আমি তোমাকে ঘৃণা করি


অনেক দিন হয়ে গেল আমরা আলাদা রাস্তায় হাঁটছি। তুমি এখন তোমার মতো করে ভালোই আছ, জানি। আমি এখনও পর্যন্ত আমার নিজের মতো করে ভালো থাকতে শিখে নিতে পারছি না। যা-ই হোক, বিদায়বেলা আমার কিছু কথা বলার ছিল, তখন সুযোগ পাইনি, তাই এখন বলছি। হয়তো তুমি এসবের কিছুই কখনও পড়বে না, তবু লিখছি। যদি ভুলে কোনওভাবে তোমার হাতে এই চিঠি পৌঁছায়, তাহলে তো ভালোই। সেই ক্ষীণ আশাটুকুও এ মনে বেঁচে রইল।


তোমাকে বেশ কিছু কারণে ধন্যবাদ। আমাদের সম্পর্কের প্রথম কয়েকটা মাস কেটেছে স্বপ্নের মতো। তুমি আমাকে শিখিয়েছিলে এবং দেখিয়েছিলে ভালোবাসা কেমন হয়, কেমন হওয়া উচিত। সেটার জন্য আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তুমি আমায় যা দিয়েছিলে, তা অন্য কোনও পুরুষ দিতে পারত কি না সন্দেহ! একদিন মোহের শেষ হল, এরপর শুরু হল তোমার কাছে আমার নতুন পাঠ নেওয়ার পালা। বিরক্তি, অবহেলা, অবিশ্বাস, ক্রোধ, ক্রমাগত অবিশ্বস্ততা, এইসব কোনও সুস্থ সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। তুমি আমায় শিখিয়েছ মানুষ কতটা বদলে যেতে পারে। তার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। আমি এখন নিশ্চিত, তুমি আমার সাথে যা করেছ, তার শতকরা দশ ভাগও যদি কেউ আমার সাথে করে, তবে আমি সেই মানুষটাকে একমিনিটও সহ্য করতে পারব না।


মাত্র এক বছর আগেও আমি ভাবতাম, যারা বেঁচে আছে, তাদের মধ্যে আমিই সবচাইতে সৌভাগ্যবতী মেয়ে। তুমিই ছিলে আমার প্রথম প্রেম, আমার স্কুলজীবনের স্বপ্নপুরুষ, এবং একজন পুরুষের মধ্যে আমি যা চাই, তার সবটুকুই তোমার মধ্যে ছিল। সেই তুমি আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরিয়ে দিলে! আমি তোমার প্রেমে এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম যে তোমাকে ঘিরেই আমার জীবনের প্রতিটি ছক বেঁধে ফেলেছিলাম। আজ বুঝি, এই যে আবেগের বশে লোকে কেমন বোকার মতো শপথ করে বসে, সারাজীবনই একসাথে থাকবে, কখনওই হাত ছেড়ে দেবে না ইত্যাদি ইত্যাদি, এসব কেবলই রূপকথার গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। সারাজীবন তো অনেক বড়ো ব্যাপার, কয়েক মাস কারও সাথে একসাথে থাকার সিদ্ধান্তই কারও পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়, আর আমরা কিনা শপথ করে বসে ছিলাম! মা আমাকে প্রায়ই বলত, একজন মানুষ ছয় মাসের জন্য ভালো হতে পারে। ভাগ্য ভালো হলে এক বছরও আমার জীবনে দারুণ মানুষ হয়েই আছে, এমন কারও সাথেও আমার দেখা হয়ে যেতে পারে। আমি খুব দ্রুত সম্পর্কের সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম, কারণ আমার মনে হয়েছিল, আমি আমার সত্যিকারের ভালোবাসার দেখা পেয়ে গেছি, আর সেই তুমি আজ কোথায়!


ভালো আছ তো, না? থাকারই তো কথা। কয়েক মাস হয়ে গেল, ভুলে যাওয়া উচিত, কিন্তু চোখের জলটা যে কিছুতেই কমছে না! কী করব, বলো! এর চাইতে বড়ো কিছু কখনও হারাইনি যে! জীবন থেকে প্রথম প্রেম হারানোর ব্যথা যে কী, এক ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেই-বা বুঝবে? তোমাকে ছেড়ে থাকাটা আমার জন্য সহজ নয়। তুমি এটা বুঝবে না, কারণ আমাকে ছেড়ে থাকতে তোমার কখনও অত কষ্ট হতো বলে আমার মনে পড়ে না। তা সত্ত্বেও, আমি কেন তোমাকে যেতে দিলাম?


