শঙ্করাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্যে আত্মাকে নিত্যশুদ্ধ, নিত্যমুক্ত, নিত্যবুদ্ধ স্বভাব পরমাত্মন্ বলে উল্লেখ করেছেন। দেহ-মন-সংঘাতের সঙ্গে গ্রন্থিবদ্ধ আত্মাই হলেন অহঙ্কার বা আমিত্ব; এই আমিত্বই কেবল অপরাধ, যা পাপাদি আর অশুভ মনোবৃত্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়। আমাদের মধ্যে দু-রকম মাত্রাই রয়েছে। একটি প্রভাবিত হয় সুখ-দুঃখ, অপরাধাদির দ্বারা—এরই নাম ছোটো আমি, যার উৎপত্তি প্রজনন-তন্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অন্যটি হলো নিত্যশুদ্ধ, নিত্যমুক্ত, নিত্যবুদ্ধ আত্মা। এই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্যাপারটিকে খুব সুন্দরভাবে মুণ্ডকোপনিষদে (৩/১/১) একই বৃক্ষে দুটি পাখির দৃষ্টান্ত দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। এই শ্লোকে পরে আসছি।
ব্রহ্মৈবেদমমৃতং পুরস্তাদ্ব্রহ্ম পশ্চাদ্ব্রহ্ম দক্ষিণতশ্চোত্তরেণ। অধশ্চের্ধ্বঞ্চ প্রসৃতং ব্রহ্মৈবেদং বিশ্বমিদং বরিষ্ঠম্।। (২/২/১১)
পুরস্তাৎ (পুরোভাগে স্থিত) ইদম্ (ইহা; এই যা-কিছু প্রতিভাত হচ্ছে, তা) অমৃতম্ ব্রহ্ম এব (অমৃতস্বরূপ ব্রহ্মই), পশ্চাৎ (পশ্চাদ্ভাগে), দক্ষিণতঃ (দক্ষিণ দিকে), উত্তরেণ চ (এবং উত্তর দিকেও) ব্রহ্ম অধঃ (নিম্নদিকে) ঊর্ধ্বম্ চ (এবং ঊর্ধ্ব দিকেও) ব্রহ্ম প্রসৃতম্ (ব্যাপ্ত আছেন); ইদম্ (এই) বিশ্বম্ (জগৎ) ইদম্ বরিষ্ঠম্ (এই প্রত্যক্ষ শ্রেষ্ঠতম) ব্রহ্ম এব (ব্রহ্মই)।
অর্থাৎ, পুরোভাগে অবস্থিত এই সমস্তই অমৃতস্বরূপ ব্রহ্ম এবং পশ্চাতে, উত্তরে, দক্ষিণে, উপরে, নিচে সমস্তই ব্রহ্মসত্তার দ্বারা সত্তাবান। ব্রহ্ম জগতের সর্বত্র প্রসূত, ব্যাপ্ত।
ব্রহ্মৈবেদমমৃতং—অমৃতস্বরূপ এই ব্রহ্মই 'ইদম্' অর্থাৎ যা-কিছু ইন্দ্রিয়গোচর, সেই সমস্ততেই ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন। শুধু পুরোবর্তী বস্তু নয়, সম্মুখে-পশ্চাতে-উত্তরে-দক্ষিণে-উপরে-নিচে সমস্ত বস্তুই ব্রহ্মসত্তার দ্বারা সত্তাবান। বিভিন্ন দিকের উল্লেখের দ্বারা আমাদের দৃষ্ট বা অনুভূত যাবতীয় বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হলো, তাই বলা হলো 'ব্রহ্মৈবেদং বিশ্বম্'। এই সমগ্র জগৎ ব্রহ্মসত্তায় সত্তাবান, ব্রহ্ম জগতের সর্বত্র প্রসূত, ব্যাপ্ত। ব্রহ্ম তাই বরিষ্ঠ, শ্রেষ্ঠতম। তিনি ছাড়া ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুরও অস্তিত্ব নেই। তাই শ্রুতি বলছেন—'নেহ নানাহস্তি কিঞ্চন' (বৃহদারণ্যকোপনিষদ, ৪/৪/১৯)—এই জগতে তিনি ছাড়া নানা বস্তু কিছু নেই। এ কথার তাৎপর্য এ নয় যে, সমস্ত বস্তু ব্রহ্মের সঙ্গে যুক্ত, এর প্রকৃত অর্থ—ব্রহ্মই জগৎ। ব্রহ্ম ব্যতিরেকে অপর কোনো বস্তুর সত্তাই নেই। জগতে যত বৈচিত্র্য দেখি বা অনুভব করি, সে সমস্তই অজ্ঞানপ্রসূত। সুতরাং জগৎ বলে যা জানি, তা স্বরূপত ব্রহ্মই। