কাছের মানুষ



যাকে-তাকে কাছের মানুষ ভাববার চেয়ে বিপদজনক স্বভাব খুব কমই আছে।


যার সামনে নিজেকে নিখুঁত করে রাখতে হয়, সে আপনার কাছের মানুষ নয়। দূরের যারা, ওদের সামনেই মানুষ নিজের খুঁতগুলি খুব যত্ন করে লুকিয়ে রাখে। কাছের যারা, ওদের সামনে খুঁত লুকিয়ে রাখতে হয় না, কেননা আপনার খুঁত দেখলেও ওরা আপনাকে কখনও জাজ করবে না, আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে না। মানুষ খুঁত লুকোয় তার কাছেই, যার কাছে সে নিজেকে ঠিক মেলে ধরতে পারে না।


নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হয় যার সামনে, নিজের বিদঘুটে ভাবনা ও অদ্ভুত স্বভাব বা অভ্যাস জানানো যায় না যাকে, নিজেকে গুছিয়ে প্রকাশ করতে হয় যার সামনে, সে আপনার আপন কেউ হয় না। যে আপনার আপন নয়, তাকে কাছের মানুষ ভাববার কোনও কারণ দেখি না। এ পৃথিবীতে এক আপনি নিজে বাদে আর তেমন কেউই আপনার কাছের মানুষ নয়। যদি পেয়ে যান অমন কাছের কাউকে, তবে তাকে আমৃত্যু মনে রাখবেন, বুকের সবচাইতে কাছে রেখে দেবেন, তার প্রয়োজনকে নিজের প্রয়োজনের উপরে জায়গা দেবেন।


কাছের মানুষ তো সে-ই, যাকে বিনা কুণ্ঠায় বলে দেওয়া যায়, সেদিন গোটা এক প্যাকেট সিগারেট ফুঁকেছি, রাস্তা পার হবার সময় অমুক মেয়ের বা ছেলের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম, কার চেহারা দেখলে গা জ্বলে, কার কথা ভাবলেও মনটা প্রশান্ত হয়। কাছের মানুষকে সবই বলা যায়। কাছের মানুষের ফোন ধরেই সরাসরি কাজের কথাটা বলে ফেলা যায়। সম্পর্কের মাত্রা বিবেচনায়, কাছের মানুষের সঙ্গে গালাগালি করেও কথা বলা যায়। কাছের মানুষের সামনে দেহের কিংবা মনের কোনও দাগ লুকিয়ে রাখতে হয় না। কাছের মানুষের কাছে নিজের ক্রোধ বা ঈর্ষা নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে গল্প করা যায়। যার কাছ থেকে নিজের ব্যর্থতা বা লজ্জা লুকিয়ে বাঁচতে হয়, সে কিছুতেই কাছের মানুষ নয়।


যার সামনে অসভ্য হয়ে থাকা যায় না, সে কাছের নয়, দূরের। যার সামনে নিজেকে অগোছালো অবস্থায় তুলে ধরা যায় না, সে কাছের নয়, দূরের। যার সামনে ভেবে কথা বলতে হয়, যার কাছাকাছি থাকবার সময় ভেবেচিন্তে বসতে হয় বা দাঁড়াতে হয় বা হাঁটতে হয়, সে কাছের কেউ নয়, দূরের কেউ। কাছের মানুষ আমাকে এলোমেলো অবস্থাতেই গ্রহণ করতে জানে। পুরো পৃথিবীও যখন মুখ ঘুরিয়ে নেয়, তখনও আমাকে কাছে টেনে নেয় যে, সে-ই আমার কাছের মানুষ। পায়ের নিচ থেকে যখন মাটি সরে যায়, মাথায় যখন আকাশ ভেঙে পড়ে, তখনও কাছের মানুষটা পরমআস্থার জায়গা হয়েই পাশে থেকে যায়।


কাছের মানুষের সামনে মুখ দেখানো যায়, মুখোশ পরতে হয় না। কাছের যারা, ওদের সামনে মেকি ভাবটা ধরে রাখতে হয় না, নিজেকে পরিপাটি করে রাখতে হয় না, সমস্ত আরোপিত কৃত্রিমতাকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। ভুঁড়ি, টাক, এলোমেলো চুল, ব্রণভর্তি মুখ, মেকআপবিহীন চেহারা, পুরনো-ছেঁড়া-বিস্রস্ত পোশাক এসব নিয়ে যার সামনে উদ্‌বিগ্ন হয়ে থাকতে হয় না, সে-ই কাছের মানুষ। কাছের মানুষের সামনে শরীরের যেখানে খুশি, সেখানে চুলকানো যায়। যার সামনে নিজেকে একদমই নিজের মতো করে প্রকাশ করতে গিয়ে একটু হলেও ইতস্তত বোধ হয়, সে কাছের মানুষ নয়।