মাসের পর মাস তোমার অবহেলা, ফোন ধরলেই ঝগড়া, কান্নায় কান্নায় কেটে-যাওয়া নির্ঘুম রাত। আমি আর কীই-বা করতে পারতাম? তোমায় ছাড়া থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যতটা কষ্টের ছিল, তার চাইতে হাজার গুণ বেশি কষ্ট হচ্ছে তোমায় ছেড়ে থাকতে। আমার খুব ইচ্ছে করে তোমার কণ্ঠটা শুনতে, তোমার হাত ধরে বসে থাকতে, তোমাকে রান্না করে খাওয়াতে; আর কিছু না হোক, শুধু তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতেও অনেক শান্তি। তুমি এই অনুভূতি বুঝবে না। আমার সব কথা জানানোর মানুষটি আজ আমার পাশে নেই। আমার একেবারে গুরুত্বহীন কথাটাও তোমাকে বলতেই হতো, তুমি আমার ওসব বকবক শুনলে খুব যে মজা পেতে, সেটা হয়তো হয়, কিন্তু তুমি আমার কথা শুনছ, আমাকে কথা বলতে দিচ্ছ, বিরক্ত হলেও সেটা দেখাচ্ছ না, এসবকিছুর দাম অনেক। একসময় আমাকে অনেক অনেক বকতে। আমি রাগ করতাম, কিন্তু ভালোও লাগত। আজ আমাকে বকার কেউ নেই। তোমার সব কথাও আমি শুনতাম। তোমাকে মনখারাপ করে থাকতে দেখলে আমি সহ্য করতে পারতাম না, তাই খুব করে চেষ্টা করতাম যাতে তোমার মনটা ভালো করে দিতে পারি।


মনে পড়ে, সেই সোনালি দিনগুলির কথা? নালন্দা গার্ডেনে আমাদের প্রিয় খয়েরি বেঞ্চটাতে বসে বসে খুব ছোটো ছোটো ব্যাপারগুলি নিয়েও আমরা হাসাহসি করতাম, একেবারে তুচ্ছ ঘটনা নিয়েও তর্কে মেতে উঠতাম, উদ্ভট সব গল্প বানাতাম, অন্য বন্ধুদের বাসায় গিয়ে হানা দিতাম, আড্ডা হইহুল্লোড় গান জম্পেশ খাওয়াদাওয়া কিংবা কিছুই না, শুধু নীরবতায় কেটে যেত আমাদের দু-জনের আশ্চর্য মুহূর্তগুলি! এইসব ছোটো ছোটো সুখ মনে মাখিয়েও কয়েকটা জীবন দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায়। আমাদের বন্ধুত্ব ছিল এমন কিছু, যার ধরনটা কেবল আমরাই ধরতে পারতাম। ভালোবাসা আর বন্ধুত্ব---এ দুইয়ের মধ্যে দেয়ালটা নিয়ে ভাববার সময়ই হয়নি কখনও। আমরা যতটা ছিলাম প্রেমিক-প্রেমিকা, ততোধিক ছিলাম বন্ধু। তোমার দেওয়া সব উপহারই আছে আমার কাছে, এবং এগুলি সবসময়ই থাকবে আমার সাথে। আমি চেয়েছিলাম তোমাকে নিয়ে বাঁচতে, এর বদলে তোমার সব স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি। জীবনটা কি এরকমই? তোমার সবচাইতে যন্ত্রণার সময়গুলিতে আমি ছিলাম তোমার পাশে, এর প্রতিদান তুমি দিয়েছ কিছু যন্ত্রণার সময় উপহার দিয়ে। আমার পরিবার, আমার বন্ধু, আমার আত্মীয়স্বজন, এর কিছুই আজ আমার পাশে নেই শুধু তোমার জন্য। ওরা আমাকে তোমার সম্পর্কে সতর্ক করত, আমি তা সহ্য করতে পারিনি, তাই ওদের সাথে সকল বন্ধন ছিন্ন করে ফেলেছি। তুমিই বলে দাও, এখন আমি কোথায় যাব?