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়—যোহয়ং স্থাণুঃ পুমাণেষঃ—এই যে সামনে স্থাণু বা অপরিবর্তনশীল অচঞ্চল কাঠবিশেষ মনে হচ্ছে, বাস্তবিক এ তা নয়, এ পুরুষবিশেষ। পুরুষের জ্ঞান হলে স্থাণুর কোনো সত্তা থাকে না। রজ্জু-সর্পের ক্ষেত্রে রজ্জুর জ্ঞান (তুলনীয়: ব্রহ্ম) হলে সর্পের সত্তা (তুলনীয়: জগৎ) বিলুপ্ত হয়ে যায়। জগৎও তেমনি ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত, ব্রহ্মজ্ঞান হলে জগতের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। 'পুরস্তাদ্ব্রহ্ম পশ্চাদ্ব্রহ্ম' ইত্যাদির দ্বারা বোঝানো হয়েছে, ব্রহ্ম যে চারিদিকে ছড়িয়ে আছেন, তা নয়; সমস্ত বস্তুর প্রকাশের মূলেই তিনি আছেন। মেরী হেলকে স্বামীজি এই সত্যই ভাষান্তরে বলেছিলেন, “All are God—একথা ঠিক নয়, God is and all are not—এটাই হলো সত্য।” ব্রহ্মাতিরিক্ত কোনো সত্তা নেই। যদি তাঁকে বাদ দিয়ে জগৎকে বুঝতে চাই, তবে কিছুই পাওয়া যাবে না, সব কিছুরই মূলতত্ত্ব ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত—এটাই হলো শ্লোকটির তাৎপর্য। অনুভবের বিষয়গুলিকে বিশ্লেষণ করে দেখা যাবে, সব কিছুরই মূলতত্ত্ব ব্রহ্মে পর্যবসিত হচ্ছে—এই জ্ঞানই হবে ব্রহ্মকে জানা। বৈচিত্র্য যতই দেখি না কেন, ব্রহ্ম সকল বিষয়ের অতীত—'বিরজং ব্রহ্ম নিষ্কলং' (মুণ্ডকোপনিষদ, ২/২/৯)।
প্রত্যক্ষ সিদ্ধ বৈচিত্র্যকে কি এভাবে অস্বীকার করা চলে? কথামৃতে রামকৃষ্ণ মোমের গাছ, মোমের ফুল, মোমের পাতার দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন, ব্রহ্মই সমস্ত হয়েছেন—তবু এ যেন মূলতত্ত্ব থেকে কয়েক ধাপ নেমে এসে বলা। তত্ত্বের দৃষ্টিতে দেখলে দেখব, তিনি ছাড়া আর কিছু নেই। যে-কোনো বস্তু বা অনুভূতিকে বিশ্লেষণ করে করে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, সবই সেই অদ্বয় ব্রহ্মসত্তাতে পর্যবসিত হয়েছে। পরিণামী বস্তুকে পরিণামী বলে বোঝা যায় একটি অপরিণামী বস্তুর সঙ্গে তুলনা করে। সমস্ত জগৎকে এই একটি গুণের দ্বারা পরিচয় করানো যায় যে—তা হলো পরিণামী। তাহলে সেই প্রশ্ন ফিরে আসছে, কোন বস্তুর সঙ্গে তুলনায় জগৎকে পরিণামী বলব? ব্রহ্মা এক্ষেত্রে অপরিণামী, জগতের যত