চলে যাবার আগে

 
  
 প্রিয় অনীশ,
  
 জানি, ভালোই আছিস। তুই খারাপ থাকলে তো আর তোকে ফেলে যেতে পারতাম না কোথাও। আচ্ছা, ভাত খেয়ে নিয়েছিস? বেশি করে খেয়েছিস তো? কী হবে অত ডায়েট করে, বল তো? অত ফিট থাকা লাগবে কেন? ফিট হতে হয় নায়কদের। তোকে অত জিমে গিয়ে পরিশ্রম করা লাগবে না রে, বোকা! তুই তোর পছন্দের খাবার খাবি, ঘুমোবি, সিনেমা দেখবি, আর মন চাইলেই গল্পের বই পড়বি। তুই নিজেকে কষ্টে রাখিস না রে, ময়না!
  
 তুই কি পিয়ানো বাজানোটা ছেড়েই দিলি? তুই যে খুব ভালো পিয়ানো বাজাতিস, তা নয়। কিন্তু মিছেমিছি তোর বাজানোর প্রশংসা করতাম যখন, সেসময় তোর চেহারায় যে আনন্দের ঝলকানি আমি দেখতে পেতাম, সেটা দেখার জন্য আমি আজীবনই এই মিথ্যেটা বলে যেতে পারব। তোর মুখে হাসি দেখার জন্য নিজের প্রাণটাও দিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। আমি চোখ বন্ধ করলেই তোর হাসিমুখ দেখতে পাই। তোর ঝাঁকড়া সুন্দর চুলগুলো থেকে চুয়ে চুয়ে পানি-পড়া, চুলের পানিতে তোর পিঠ ভিজে যাওয়া, বাঁ-হাতে কফি খেতে খেতে তোর বইপড়া, সবই আমি দেখতে পাই, চোখ বুজলেই দেখতে পাই। আমার চোখে তোর চাইতে সুদর্শন পুরুষ পৃথিবীতে আর একটিও নেই।
  
 তুই কেমন আছিস রে? কেমন কাটে তোর শীতের সোনালি বিকেলবেলা কিংবা গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরবেলাগুলো? কী কী করিস অবসরে? এখনও কি বিছানায় শুয়ে পড়তেই ঘুমে তলিয়ে যাস, না কি রাতজাগা শিখেছিস? আচ্ছা, আমাদের খরগোশ, মানে তোর খরগোশ ‘ইতু’ এখন কেমন আছে? ক’টা বাচ্চা হয়েছে ওর? ওদের নাম কী রেখেছিস, আমাকে জানালি না তো! আচ্ছা, তোর কি এখনও গ্রামে যাওয়া হয়? তুই কি গ্রাম থেকে এখনও হিজল ফুল কুড়িয়ে নিয়ে আসিস? ‘হিজল গাছে ভূত থাকে কিন্তু!’ এটা বলে আর কাকে কাকে ভয় পাইয়ে দিস তুই? আমি দেখতে কেমন, কেমন করে কাঁদি, চা খাওয়ার সময় কেমন সুড়ুৎ সুড়ুৎ শব্দ করি, কোন রং আমার বেশি প্রিয়, এগুলো কি তুই মনে রেখেছিস? আচ্ছা অনীশ, তোর কি আমাকে মনে আছে? না কি তুইও…
  
 রোজ রাতে তোর কথা ভেবে ভেবে কাঁদি, জানিস? কখনওই না কেঁদে আমি ঘুমোই না। রাতে যখনি আশেপাশের সব নিশ্চুপ হয়ে যায়, সবাই যার যার মতন ঘরের দরজা এঁটে চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়ে, আমি তখন তোকে মনে করে ইচ্ছেমতন কাঁদি। এটা আমার একটা অভ্যেস হয়ে গেছে। তোকে হারিয়ে আমার যে কতটা ক্ষতি হলো, তুই কি সে খবর জানতে পারবি? তুই কি জানতে পারবি, তোর জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া আমার একটিও প্রার্থনা কখনও শেষ হয় না?
  
 জানিস, মাঝরাতে আমার বুকের ভেতর থেকে একটা চিৎকার ধেয়ে আসে। মনে হয়, কেউ যেন আমার গলা চেপে ধরে আছে। আমি সেসময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি, কোনও শব্দ করতে পারি না। রাতে মায়ের সাথে ঘুমোই তো, তাই খুব সাবধানে কাঁদতে হয়। আয়, দেখে যা আমার জীবন! নিজের সাধ মিটিয়ে আমি কাঁদতেও পারি না। তাহলে কি আমার নিজস্ব বলে কিছু আছে? অনীশ, তুইও কি কাঁদিস? তোকেও কি রোজই আমার মতন কোনও একটা কিছু তাড়া করে বেড়ায়?
  
