মা, তুমি কেমন আছ? আজ অনেক দিন হয়ে গেল, তোমাকে দেখি না। জীবনের ভেলায় ভাসতে ভাসতে, দমের খড়কুটোকে আঁকড়ে ধরে, তোমাকে ছেড়ে, তোমাদের না দেখে…আজ আমি দিব্যি আটকে আছি কারফিউর প্যাকেটে-মোড়া এই শহরের কোনও একটা মোড়ের চারতলায়। মা, টিভিতে দেখেছ নিশ্চয়ই, আজ গোটা পৃথিবী অসহায় হয়ে আছে কোভিড-নাইনটিনের চোয়ালের নিচে। হাজার হাজার প্রাণ এই ঘাতকের গ্রাসে নিমিষেই হাপিস হচ্ছে…সারাদিন, সারারাত। মৃত্যুর আবছায়া ক্রমেই গিলছে নগরের সমস্ত অস্থিমজ্জা, গ্রামের নরম পুতুলশরীর। সেই রক্তপিশাচের আগ্রাসী ক্ষুধা কিছুতেই থামছে না---আরও প্রাণ, আরও…! আজ কদমে কদমে শোকের মাতম। পাল্লা দিয়ে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুমিছিল। পৃথিবীর মেরুদণ্ড নুয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। মা, ত্রাসের এই থাবার নিচে যদি আমিও পড়ি? সেই মিছিলে যদি আমাকেও ঢুকে যেতে হয়? আমাদের যদি আর কখনও দেখা না হয়, মা? তোমাকে শেষ একবার না দেখেই মরে যদি যাই? জানো মা, এবার বাড়ি গেলে তোমাকে দেবো ভেবে একটা নীলপেড়ে জামদানি শাড়ি কিনেছিলাম… টিউশনির কিছু টাকা জমিয়ে। মণির জন্য ওর পছন্দের লাল আর আকাশিরঙের একডজন কাচের চুড়ি কিনেছি। গেল-বার বাড়ি থেকে ফেরার সময়, তোমার চোখের আড়ালে আমার পথ আগলে, ছোট্ট ছোট্ট হাতদুটি দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে, ওর মায়াবী দুচোখে পৃথিবীর সমস্ত ইচ্ছেকে দমিয়ে রেখে, একগাল হেসে…শুধু একডজন চুড়ির আবদার করেছিল পাগলিটা। এই চুড়িগুলো ওকে পরিয়ে দেবার সুযোগটা পাবো তো, মা? এই দামি শহরটার অলিতে গলিতে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে… মৃত্যুর অঘোষিত পরোয়ানা জারি হয়ে গেছে আজ। যে-কোনও সময় মৃত্যু এসে…ঘাড় ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে পারে…যে কাউকেই! সেখানে যদি আমিও থাকি,…মা? মা, আজকাল তোমার ছেলে অনেক বদলে গেছে, সে ভয় পেতে শিখে গেছে! আমার ভয়---তোমাকে হারাবার ভয়। নীলশাড়িটা পৌঁছে দিতে না পারার ভয়। ছোটো বোনটিকে হারাবার ভয়। চুড়িগুলো পরিয়ে দিতে না পারার ভয়। মা, মণির দিকে খেয়াল রেখো। আচারের বয়ামটা, ওকে মাঝেমধ্যে ধরতে দিয়ো। টিয়াপাখিটা উড়তে শিখলে উড়িয়ে দিয়ো। পুকুরপাড়ের গাছগুলোতে আগাছা হলে কেটে দিয়ো। বাড়ির সামনে…আমার বাগানটাতে, সময় করে একটু জল দিয়ো। যদি বেঁচে ফিরতে না পারি, যদি বাবার কাছে চলে যেতে হয়, আমার লাশের কাছে এসো না, মা। এই অনুরোধটা রেখো? ওদের বলে রেখেছি, আমি মরলে আমার লাশটা যেন এখানে কোথাও বেনামে দাফন করে দেয়। ওদের বলেছি, আমার কেউ নেই, আমি এতিম। মা, যদি বেঁচে ফিরতে পারি, তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে…অনেকক্ষণ চিৎকার করে কাঁদব। আমি অনেক দিন কাঁদি না, মা… মা, তোমরা সাবধানে থেকো, সুস্থ থেকো। ইতি, নার্সিংহোমের বেডে আটকেপড়া তোমার রাফি।