক্তারদের কাছে। আমার শুধুই মনে হচ্ছিল, আমার মানুষটাকে একটু দেখতে না পেলে বোধ হয় আমি বাঁচব না। তাকে দেখতে না পাওয়ার এই তীব্র ইচ্ছে নিয়েই বোধ হয় আমি মরে যাব। ডাক্তার আমার কান্না দেখে কিছুসময় অপেক্ষা করলেন, তারপর আমাকে বেহুঁশ করে ফেললেন। আমার জ্ঞান ফেরে সেই বিকেল চারটায়।


জ্ঞান ফিরলে দেখি, আমি আইসিউ’তে, লাইফসাপোর্ট। আমার মনে হচ্ছিল, আমি আর বাঁচব না, আমার সারাশরীর যেন ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে আসছিল। এর সাথে নিষ্প্রাণ হচ্ছিল আমার হৃদয়টাও। সেই রাতে কত কত মানুষ যে আমাকে দেখতে এসেছিল, কিন্তু সেই মুখগুলোর মধ্যে একটাও মুখ আমার সেই মানুষটার নয়! নিজেকে একজন চরম পর্যায়ের পরাজিত মানুষ মনে হচ্ছিল। শরীর এতটাই দুর্বল ছিল যে কাঁদতেও পারছিলাম না।


পরদিন সকালে সে আমাকে ফোন করে। আসল ধাক্কাটা বোধ হয় তখন খেলাম, যখন সে বলল, ‘তোমার অপারেশন তো ঠিকঠাকভাবেই হয়েছে! দোয়া করি, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও। আর একটা কথা। আমাকে তুমি আর কখনও ফোন দিয়ো না। এই সম্পর্কটা রাখা আমার পক্ষে আর সম্ভব না।’ কিছু সময়ের জন্য মনে হলো, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ‘ভালো থেকো।’ বলেই সে ফোনটা কেটে দিল। আমি নীরব নিস্তব্ধ নিথর হয়ে গেলাম। তার কিছুক্ষণ পরই একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য ছটফট করতে শুরু করলাম। আমাকে ওরা অক্সিজেন দিল। তারপর নিঃশ্বাস নিতে পারলাম। আমার ওরকম অস্থিরতা দেখে ওরা আমাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখল।


ঘুম থেকে ওঠার পর আমি তার কাছে যাওয়ার জন্য পাগলের মতো করছিলাম। আমাকে আমার বেডে আনা হলো। অনেক দিন হসপিটাল থাকতে হলো। ইনজেকশন নিতে নিতে আর ব্যথা সহ্য করতে করতে কেমন জানি অনুভূতিশূন্য হয়ে গেলাম। কারও সাথেই কোনও কথা বলি না। শুধুই দু-চোখের জল ফেলা ছাড়া যেন আর কিছুই করতে পারি না। এতদিনে একটা বারও আমার ভালোবাসার মানুষটা আমাকে ফোন করেনি, দেখতে আসেনি। মানুষ মানুষকে এভাবে ভুলে যেতে পারে! এ-ও সম্ভব!


হসপিটাল থেকে বাসায় গেলাম। মনে হচ্ছিল, বাসায় শুধু আমার জ্যান্ত শরীরটাই গেছে, আমার মন তো মরে গেছে সেদিনই! বাসায় আসার পর দিন দিন আমার পাগলামি বেড়ে যেতে থাকে। রুমের কোনও কিছুই ঠিক থাকে না, হাতের কাছে পেলেই ভাঙচুর শুরু করি। যখন-তখন হাত কাটি, আমার আম্মু দেখে ভয় পেয়ে যায়। আমার চোখের সামনে থেকে ছুরি-ব্লেড-কাঁচি সরিয়ে রাখা হতো। আমাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো শুরু হলো। সারাদিন ঘুম পাড়িয়ে রাখত আমার পাগলামির জন্য। আমি শুধু একটা কথাই ভাবতাম, আমার সাথে সে এমন কেন করল! অনেক ভেবেও আমি আমার একটাও অপরাধ খুঁজে পাইনি! আমার সততা, আমার আন্তরিকতা, আমার ভালোবাসা এসবের কী কোনও দাম নেই?