 জানি না, এই অসময়ে কেন আবার কান্না পাচ্ছে! ঘরভরা অনেক লোক আজকে, তাই কোথাও গিয়ে একটু কাঁদারও জো নেই। তোর বাসার সবাই কেমন আছে? মাসিমা, মেসো, ছোটো কাকা, ছোটো কাকিমা আর তোদের বাড়ির রমলা পিসিমণি, যার হাতে তুই বড়ো হয়েছিস, সবাই ভালো আছে তো? তোর বন্ধু অমল, সুমিত আর বিনয়, ওরা কেমন আছে? তোরা ঘুড়ি ওড়াস না এখন আর ছাদে গিয়ে? মনে আছে, আমি তোদের সাথে মিলে ঘুড়ি ওড়াতে কত চাইতাম? তোরা আমাকে কখনও দলে নিতে চাইতিস না। বলতিস, আমি ঘুড়ি ওড়াতে গেলে নাকি সুতোই কেটে যাবে! আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোর ওড়ানো দেখতাম। তোর কি ওইসব দিনের কথা মনে আছে?
  
 তোদের বাগানে আমি আর তুই মিলে যে অনেকগুলো গাঁদা আর কৃষ্ণচূড়ার চারা লাগিয়েছিলাম, ওগুলো কতটা বড়ো হয়েছে? ফুল ফোটে? তুই কি এখনও পাখিশিকার করিস? করিস না কিন্তু! পাখির প্রাণ নেওয়া খুব বড়ো পাপ। এসব আর করিস না। দাদি বলত, ‘পাখিরাও কিন্তু অভিশাপ দেয়!’ তোকে আমি আশীর্বাদে মুড়িয়ে রাখব, একটা অভিশাপও তোর ধারেকাছেও আসতে পারবে না।
  
 আচ্ছা, তুই কি সত্যিই দেশের বাইরে চলে গেছিস, পড়াশোনা করতে? সবাই তো আমাকে তা-ই বলে! কেন রে? তোর তো এমন কোনও শখ ছিল না কখনও। আমার সাথে তো তুই সব কিছুই শেয়ার করতিস। এরকম কিছু তো কোনওদিন বলিসনি। কেমন লাগে নিজের মানুষ ফেলে রেখে বিদেশে গিয়ে থাকতে? না না, আমার কথা বলছি না! তোর পরিবারের সবার কথা বলছি। আমি কি কেউ হই নাকি? রক্তের কিংবা কাগজের সম্পর্কের বাইরে গিয়ে যদি দু-জন নারী-পুরুষের মধ্যে কোনও অনভ্যস্ত অনুভূতির তৈরি হয়, কোনও কারণ ছাড়াই যদি মায়া, টান, ভালোবাসা কিংবা চোখের জলের দাবিতে কোথাও আটকে যেতে হয়, তবে মানুষ নাম দেওয়ার ভয়ে সেই সম্পর্কটাই লুকিয়ে ফেলে!
  
 তুই যেমনটা লুকিয়ে ফেললি আমাদের সম্পর্কটাকে, তোকে অন্তত কখনও আমি এরকম ভাবিনি। না, তোকে কাপুরুষ কিংবা স্বার্থপর বলছি না। শুধুই জিজ্ঞেস করতে চাই, অনীশ, তোর আর আমার মধ্যে কি শুধুই বন্ধুত্ব ছিল? তুই কি কখনও অন্য কোনও স্বর্গীয় সুখ কিংবা দুঃখ অনুভব করিসনি, যার পুরোটাই আমি তৈরি করেছি? তবে কি সবটাই আমার ভুল ছিল? তুই যে মুখে না বলেও চোখের ভাষায় আমায় কত কী যে বলতিস, ওসব কি শুধুই আমার চোখের ভুল ছিল? আমাকে কাঁদতে দেখলে তুইও যে ভুল করে কেঁদে ফেলতিস, সেটা মনে আছে? আমার যেবার বসন্ত হলো, মুখের দাগগুলো নিয়ে যখন মন খারাপ করে বসে থাকতাম, তুই আমার কপাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে আদর করে যে বলতিস, ‘আরে, বিয়ে তো তোকে আমিই করব, এত চিন্তা কীসের?’ এ সবই কি তুই না বুঝে বলতিস তখন?
  
 যা হোক, আর লিখতে পারছি না। মনে হচ্ছে, দম আটকে এক্ষুনি বুঝি মরে যাব!
  
 ভালো থাকিস, অনীশ। আমি চলে যাচ্ছি, খুব শিগ্‌গিরই চলে যাব।
  
 তুই ভালো থাকিস।
  
 ইতি-
 তোর অচেনা নির্ঝর