কাছের মানুষের সামনে বলে দেওয়া যায়, কী কী বাজে অভ্যাস আজও যত্ন করে পুষে রেখেছি, প্রেমিকার সাথে কয়টা মিথ্যে বলেছি গত এক সপ্তাহে, একা একা থাকলে কী কী উদ্ভট কাণ্ড ঘটাই, এ জীবনে কী কী পাপ করে সুখ পেয়েছি। পাপের সুখ নিয়ে যার সঙ্গে মন খুলে আড্ডা দেওয়া যায় না, সে কিছুতেই কাছের মানুষ নয়। যে শুধুই আপনার পুণ্যের ফল নেয়, পাপের ভাগ নেয় না, সে আপনার কাছের কেউ হয় না।


যে মানুষের সামনে সারাক্ষণই নিজের পারিপাট্য, সৌন্দর্য, ভদ্রতা নিয়েই থাকতে হয়; যে আমার সুন্দরকেই নিতে পারে কেবল, অসুন্দরকে নয়; যার মনে আমার কদর্যতা ও অকপটতা ঠিক হজম হয় না; যার কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা কিছু শর্তনির্ভর; সে মানুষ আসলে আমার তেমন কেউই হয় না। সে আমার পরিচিত কেউ, কলিগ, ক্লাসমেট, আত্মীয় কিংবা এরকম যে-কেউই, তবে কাছের মানুষ কোনোভাবেই নয়। তাকে সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছুই নেই। যাকে-তাকে সিরিয়াসলি নেয় যারা, ওদের জীবনে যে-সে এসে কষ্ট দিয়ে মজা লোটে। যে আমার কেউই হয় না, সে-ও আপন হতে পারে; কিন্তু যে আমার আপন নয়, সে সত্যিই আমার কেউই হয় না।


আপনি যদি এই মুহূর্তেই মারা যান, তবে তারপর কে আপনার পাশে আছে বা কে নেই, তা তো আপনি দেখতে পাবেন না। আপনি দেখতে পাচ্ছেন না বলেই আপনাকে খুশি করবার আর কোনও দায়ই কারুর নেই। তখন আপনার লাশের পাশে থাকবে যারা, ওরা কারা? চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, কে তখন ছুটে আসবে কোনও স্বার্থ ছাড়াই? কে আপনার জন্য কাঁদবে বছরের পর বছর? আপনি নেই বলে কে নিজেকে একদমই শূন্য, অসম্পূর্ণ ও অসহায় ভাববে? মৃত মানুষকে খুশি রাখবার দায় কারুর থাকে না। তবু যারা তখন ছুটে আসে, তাদের মধ্যে দু-ধরনের মানুষ আছে। বেশিরভাগ মানুষই আসে মৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়দের খুশি করতে বা সামাজিক নিয়ম রক্ষার্থে। মাত্র কয়েক জন আসে, যে চলে গেছে, তার শোকে মুহ্যমান হয়ে; কিংবা আসতে না পারলেও মৃত ব্যক্তির বিচ্ছেদব্যথায় তারাও অনেকটা অর্ধমৃত হয়ে যায়। ভাবুন তো, দ্বিতীয় দলে কারা থাকতে পারে? এক ওরা বাদে আর কেউ কি আপনার কাছের মানুষ?


