এক শতাংশের লোভে

আমি জানি, যখন চোখের সামনে কোনও পথ আমরা দেখি না, তখন কতটা অসহায় লাগে! আমার হারিয়ে যাবার কথা ছিল! সেখান থেকে আমি আজকের অবস্থানে এসেছি।




আমি তো খুবই বাজে অবস্থায় ছিলাম আমার লাইফে! একদমই প্রান্তিক অবস্থার মধ্যে ছিলাম এবং আমার হারিয়ে যাবারই কথা ছিল। আমি আত্মহত্যা করার চিন্তা করেছিলাম, চেষ্টা করেছিলাম! ভাবুন, একটা মানুষ কখন আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে?! যখন জীবন থেকে তার আর কোনও কিছুই চাওয়া-পাওয়ার থাকে না! যখন সে তার নিজের অস্তিত্বের ভারটা বহন করতে আর পারে না কিংবা চায় না!




হ্যাঁ, আমি সে অবস্থায় চলে গিয়েছিলাম এবং আমি এমন একটা মানুষ ছিলাম, যে মানুষটাকে কখনও কেউ পাত্তা দেয়নি, যে মানুষটার ফোন কখনও কেউ রিসিভ করেনি, যে মানুষটার সঙ্গে কখনও কেউ ভালো করে দুটো কথা বলেনি, ঠিক তেমনই একটা মানুষ ছিলাম আমি। এমন একজন ছাইতুল্য মানুষ হয়েও এই পৃথিবীতে অনেকেই বেঁচে থাকে! একদিন ভালো থাকতে চাইলে সেই স্বপ্নে বাঁচতে হয়!




আমি খুব ভালো করে জানি পাত্তা না পেতে কেমন লাগে! আমি জানি, যখন সামনে কোনও পথ আমরা দেখি না, তখন কতটা অসহায় লাগে! হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে যখন সবাই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, দূর-দূর ছাই-ছাই করে, তখন মনের অনুভূতিটা কেমন হয়, এটা আমি জানি। হ্যাঁ, আমি জানি আপনাদের কষ্টটা কেমন এবং কোথায়।




যা বলছিলাম, আমার হারিয়ে যাবার কথা ছিল! সেখান থেকে আমি আজকের অবস্থানে এসেছি। আমার বাবা-মায়ের আশীর্বাদে, সৃষ্টিকর্তার কৃপায়, সৌভাগ্যের জোরে, আমার কিছু চেষ্টার জোরে আমি আজকের অবস্থানে এসেছি। এই কারণেই আমি আজকে যা যা পেয়েছি আমার লাইফ থেকে, তার বেশিরভাগই হচ্ছে বোনাস, মানে বাড়তি! এটা আমার পাবার কথা ছিল না, তবু আমি পেয়েছি!




ধরো, তুমি একটা চাকরি করো! সেই চাকরি থেকে প্রতি মাসে তোমার বেতন হচ্ছে ১০ টাকা এবং তুমি ১০ টাকা পেলেই খুশি। কোনও একটা মাসে, কোনও একটা জায়গা থেকে, কোনও একটা উপায়ে তুমি ১৫ টাকা কামাই করলে! হ্যাঁ, বাড়তি ৫ টাকা! যে ৫ টাকার প্রত্যাশা তুমি করোনি, যে ৫ টাকা তোমার প্রাপ্য নয়!




তুমি পেয়েছ বাড়তি ৫ টাকা। সৃষ্টিকর্তা দেখবেন চুপচাপ, তুমি সেই ৫ টাকা দিয়ে কী করো। যদি তুমি সেই ৫ টাকার পুরোটাই ভোগ করে ফেলো কিংবা নিজের পকেটে রেখে দাও, কাউকেই কিছু না দাও, তাহলে সৃষ্টিকর্তা ভাববেন, তোমাকে এই ৫ টাকাটা দিয়ে কী লাভ হলো! এই ৫ টাকা তোমাকে না দিয়ে অন্য কাউকে দিলে হয়তোবা সেখান থেকে কিছু গরিব মানুষ টাকা পেত! তখন পরবর্তী মাস থেকে তোমার সেই বাড়তি ৫ টাকার সৌভাগ্য কেড়ে নেওয়া হবে। অথচ তুমি যদি সেই ৫ টাকা থেকে আড়াই টাকা মানুষকে দিয়ে দিতে, তাহলে কিন্তু তোমার প্লাসে-মাইনাসে আড়াই টাকা লাভ! পরের মাসেও আড়াই টাকা লাভ।




তখন সৃষ্টিকর্তা হয়তোবা তোমাকে তার পরের মাসে আরও দুই টাকা বাড়িয়ে দিলেন! সতেরো টাকা দিলেন! প্লাসে-মাইনাসে সাড়ে ৩ টাকা লাভ! এরকম চলতেই থাকবে! দানে সম্পদ বাড়ে।




সেই সৌভাগ্যটা, যে সৌভাগ্যটা তোমার পাবার কথা ছিল না, সেখান থেকে কিছুটা মানুষকে প্রত্যাশাহীনভাবে দিয়ে দাও। তুমি ভালো থাকবে। মিলিয়ে নিয়ো। সেই মানুষগুলোর মুখ দেখলেও তুমি ভালো থাকবে। সেই মানুষগুলোর প্রার্থনা যখন সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছে যাবে, তখন‌ সৃষ্টিকর্তা তোমাকে ভালো রাখবেন। বিশ্বাস করো না করো, এইসব ঘটে।




আমি মনে করি, যা-কিছু সৌভাগ্য আমি পেয়েছি, তার বেশিরভাগই হচ্ছে বোনাস। যদি আমি সেইটুকু কিছু মানুষকে পেতে সাহায্য না করি, তবে সে সৌভাগ্যটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হবে। আমি সেই ভয় থেকে বিনা পয়সায় মানুষের জন্য কাজ করি। আর সত্যিই আমার কথা বলতে ভালো লাগে! যখন দেখি, আমার কথাগুলো শুনে কেউ-না-কেউ জীবনে কিছু করতে পারছে, কেউ-না-কেউ ভালো কিছু করছে, তাতে তো আমার কোনও ক্ষতি নেই!