বৈচিত্র্য, সমস্তই তাঁর পরিণাম। এটাই বেদান্তের মূল রহস্য। এইভাবে তাঁর সাধারণ ও বিশেষ সত্তা 'অনুভাতি' ও 'বিভাতি' তথা এক ও বহুরূপে প্রকাশিত। যত বৈচিত্র্য, তার সবই আমাদের দৃষ্টিতে ও অনুভবে, ব্রহ্মে নয়। সেই বর্ণনাতীতকে বর্ণনা করার জন্যই বলা হয়, সব বস্তুতে তিনি আছেন; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁর অতিরিক্ত কোনো বস্তুর সত্তাই নেই। নুনে ডুবে আছে—এ কথার অর্থ, কোনো এক বস্তু আছে এবং তাতে নুন ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছে। ব্রহ্ম জগতে ওতপ্রোতভাবে আছেন, এ কথা শ্রুতিতে বলা হলেও এটি বর্ণনার জন্যই বলা, মূলতত্ত্ব থেকে নেমে এসে বলা। তা নাহলে তাঁকে সীমিত করে ফেলা হয়।
রজ্জু-সর্পের ক্ষেত্রে রজ্জু সাপকে জড়িয়ে থাকে না, সাপ তো নেই-ই—তার মাথা কি লেজ, সবই দড়ি মাত্র। এই অর্থে 'পুরস্তাদ্ব্রহ্ম পশ্চাৎব্রহ্ম'—ব্রহ্ম উপরে-নিচে-উত্তরে-দক্ষিণে। যেমন রজ্জুর প্রকাশ দ্বারা সাপ প্রকাশিত, তেমনই ব্রহ্মের সত্তায় জগৎ প্রকাশিত। এটিই হলো অদ্বৈত বেদান্তের মত। মোমের ফুল আর মোমের ফল হলো বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের কথা। কিন্তু মতবাদের বিভিন্নতা থাকলেও মূলতত্ত্ব তো দু-রকম হতে পারে না, তবু যে দু-রকম উদাহরণই আমরা দেখি, তার প্রধান কারণ, পরম তত্ত্বকে কখনও মুখের কথায় স্পষ্ট করে বোঝানো যায় না। এটি ব্যক্তির আপন অনুভবের বিষয়। ঘট-পটকে বুদ্ধিগ্রাহ্য বিষয় করা যায়, কিন্তু আত্মা তো জ্ঞানের বিষয় নয়, তাই জাগতিক দৃষ্টান্ত দিয়ে আত্মতত্ত্বের সম্যক জ্ঞান হতে পারে না এবং পারে না বলেই শ্রুতিতে বহুস্থানে তাঁকে নেতিবাচক বিশেষণের দ্বারা বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি 'সচ্চিদানন্দ' পদটিও সাক্ষাৎভাবে ব্রহ্মবাচক নয়। সেখানে অর্থ করা হয়: সৎ মানে অসৎ নয়, চিৎ মানে অচিৎ বা জড় নয়, আনন্দের অর্থ অনানন্দ বা দুঃখ নয়। ব্রহ্মকে মুখে প্রকাশ করা যায় না বলে নানা উপমার সাহায্যে তাঁকে বোঝাতে হয়। সেজন্যই রামকৃষ্ণ এক জায়গায় বলেছেন, অগাধ জলরাশি, তারই মধ্যে কোথাও বরফের স্তূপ দেখা যায়। জমা বরফের চারপাশেই কিন্তু জল। এই জল আর বরফের মধ্যে কোনো বস্তুগত পার্থক্য নেই, আছে রূপের বৈচিত্র্য মাত্র। ব্রহ্ম ও পরিদৃশ্যমান জগতেও তেমনি প্রকাশের বৈচিত্র্য। এইদিক দিয়েই 'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম' (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৩/১৪/১), অর্থাৎ এ সবই ব্রহ্ম—এই উক্তিটির সার্থকতা।