অনেক দিন পর হঠাৎ একদিন জানতে পারি, আমার সেই মানুষটার জীবন এখন অন্য কারও সাথে জড়িয়ে গেছে। তার পাশে এখন অন্য কেউ, তার হাতের উপর এখন অন্য কারও হাত। এসব জানতে পারার পর মনে হলো, জীবনটা একেবারে শেষ হয়ে গেল! এত বছরের সম্পর্ক ভেঙে সে কীভাবে পারে এমনটা করতে! শেষ যে বার সে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ছিল, সেদিনটায় কেমন জানি বুকটা কেঁপে উঠেছিল। বুঝিনি তখন, ছেড়ে যাবে বলেই সেদিন অমন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ছিল। এর আগে সে কখনও এমন শক্ত করে আমাকে বুকের সাথে লেপটে রাখেনি। সে এখন আর আমার নয়, এ-ও মানা যায়! কিন্তু সে এখন অন্য কারও, এটা মেনে নিই কীভাবে?


এত কিছু ভাবতে ভাবতে দিন দিন যন্ত্রণা আরও বাড়তে লাগল। সহ্য করতে না পেলে সুইসাইড করার সিদ্ধান্ত নিলাম। গলায় ফাঁস দেওয়ার চেষ্টা করলাম, আর তখনই আম্মুর মুখটা ভেসে উঠল! চোখে ভাসল, আমার মৃত্যুর পরের দিন আম্মু আমার চলে যাওয়ার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মারা গেছে। ঠিক তখনই জোরে চিৎকার দিলাম আম্মু আম্মু বলে, আর অমনিই সবাই দরজা ধাক্কাধাক্কি করে রুমে ঢুকে পড়ে। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কান্না শুরু করি। সত্যিই আমার যদি কিছু হয়ে যায়, তবে আমার আম্মুকে আর বাঁচানো যাবে না। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে অনেক সময় ধরে কান্না করার পর একটু শান্ত হলাম। তারপর আম্মুর কোলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে ওঠার পর অনেকটা শান্তি পেলাম। মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলে কেমন লাগে, তা আজ আমি জানি।


ভাবলাম, যে মানুষটার জন্য আমাকে এত কষ্ট পেতে হচ্ছে, সে কি আসলেই আমাকে এখন আর ভালোবাসে? না, বাসে না! তাহলে কেন আমি তার জন্য নিজের জীবনটা শেষ করে দেবো? দু-জনে অনেকটা পথ একসাথে চলেছি। ভালো আর বাসে না বলেই সে আমাকে মাঝপথে ছেড়ে চলে গেছে। নাহলে আজ আমাদেরও একটা সংসার হতো। যা হয়নি, তা হওয়ার কথা ছিল না বলেই হয়নি। এ পৃথিবীতে, যা হওয়ার নয়, তা হয় না। এটা আগে বুঝিনি। আজ বুঝেও কেন এমন অবুঝের মতো করব? যে আমার কথা এখন আর ভাবে না পর্যন্ত, তাকে ভালোবাসতে ভালোবাসতে নিজেকে এভাবে শেষ করে দিচ্ছি কেন? সে তো ভালোই আছে অন্য মানুষকে নিয়ে! আমি কেন এমন একা একা থেকে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছি? আমি যখন মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি, তখন তো সে দিব্যি আমোদফুর্তিতে ব্যস্ত ছিল! আমার জন্য তার মনের ভেতর একটুও অনুভূতি থাকলে কি সে কাজটা করতে পারত? বুঝি সবই, তবু মন যে মানে না! মনের চাইতে নির্লজ্জ আর কিছু হয় না!


আমার সুইসাইড করতে যাওয়ার কথা পরের দিন সে আমার বান্ধবীর কাছ থেকে জানতে পারে। ছুটে চলে আসে আমার বাসার সামনে। ওকে আমার পরিবারের কেউ বাসার ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। আমার বাবা-ভাইয়া আমাদের সম্পর্কটা মেনে না নিলেও আমার পরিবারের বাকি সদস্যরা ভীষণ ভালোবাসত ওকে। আমাদের বিয়ে দিতে রাজি না হওয়ার কারণ একটাই ছিল: আমার অসুস্থতা। আব্বুর একটাই কথা, আমার রিমি আগে সুস্থ হবে। অনার্স শেষ হবে, তারপর বিয়ে দেবো, এর আগে না। কিন্তু ও সেটা একদমই মানতে চাইত না। আমাকে অনেক বারই বলেছিল বাসা থেকে পালানোর কথা। আমি কখনও রাজি হইনি। এর জন্য বহু বার কথাবলাই বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি সবসময়ই বলেছি, আমার পরিবার তো বলেছে, তোমার সাথেই বিয়ে দেবে, তাহলে তুমি কেন একটু ধৈর্য ধরতে পারছ না আমার জন্য? আমার অসুস্থতা নিয়ে আমি তোমার সংসার সুখী করতে পারব না। কিন্তু আমার এইসব কথায় ওর কখনওই মন ভরত না। আমি তার মুখ দেখেই সব বুঝতে পারতাম।


আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ওর কান্না সেদিন আমাকে দুর্বল করে দেয়। বড্ড বেহায়া আমি! ভালোবাসা পাওয়ার কাঙাল আমি! চারতলা থেকে একদৌড়ে নেমে বাসার গেট খুলে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াই। এত কিছু হওয়ার পরেও খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, জড়িয়ে ধরি! পরক্ষণেই মনে পড়ল, সে এখন অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে। সে আজ আর আমার নয়! নিজেকে খুব কষ্টে সামলে রাখলাম। আমি নিজেকে সামলে নেওয়ার প্রস্তুতি নিলেও সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করে, আর বলতে থাকে, ‘রিমি, মাফ করে দাও! রিমি, মাফ করে দাও!’ আমি চোখের জল আটকে রাখতে পারলাম না। আমিও কাঁদতে শুরু করলাম। এরপর বাসায় নিয়ে গেলাম তাকে। মানুষ নিজেই আদর করে ঘরে বিপদ ঢোকায়!


ওকে মনে হয় এই মুহূর্তেই মেরে ফেলবে, এমন রাগী রাগী চোখে আব্বু-ভাইয়া ওর সামনে এল। আমি তখুনি ওর হাতটা চেপে ধরলাম। ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কী চাস, রিমি?’ আমি বললাম, ‘ভাইয়া, আমি ওকেই চাই! আমি ওকে মাফ করে দিয়েছি। ও একটা ভুল করে ফেলেছে। যদি ভালোবাসতে পারি, তবে ক্ষমা কেন করতে পারব না?’ ভাইয়া বলল, ‘অনেক কথা শিখে গেছিস দেখছি!’ এই বলে আমার গালে একটা থাপ্পড় দিল। আর বলল, ‘এর জন্য তোকে অনেক পস্তাতে হবে, দেখে নিস।’ আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম, আর একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মনে মনে বললাম, ‘কিছুই হবে না! আমরা অনেক সুখেই থাকব, দেখে নিয়ো।’ যারা চোখে দেখে না আর যারা প্রেমে পড়ে, এই দুই দলের মধ্যে আসলে কোনও পার্থক্য নেই।


রাতে ওর পরিবারকে ডাকা হলো বাসায়। আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে কে কী করতে চায়, তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বাসায় ওরা সবাই এল। ওদের পরিবার আমাদের এনগেজমেন্ট নিয়ে কথা বলল। তখন দু-জন দু-জনের দিকে তাকিয়ে কী যে একটা শান্তি পাচ্ছিলাম, তা বলে বোঝানো যাবে না! তবে ভাইয়া কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। চার দিন পর আমাদের এনগেজমেন্টের তারিখ ঠিক হলো। বড়ো ফুফু ও মেজো কাকাকে অনেক বুঝিয়েও রাজি করাতে পারিনি। আমিও না খেয়ে বসে থাকলাম রুমের মধ্যে। যতক্ষণ ভাইয়া রাজি না হবে, ততক্ষণ আমি রুম থেকে বের হব না। ভাইয়া রেগে গিয়ে বলে বসল, ‘ওর সাথে যদি রিমির বিয়ে হয়, তবে আমার সাথে এই বাসার কারও সম্পর্ক থাকবে না। আমি এই বাসা ছেড়ে চলে যাব একেবারে। বাসায় হয় রিমি থাকবে, নইলে আমি।’


