একজন রঘুনাথ

মৈথিল পণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় গঙ্গেশ উপাধ্যায়, মহর্ষি গৌতম প্রণীত ন্যায়দর্শনের ‘চিন্তামণি’ নামক গ্রন্থের চার খণ্ডের অসামান্য টীকা (ব্যাখ্যা) প্রস্তুত করেন। পরে মুরারি মিশ্র, বাচস্পতি মিশ্র, পক্ষধর মিশ্র প্রভৃতি মৈথিলি পণ্ডিত ন্যায়দর্শনের কিছু সমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন।




একসময় মিথিলায় যাওয়া বাদে ন্যায়দর্শন শেখার আর কোনো উপায় ছিল না। মৈথিল পণ্ডিতেরা ন্যায়দর্শনের কোনো গ্রন্থ অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে দিতেন না। সেই সময় ছাপাখানা ছিল না বিধায় সমস্ত গ্রন্থই ছিল হাতে-লেখা পাণ্ডুলিপি। দেখে দেখে লিখে নেওয়া বা নকল করা বাদে গ্রন্থের দ্বিতীয় কপি হাতে পাবার আর কোনো উপায়ই ছিল না তখন।




নবদ্বীপের বাসুদেব সার্বভৌম ২৫/৩০ বছর বয়সে নিজগ্রামের পাঠ শেষ করে মিথিলায় ন্যায়শাস্ত্র পড়তে গেলেন। তাঁর একান্ত আকাঙ্ক্ষা, নিজের দেশে ওই বিদ্যা নিয়ে আসবেন।




মৈথিল পণ্ডিতগণসৃষ্ট চরম প্রতিকূলতার মুখে ন্যায়শাস্ত্রের গ্রন্থ নকল করে আনাটা অসাধ্য দেখে ওই চার খণ্ড ‘চিন্তামণি’র পুরোটাই তিনি কণ্ঠস্থ করলেন। ‘কুসুমাঞ্জলি’র শ্লোকভাগ কণ্ঠস্থ করার পর এবং টীকাভাগ কণ্ঠস্থ করার আগেই মৈথিল ছাত্রদের মধ্যে তাঁর উদ্দেশ্য প্রচারিত হয়ে পড়ায় তাঁর ওই কাজটি সম্পূর্ণ হলো না।




শ্রদ্ধেয় উপাধ্যায় পক্ষধর মিশ্র তাঁকে ‘সার্বভৌম’ উপাধি দিয়ে পাঠ শেষ করিয়ে দিলে, বাসুদেব কাশীধামে বেদান্তদর্শনের আলোচনা করে দেশে ফিরলেন এবং নবদ্বীপে প্রথম ন্যায়শাস্ত্রের টোল খুললেন।




নিজের অক্লান্ত চেষ্টায় অসীম বিঘ্নবিপত্তি অতিক্রম করে নিজের দেশে নতুন বিদ্যা নিয়ে এসে বাসুদেব ধন্য হয়ে গেছেন। উল্লেখ্য, বাংলার মুখ উজ্জ্বলকারী বিখ্যাত নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি এবং শ্রীমৎচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁরই ছাত্র ছিলেন।




যাঁর জন্য গোটা ভারতে নবদ্বীপের ন্যায়শাস্ত্রচর্চা আজ পর্যন্ত বিখ্যাত রয়েছে, তাঁর নাম রঘুনাথ শিরোমণি। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তাঁর বিখ্যাত ‘আমার দেশ’ গানে তাঁকেই উল্লেখ করে লিখেছেন, “ন্যায়ের বিধান দিল রঘুমণি।” বাঙালির গৌরব এই তীক্ষ্ণবুদ্ধি পণ্ডিতের কথা সবারই জানা উচিত।




জন্ম থেকেই রঘুনাথের এক চোখ অন্ধ ছিল। অল্প বয়সে বাবা মারা গেলে তিনি খুবই দরিদ্রাবস্থায় পড়ে যান। যখন পাঁচ বছর মাত্র বয়স, তখন একদিন মায়ের আদেশে বাসুদেব সার্বভৌমের টোলে আগুন আনতে গিয়েছিলেন। কয়েকবার আগুন চাওয়ার পর বালক রঘুনাথের প্রতি বিরক্ত হয়ে টোলের একজন ছাত্র একটা হাতা করে জ্বলন্ত কয়লা এনে বলল, “কীসে নেবে নাও।”




বালকের হাতে কিছুই ছিল না। টোলের ছাত্ররা ঘুঁটের একদিকে আগুন ধরিয়ে ওটাই তাকে দেবে, বালক এমনটা মনে করেই সেখানে গিয়েছিল। কিন্তু তাকে অবজ্ঞা করে হাতে কয়লা দিতে যাওয়ায় বিন্দুমাত্রও বিচলিত না হয়ে অসাধারণ বুদ্ধি ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় দিয়ে বালক তখুনি এক অঞ্জলি ধুলো তুলে নিয়ে ওই ধুলোর উপর কয়লা নিল। কঠিন সমস্যার পূরণ বা তর্কে জয় ওই বয়সেই আরম্ভ হলো!