পরিদৃশ্যমান বৈচিত্র্যপূর্ণ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও সেই ব্রহ্মেরই বিকাশ। ব্রহ্মকে কোনো বিশেষণের দ্বারা বোঝানো বা কোনো ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে জানা সম্ভব নয়, কারণ তিনি ইন্দ্রিয়ের অগোচর। তাই ব্রহ্মকে বোঝাবার জন্য অদ্বৈতবাদীরা বলেন, 'নেতি নেতি', 'অস্থূলম্, অনণু, অহ্রস্বম্, অদীর্ঘম' (বৃহদারণ্যকোপনিষদ, ৩/৮/৮) —ব্রহ্ম এটা নয় ওটা নয়, স্থূল নয় সূক্ষ্ম নয়, হ্রস্ব নয় দীর্ঘ নয় ইত্যাদি। এই ব্রহ্মবস্তু কীভাবে সমস্ত জগৎ ব্যাপ্ত করে আছেন? তিনি না থাকলে তো কোনো বস্তুর প্রতিষ্ঠাই নেই। যে জাগতিক বৈচিত্র্য দর্শন করি, সবই যদি তাঁর প্রকাশ হয়, তাহলে তো তিনি সর্বব্যাপী হলেন—'বিশ্বমিদং বরিষ্ঠম্'। এভাবেই সমস্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ জগতের মধ্যে তিনি প্রসূত, বরিষ্ঠ, শ্রেষ্ঠতম। এমনি করে ব্রহ্মকে আমরা গৌণভাবে জানছি। তিনি কী, তা যখন মুখে বলা যায় না, তখন তিনি কী নন, সেই ব্যাতিরেক-মুখেই আমাদের চিন্তাধারা যাচ্ছে। 'জানছি' এ-কথার অর্থও কোন কিছুর সাহায্যে জানা নয়—'প্রতিবোধবিদিতং' (কেনোপনিষদ, ২/৪)—বুদ্ধিবৃত্তিসমূহের আত্মারূপে তিনি বিদিত হচ্ছেন। বুদ্ধিবৃত্তি জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রকাশ হচ্ছে, তাই তাঁকে জানছি। বুদ্ধির দ্বারা তাঁকে প্রকাশ করা যায় না, কিন্তু প্রতিটি বৃত্তির ভেতর দিয়ে যিনি জ্ঞানস্বরূপ প্রকাশিত রয়েছেন, বৃত্তির প্রকাশের ভেতর দিয়ে তাঁরই প্রকাশ—এ-ই হলো বেদান্তের সিদ্ধান্ত। এই শ্লোকে এভাবে ব্রহ্মের সর্বব্যাপিতার উপসংহার করা হলো।
এ ছাড়া আর-একটি দৃষ্টি আছে। সেটি উপাসনার দৃষ্টি। ব্রহ্মের প্রকাশ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, এই দৃষ্টিতে গ্রহণ না করে যদি, ব্রহ্ম সর্ববস্তুতে আছেন, এমন ধারণা করি, অর্থাৎ ব্রহ্মের অতিরিক্ত অপর বস্তুর সত্তা স্বীকার করে উপাসক যদি অগ্রসর হন, তাহলেও সর্বত্র সেই ব্রহ্মচিন্তা করতে করতে তাঁর দ্বৈতাসক্তি তথা দ্বৈতজগতের প্রতি মনের যে-ঝোঁক, তা ক্রমশ কমে যাবে। তখন এই সত্য উপলব্ধ হবে যে, ব্রহ্মই জগতের একমাত্র অধিষ্ঠান, আশ্রয়।
ব্রহ্মবস্তুকে জানা এত দুরূহ যে, নানাদিক থেকে তাঁকে আলোচনা করা প্রয়োজন এবং শাস্ত্র বিভিন্নভাবে বার বার সে আলোচনা করেছেন। সেজন্য অন্যান্য ক্ষেত্রে যে-পুনরুক্তি দোষের, শাস্ত্রে তা কোনো সময়েই দূষণীয় নয়। এই দুর্জ্ঞেয় ব্রহ্মতত্ত্বকে দুটি পাখির দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা হচ্ছে:
দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে। তয়োরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্য— নশ্নন্নন্যো অভিচাকশীতি।। (৩/১/১)
সযুজা [সযুজৌ] (সর্বদা সম্মিলিত) সখায়া [সখায়ৌ] ('আত্মা'—এই সমান নামধারী অর্থাৎ সমভাবাপন্ন) দ্বা [দ্বৌ] (দুইটি) সুপর্ণা [সুপর্ণৌ] (পাখি, অর্থাৎ জীবাত্মা ও পরমাত্মা) সমানম্ (একই) বৃক্ষম্ (বৃক্ষকে বা শরীরকে) পরিষস্বজাতে (আলিঙ্গন করে বসে আছে); তয়োঃ (ওদের মধ্যে) অন্যঃ (একটি অর্থাৎ জীব) স্বাদু ([বিচিত্র] আস্বাদযুক্ত) পিপ্পলং (ফল তথা কর্মফল) অত্তি (ভোগ করে), অন্যঃ (অপরটি বা অন্যজন অর্থাৎ ঈশ্বর) অনশ্নন্ (ভোগ না করে) অভিচাকশীতি ([কেবল] দর্শন করেন)।
সর্বদা সম্মিলিত ও সমনামধারী বা সমভাবাপন্ন দুটি পাখি একই গাছে থাকে; এদের মধ্যে একটি পাখি তিক্ত কি স্বাদু সবরকম ফলই খায়; অন্যটি কোনো ফলই খায় না, শুধু দেখে।
দুটি পাখি একই গাছে থাকে। একটি পাখি তিক্ত স্বাদু সবরকম ফল খায় অর্থাৎ কর্মফল বা সুখ-দুঃখ ভোগ করে। আর একটি পাখি কোনো ফল খায় না, শুধু দেখে অথচ আনন্দে থাকে। তেমনি দেহরূপ বৃক্ষে দুটি পাখি থাকে—একটি জীবাত্মা, অপরটি পরমাত্মা। জীবাত্মা দেহ-মন-ইন্দ্রিয়াদিতে আমি-বুদ্ধি করছে এবং দেহ-ইন্দ্রিয়াদির পরিণামের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পরিণামী অর্থাৎ সুখী বা দুঃখী ভাবছে। আমরা সর্বদাই দেখতে পাই, ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সম্পর্কের ফলে আমাদের সুখ-দুঃখের বোধ হয়। গীতা বলছেন—মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ (২/১৪)—ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়াদির সংযোগেই শীত-উষ্ণ, সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্বের অনুভব হয়। আমি এই জগতের সকল বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে সুখ-দুঃখ ভোগ করছি, কিন্তু এর পশ্চাতে আর-একটি সত্তা রয়েছে, যা সদা স্বমহিমায় অপরিণামীরূপে প্রকাশিত। একটি অপরিণামী বস্তুকে কল্পনা না করলে পরিণামী বস্তুকে বোঝা যায় না। এই যে আমি এখন সুখী, পরক্ষণেই দুঃখী, তার পিছনে একটি অপরিবর্তনশীল বস্তু না থাকলে সুখ-দুঃখাদিবিশিষ্ট আত্মার প্রকাশ হতো না। এর কারণ, যেখানে পরিণাম, সেখানে পরিণামের অপর দ্রষ্টা না থাকলে পরিণামের অনুভব হবে না। সেই অপরিবর্তনশীল তত্ত্বকে বলে পরমাত্মা বা কেবল আত্মা, যিনি সর্বত্র পরিব্যাপ্ত, যাঁকে আশ্রয় না করে কোনো বস্তুর প্রকাশ হতে পারে না, অথচ তিনি প্রকাশ্য