ভাইয়ার এইসব কথা শুনে বাসার সবার মতামত পালটে যেতে লাগল। কী করব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। রুমে মধ্যে বসে তাকে ফোন করে কান্নাকাটি করতে থাকি। আমাকে খেতে দিলেও কিছুই খাই না। টানা দুই দিন না খেয়ে থাকলাম। অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমার অবস্থা দেখে ভাইয়া অনেক কষ্ট পায়। পরে রাজি হয়ে যায়। তখন আমি খুশিতে যেন হাসি বন্ধই করতে পারছিলাম না! ঠিক হলো, সামনের শুক্রবার আমাদের এনগেজমেন্ট অনেক বড়ো করেই হবে। পরিবারের ছোটো মেয়ে আমি। তার উপর অসুস্থ হওয়ায় আরও বেশি আদরের। সবাই আমাদের জন্য কেনাকাটা করতে গেল। বড়ো মামা আর খালামণি আমাদের বিয়ের আংটি কিনতে গেল। বাকিরা গেল শাড়ি, পাঞ্জাবি, কসমেটিকস এসব কিনতে। ওদের পরিবারের সবাই গ্রামের বাড়িতে, তাই এনগেজমেন্ট আমাদের বাসায় হবে। ওর পরিবারের সদস্য বলতে ওর মা-বাবা আর ছোটো বোন। খুবই ছিমছাম মধ্যবিত্ত পরিবার ওদের। আমি আগে ভাবতাম, মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা খুব ভালো হয়। আজ বুঝি, একটা মানুষ ভালো কিংবা খারাপ হওয়ার সাথে বিত্তের কোনও সম্পর্কই নেই।


শুক্রবার সকালের কথা। ও আমাদের বাসায় আসে ওর বড়ো চাচাতো ভাই আর বন্ধুদের নিয়ে। ওকে কী যে সুন্দর লাগছিল পাঞ্জাবিতে! সেদিন আমি অনেক সেজে ছিলাম শাড়ি পরে। প্রচুর রান্নাবান্না করা হয়। ওর পছন্দের প্রতিটি খাবারই বানানো হয়। দুপুরে নামাজ পড়ে এসে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবাই একসাথে হয়। তখন বিকেল, ঘড়িতে ঠিক সোয়া চারটা। পারিবারিকভাবেই আজ আমাদের এনগেজমেন্ট! কী যে অদ্ভুত সুন্দর ছিল সেই অনুভূতিটা, বলে বোঝাতে পারব না। তার উপর সবাইকে বলাবলি করতে শুনলাম, ঈদে ভাইয়ার বিয়ের পর আমাদের বিয়ের তারিখ দেবে। ভালোবাসার মানুষটাকেই বিয়ে করতে পারার চাইতে বড়ো সৌভাগ্য আর কী আছে এ পৃথিবীতে!


ভাইয়া রুম থেকে আসতে একটু দেরি করায় সব মেহমান ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। আমিও তাই ওই ফাঁকে একটু অনলাইনে যাই। আমাদের দু-জনের কাপল-ছবি, আমার যে বান্ধবীরা আসেনি, ওদের পাঠালাম। বকাঝকাও করলাম এই বলে যে, কেন ওরা আসেনি! হঠাৎই কেন জানি মেসেজ রিকোয়েস্টে গেলাম। দেখি, সেখানে এত এত মেসেজ জমা হয়ে আছে! খেয়াল করলাম, একটা মেয়ে আমাকে অনেকগুলো মেসেজ পাঠিয়েছে। সেখানে অসংখ্য ছবিও আছে। মেসেজ রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করলাম। তারপরই সে আমাকে একটানা কল দেওয়া শুরু করল। আমি খানিকটা ভয় পেয়ে গেলাম কেন জানি! তার কল বার বার কেটে মেসেজ আর ছবিগুলো দেখতে শুরু করলাম। দেখলাম, ওর সাথে ওই মেয়ের অনেক ঘনিষ্ঠ ছবি। ওরা দু-জন কক্সবাজার গিয়েছিল। সেখানকার অনেক ভিডিয়ো। আমি ওগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মেসেজগুলো পড়ে বুঝতে পারলাম, আমি যখন হসপিটালের বেডে, তখন আমার ভালোবাসার মানুষটা অন্য কারও বুকে!