বাসুদেব বালকের এই প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখে বিস্মিত হলেন এবং মনে মনে স্থির করলেন, এই বালককে দিয়ে নিশ্চয়ই কোনো অসাধারণ কাজ সম্পন্ন হবে। তিনি বিধবাকে ডেকে আনিয়ে কথাবার্তা বলে নিজেই রঘুনাথের পড়াশোনা ও ভরণপোষণের ভার নিলেন এবং তাকে পড়াতে লাগলেন।




এমন পড়ানো বুঝি কেউ কখনও দেখেনি! ক খ শেখাতেই রঘুনাথের জিজ্ঞাসা, ক আগে কেন? খ আগে নয় কেন? বর্গীয় ও অন্তঃস্থ এই দুই জ (জ ও য) এবং দুই ব, দুই ন (ন ও ণ) এবং তিনটা স (শ, ষ ও স) এই সবকিছুতেই বালক রঘুনাথ আপত্তি তুলল। সংস্কৃত বর্ণমালা উচ্চারণস্থান হিসেবে প্রস্তুত এবং স্বরসম্বন্ধীয় বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে ব্যবস্থিত, এক‌ই নামের বিভিন্ন বর্ণের প্রকৃত উচ্চারণও বিভিন্ন, ষত্ত্ব ও ণত্ব বিধি আছে…ভাগ্যিস! নইলে এই বালককে নিয়ে মহাপণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমকেও মহাবিপদে পড়তে হতো। যা-ই হোক, বালককে বর্ণমালা শেখাতেই অনেক ব্যাকরণের সূত্রের উল্লেখ করতে হয়েছিল।




বালকের স্মৃতিশক্তিও যেমন, বিচারশক্তিও তেমনি। আনন্দোৎফুল্ল অধ্যাপকের পরমযত্নে বালকের বেশ দ্রুতই পাঠোন্নতি হতে লাগল। কাব্য, ব্যাকরণ, অভিধান এবং স্মৃতি পড়ে রঘুনাথ ন্যায়শাস্ত্র পড়তে আরম্ভ করলেন। দিনের বেলায় যা পাঠ হতো, রাতে তা লিপিবদ্ধ করে তাতে কোনো তর্কসম্বন্ধীয় খুঁত পেলে রঘুনাথ তার সামঞ্জস্য করে পরদিন নিজের মতো করে গুরুকে শোনাতেন। এভাবেই ক্রমাগত চর্চার মধ্য দিয়ে তর্কশাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা জন্মাল।




বাসুদেব নিজের সমস্ত বিদ্যা রঘুনাথকে অতিযত্নের সাথে শিক্ষা দিতে লাগলেন। রঘুনাথ ‘নিরুক্ত’ নামক টীকার ভুল বা অসামঞ্জস্য গুরুকে দেখালে, তিনি ভীষণ খুশি হয়ে ভালোভাবে শাস্ত্রপাঠ সম্পন্ন করার জন্য রঘুনাথকে মিথিলায় পাঠালেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, যদি কারও দ্বারা সম্ভব হয়, তাহলে রঘুনাথই মিথিলার পণ্ডিতগণকে তর্কে পরাজিত করে নবদ্বীপের প্রাধান্য স্থাপন করবেন। তখন নিজদেশ বলতে যে যার আপনার প্রদেশকেই বুঝতেন।