তোমাকে মারতে ইচ্ছে করে, নাকে ঘুসি বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে; ইচ্ছে করে, সব শক্তি দিয়ে আঘাত করে একেবারে শেষ করে দিই; কিন্তু আমি এসবের কিছুই করব না। এমন নয় যে এমন আচরণ তোমার প্রাপ্য নয়, বরং এইজন্য যে আমার রুচিও হয় না তোমাকে শাস্তি দেওয়ার! আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার অধিকারটুকুও নেই তোমার। তোমার চোখে বেদনার ছায়া যে আমাকে অস্থির করে তুলত একসময়, সেই আমিই এখন চাই, তুমিও আমার বেদনাটা সত্যিই অনুভব করো। আমাকে আমি আর চিনতে পারি না। এই যে বদরাগী, ভয়ংকর, খিটখিটে মেয়েটা---এই কি আমি? আমার আর কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, জীবন নিয়ে আর কোনও স্বপ্ন নেই। যে মানুষটা ঘৃণার কোনও মানেই জানত না, সেই মানুষটা এখন ঘৃণার উপর একটা গবেষণাপত্র লিখে ফেলতে পারবে। এ সবকিছুর জন্য দায়ী একমাত্র তুমিই।


আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ তুমি আমার বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছ।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ তুমি আমাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছ।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ তুমি আমাকে শেষ করে দিয়েছ।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ তুমি আমার অনুভূতি নিয়ে দিনের পর দিন খেলেছ।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ শুধু তোমার কারণে আমাকে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ তোমার জন্যই দুশ্চিন্তা আমার পিছু ছাড়ে না।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ যখন আমার নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করার কথা ছিল, তখন আমি আমাকে তোমার মতো করে গড়ে তুলতে ব্যস্ত ছিলাম।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ তুমি আমাকে যা যা স্বপ্ন দেখিয়েছ, তার সবই মিথ্যে।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ পুরো পৃথিবীর চোখে তুমি দারুণ একজন মানুষ হলেও একমাত্র আমি জানি, তুমি কতটা জঘন্য।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ তুমি অনেক রকমের মুখোশ পরে চলো।
আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ তুমি বেশ ভালো আছ, আর শুধু তোমার কারণে আমি ভালো নেই।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ তুমি আমার সকল বোধ, বিবেক, ভাবনা নিষ্ঠুরভাবে নষ্ট করে দিয়েছ।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ তোমাকে ভালো থাকতে দেখলে আমি ভালো থাকতে পারছি না, এবং আমার এই অপারগতার সমস্ত দায় একমাত্র তোমার।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ তোমার কারণেই আমি তোমাকে ঘৃণা করতে শিখেছি।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ তোমাকে ঘৃণা করি বলে আমি আমার নিজেকেই ঘৃণা করি।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ আমি কী ছিলাম, কী হয়ে গেলাম, সামনে কী হবো, এসব ভাবতে ভাবতে আমার মাথা আর কাজ করে না।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ যখন তুমি সবচাইতে বেশি আমাকেই খোঁজো, তখন আমি তোমার পাশে থাকতে পারি না, আমি যখন সবচাইতে বেশি তোমাকেই খুঁজি, তখন তুমি আমার পাশে আর আসো না।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কারণ আমাদের দুজনের সুন্দর পৃথিবীটা তুমি ধ্বংস করে দিয়েছ, আমাদের প্রেম, আমাদের বন্ধুত্ব, আমাদের আন্তরিকতা---সব, সবকিছুই তুমি অতীত আবর্জনার স্তূপে ছুড়ে ফেলে দিয়েছ।


হ্যাঁ, আমি জানি, সব দোষ তোমার একার নয়। দোষ আমারও আছে। তোমাকে সবকিছুর বিনিময়ে চাওয়াটা আমার দোষ, পুরো পৃথিবীর সবকিছুর চাইতে তোমাকে বেশি বিশ্বাস করাটা আমার দোষ, তোমার প্রতি অতিরিক্ত খেয়াল রাখাটা আমার দোষ, এই যে প্রতিদিনই প্রতিটি মুহূর্তেই ঘৃণার সাগরে ডুবে ডুবে হারিয়ে যাচ্ছি আমি, এর দায়ভারটাও আমারই। আমি আমাকে এখন ঘৃণা করি। খুব খুব খুব বেশি ঘৃণা করি নিজেকে। আমি এই নরকে অনন্তকাল থেকে যেতে চাই না। আমি কীভাবে মুক্তি পাবো, বলতে পারো?