হঠাৎ করেই আমার নম্বরে একটা কল আসে। আমি রিসিভ করার সাথে সাথেই সে আমাকে বলে, ‘তুমি কি চাও তোমার খালাতো বোনের মতো কারও জীবন শেষ করতে? তোমার যার সাথে আজ এনগেজমেন্ট, আমি তার গার্লফ্রেন্ড। আমরা একসাথে রিসোর্টে ছিলাম। ও আমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। এই বছরই আমাকে বিয়ে করবে বলেছে। তুমি চাইলে ওকে জিজ্ঞেস করে দেখো। আর যদি ও এখন তোমাকে বিয়ে করে, তবে আমি ওর জীবন শেষ করে দেবো। ওকে শেষ করে আমি নিজেও শেষ হয়ে যাব।’ আমি ফোনটা লাউডস্পিকারে দিই। আর শক্ত করে তার হাতটা চেপে ধরি। মেয়েটাকে বলি, ‘আপু, আজ আমাদের এনগেজমেন্ট হচ্ছে, আর আপনি কী সব বলছেন! ও আমাকে ভালোবাসে। ঈদের পরে আমাদের বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেছে। আমি আপনার কোনও কথা বিশ্বাস করি না।’ সে তখন বলল, ‘যদি বিশ্বাস না করো, তাহলে তাকেই জিজ্ঞেস করো, এটা কি মিথ্যে, না কি সত্যি!’ আমি বোকার মতো ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলি, ‘বলো না, এটা মিথ্যে! উনি যা বলছেন, তার সবই মিথ্যে!’ কিন্তু তখন সে একটা কথাও বলল না। ওই মেয়ে কলটা কেটে দেয়। আর সে আমার হাতটা ছেড়ে দেয়। ওই মুহূর্তের অসহ্য অনুভূতির কথা ঠিক লিখে বোঝাতে পারছি না। ওরকম একটা জঘন্য অনুভূতির মুখোমুখি হওয়ার চাইতে মরে যাওয়াও ভালো!


শুধু একটা কথা বলে ও চলে গেল। ‘রিমি, আমার অনেক বড়ো একটা ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ, আমাকে তুমি মাফ করে দাও।’ একে একে সবাই আমাদের বাসা থেকে চলে গেল। আমার আম্মু সেদিন আমাকে ইচ্ছেমতো থাপ্পড় দিল। আম্মু আমাকে এর আগে কখনও অমন করে মারেনি। আমার চোখ থেকে একফোঁটাও জল সেদিন পড়েনি। আম্মু আমাকে ক্রমাগত মারছিল আর কাঁদছিল। আর ওকে সবাই অনেক ধাক্কাধাক্কি করে বাসা থেকে বের করে দিচ্ছিল। ও শুধু একটাই কথা বলে চলছিল, ‘রিমি, আমাকে ক্ষমা করে দাও।’ ভাইয়া আমাকে রুমে নিয়ে আটকে রাখল। আর ও চিৎকার করতে করতে চলে গেল। আমার মাথা, বোধ কিছুই কাজ করছিল না।


আচ্ছা, আমি যদি ওকে মাফ করেও দিই, তবু্ও কি এই আঘাতটা কখনও ভুলতে পারব যে আমার মানুষটা আমার সাথে সম্পর্কে থাকা অবস্থায় অন্য কারও সঙ্গে রাত কাটিয়েছে? মানতে পারব যে তার শরীরে অন্য কারও স্পর্শ লেগে আছে? আমি পারব না ভুলতে এইসব! আমি পারব না তাকে আর নিজের করে নিতে! সম্ভব না আর। সবকিছু শেষ! আমি সব সহ্য করতে পারব, কিন্তু এরকম বেইমানি সহ্য করতে কিছুতেই পারব না।


বাসার সবাই কেমন জানি চুপ! কোনও সাড়াশব্দ নেই। যেন মৃত্যুপুরী! বুঝলাম, ও তাহলে আমাদের বাসা থেকে চিরবিদায় নিয়েছে। আমি রুমের মধ্যে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম দেয়ালে ঝোলানো আমাদের কাপল ছবিটার দিকে। আর কোনওদিনই আমাদের দু-জনের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তোলা হবে না। হাতে হাত রাখা হবে না, একসাথে পথচলা হবে না। একনিমিষেই শেষ হয়ে গেল সবই চোখের সামনে। দ্বিতীয় বারের সেই ধাক্কাটা অনেকটা পাথর করে দিয়েছিল আমাকে। বুক ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু চোখে কোনও জল নেই। দ্বিতীয় বারের মতো জীবনটা আবার থমকে গেল! অনেক বকবক-করা সেই চঞ্চল রিমি এখন সারাদিনে হাতেগোনা চার-পাঁচটা টা শব্দ ছাড়া আর কোনও কথা বলে না। এই পৃথিবীর সব নিষ্ঠুর শাস্তি বুঝি উপরওয়ালা এক আমার জন্যই রেখে দিয়েছিলেন! আমি সারাদিনই ভাবতে থাকি, কিন্তু কোনও হিসেবই মেলে না।