স্বদেশভক্ত বাসুদেবের দুই ছাত্র রঘুনাথ এবং শ্রীমৎচৈতন্য মহাপ্রভু তর্কশাস্ত্রে এবং ভক্তিমার্গে অতুল্য হয়ে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও উদ্যমের সাফল্য সাধন করে বাংলার মুখ পুরো পৃথিবীতে উজ্জ্বল করে দিয়ে গেছেন। যে-কোনো শুভ-বিদ্যা যতই কঠিন হোক, নিজদেশে নিয়ে আসার দৃঢ় ইচ্ছা থাকলেই যে বাঙালি তা একপুরুষে, নাহয় দুইপুরুষে পারেন, তা সশিষ্য বাসুদেব সার্বভৌম প্রমাণ করে গেছেন। প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি, জাপানও ঠিক এভাবেই ছাত্র পাঠিয়ে ইয়োরোপীয় বিজ্ঞান ও সামরিকবিদ্যা দেশে নিয়ে এসে তা স্থাপন করেছে এবং ইয়োরোপের চাইতেও উৎকর্ষ লাভ করার জন্য সযত্নে চেষ্টা করে গেছে।




মিথিলার সর্বপ্রধান নৈয়ায়িক পক্ষধর মিশ্রের নিয়ম ছিল, দেয়ালের দিকে মুখ করে তিনি ছাত্রদের পড়াতেন এবং টীকা লিখতে লিখতেই ছাত্রদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। কোনো ছাত্র তাঁকে তর্কে একটু অসাধারণভাবে তুষ্ট করলেই তবে তিনি মুখ ফিরিয়ে তর্কের বিচার করতেন।




পক্ষধর মিশ্রের টোলে যে কয়েকজন ভালো ছাত্র ছিল, কিছুকালের মধ্যেই রঘুনাথ তাদের প্রত্যেককেই তর্কে পরাজিত করে তাঁকে খুশি করলেন; এবং বরাবরই তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে পাঠদান করতে গুরুকে বাধ্য করলেন। অল্পকালের মধ্যেই রঘুনাথ ন্যায়শাস্ত্রে শিক্ষা সম্পূর্ণ করে পক্ষধর মিশ্রের ‘সামান্যলক্ষণা’ গ্রন্থের দোষ ধরে গুরুর সাথে বিচার আরম্ভ করেন।




তর্কশাস্ত্র একধরনের মানসিক কুস্তি। ওতে গুরু-শিষ্যেও যুক্তির লড়াই করায় কোনো দোষ নেই। পক্ষধর মিশ্রের সাথে রঘুনাথের ঘোরতর তর্কসংগ্রাম চলতে লাগল। মিথিলার নানাস্থান হতে বহুসংখ্যক পণ্ডিত ও ছাত্র সেখানে উপস্থিত হতে লাগলেন।




তর্কের সংঘর্ষে নানান বিদ্রূপও আরম্ভ হয়েছিল। পক্ষধর বলেন,




বক্ষোজ-পানকৃৎ কাণ সংশয়ে জাগ্রতি স্ফুটং।
সামান্যলক্ষণা কম্মাদকম্মাদবলুপ্যতে॥




অর্থাৎ – তুমি মাতৃদুগ্ধপায়ী শিশু (অপরিপক্ব বুদ্ধিসম্পন্ন) একচক্ষু (শাস্ত্রে সম্যক দৃষ্টিবিহীন) সংশয়ের উপর অবস্থিত; সামান্যলক্ষণা হঠাৎ করে তুমি কীভাবে লোপ করতে চাও?




রঘুনাথ উত্তর করেন,




যোহন্ধং করোত্যক্ষিমন্তং যশ্চ বালং প্রবোধয়েৎ।
তমেবাধ্যাপকং মন্যে তদন্যে নামধারিণঃ।।




অর্থাৎ — যিনি অন্ধকে চক্ষুষ্মান করেন, বালককে যিনি প্রবোধিত করেন, আমি তাঁকে প্রকৃত অধ্যাপক বলে মনে করি; তা বাদে বাকি সবাই ‘অধ্যাপক নামধারী’ মাত্র।




তারপর তর্কসংগ্রামে রঘুনাথ সুস্পষ্টভাবেই পক্ষধরের মত খণ্ড খণ্ড করে ফেললেন, কিন্তু পক্ষধর রঘুনাথের মত অকাট্য বুঝেও সরলমনে পরাজয় স্বীকার করতে পারলেন না; বরং নির্বোধ, নাস্তিক, বেল্লিক ইত্যাদি শব্দে তাঁকে অপমান করলেন। উপস্থিত মৈথিল পণ্ডিত ও ছাত্ররা চিৎকারে ও গালিগালাজে পক্ষধরের কটূক্তির সমর্থন করতে লাগলেন।




ছাত্ররা বলল,




আখণ্ডলঃ সহস্রাক্ষো বিরূপাক্ষস্ত্রিলোচনঃ।
অন্যে দ্বিলোচনাঃ সর্ব্বে কো ভবান্ একলোচনঃ।।




অর্থাৎ — ইন্দ্রের হাজার চোখ, মহাদেবের তিন চোখ, আর সকলের দুই চোখ; তুমি একচোখা কে হে বাপু?




