কোলাহলের স্মৃতি হাতড়ে

মাঝে মাঝে কোনও কথাবার্তা ছাড়াই তোমাকে আই লাভ ইউ বলি। কেন বলি, জানো? এই বলাটাই ইগোর কারণে শত চেষ্টা করলেও, শত ইচ্ছা থাকলেও বলতে পারি না আমরা অনেকেই। তবে আমি এর প্রত্যুত্তর আশা না করেই বলি। আমি এটা তখনই বলি, যখন আমি ফিল করি বলার জন্য; যখন করি না, তখন শুধু উত্তর দেবার জন্যও বলি না। ভুল করেও কখনোই বলি না।

ভান ব্যাপারটা আমার ভালোবাসার সম্পর্কেও কখ‌নও আসে না। যা আমি ফিল করি না, তা মিথ্যে করে হলেও বলি না বা বলা ভালো, আমি আসলে ওরকম কিছু বলতে পারি না। ভাবি, জীবনটা সত্যিই খুব সংক্ষিপ্ত; আমরা তো জানি না আমাদের মৃত্যুক্ষণ কোনটা। হতে পারে, এই আই লাভ ইউ-টাই আমার শেষ বলা কিংবা বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু বলিনি বা পারিনি...তাহলে আফসোসটা তো থেকেই যাবে। তাই হঠাৎ হঠাৎ বলে ফেলি, ঠিক যখন খুব ফিল করি বলতে।

হয়তো সবসময় বলতে চাইলেও সময়ে কিংবা ক্ষণে মেলে না তোমার সাথে আমার। আমি তোমাকে যখন-তখন কল দিই না, তার মানে এটাও না যে, আমার কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। তবে সাধারণত তোমাকে জানিয়েই কল দিই। মাঝে মাঝে না বলেই দিই, তার মানে, ওই সময়টাতে আমার হৃদয় ছুটে যায়, আমি পারি না ওকে ধরে রাখতে। ওই সময়টাতে তোমাকে দেখতেই হবে, একমিনিট হলেও কথা বলতেই হবে...এতটাই কষ্ট হয়।

তবে এখন সেটাও বাঁধ মেনে নিতে শিখেছে, বলতে হয়, তুমিই শিখিয়েছ। এটা একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। মানুষ বাধা না পেলে শেখে না। আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য‌ও এটার প্রয়োজন আছে। তবে দিনশেষে আমরা সবাই মানুষ তো, তাই কিছু প্রত্যাশা তৈরি হয়েই যায়। আমাদের ব্রেইনের কোডিংটাই ওভাবে করা। এই জায়গাটাতে আমাদের কিছুই করার নেই।

একা একা আমরা হয়তো ৯০% বাঁচতে শিখে যাই, ১০% আর পারি না। ওই ১০%-ও যখন পূরণ হয় না, তখন মনে হয়, ৯০%-ও অকেজো হয়ে পড়ে মাঝে মাঝে। মানুষ ওই ১০%-এ তখন ভয়ে, আতঙ্কে আর কাউকে বসাতে চায় না। যাকে বসায়, সে-ই আঘাত করে, কষ্ট দেয়, গভীর ক্ষত তৈরি করে দেয়। ক্ষত বহন করে বাঁচতে খুব কষ্ট হয়। জীবনের এই ১০% অপূর্ণতা তাকে বাকিটা জীবন অপূর্ণতায় পরিপূর্ণ করে রাখে, আর ৯০% ভাগের সেই শিখে যাওয়াটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। ভাঙা গুঁড়োগুলিকে নিয়ে কোনোমতে জীবনটা একপলকে উড়িয়ে দিতে পারলেই মুক্তি মিলে যাবে!...এই ভাবনা ভাবা ছাড়া আর নতুন কিছু ভাবনায় আসে না তখন আর।

একসময় শরীরের শক্তি ফুরোবে, চামড়ায় টান পড়বে, আরও কমে আসবে গতি...মনটা তবু ১০% অপূর্ণতায় ভরে থাকবে কানায় কানায়। ওই ১০% হলো মনের ১০০%, যা সে আজন্ম ভালোবেসেও নিজের করে রাখতে পারেনি। তারপর একসময় স্মৃতির ইজিচেয়ারে বসে ১০% অপূর্ণতাকে মনে করে করে হারিয়ে যাবে ফিরে-না-আসা এক মহাশূন্যে।

এই ৯০% শিখতে আমার সময় লেগেছে ১৪ বছর; আমার বড়ো বোনের বিয়ে হবার পর থেকে। তখন ব্রেইন ইম্যাচিউর ছিল, তাই ধাক্কাটা নিতে পারেনি। তৈরি হয়েছে স্নায়বিক চাপ, যার মাত্রা বাড়তে থাকে প্রতিনিয়তই। সেখান থেকে আমি মেনে নিয়েছি, এটাই আমার চিরদিনের জীবনধারা! মেনে নিতে পারলে বেঁচে থাকাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। বাঁচতে শেখার একটিই মূলমন্ত্র: মানতে শেখা।

আজ ডেলিভারি বয়কে কল দিতে গিয়ে দেখি, কল যাচ্ছে না। আইভিআর থেকে বলা হচ্ছে, আমার ব্যালেন্সের মেয়াদ শেষ। ব্যালেন্স চেক করে দেখি, অনেক টাকা আছে, তবুও কল যাচ্ছে না, কারণ মেয়াদ নেই। মনে মনে হাসি আর ভাবি, একসময় মেয়াদ ফুরোত না, ফুরিয়ে যেত ব্যালেন্স। আজ ব্যালেন্স ফুরোয় না, ফুরিয়ে যায় মেয়াদ। সময়ের এ কী লীলা! আমার কি সত্যিই কাউকে কল করার নেই আর!! বিগত অনেক দিন যাবৎ রিচার্জ করি শুধুই মেয়াদ ফুরিয়ে যায় বলে।

আহা রে, কী রিক্ত একটা মানুষ আমি! সবাই-ই কি একদিন এমন রিক্ত হয়ে যায়?

একটা সময় ছিল, যখন ভালো ছাত্রী, স্পোর্টসে এক্সপার্ট, সুন্দরী, স্মার্ট, ড্যামকেয়ার, টমবয়-লাইক...এরকম অনেক উপাধিতে আমাকে এলাকায় সকলেই চিনত। ছেলেরা পর্যন্ত ব্যাডমিন্টন খেলায় আমার সাথে টিকতে পারত না। আমার বড়ো বোনকে তেমন কেউ চিনত না। কেউ জানতই না, আমার বাবার আরেকটা মেয়ে আছে। আজ আমার বড়ো বোন তার বর, সন্তানদের নিয়ে যখন বেড়াতে আসে, তখন লোকে ভাবে, আমার বাবার একটাই মেয়ে যে বাবার বাড়িতে আসে। আরেকটা যে মেয়ে আছে, সেটাই কেউ জানে না। সেই মেয়েটা হলাম: আমি!

সময়ের কী লীলা...কী লীলা!
আহা রে, কী শূন্য একটা মানুষ আমি! নিজের দিকে তাকালে আজ বড্ড মায়া হয়!

ভাবি, সংসারজীবনে যে সফল, দিনশেষে সে-ই সত্যিকারের সফল মানুষ। মাঝের এইসব সফলতা শুধুই কোলাহল...শুধুই কোলাহল ব‌ই আর কিচ্ছু নয়, কিচ্ছু নয়! আজ আমি কোলাহলের স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে বেঁচে থাকা একজন মানুষ।