সেদিনের ঘটনার ঠিক কিছুদিন পর এমনই একটা শুক্রবারে শুনলাম, তার বিয়ে অনেক বড়ো অনুষ্ঠান করে হচ্ছে ঢাকাতেই, সেই মেয়েরই সাথে। মেয়েটা পুরান ঢাকার অনেক বড়ো এক ব্যবসায়ীর মেয়ে। আমি জানলাম, সেই মেয়েটাকেই সে বিয়ে করছে, যে মেয়েটা আমার কাছ থেকে তাকে কেড়ে নিয়েছে। সেই মেয়েকেই সে এখন জীবনে বেছে নিল। লক্ষ করলাম, আমার বুকের মধ্যে কেমন জানি একটা হাহাকার হচ্ছে। আমার ভেতরে বাইরে পুরোপুরিই ফাঁকা হয়ে গেছে! কিন্তু আমি কিছুতেই চিৎকার করতে পারছি না। খুব চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে কোনও শব্দই বের হচ্ছে না। আম্মু বলল, ‘রিমি, কান্না কর! আজকে তুই ভাঙচুর কর! গলা ফাটিয়ে চিৎকার কর তুই! এমন নীরব হয়ে থাকলে তোর কিছু একটা হয়ে যাবে! মনের মধ্যে কষ্ট চেপে রাখিস না এমন করে!’ এত চেষ্টার পরও আমি কাঁদতে পারলাম না। অতটা কষ্টেও কাঁদতে না পারার যন্ত্রণা সহ্য করা সত্যিই অনেক কঠিন! ওরকম অবস্থার মধ্য দিয়ে যাকে যেতে হয়নি, সে এটা বোঝা দূরে থাক, অনুমান পর্যন্ত করতে পারবে না।


চার-পাঁচটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে রইলাম। এভাবেই ঘুমের ওষুধ খেয়ে প্রতিদিন বিছানায় পড়ে থাকি। মোবাইল ফোন আমার কাছ থেকে অনেক দূরে কোথাও এক জায়গায় পড়ে থাকে। একদিন তার প্রোফাইলে গিয়ে দেখলাম, আমার সাথে যে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দেওয়া ছিল, সেটা এখন অন্য একজনের সাথে ম্যারিড স্টাটাস দেওয়া। দেখে আমি সহ্যই করতে পারছিলাম না। নিজের জিনিস, নিজের মানুষ বিনা দোষে অন্য কারও হয়ে গেলে কেমন একটা জানি কষ্ট লাগে! আমার খুব খারাপ লাগে যখন আমার কাছে বসে কেউ বলে, তোর মানুষটা এখন আরেকজনের হয়ে গেল রে! আমারও সেই প্রত্যেকটা মুহূর্তে কষ্ট লাগে যখন মানুষটার পাশের ছবিতে অন্য কেউ থাকে। আমারও দম বন্ধ-করা কষ্ট হয় যখন আমার নিজের তুমি’টাকে অন্য কেউ নিজের তুমি বলে জানে। কত মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার জন্য কত-কীই তো থাকে! আর আমার জীবনে যে একটা মাত্র অবলম্বন ছিল, তা-ও এভাবে হারালাম!


আমি শুধু একটা কথাই ভেবে পাই না। মানুষটা আমাদের পাঁচ বছরের সম্পর্ক ভেঙে দিল যখন আমি হসপিটালের বিছানায় পড়ে আছি। তারপর আবার সে ফিরে এল আমাকে এই আঘাতটা দিতে! কীভাবে পারল সে আমাকে ধোঁকা দিতে। একবারও ভাবল না রিমি কীভাবে বেঁচে থাকবে আমাকে ছাড়া? ও তো আমাকে একদিন দেখতে না পেলে না খেয়ে থাকে! বেচারি বাঁচবে কী করে? নাহ্‌! সে ভাবেনি এসব একটি বারের জন্যও! শুধুই নিজের ভালো থাকার কথাটাই সে ভেবে গেছে। নাহলে আজ আমাদেরও একটা সংসার হতো। খুব ইচ্ছে ছিল একটা সংসার হবে আমার! ছোট্ট সংসার! আমরা দু-জন মিলে বিত্তে হোক না হোক, চিত্তে অন্তত বাঁচব। আমাদের ভালোবাসার প্রমাণ হয়ে বেঁচে থাকবে আমাদের সন্তান। এ সবই শুধু স্বপ্নই থেকে গেল। আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য নয়, আমার এইসব স্বপ্ন ভেঙে ফেলার অপরাধে আমি তাকে কখনও ক্ষমা করব না। কোনওদিনই না! তবে আমি মন থেকেই চাই, সে ভালো থাকুক। তার ভালো থাকার জন্যই তো এত কিছু!