এভাবে ‘কানা’ বলে চিৎকারে প্রকৃতপক্ষে তর্কে জয় হয় না। কিন্তু সেদিন সভাস্থল হতে রঘুনাথ পুরো মিথিলার ‘কানা কানা' চিৎকারেই হতমান হয়ে বাসায় ফিরলেন। যখন ধীরভাবে নিজের প্রত্যেকটি কথা স্মরণ করে তিনি বুঝলেন যে, তিনি কয়েক দিনের বিচারে একটাও অভব্য বা অশিষ্ট শব্দের ব্যবহার করেননি এবং তাঁর যুক্তি একান্তই অকাট্য, তখন তাঁর বড়ো রাগ হলো।




রঘুনাথের বয়স ২২ কি ২৩ মাত্র, রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তিনি মনস্থির করলেন, পক্ষধরের বাড়িতে গিয়ে তাঁর সাথে আবারও বিচার আরম্ভ করবেন। বহুসংখ্যক লোকের চিৎকারের বাইরে, যদি বিচারে ঠেকে গিয়ে পক্ষধর সরলভাবে পরাজয় স্বীকার করেন তো ভালো, তখন তিনি নিজদেশে গিয়ে নিজমত প্রচার করবেন; নতুবা পক্ষধরের এবং নিজের প্রাণ তরবারির সাহায্যে বিনাশ করে সব শেষ করে দেবেন।




সেদিন শরৎকালের পূর্ণিমা। পক্ষধরের স্ত্রী বলছিলেন, “এই জ্যোৎস্নার চাইতে নির্মল কিছু আছে কি?” পক্ষধর তখন নিজের অসরল ও অন্যায় আচরণে লজ্জিত হয়ে রঘুনাথের কথাই ভাবছিলেন। তিনি বললেন, “নবদ্বীপ হতে এক নবীন নৈয়ায়িক এসেছেন। ওঁর বুদ্ধি এই জ্যোৎস্নার চাইতেও নির্মল!”




ব্রাহ্মণের ক্রোধ বাঁশপাতার আগুন। তরবারিহস্ত রঘুনাথের ততক্ষণে রাগ পড়ে এসেছিল। তিনি গুরুগৃহে পৌঁছেই অনুতপ্ত হয়ে ফিরে যাবার উদ্যোগে ছিলেন। গুরুর কথাগুলি শুনতে পেয়ে তরবারি ফেলে দিয়ে সাষ্টাঙ্গে গুরুর চরণতলে গিয়ে পড়লেন এবং স্বীকার করলেন, যে বুদ্ধির তিনি প্রশংসা করছিলেন, সেই বুদ্ধিই তাঁকে সেখানে তরবারি হাতে গুরুহত্যার জন্য এনেছিল।




পক্ষধর শিষ্যকে পেয়ে গাঢ় আলিঙ্গন করে উপযুক্ত শিষ্যের অনুচিত অবমাননা করার জন্য আত্মগ্লানি এবং তা থেকে উৎপন্ন অসীম অনুশোচনা উপশম করলেন এবং ব্রাহ্মণের উপযুক্ত কর্তব্যপথে দৃঢ়তা লাভ করলেন।




পরদিনই সকলকে ডাকিয়ে এনে পক্ষধর সুস্পষ্টভাবে নিজের পরাজয় স্বীকার করলেন। এতকাল পর্যন্ত যে-সকল মত অকাট্য ও অভ্রান্ত বলে স্বীকৃত হয়ে আসছিল, তা রঘুনাথের অসাধারণ ধীশক্তিগুণে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হলো। রঘুনাথ সমগ্র ভারতবর্ষের শিরোমণি হলেন। তিনি নবদ্বীপে এসে টোল স্থাপন করলে ভারতবর্ষের সব প্রদেশের ছাত্র এসে তাঁর কাছে ন্যায়দর্শন শিখতে লাগলেন।




নবদ্বীপে পড়ার সময় রঘুনাথের সাথে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর (তখন তিনি নিমাই পণ্ডিত মাত্ৰ) বড়ো মধুর সম্পর্ক ছিল। একদিন কোনো এক জটিল বিষয়ের মীমাংসার জন্য রঘুনাথ গাছের নিচে বসে চিন্তা করছিলেন। সারারাত কেটে গেছে; শরীরের উপর পাখিরা বিষ্ঠাত্যাগ করছে; রঘুনাথের কোনো হুঁশ নেই। নিমাই এসে রঘুনাথের মাথায় নিজের কমণ্ডলুর জল দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বসে বসে কী ভাবছ?” রঘুনাথ বললেন, “সে কথা তোমায় বলে কী হবে?”