ক্ষতি তো নেই-ই, বরং লাভ আছে! কীরকম লাভ? আমি কিছু স্মাইলিং-ফেইস দেখতে পাচ্ছি! কিছু কনটেনটেড মানুষ দেখতে পাচ্ছি! এটা আমার ভালো লাগে। কাউকে খুশি থাকতে দেখলে আমি খুশি হই। এই কারণেই কাজগুলো করা।




আমার কাছে নিজের কোন সত্তাটি ভালো লাগে? আমার যে সত্তাটি আমার সবচেয়ে ভালো লাগে, সেটি হচ্ছে লেখকসত্তা। আমার জীবনটাকে আমি ঠিক এভাবেই মূল্যায়ন করি: যদি আমি কখনও লেখক হতে পারি, যদি আমি ওরকম ভালো কিছু লিখতে পারি কখনও, তবে সেদিনটা হবে আমার জন্য সব থেকে সুখের দিন। মৃত্যুর আগে যদি আমি দেখি, আমাকে লেখক হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়, লেখক হিসেবে পরিচিতিটা আমি কখনও পাই, সেটা আমার জন্য সবচাইতে আনন্দের বিষয় হবে।




তা‌ যদি না-ও পাই, তাতেও কোনও দুঃখ নেই। আমি লিখি মূলত আমার আনন্দের জন্য। কে পড়ল কে পড়ল না, সেটা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আর বেশিরভাগ মানুষই আমার লেখা পড়ে না, মাত্র গুটিকয়েক মানুষ পড়ে। হ্যাঁ, হাতেগোনা‌ কয়েকজন মানুষ। বেশিরভাগই কোনও কারণ ছাড়া লাইক দেন, কমেন্ট করেন...ওয়াও সুপার! এর কারণ, আমি বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি। বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম না হলে, আমার লেখা এত জন পড়ত না, এত জন লাইক-কমেন্টও করত না, কিছুই করত না। এটাই সত্য।




ওরা বোধ হয় ভাবে, ব্যাটা বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে, আমিও তো বিসিএস পরীক্ষা দেবো! কিংবা ভাবে, সুশান্ত দাদার স্ট্যাটাসে যদি একটা লাইক দিই‌ আর ওই পুণ্যে(!) যদি প্রিলিটা পাশ করে ফেলতে পারি, তাহলে অসুবিধা কী! ওরকম আর কি! আমার লেখা পড়ে লাইক-কমেন্ট করে খুব কম মানুষ। হ্যাঁ, কেউ কেউ অবশ্য করে। কিছু ভালো পাঠক আমার আছে। তাদের আমি চিনি, বুঝতে পারি। আবার অনেকে আছে, যারা লাইকও করে না, কমেন্টও করে না, চুপচাপ পড়ে। হ্যাঁ, নীরব পাঠকও আছে অনেক। তাদের প্রতি ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধা রাখছি।




আমাকে অনেকে বলে, তুমি যা লিখছ, তা কিছুই হচ্ছে না, সব‌ই ট্র্যাশ...এই-সেই! তাদের আমি বিনীতভাবে বলি, আমি তো আপনাকে বিচারকের দায়িত্ব দিই নাই। আমি তো জানি, আমি ট্র্যাশ লিখছি, আমি জানি আমার লেখাগুলো কিচ্ছু হচ্ছে না। এতে তো আমার কোনও সমস্যা নেই! আপনার কী সমস্যা? ভালো না লাগলে আমার লেখা পড়বেন না, আমার ওয়ালে আসবেন না। এতটা নির্লজ্জ হয়ে বাঁচবেন না, প্লিজ!




আমার ফিলোসফিটা খুব সিম্পল। পাবলো পিকাসো ছবি এঁকেছেন প্রায় পঞ্চাশ হাজার। আর পাবলো পিকাসোর যে ছবিগুলো আমরা চিনি, সেগুলোর সংখ্যা বড়োজোর এক-শো! তাঁর আঁকা পঞ্চাশ হাজার ছবির মধ্যে মাত্র এক-শো'টা ছবি আমরা চিনি। সেগুলোই টিকে আছে, আমাদের মনের মধ্যে আছে। বাকিগুলো তো নেই!




ঠিক একইভাবে, আমি যা-কিছু লিখব, তার এক শতাংশও যদি টিকে থাকে, বাকি নিরানব্বই শতাংশ যদি আবর্জনাও হয়, তাতেও তো কোনও অসুবিধা নেই। আমি তো জানি না কোন এক শতাংশ টিকে থাকবে! ওই এক শতাংশের লোভেই আমি এক-শো শতাংশ কাজ করার চেষ্টা করছি। আর কোনও কিছু না।




আসুন, আমরা সবাই এক শতাংশের লোভে এক-শো শতাংশ বাঁচি!