রাগ কমাতে চাইলে



ক্রোধ এবং অস্থিরতা আমাদের সৃজনীক্ষমতাকে ক্রমেই নষ্ট করে দেয়। কেউ যখন ক্রুদ্ধ হয়ে থাকে, তখন সে খুব চেষ্টা করেও কোনও নির্দিষ্ট সমাধানে পৌঁছতে পারে না। অস্থিরতা কোনও পরিস্থিতিকে, সেটি যতটা জটিল, তার চাইতে জটিল করে দেখায়। ফলে সংকটের সময় অস্থির হয়ে-ওঠা মানুষ ঠান্ডা মাথায় কোনও বিশ্লেষণী চিন্তাভাবনা করতে পারে না। কিছু মানুষ আছে, যাদের ধারণাই হলো, যে-কোনও সমস্যায় পড়লে প্রথম কাজই হচ্ছে, ছোটাছুটি আরম্ভ করে দেওয়া, যেন না ছুটলে ওদের দেখে সবাই ভাববে, ‘কী অথর্ব! এমন বিপদের সময়ও হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে!’ বিপদের সময় মাথা কাজ কম করে, সে সময় লোকের কথা কানে নেওয়া যাবে, তবে সবকিছুই মাথায় নেওয়া যাবে না। আমরা যা মাথায় নেওয়া দরকার, তা কানে নিই; আর যা কানে নেওয়া দরকার, তা মাথায় নিই। ঝামেলাটা বাধে তখনই।


অযথা ব্যস্ততা কাজটাকে সহজ করে দেয় না, বরং ব্যক্তিকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়। চায়ের কাপে চা ঢালার সময় মনের রাগ কিংবা অস্থিরতা চায়ের উপর ঝাড়লে, কাপের কিছুই হয় না, কেবল জোরে চা ঢালতে গিয়ে কিছু বাড়তি শক্তি খরচ হয়, এমনকি কিছু চা ছিটকে গায়ের উপর এসেও পড়তে পারে। শাস্তিটা কাপ পায় না, যে ঢালছে, সে পায়। ক্রোধপ্রকাশের ভ্রম ও মোহ থেকে খুব কম মানুষই বেরিয়ে আসতে পারে। যে ব্যক্তি এর বশবর্তী হয়ে পড়ে, সে সবসময়ই মুহূর্তের উত্তেজনার দাস হয়ে থাকে এবং ক্রোধের নগ্নপ্রকাশকেই সাফল্য মনে করে। এমন মানুষ একধরনের শক্তির পুতুল হয়ে পড়ে, সে শক্তির ইচ্ছেমাফিক চলে, যে শক্তি খুব একটা মঙ্গল বয়ে আনে না।


এখন কথা হচ্ছে, এর সমাধান কী? ক্রুদ্ধ হলে কী করতে হবে? পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল নীরবে। জগতের কোনও মহৎ কাজই অস্থিরতায় হয়নি। ক্রোধ কিংবা অহেতুক রাগ থেকে কোনও ভালো কিছু কখনওই হয়নি। কী করা দরকার, কী করা দরকার নয়, এই বোধ যার যত বেশি, সে তত চুপচাপ ধরনের। কী এক অদ্ভুত সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি! আমরা একে অন্যের পেছনে লেগে আছি, পুরোটা না বুঝেই রেগে যাচ্ছি এবং সে রাগ থেকেই কোনও-না-কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছি। ছোটার নামই জীবন, তবে না বুঝেই ছোটার নাম মৃত্যু। ১০ মিনিট ভালো কথা বলার জন্য অন্তত ১০ দিন নীরবে প্রস্তুত হতে হয়। যদি আমি চাই, ১টা দিন এমন হোক, যে দিনটা শুধুই আমার জয়ের কথা বলবে, তবে তার জন্য অন্তত ১ বছর ধরে প্রস্তুত হতে হবে---অবশ্যই নীরবে। লোকে হইচই ফেলে দেয় আসল কাজটা করার আগেই। কোনও মানে হয়! বছরে ১২টা বাজে মুভি বানানোর চাইতে বরং বছরে ১টা ভালো মুভি বানানো অনেক ভালো। তাড়াহুড়োয় বাজে কিছু করার চাইতে সময় নিয়ে ভালো কিছু করা অনেক ভালো। লোকে, কাজটা কত ভালো হয়েছে, তা দেখে; কাজটা কত দ্রুত হয়েছে, তা দেখে না।


অমর হতে চাইলে আগে মৃত্যুকে বরণ করতে শিখতে হয়। এ মৃত্যু কেমন মৃত্যু? নীরবতার অন্য নাম মৃত্যু! কষ্টের অন্য নাম মৃত্যু। দুই-ই গ্রহণ করতে হয় স্বেচ্ছায়, মাথা পেতে। বেশিরভাগ মানুষই সাধারণ মানুষ। ওরা পৃথিবীতে আসে, তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু না করেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। অন্য ১০ জনের মতো বাঁচা সহজ, কিন্তু গৌরবের কিছু নয়। কোলাহলে মঙ্গল নেই, যত মঙ্গল নীরবতায়। জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা মানুষ পায় নিজের ভেতরের মানুষটার কাছ থেকে। কোলাহলের মধ্যে ভেতরের মানুষটা কখনও কথা বলে না। প্রকৃতির সবসময়ই শেখায়---তবে সে শিক্ষাগ্রহণের জন্য নিজেকে প্রকৃতির কাছে নিতে হবে, কোলাহল থেকে দূরে সরে যেতে হবে। চোখদুটো বন্ধ করে ধীর-স্থির-মৌন থেকে নিজের হৃদয়ের সাথে যে কথোপকথন, সেটাই মানুষকে মানুষ হতে শেখায়।


