কৃপার আশায়

তুমি আত্মা, তুমি বিশ্ব। তুমি বিশ্বাত্মা, তুমি জীবাত্মা। একাধারে দুই-ই তুমি। দুইয়ে এক, একে দুই। ভেদে অভেদ, অভেদে ভেদ। অচ্ছেদ্য অনির্বচনীয় যোগ। যোগ দেখলে তো সব দুঃখ চলে যায়।




জীবনের ব্যর্থতার জন্যে কত অভিযোগ করি। তোমাতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারিনি বলে নিরাশ হই। সব সাধন ব্যর্থ হয়েছে বলি। তুমি এসব কথার, এসব ভাবের, প্রতিবাদ করছ। কোনো সাধন ব্যর্থ হয়নি, সব চেষ্টাই সফল হয়েছে, তোমার নিকটে নিয়ে গিয়েছে। দিনের পর দিন তোমার কাছে যাচ্ছি। অহংকারমূলক সাধন ছেড়ে, অকিঞ্চন হয়ে, তোমার অহেতুকী কৃপা না চাইলে সিদ্ধি হবে না ভাবছি।




তুমি আজ আমার এসব কথার ভুল দেখিয়ে দিচ্ছ। আমি যাকে অহংকারমূলক সাধন বলছি, তাতে তোমার অহেতুকী কৃপা রয়েছে, তাতে আমার কাতর প্রার্থনা রয়েছে। অহেতুকী কৃপার জন্যে আমার যে কাতর প্রার্থনা, তা-ই আমার সাধন। আমি সাধন ও প্রার্থনায় বৃথাই ভেদ করছি। তোমার জন্যে যা করছি, তা-ই তোমার কৃপা, আর তা-ই আমার সাধন। কোনো সাধন ব্যর্থ হচ্ছে না। কোনো মুহূর্তে তোমার কৃপাস্রোত বন্ধ হচ্ছে না। প্রত্যেক সাধন সফল হচ্ছে, প্রত্যেক মুহূর্তে তোমার কৃপাস্রোত আমাকে তোমার নিকটবর্তী করছে, তোমার সঙ্গে সজ্ঞান অচ্ছেদ্য যোগের দিকে অগ্রসর করছে।




আমার অভিযোগ বন্ধ করো, আমার নিরাশা দূর করো। প্রত্যেক রাত্রির সুষুপ্তিতে তোমার মধ্যে লুকিয়ে যাচ্ছি; আমার সসীম-জীবনের কোনো প্রকাশ থাকছে না। লুকিয়ে যাচ্ছি, অব্যক্ত হচ্ছি, কিন্তু লীন হচ্ছি না। আমার সাধনের, জীবন-সংগ্রামের, সমস্ত ফল তোমাতে, তোমার অক্ষয় জ্ঞানে সঞ্চিত থাকছে। প্রতিদিন ঘুম ভেঙে তুমি আমাকে সমস্ত ফিরিয়ে দিচ্ছ। তোমার রাজ্যে, তোমার মঙ্গলবিধানে কিছুই নষ্ট হয় না, কিছুই নিষ্ফল হয় না।




আমার অজ্ঞানতা, আমার ভয়, আমার নিরাশা, আমার অবসাদ দূর করে তুমি আমাকে সবল করো, আশান্বিত করো, উৎসাহযুক্ত করো। তোমার সঙ্গে আমার অভেদ দেখে আমি অনেকসময় আমার ব্যক্তিত্বের মূল্য ভুলে যাই। এই অভেদের মধ্যে অনির্বচনীয় ভেদ করে, আমাকে স্নেহযত্নের পাত্র করে তুমি আমাকে অনন্ত মূল্যে মূল্যবান করেছ। আমার মূল্য আমি ভুলে যাই, তুমি ভোলো না। অনন্তস্বরূপ তুমি যাকে ভালোবেসে সৃষ্টি করেছ, তোমার থেকে ভিন্ন করে ব্যক্ত করেছ, যাকে নিয়ে প্রতিমুহূর্তে ব্যস্ত রয়েছ, তার মূল্য তো অনন্তই হবে। তোমার সৃষ্ট সমস্ত জগৎ তো তার মূল্যেই মূল্যবান। তার সেবায় না লাগলে চন্দ্ৰ-সূর্য, অগ্নি-বায়ু, নদী-সমুদ্র, বৃক্ষ-লতার কী মূল্য থাকত?




ওগো, তোমার ঐশ্বর্য, তোমার মাধুর্য কি তার সম্বন্ধে সার্থক নয়? তার জীবনের নিয়ন্তা বলেই তুমি ঈশ্বর। তার স্নেহময়ী মা বলেই তুমি মধুর। তোমার সঙ্গে তার অচ্ছেদ্য যোগ কী অপূর্বভাবে দেখাচ্ছ! মানুষ আমাকে ভোলে, আমাকে ছাড়ে। আমি কত লোককে ভুলেছি, কত লোককে ছেড়েছি। মানুষের প্রেমে আমার আস্থা নেই।




অনন্ত-স্বরূপ যে তুমি, তোমার প্রেম তো অমন হতে পারে না। তুমি তোমার সন্তানকে উপেক্ষা করতে পারো না। কী আশার কথা, আশ্বাসের কথা, পরমানন্দের কথা! আমাকে এই কথা দিন দিন, মুহূর্তে মুহূর্তে শোনাও। আমার অজ্ঞানতা, আমার ভ্রম, আমার অপ্রেম দূর করো। প্রেমবলে আমাকে বলীয়ান করো। আমাকে প্রাণভরা প্রেম দিয়ে আমার সমস্ত দুর্বলতা, সমস্ত অশান্তি, সমস্ত দুঃখ দূর করো।