অনেক দিন পার করার পর আস্তে আস্তে সবকিছু মেনে নিতে শুরু করলাম। আমার প্রথম বারের অপারেশনে চার লাখ আর পরের বারে দুই লাখ টাকা খরচ হয়। মনে একটা জেদ আনলাম। আমাকে বেঁচে থাকতে হবে, এবং যে-কোনও মূল্যে ভালো থাকতে হবে৷ জীবনে অনেক বড়ো হতে হবে। হয়তো এই ছয় লাখ টাকা কিছুই না। তবুও জেদ করলাম, নিজে উপার্জন করে এই ছয় লাখ টাকা আমি আগে দিয়ে দেবো আমার পরিবারকে। আমার আম্মুর খুব স্বপ্ন, তার মেয়ে বিসিএস ক্যাডার হবে। তাই পড়াশোনাটা খুব ভালোভাবে শুরু করে দিলাম।


যখন আমার বান্ধবীরা সবাই গল্পে-আড্ডায় জীবন সাজাতে গোছাতে ব্যস্ত, তখন জীবনের সেই অধ্যায়টা আমার কাছে অসহ্য ঠেকছে! যেসব ছেলেবন্ধুর সাথে আগে কথা বলতাম, আড্ডা দিতাম, তাদের সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম। বান্ধবীরা আমার এই পরিবর্তন দেখে বলল আরেক বার রিলেশনশিপে জড়িয়ে যেতে। সবাই তো আর এক না! ওদের ধারণা, ভালো থাকার একটাই রাস্তা: রিলেশনশিপে থাকা।


তবে আমি ভালোবাসা নামের শব্দটাকেই বেমালুম ভুলে গেছি। ভুলে যেতে চাই ভালোবাসার যা-কিছু আছে। জীবনে ভালো কিছু হয়ে দেখাব, এটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। ভালোবাসার মধ্যে আমি আর কখনওই মানসিক শান্তি খুঁজে পাবো না। আমি তার দেওয়া কষ্টকে সাথে নিয়েই জীবনে ভালো কিছু হবই হব! আমার কষ্টই হোক আমার জন্য আশীর্বাদ! আমি চাই, একদিন যেন ওই মানুষটা আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কাঁদে আর আফসোস করে। আমি যেন সেদিন তাকে বলতে পারি, ডাক্তার হতে পারিনি তোমার মতো, তবে জীবনে একজন ভালো মানুষ হতে পেরেছি। তোমার মতো কাউকে ঠকাতে আমি জানি না। জীবনে অনেক কিছু পেয়ে গেছ বুঝি আমাকে ঠকিয়ে?


আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করলাম। কিন্তু নামাজে দাঁড়ালেই চোখে পানি চলে আসত। আমি মোনাজাতে আল্লাহর কাছে কিছুই চাইতে পারতাম না, শুধুই কান্না করতাম। আর খুব করে মনে মনে বলতাম, সে যেন ভালো থাকে। নিজের সব বাজে অভ্যাস ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। এই যেমন, রাত বারোটা-দুইটা পর্যন্ত অনলাইনে থাকা, রাতজাগা সবই বাদ দিয়ে দিলাম। প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকতে শুরু করলাম। পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন বই পড়া, বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া শুরু করলাম। অনলাইনে একটা উদ্যোক্তা সম্পর্কিত কোর্সে ভর্তি হলাম। ভাবলাম, সময় কাটানোর জন্য আরও কিছু করা দরকার। আমার আগের সেই অনলাইন বিজনেসটা আবার নতুন করে শুরু করলাম। আমার গানের গলা বেশ ভালো। গলার যত্ন নিতে প্রতিদিন রেওয়াজ করি। আরও শুরু করলাম অনেক শখের আরজে অনলাইন কোর্স। তারপর একটু-আধটু কবিতা আর লেখালেখিও শুরু করলাম। কী হবে মানুষটার জন্য নিজের জীবনকে থামিয়ে রেখে? সে তো তার নিজের জীবন নিয়ে ভালোই আছে!


