একাকিত্বের কালো রং

 আমার মনে হয়, একাকিত্ব কী, তা আমি এখন খুব ভালো করে বুঝতে পারি। অবশ্য এই একাকিত্বটি সাময়িক, কেটে যাবে। এটা আসে, যখন নিজের মধ্যে একধরনের শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তখন মনে হতে থাকে, এ বুঝি রক্তের মধ্য দিয়ে শরীরের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। যখন এই একাকিত্ব পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, তখন খুব চেষ্টা করেও আর মনে করা যায় না, এর শুরুটা ঠিক কোথা থেকে হয়েছিল। যে যন্ত্রণার উৎস জানা যায় না, সে যন্ত্রণা সারানোও যায় না।
  
 হ্যাঁ, এই একাকিত্ব একসময় নিজে নিজেই ফ্যাকাসে হয়ে আসবে। ফ্যাকাসে হতে হতে ঠিকই মিলিয়েও যাবে। এই তো আগামীকালই যখন অফিসে ছুটব, ব্যস্ততায় ডুবে থাকব, ল্যাপটপে বসে কাজের ডেটলাইনগুলি চোখের সামনে রাখব, তখন এই যে একাকিত্ব বোধ করেছি এই মুহূর্তে, সেটাই তো আর মনে পড়বে না! অত ছোটাছুটির মধ্যে সময় কোথায় একাকিত্ব নিয়ে ভাবার?
  
 কিন্তু এখন? এখন তো এখান থেকে বেরোতে পারছি না। খুব চেষ্টা করছি মনটা ভালো করতে, কিন্তু হচ্ছে না তো! জানি, এটা কেটে যাবে, আগেও যেমন গেছে; তবু কেটে যাবার আগ পর্যন্ত সহ্য করব কীভাবে! এখন আমার কত কী-ই তো করার ছিল! ওসব কিচ্ছু মনে নেই! মাথা কাজ করছে না, কিছুই মাথায় আসছে না! মনে হচ্ছে, জীবনের কাছ থেকে এই মুহূর্তেই ছুটি নিয়ে নিই! যারা বলে, জীবন থেকে পালায় কাপুরুষেরা, তাদের বোধ হয় একাকিত্ব এভাবে কখনও গ্রাস করেনি। জীবন থেকে পালায় যারা, ওরা কি সত্যিই কাপুরুষ? না কি একা?
  
 ভালো লাগছে না কিছুই! এই পুরো পৃথিবীতে এক আমি বাদে আর কেউই বেঁচে নেই। সবাই মৃত। আমাকে একা ফেলে রেখে সবাই কোথায় যেন চলে গেছে! আমি যদি এই মুহূর্তে বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামি, তাহলে দেখব, কোথাও কেউ নেই; কিছু ফাঁকা দোকান, কিছু ফাঁকা বাড়ি, কিছু ফাঁকা কানাগলি আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসবে। ওদের চোখে-মুখে থাকবে শুধুই তাচ্ছিল্য, তখন আমার আরও বেশি খারাপ লাগবে।
  
 মানছি, জীবনে অনেক হইচই আছে, উদ্‌যাপন আছে, কোলাহল আছে, সুখ-হুল্লোড় আছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখুন। ও যে সবই মুখোশ! ওসবের নিচের মুখটার কথা ভাবুন। এইসব মিথ্যে অভিনয় কতক্ষণ চলবে? অল্প সময়ের জন্যই তো, তাই না? তারপর? দিনশেষে, এক নিজে বাদে আর কে থাকে সঙ্গে? কান্নার সঙ্গী হয় কেউ? হাসির সঙ্গী হয়ে কী লাভ? হাসতে কাউকে লাগে নাকি কারও?
  
 মুখোশের দিকে না তাকিয়ে এবার মুখের দিকে তাকান। সব বুঝে যাবেন। নিজের সঙ্গে বাঁচতে সবাই-ই চায়, তবে ওটা অত সহজ নয়। নিজের কান্না নিজে সহ্য করা যায়? গেলেও তা কতক্ষণ? মনে যা আসে, তা-ই চুপচাপ গিলে ফেলার মতো মনের শক্তি কয়টা মানুষের আছে? নিজের সকল অর্থহীন প্রলাপকে মেনে নিয়ে নীরব-নিরাবেগ-নির্লিপ্ত থাকতে পারে, এমন পরিপক্ব মনের মানুষ লাখে একটাও তো খুঁজে পাবেন না!
  
 একাকী মানুষ এভাবেই ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। মনের দিক থেকে, শরীরের দিক থেকে। প্রতিদিনই কাঁদা, প্রতিদিনই অন্ধকারে ডুবে যাওয়া, প্রতিদিনই নিজের প্রতি ঘেন্না জন্মানো, প্রতিদিনই হাত বাড়িয়ে কারও হাত না পাওয়া, প্রতিদিনই বিষাদের একেক রং সহ্য করা, প্রতিদিনই নিজেকে আরও একা হতে দেখা, এসব সহজে লিখে ফেলা যায় কিংবা বলে ফেলা যায়, কিন্তু সহজে মেনে নেওয়া যায় না।
  
 একাকিত্ব মানুষকে ভেতরে ভেতরে হত্যা করতে থাকে। বাইরে থেকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না। যারা এমন একাকিত্বের মধ্য দিয়ে কখনও যায়নি কিংবা গেলেও সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে কোনও-না-কোনও উপায়ে, তারা এর ভয়াবহ যন্ত্রণাটা সম্পর্কে অনুমানও করতে পারবে না! তারা হয়তো বলবে, 'প্রার্থনা করো! যার কেউ নেই, তার ঈশ্বর আছেন!' তারা জানে না, আসল সত্যটা হচ্ছে, যার কেউ নেই, তার কেউই নেই! যার কেউই নেই, তার ঈশ্বরও নেই। অতটা অসহায় একজন মানুষ প্রার্থনা করার শক্তিটুকুও তো হারিয়ে ফেলে!