বস্তুগুলি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আত্মা শব্দের অর্থই হচ্ছে সর্বব্যাপী। সুতরাং তা দুটি হতে পারে না, কারণ তাহলে একটি বস্তু অপরটিকে সীমিত করবে। একটি আত্মা subject, অপরটি object হলে আত্মার সর্বব্যাপিতা বাতিল হয়ে যায়। দুটি সর্বব্যাপী বস্তুর কল্পনা যুক্তিবিরোধী। স্বরূপত দুটি বস্তু এক কিন্তু একটিকে আমরা যেন ভিন্নভাবে ভ্রান্তভাবে কল্পনা করে পৃথক করে ফেলছি—এ কেবলই কল্পিত পৃথকত্ব। এই দুটি জিনিসকেই আত্মা বলা হলো কেন? দুই-ই চেতন। একটি চৈতন্যধর্মবিশিষ্ট, অপরটি হচ্ছে চৈতন্যের স্বরূপ—দুই-ই প্রকাশধর্মী।
এজন্য দুটিকেই পাখি বলা হলো। একটি পরমাত্মা, অপরটি জীবাত্মা। উভয়ে স্বরূপত ভিন্ন নয়, তাই বলা হয়েছে ‘সযুজা’ বা সর্বদা এই পাখি দুটি সম্মিলিত এবং তারা ‘সখায়া’ আত্মা—এই সমান নামধারী, স্বজাতীয় বা সমধর্মী অর্থাৎ চৈতন্যধর্মী। একই গাছে অর্থাৎ দেহে থেকে দেহের অধীশ্বর এবং অধিষ্ঠানরূপে প্রকাশ পাচ্ছে। অধিষ্ঠান এবং তার সঙ্গে সম্বন্ধরূপে প্রকাশ পাচ্ছে। অধিষ্ঠান যেমন স্ফটিক, সে লাল রঙের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়, তার লাল রঙ নেই, কিন্তু জবা ফুল বা লাল ফুলের সান্নিধ্যবশত লাল রং স্ফটিকে আরোপিত হওয়ায় তাকে লাল দেখাচ্ছে। এই আরোপের অধিষ্ঠান হলো স্ফটিক। জীবাত্মার যে পরিবর্তনশীল রূপ, সেটি আরোপিত আর আরোপের অধিষ্ঠান বা উৎস বা দ্রষ্টা বা সাক্ষী হচ্ছে পরমাত্মা।
কিন্তু জীবাত্মাই বলি, আর যে নামই দিই, তাতে যদি আত্মধর্ম থাকে, তাহলে সুখ-দুঃখাদির সঙ্গে তার সম্বন্ধ হতে পারে না, কারণ ওগুলি জড়ের ধর্ম। সম্বন্ধ হতে পারে না, অথচ সম্বন্ধের প্রতীতি হচ্ছে—এইজন্য বলা হচ্ছে, এগুলি আরোপিত। স্ফটিকের রং লাল হতে পারে না, কিন্তু লাল দেখাচ্ছে; এখানে লাল রং আরোপিত। জীবাত্মাকে বিশ্লেষণ করার আগে একটি পৃথক অস্তিত্ববিশিষ্ট বলে মনে করি আর বিশ্লেষণ করলে বুঝতে পারি, সেটি স্বরূপত শুদ্ধ চৈতন্য, উপাধি-সম্বন্ধের জন্য তাকে যেন পরিবর্তনশীল মনে হচ্ছে। সেইজন্য তাকে ভিন্ন বলে ধরে নিয়ে ভ্রমানুভূতির অনুসরণ করে বলছি—দুটি প্রকাশ, আসলে বিচার করলে দাঁড়াবে—একটিই প্রকাশ। একটি চৈতন্যই জগৎকে প্রকাশ করছে, আমরা তার ভেতর তারতম্য করে দুটি চৈতন্য বলে কল্পনা করছি। একটি চৈতন্যের সঙ্গে আমাদের ব্যবহার হয়, আর-একটি অব্যবহার্য। এইজন্য দুটি পাখি বলা হলো। তারা সর্বদা সংযুক্ত হয়ে থাকে, তাদের সমান বা একই আত্মা—নাম বা স্বরূপ।