বিপদে পড়বেন যখন, তখন দেখবেন, যাদের আপনি এতদিন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, আপনজন, পরিবারের মানুষ হিসেবে জানতেন, আত্মার মানুষ হিসেবে দেখতেন, তাদের বেশিরভাগই আসলে আপনার কেউই নয়। আপনাদের মধ্যে শুধুই পরিচয় আছে, এর বেশি বন্ধন কখনও গড়ে ওঠেনি। আপনার বাবার অপারেশনের জন্য ধার চেয়ে হয়তো এমন কারও কাছ থেকে টাকাটা পাবেন, যিনি আপনার কেউই হন না; কাছের ভাবেন যাদের, তখন ওদের ‘আকস্মিক দারিদ্র্য’ দেখলে আপনি নিজেই অবাক হয়ে যাবেন। জেনে রাখুন, তিনিই আপনার কাছের মানুষটা হন, যিনি আপনার বাবার সুস্থতার কথা ভেবেছেন, আপনাকে বিপদমুক্ত হতে সাহায্য করেছেন; বাকিরা কেবলই পরিচিত ও আপনার জীবনের জন্য অপ্রয়োজনীয়। বিপদে পড়ে যদি কখনও আত্মগোপনে থাকতে হয়, তখন দেখবেন, আপনার সবচাইতে কাছের আত্মীয় যিনি, তিনি আপনার জন্য একবেলার খাবারও রান্না করে পাঠাবেন না, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে কখন কী ঝামেলায় পড়ে যান, সেই ভয়ে। আপনার ওরকম একটা বিপদের সময়ে, আপনি খেয়ে আছেন কি না খেয়ে আছেন, এরই তোয়াক্কা করে না যে, সে আপনার রক্তের সম্পর্কের কেউ হলেও-বা কী এসে যায়? রক্তের সম্পর্কের চাইতে আত্মার সম্পর্ক অনেক অনেক বড়ো জিনিস। রক্তের সম্পর্ক অর্জন করে নিতে হয় না, আত্মার সম্পর্ক অর্জন করে নিতে হয়। যা মানুষ জন্মসূত্রে বিনা চেষ্টাতেই পেয়ে যায়, তা দিয়ে মানুষকে কখনওই চেনা যায় না।


আমি যাদের কাছের মানুষ ভাবতাম, আমার চরম বিপদের সময়, তাদের মোটামুটি সবাই-ই একবাক্যে বলে বেড়াত, তারা আমাকে তেমন একটা চেনে না এবং আমার মতো মানুষের ওই বিপদে পড়াই উচিত! আমাকে নিয়ে নেগেটিভ কথা বলাই ছিল তখনকার ফ্যাশন, না জেনেই আমার বিরুদ্ধে দুটো কথা বলাই ছিল অনেকের জন্য জাতে ওঠার এক অব্যর্থ রাস্তা, এবং আমার কাছের লোকজনও সেই প্রবাহে আনন্দে গা ভাসিয়েছে। এ জীবনে যাদের কাছের মানুষ ভেবেছি দীর্ঘকাল ধরে, আমার বিপদের সময় আমি তাদের অনেকেরই নির্লিপ্ততা ও নিষ্ঠুরতা দেখেছি। ঈর্ষাপ্রসূত নিষ্ঠুরতা প্রকাশের সুবর্ণ সুযোগ যারা মিস করতে পারে না, তাদের আমি মানুষ বলি না।


তাদের তেমন কেউই আমার ফোন ধরেনি এই ভয়ে, যদি আমার ফোনটা ধরলে কোনও ঝামেলায় পড়ে যায়! কেউ কেউ ধরলেও, তাদের সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝেছিলাম, আমাকে বিপদে ডুবতে দেখে তারা খুব মজা পাচ্ছিল! তাদের অনেকেই প্রকৃত ঘটনা না জেনেই আমার ভুল বের করে করে আমার বাবা-মা ও অন্যান্যদের কাছে আমার সম্পর্কে বিষোদ্‌গার করে চলেছে দিনের পর দিন। আমি ওদের ক্ষমা করে দিয়েছি যদিও, তবু খুব চেষ্টা করেও আমি ওদের ভুলতে পারিনি। আমি ওদের এই মন থেকে এ-জন্মের মতো ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। ওদের আসল চেহারা আমার চেনা হয়ে গিয়েছে। আমি জেনেছি, জীবনযাপন একটা একাকী যাত্রা। সে যাত্রায় বিপদ এলে তখন যারা সঙ্গী হয়, তাদের তেমন কাউকেই আমরা চিনি না বা চিনলেও কাছের মানুষ ভাবি না। প্রয়োজনই কাছের মানুষ চেনায়। বিশ্বাস ও সারল্য দিয়ে সবসময় জীবন চলে না। আমি সেই ভয়াবহ বিপদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ! আমার পাশে তথাকথিত কাছের মানুষদের একজনকেও না পেয়েও, মাত্র দু-একজন শুভাকাঙ্ক্ষীকে সঙ্গে নিয়ে পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে একলা লড়াই করে মাথা উঁচু রেখেই জিতে ফিরেছি যে আমি, সেই আমার পক্ষে আহত হওয়া যতটা শক্ত, যাকে-তাকে কাছের বলে বিশ্বাস করে ফেলাটা ততোধিক কঠিন।