যখন এমন কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করে, যাকে আমি আমার সমস্তটা দিয়ে ভালোবেসেছিলাম, যার মঙ্গলকামনাই আমার একমাত্র প্রার্থনা হয়ে গিয়েছিল, যার পাশে থাকলে আমার পুরো পৃথিবীটাই ঝলমল করে হেসে উঠত, যাকে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি বিশ্বাস করতাম, তখন সেই মানুষটিকে কীভাবে ক্ষমা করে দেওয়া যায়? যদি কেউ বিশ্বস্ততা আর আন্তরিকতার অভিনয় করে যায় দিনের পর দিন, আর এরপর ছুড়ে ফেলে দেয় দূরের একটা অন্ধকার কোনায় চরম নিষ্ঠুরতা আর অবহেলায়, সে-ও ক্ষমার যোগ্য হয় কী করে? সৃষ্টিকর্তার সাথে যতটা নিশ্চিন্ত, নির্ভার, বিশ্বস্ত বন্ধুত্ব, ততটা পরমবন্ধুত্বকে অসম্মান করতে পারে যে, তাকে ক্ষমা করতে বলছ?


আমার মধ্যে তুমি এরকম অসংখ্য ‘কেন’র জন্ম দিয়ে আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছ! এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে খুঁজে আমার প্রতিটি রাত আক্ষরিকভাবেই নির্ঘুম কাটে। আমি জানি, তোমার কাছে এসবের কোনও উত্তর বা ব্যাখ্যা নেই। আমি কখনওই জানতে পারব না, কী অপরাধে আমার জীবনটা তুমি শেষ করে দিয়েছ। আমাদের যা ছিল, তা এখন আর নেই। কেন নেই, এর উত্তর আমি জানি না। কোনও কারণ ছাড়াই কেন এতটা কষ্ট আমাকে পেতে হলো, আমি তার উত্তর চাই। তুমি আমার সাথে যা করেছ, তা সম্পূর্ণ ইচ্ছে করেই করেছ। তুমি ঠিকই জানতে কী হচ্ছে, কী হতে যাচ্ছে। এর জন্য তোমাকে চরম শাস্তি পেতে হবে। কোনও অজুহাতই তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।


তোমার আচরণের কোনও ব্যাখ্যা নেই, তুমি যা যা বলেছ, তা একটা পাগলও বিশ্বাস করবে না। এটাই সত্য। আমাদের মধ্যে যা ছিল, তা তুমি কেন নিজহাতে এমন করে নষ্ট করে দিলে, আমাকে এতটা দুঃখ কেন দিলে, এর পেছনে তুমি যদি হাজারটা কারণও আমাকে বলো, তবু আমি তোমাকে কখনওই ক্ষমা করতে পারব না। তুমি যা করেছ, তা ইচ্ছা করেই করেছ, এবং এর জন্য তোমার শাস্তি পাওয়া উচিত। আমি যাকে ভালোবাসলাম, সে এতটা বাজে লোক, এটা ভাবতেও আমার ঘেন্না লাগে। তোমার মতন একটা শয়তানকে কী করে বিশ্বাস করলাম? ইদানীং তুমি বলো, তুমি নাকি এখন আমার জীবনে আবারও ফিরতে চাও! লজ্জাও করে না তোমার? কী ভাবো আমাকে?


হ্যাঁ, তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার কষ্ট হবে। আমি তোমার উপর এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে প্রতিটি প্রয়োজনের সময় তোমাকে আমার লাগেই। সাথে আমি এ-ও জানি, একবার তোমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখে গেলে, পৃথিবীর কোনও কিছুই আমাকে আর আটকে রাখতে পারবে না। আমার যত কষ্ট আর হতাশার কথা, তা একমাত্র তোমাকেই বলতাম। আমাকে তো তোমার চাইতে ভালো করে আর কেউই চেনে না, তাই তুমি জানতে আমি কী পারি, কতটুকু পারি। তুমি আমাকে যা বলতে, আমি তা-ই বিশ্বাস করতাম। যদি বলতে আমি কোনও একটা কাজ পারব, আমি ধরেই নিতাম যে আমি ওটা নিশ্চয়ই পারব। আমার আত্মবিশ্বাস ও বিশ্বাস, দুই-ই তুমি পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছ!


