কোভিডের এই সময়ে

 কোভিডের এই সময়টা তরুণদের প্রতি বেশ কঠিন কিছু উত্তর ছুড়ে দিচ্ছে, যেগুলির প্রশ্নই কখনও ওদের মাথায় আসেনি! যারা এখনও ক্যারিয়ার শুরু করতে পারেনি, তাদের অনেকেই ঠিক সময়ে পাশ করে বেরোতে পারবে না, কেননা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ আছে। পরিবারের চাপ ও ব্যক্তিগত নানা দায়, এই দুই মিলে তারা মানসিকভাবে অনেকটাই কোণঠাসা অবস্থায় আছে এখন।
  
 এই সময়টাতে প্রথমেই যা দরকার, তা হলো, বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। বৈশ্বিক সংকটের এই মুহূর্তে যা-কিছুই ঘটছে, তার প্রতিটিই কিন্তু সর্বজনীন। কারও একার ক্ষেত্রে এসব ঘটছে না। আমি যেমনি পিছিয়ে যাচ্ছি কিংবা পিছিয়ে যাবার আশঙ্কা করছি, বাকিদের জীবনেও তা-ই ঘটছে। সবার যে গতি, আমারও একই গতি। প্রকৃতপক্ষে, এটাই এখনকার পরিস্থিতি। আমি আলাদাভাবে এমন কিছু সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি না, যা কিনা আমার প্রতিযোগীরা পেয়ে যাচ্ছে।
 এটা ভুলে গেলে চলবে না, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে নিজেকে তৈরি করে নেবার একটা বাড়তি সময় নিশ্চয়ই পাওয়া যাচ্ছে। যে যেখানে ক্যারিয়ার গঠন করতে চায়, হোক সেটা ব্যাবসা বা চাকরি, সেখানে যাবার রাস্তাগুলি খুব ভালো করে জেনে নেবার সুযোগ ও সময়, দুই-ই এখন অফুরন্ত। সময় নষ্ট করার সময় এখন নয়। এই সময়ে যারা নিজেকে যত বেশি প্রস্তুত করে নেবে, তারা তত বেশি এগিয়ে যাবে। পথে নেমে যাওয়াটা কোনও সমস্যা নয়; সমস্যা তখনই হয়, যখন একলা আমাকেই পথে নামতে হয়।
  
 কখন কী হবে, এসব নিয়ে টেনশন মাথায় আসবেই। এটাই স্বাভাবিক। তবে যা-কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, তা নিয়ে ভেবে ভেবেই-বা কী হবে, কিছু মানসিক শক্তির ক্ষয় বাদে? যা হবার হবে। দেখা যাক না! কোভিড কাড়ল তো অনেকই, আর কতটুকুই-বা কাড়বে! নিজেকে যতটা তৈরি করে নেওয়া যাবে এই সময়ে, আর কখনও এমন সুযোগ পাওয়া যাবে কি? ভালো কিছু বই-মুভিতে ডুব দেওয়া, নিজের ভালোলাগার কাজগুলি নিয়ে ব্যস্ত থাকা, পরিবারকে সময় দেওয়া, এসবেরও তো প্রয়োজন আছে।
  
 অনেকেরই টিউশনি চলে গেছে, উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে কিংবা সংকুচিত হয়ে এসেছে। সত্যি বলতে কী, এই যে কষ্টটা, এটা পাবার কথা ছিল। কথা ছিল বলেই পাচ্ছি, আমাদের আয়ুর সঙ্গে এই অধ্যায়টা লেখা ছিল, এরকম করে ভাবলে মনের শক্তি ঠিকঠাক থাকবে। যদি মাথায় আসে, অমুক অমুক তো ভালো আছে, তবে আমি আপনাকে বলব, এই ভালো থাকতে গিয়ে আগে একসময় ওরা কতটা যে খারাপ ছিল, সে খোঁজ আপনি রেখেছেন? যারা পারিবারিক সচ্ছলতার সুবাদে ভালো আছে, তাদের দিকে তাকালে মনে যদি আফসোস আসে, তবে তার সঙ্গে এ-ও মাথায় আনুন, আপনি সে পরিবারের কেউ নন। যদি কেউ হতেন, তখন আপনি নিজেও নিশ্চয়ই ওরকমই থাকতেন, তাই না? রাস্তায় ব্যারিকেড আসার মানে এখানেই রাস্তার শেষ, তা নয়, বরং এখন অন্য রাস্তা ধরতে হবে। অনেকেই ধরছে; ওরা ভালো আছে কি মন্দ আছে, তা এখানে বিবেচ্য নয়, এটাই সময়ের দাবি, যা আমরা এড়াতে পারি না।
  