রাগ, সহিংসতা, অস্থিরতা, এ সব কিছুই দুর্বলতার লক্ষণ, সবসময়ই। কেউ যখন এমন কিছু বলতে থাকে, যা তার বলা উচিত নয়, তখন ধরে নেওয়া যায়, সে মানসিকভাবে দুর্বল কিংবা ওই মুহূর্তে বিক্ষিপ্তচিত্তে আছে। বর্তমান মুহূর্তটাকে বোঝার কিংবা অনুভব করার সবচাইতে ভালো উপায় হলো পুরোপুরি নীরবতার মধ্য দিয়ে সামনের মুহূর্তটিতে প্রবেশ করা। এ সময়ে নিজের সমস্ত ইগোকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। রাগ কিংবা অস্থিরতা আসে মূলত ইগো থেকে। কোনও কিছুকে পার্সোনালি নিয়ে ফেললে সেটা আমাদের উপর প্রভাববিস্তার করতে শুরু করে। কেউ যদি এমন কিছু বলে, যা আমাদের রাগিয়ে দিতে পারে, তবে সে মনে মনে নিশ্চয়ই আমাদের রাগই প্রত্যাশা করে। যদি আমরা কোনও ধরনের প্রতিক্রিয়া না দেখাই এবং নিঃস্পৃহ থাকি, তবে সে হতাশ হয়। আমরা কোনও পালটা জবাব না দিয়ে কিংবা তার কথার বা কাজের ফলাফলস্বরূপ কোনও কিছু না করে তাকে সহজেই হারিয়ে দিতে পারি।


রাগকে প্রশ্রয় দিলে বাড়ে। কেবল বাড়েই না, এক রাগ অন্য অনেক রাগকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসে। যে বিষয় নিয়ে রাগ হচ্ছে, যদি সে বিষয়টিকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে দেখি, তবে রাগটা তার শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে আমাদের চেতনাকে দখল করে নিতে আর পারে না। সেক্ষেত্রে আমাদের ইচ্ছাশক্তি কাজ করতে শুরু করে, এবং সে শক্তি রাগটাকে দূরে তাড়িয়ে দেয়। এর ক্রমাগত চর্চার ফলে সে শক্তি বাড়তে থাকে এবং বাহ্যিক বিভিন্ন কারণ আমাদের ভেতরের সত্তার নিয়ন্ত্রণ আর নিতে পারে না। রেগে গেলে কাউকেই কোনও কিছু না বলে একেবারেই চুপ হয়ে যাওয়া ভালো। ওই সময়ে অন্য কোনও বিষয়ে নিজের মনোযোগকে সরিয়ে নেওয়া যেতে পারে। বইপড়া, গানশোনা, মুভিদেখা, ঘুরতেযাওয়া, শপিংকরা, কারও সাথে গল্পকরা। কিংবা, অন্য যে-কোনও কিছু।


অনেকেই আছে, যারা নিজেকে কিছুতেই রেগেযাওয়া থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। “আমি আর কখনওই রেগে যাব না।” এমন সিদ্ধান্ত বার বার নেওয়া সত্ত্বেও ঠিকই রেগে যায়। কী করা যায়? আচ্ছা, ধরা যাক, কেউ আমার বাড়িতে এল। আমি দরজা খুললাম না। সেক্ষেত্রে কি সে আমার বাড়িতে ঢুকতে পারবে? “রাগটা, যার বাড়ি ইচ্ছা, তার বাড়ি যাক। আমার বাড়িতে এলে আমি রাগকে ঢুকতেই দেবো না। রাগের জন্য আমার মনের সব দরজা বন্ধ করে রাখলাম। আজ থেকে আমি এমনই।” দরজা যতটা খোলা হবে, রাগ ঠিক ততটাই ঢুকবে। যারা রেগে যায়, তাদের বেশিরভাগই জানে না, আসলে কেন তারা রেগে যাচ্ছে। রাগ হলে যে ব্যাপারটা নিয়ে রাগ হচ্ছে, তা নিয়ে কোনও কথাই বলা যাবে না, তা নিয়ে অন্তত ওই মুহূর্তে কোনও কিছুই করা যাবে না। একসময় রাগ পাত্তা না পেয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। রাগ চলে গেলে বোঝা যায়, কতটা সহজেই রেগে যাওয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা যেত! তখন হাসি পায়! কিছু অর্থহীন কথা আর আচরণের জন্য আফসোস হয়। যদি আমি নিজে সেই রাগকে শুরুতেই আশকারা না দিতাম, তবে এতকিছু হত না। এসব কথা মনে আসে। কিন্তু তখন তো আর কিছুই করার থাকে না।