কথা বলতে বলতে নিমাই এমন কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করলেন, যার উত্তর নিয়ে ভাবতে গিয়ে রঘুনাথ ঠিক মীমাংসা পেয়ে গেলেন। রঘুনাথ তখনই বললেন, “ভাই, যা আমি তিন দিন ভেবে ঠিক করতে পারলাম না, তা তুমি একমুহূর্তেই স্থির করে দিলে! তুমি নিশ্চয়ই মহাপুরুষ!”




কথিত আছে, রঘুনাথ তাঁর ন্যায়ের টীকাশাস্ত্র ‘দীধিতি’ লিখতে আরম্ভ করার পর নিমাই তাঁকে নিজের একটি টীকা পড়ে শোনালে রঘুনাথকে নিতান্তই হতাশ্বাস ও ম্লানমুখ হতে দেখলেন। তখন নিমাই বলেন, “ভাই, এই অফল শাস্ত্রে তোমার অভিলষিত যশের পথে আমি প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাই না; এই আমার টীকা আমি গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করলাম।”




ফলত তর্কশাস্ত্র মানুষের চরম লক্ষ্য নয়; তা বুদ্ধি পরিমার্জনার জন্যই প্রয়োজনীয়। তার সাথে স্মৃতিপ্রমাণে সদাচারলাভ এবং আত্মতত্ত্ব বা নিত্যবস্তুর বিষয়ে জ্ঞানলাভের জন্য সভক্তিক বিচার এবং প্রত্যক্ষ অনুভূতি লাভের জন্য সভক্তিক যোগসাধনাই চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত!




ব্যুৎপত্তিবাদ, লীলাবতী টীকা, তত্ত্বচিন্তামণি, দীধিতি, অদ্বৈতেশ্বরবাদ, ব্রহ্মসূত্রবৃত্তি প্রভৃতি অনেক গ্রন্থ রঘুনাথ রেখে গেছেন।




হরিঘোষ নামক এক ব্যক্তি তাঁর সুবিস্তৃত গোশালায় রঘুনাথের চতুষ্পাঠী খুলে দিয়ে তাঁর বহুসংখ্যক ছাত্রের স্থানসংকুলান করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে ছাত্রের কলরবপূর্ণ স্থানকে লোকে ‘হরিঘোষের গোয়াল’ বলে।




মিথিলায় রঘুনাথ কাণ ভট্ট শিরোমণি নামেই প্রসিদ্ধ। রঘুনাথের কবিত্ব-শক্তিও ছিল। কিন্তু তিনি ওটিকে বড়ো মনে করতেন না; যদি করতেন, তবে একটি উৎকৃষ্ট ও উপাদেয় মহাকাব্যও লিখে যেতে পারতেন। তাঁর কবিতার কেউ প্রশংসা করায় তিনি বলেন,




কবিত্বং কিমহো তুচ্ছং চিন্তামণিমনীষিণঃ।
নিপীতকালকূটস্য হরস্যেবাহিখেলনং।।




মহাদেব যে সর্পধারণ করেন, তাঁর কালকূটপানের কাছে তা যেমন খেলা মাত্র, তেমনি অতি কঠিন চিন্তামণি বা ন্যায়শাস্ত্র-শিক্ষিতদের পক্ষে কবিতারচনা তুচ্ছ কাজ।




আহা, এই কবিতাটিই কী সুন্দর কবিত্বশক্তির পরিচয় দিচ্ছে!




তাঁর গুরু কোনো এক সময়ে রঘুনাথকে বিয়ে করতে অনুরোধ করলে আমৃত্যু ব্রহ্মচারী রঘুনাথ বলেন, “দীধিতি আমার পুত্র, লীলাবতী আমার কন্যা। লোকে পুত্র-কন্যার জন্যই তো বিয়ে করে। আশীর্বাদ করুন, আমার ওই পুত্র কন্যা অমর হোক।”




রঘুনাথের জীবনের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবি, কতটা একাগ্রতার সাথে সাধনার ফলে কোনো বিষয়ে এমন পূর্ণ সিদ্ধিলাভ হয়!