 আমরা যেমন হয়ে জন্মেছি কিংবা যেরকম করে বাড়ছি, তা কি আমরা ছুড়ে ফেলে দিতে পারি? নিয়তিকে অস্বীকার করে বাঁচা তো সম্ভব নয়, তবে নিয়তটাকে নিজের বুদ্ধি ও বোধের চর্চায় ঠিক করে নেওয়া যায়। সব সুযোগ এখনও শেষ হয়ে যায়নি, শুধু দেখতে না পারার ব্যর্থতার কারণে বেশিরভাগ মানুষই সুযোগকে সমস্যা ভাবে। আমরা যেন মনে রাখি, এই পৃথিবীতে দরিদ্র হয়ে আরও অনেকেই বেঁচে আছে, আমি একলা নই। আমার ভাগ্যে এটাই লেখা ছিল। এর নাম আশীর্বাদ কি অভিশাপ, তা সময়ই বলে দেবে। ভালো সময় ও খারাপ সময়, দুই-ই একদিন ফুরিয়ে যায়। আজকের সময়কে কীভাবে সময় দিচ্ছি, তা-ই নির্ধারণ করবে, সামনের সময়টা আমাকে কীভাবে সময় দেবে।
  
 চাকরি না পাবার চাইতে চাকরি পেয়ে হারানোর কষ্ট কিন্তু অনেক বেশি। চাকরি করেন যাঁরা, তাঁদের অনেক খরচই চাকরির উপার্জনের ছকে বাঁধা। হুট করে সেই ছকটা ভেঙে ফেলা খুব শক্ত। ব্যাবসায়ীরাও আজ ভালো নেই, অনেকেই পরিবারের নানান খরচ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন, খোঁজ নিয়ে দেখুন। এই কোভিডের কারণে জীবনযাত্রার মান নামিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন, দেশে এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। যে আয়ে সংসার চলে না, সে আয়টা করতে বাধ্য হন, অন্য আয়ের সুযোগ পাননি বলে, এরকম যাঁদের জীবন, তাঁদের কথা ভাবুন তো এক বার! এই এক কোভিড আমাদের সব শেষ করে ফেলল যেন!
  
 তবু আমরা বাঁচব। মানুষ কষ্টে মরে যায় না, শুধু বাঁচতে খুব কষ্ট হয়। এটা মেনে নিয়ে বাঁচতে পারে যারা, তাদের মধ্যে একজন হতে পারাই এখনকার মূল চ্যালেঞ্জ।
  
 বাঁচার জন্য এই একটা মাত্রই জীবন আছে আমাদের। সেখানে সুখ ও দুঃখের যে পালাবদল, তা কারও ক্ষেত্রে বেশি বা কম নয়। যার যতটা পাবার, তাকে ততটা ভোগ করেই যেতে হবে। যদি আপনার মনে হয়, আপনি আরও বেশি পাচ্ছেন না কেন? তবে আমি আপনাকে বলব, এই যে এত এত মানুষ কোভিডে মারা যাচ্ছে, সেখানে তো আপনি আমি যে কেউই থাকতে পারতাম, তাই না? এখন পর্যন্ত যে সেই লিস্টে আমাদের নামটা ঢোকেনি, তার মানে হলো, নিশ্চয়ই আমাকে আপনাকে নিয়ে স্রষ্টার ভালো কোনও পরিকল্পনা আছে। সেই পরিকল্পনাটা সত্য করতে হলে আমাদের বাঁচতে হবে ও আয়ুর সদ্ব্যবহারটা অবশ্যই করতে হবে।
  
 আসুন, কষ্ট করে হলেও বেঁচে থাকি! কালকের দিনটা যে দেখার এখনও বাকি!