আমি সুস্থ হয়ে উঠছি। তুমিহীনতা কাটিয়ে উঠছি ধীরে ধীরে। প্রায়ই মনে হয়, যদি তুমি এই সময় আমার পাশে থাকতে, তবে নিজেকে সামলে নেওয়াটা আমার জন্য সহজ হতো। আমি বুঝেছি, তুমি পাশে থাকলে আমি আর কখনওই স্বাভাবিক হতে পারব না। আমি জানি, আমি যে মানুষটার জন্য এমন করে কেঁদে মরছি, সে মানুষটা তুমি ছিলে না, সে মানুষটার কোনও অস্তিত্বই ছিল না, অস্তিত্ব থাকবেও না। আমাদের মধ্যে যে বন্ধুত্ব ছিল, তা ছিল অপবিত্র, নোংরা। অন্তত এখন তা-ই মনে হয়। সত্যিই এতকিছুর দরকার ছিল না! তুমি মনের ও দেহের চাহিদা মিটিয়েছ প্রেমের অভিনয়ে, আর আমি তা মিটিয়েছি প্রেমের বিনিময়ে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজের দিকে তাকাতেও এখন নিজেরই ঘেন্না হয়!


ভয় পেয়ো না। তোমার সাথে কখনও কোথাও দেখা হয়ে গেলেও আমি তোমাকে কিছুই বলব না। ওই শিক্ষা আমি পাইনি। আমি তোমার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করব, তোমার কোনও কাজে আসতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব, তোমার সাথে হাসিমুখেই কথা বলব। তবে এটা কিছুতেই ভুলে যেয়ো না যে আমি তোমাকে ঘৃণা করি, যতটা ঘৃণা একটা মানুষকে করা যায়, তার চাইতেও বেশি ঘৃণা করি। তুমি আমার সাথে যা করেছ, তার জন্য তোমাকে কোনও শাস্তি আমি সুযোগ পেলেও দেবো না, তবে আমি কখনওই তোমার কৃতকর্ম ভুলে যাব না। আমি ভুলতে পারি না। ভুলে যেতে পারাটা খুব চমৎকার একটা ব্যাপার, যা আমি আজও শিখতে পারিনি। ভুলে যেতে পারি না বলেই বেঁচে থাকতে আজও এত কষ্ট হয়!


আমাকে সামনের দিকে এগোতেই হবে। আমি সবসময়ই অতীতের সবকিছু নিয়েই থাকতে চাইছিলাম, আমার বার বার মনে হচ্ছিল, সবকিছু ঠিক হয়ে না গেলে আমার পক্ষে ঠিক হওয়া আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি কী একটা ভুলের মধ্যে আমি বেঁচে ছিলাম! আসলে ভুল নিয়ে বেঁচে থেকে কখনও ঠিক কিছুতে পৌঁছানো সম্ভব নয়। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, সেটাকে আর কোনওভাবেই ঠিক করা যাবে না। কিছু জিনিস একবার ভেঙে গেলে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা আর যায় না, সম্পর্কও তেমন। যত বেশি ওটা নিয়ে ভাবব, তত বেশি কষ্টই পাবো।


বিদায়, বন্ধু! যার সাথে আমি সারারাত, এমনকী ভোর পর্যন্ত কথা বলতাম, যার সাথে কোনও সংকোচ ছাড়াই সব কিছু শেয়ার করতাম, সবচাইতে ছেলেমানুষিগুলো যার সাথে করতে পারতাম, যার সাথে আমি জীবনের সেরা কিছু মুহূর্ত কাটিয়েছি, যার কাছে আমি আমার সব কাজ ফেলে ছুটে যেতাম, যার হাত ধরে বিয়েতে ঘুরে ঘুরে নাচব ঠিক করে রেখেছিলাম, যাকে আমার জীবনের সবচাইতে বড়ো বন্ধু বলে বিশ্বাস করতাম, যার সাথে বসে বাদাম খেলেও তা অমৃত মনে হতো, যাকে আমি আমার জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষ ভাবতাম, আমার সন্তান যার ছায়ায় বেড়ে উঠবে ভেবে আমি স্বপ্ন দেখতাম, যার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বললেও সময় ফুরিয়ে যেত খুব দ্রুতই, যার সাথে একসাথে বুড়ো হওয়ার কথা ছিল, সেই বন্ধুকে আজ বিদায় জানাই! তুমি ভালো থেকো। তুমি সুখী হলে আমার ভালো লাগবে। আজ থেকে আমরা কেবলই পরিচিত হয়ে গেলাম। আমি নিজের উপর চরম বিরক্ত, কারণ যে মানুষটা আমার একটা মুহূর্ত হওয়ারও যোগ্যতা রাখে না, তাকেই আমি আমার পুরো জীবন বানিয়ে বসেছিলাম!