আমি একটা ক্যাডেট স্কুলে প্রাইমারি সেকশনের টিচার হিসাবে ছিলাম। কোভিডের কারণে এখন অনলাইনে ক্লাস নিতে হয়। অসুস্থতার জন্য ক্লাস নেওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছিলাম আমার অপারেশনের পর। অনেক ভেবেচিন্তে আবার যুক্ত হলাম স্কুলের সাথে। অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করলাম। দিনের বেশিরভাগ সময়ই অনলাইনে বাচ্চাদের সাথে কাটতে থাকে। বড়ো ভালো লাগে। মনের মধ্যে একধরনের সুখ সুখ অনুভূতি হয়। মাঝে মাঝে ভাবি, সেদিন যদি সুইসাইড করে ফেলতাম, তাহলে জীবনের এত সুন্দর অধ্যায়টা দেখাই হতো না। জীবনে সামনে কী হবে, তা দেখার জন্য হলেও তো বেঁচে থাকা যায়! আগে আমার পাগলামির জন্য আম্মু আমাকে কতই-না রুমে আটকে রেখেছে! আর এখন আম্মুই বলে, মাসে এক বার দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে পারিস না? বন্ধুদের সাথে আড্ডা দে! বাইরে যা!


এখন মন আর এইসব চায় না। সারাদিন শুধুই ব্যস্ত থাকতে ইচ্ছে হয় নিজেকে নিয়ে। তবে আমি সত্যিই জানি না আমাদের সম্পর্কটা ঠিক কবে শেষ হয়েছিল। সবাই জিজ্ঞেস করে, তোমাদের সম্পর্কটা শেষ হলো কবে? আমি তখন কোনও উত্তর দিতে পারি না। চুপ হয়ে নিজের কাছে প্রশ্ন করি, সম্পর্কটা ঠিক কবে শেষ হলো? যেদিন সে আমাকে শেষ বারের মতো জড়িয়ে ধরে ছিল, সেদিন? না কি যেদিন সে আমার হাতটা ছেড়ে দিল, সেদিন? আমি সত্যিই জানি না আমাদের বিচ্ছেদটা ঠিক কবে হয়েছিল! তবে হ্যাঁ, দু-জনের মনের বিচ্ছেদ হয়েছে বহু বহু বার। আসলে মনের বিচ্ছেদ হয়ে গেলে চূড়ান্ত বিচ্ছেদটা সময়ের ব্যাপার মাত্র!


এই একুশ বছর বয়সে জীবনের অনেক ভাঙাগড়া দেখে ফেলেছি। জীবনে বেঁচে থাকার লড়াইটা একাই লড়তে হয়, এটা খুব ভালো করেই শিখে গেছি। এ পৃথিবীতে কেউ আসলে কারও জন্য মরে যায় না, বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই শুধু মরে যায়। তবু কারও জন্য কারও জীবন থেমে থাকে না। কোনও-না-কোনও এক পথে জীবন চলতে থাকে। এখন আমার মাসিক আয় প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা। নিজে উপার্জন করি, নিজের টাকায় চলি। স্বাধীনভাবে চলতে পারি। পরিবারে আমার সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি। ফ্রেন্ডরাও খুব উৎসাহ দেয়, সম্মানও করে। এখন আমার মন খারাপ হয় খুব কমই। কষ্ট পাওয়ার সময়ই তো পাই না!


এই দিনটা কখনও আসতই না, যদি না মানুষটা আমাকে অতটা আঘাত দিয়ে চলে যেত। আমি যে একটু মন খারাপ করে বসে থাকব, কিংবা তার কথা মনে করে একটু কষ্ট পাবো, সেই সময়টুকুও এখন আর হয়ে ওঠে না। সবকিছুর মাঝে আমি আজ চার-পাঁচটা কবিতা ও লেখালেখি গ্রুপের মডারেটর। অনেকগুলো পেইজের সাথে জড়িত হয়েছি অ্যাডমিন হিসেবে। বিভিন্ন গ্রুপে ও পেইজে লেখালেখি করি। রাত হলে নিজের জীবনের গল্পটা একটু লিখতে বসি। রিমির জীবনের গল্প! আমি অবসর চাই না, নির্বাসন চাই না, আমি শুধুই বাঁচতে চাই। নানান কাজে নিজেকে সারাক্ষণই ভীষণ ব্যস্ত করে রাখি। এভাবেই চমৎকার কেটে যাচ্ছে জীবন…নীল আকাশের একটুকরো মেঘ হয়ে।