আত্মা মানে সর্বব্যাপী—আ সমন্তাৎ তনোতি ব্যাপ্নোতি—সবদিকে যিনি পরিব্যাপ্ত। জীবাত্মা এই ‘দেহ ও ইন্দ্রিয়াদির সংঘাতে’ এবং পরমাত্মা ‘সকল বস্তুতে’ পরিব্যাপ্ত। আর একই হৃদয়গুহাতে তাদের উপলব্ধি হয়, সেজন্য বলা হয়েছে—'সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে'—একই বৃক্ষ বা একই স্থানকে অবলম্বন করে তারা থাকে। এই বৃক্ষ হলো দেহ-ইন্দ্রিয়-সংঘাত বা দেহ ও ইন্দ্রিয়ের মিথস্ক্রিয়া। একে বৃক্ষ বলার কারণ 'ব্রশ্চনাৎ ক্ষরণাৎ বৃক্ষ'—বৃক্ষের মতোই, দেহ ও ইন্দ্রিয় উভয়েই নশ্বর-ক্ষয়িষ্ণু এবং উভয়কেই অতিক্রম করে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার ঐক্য উপলব্ধি করতে হবে। তা ছাড়া ফল ভক্ষণ করার জন্য পাখি যেমন বৃক্ষকে আশ্রয় করে, তেমনি এখানেও দেহকে অবলম্বন করেই জীবাত্মার কর্মফল ভোগ হয়, এই ধারণাটিও এই উপমার দ্বারা সূচিত হচ্ছে।
'ঊর্ধ্বমূলোহবাক্শাখ এষোহশ্বথঃ সনাতনঃ।' (কঠোপনিষদ, ২/৩/১) অর্থাৎ, 'এষঃ সনাতনঃ অশ্বত্থঃ ঊর্ধ্বমূলঃ অবাক্শাখঃ'—এই সংসাররূপ অনাদি অশ্বত্থবৃক্ষের মূল ঊর্ধ্বে অর্থাৎ সর্বোত্তম পরমাত্মা এর কারণ, শাখাসমূহ অধোগামী অব্যক্ত, হিরণ্যগর্ভ, বিরাট ইত্যাদি পর্যন্ত বিস্তৃত।—শ্রুতির এই উক্তিও বৃক্ষের সঙ্গে সংসারের সাদৃশ্য জ্ঞাপন করে। এই সংসার-বৃক্ষের মূল ‘অব্যক্ত ব্রহ্ম’ ও নিচের দিকে ব্রহ্ম-বিপরীত ‘অনাত্ম বস্তু’র দিকে প্রসারিত তার শাখা-প্রশাখা। সংসারের উৎপত্তি সেই অব্যক্ত ব্রহ্ম থেকেই। কর্মফলের আশ্রয়স্বরূপ এই সংসারে দুটি পাখি রয়েছে। অবিদ্যা-কাম-কর্ম-বাসনা-লিঙ্গ-উপাধি আশ্রয় করে যে রয়েছে, সে-ই সূক্ষ্ম শরীরাভিমানী আত্মা একটি এবং ঈশ্বর যিনি সকলের নিয়ন্তা, তিনি আর-একটি। যদিও দেহ এবং ইন্দ্রিয়ের সংঘাতের মধ্যেই এই পাখিদুটির উপলব্ধি হচ্ছে, তবুও তাদের মধ্যে একটি, যাকে ক্ষেত্রজ্ঞ (জীবাত্মা) বলে, সে দেহ-ইন্দ্রিয়াদি উপাধিরূপ বৃক্ষের নানাবিধ ফল খাচ্ছে অর্থাৎ কর্মের দ্বারা যে সুখ-দুঃখাদি অর্জন করছে, তা বোধ করছে, আনন্দ-বেদনা নানা বৈচিত্র্য ভোগ করছে। অজ্ঞতাই এই ভোগের কারণ। নিজেকে সে এই দেহাদি থেকে ভিন্ন বলে ভাবতে পারছে না বলেই তার এই ভোগ।
আর-একটি পাখি হলো নিত্যশুদ্ধবুদ্ধ মুক্তস্বভাব সর্বজ্ঞ পরমাত্মা—সর্বপ্রাণীরূপ যে-উপাধি, তার ঈশ্বর প্রেরয়িতা, ভোজ্য এবং ভোক্তা সকলের সাক্ষী এবং নিয়ন্তা, কিন্তু নিজে অভোক্তা। সে কোনো ফল খাচ্ছে না অর্থাৎ কোনো কর্মফল ভোগ করছে না, সে কেবলমাত্র সেখানে অবস্থান করছে, দর্শন করছে—'অনশ্নন্ অভিচাকশীতি'। তিনি প্রকাশ পাচ্ছেন মাত্র, কিন্তু তাঁর সেই প্রকাশই, তাঁর সান্নিধ্যমাত্রই জীবকে কর্মে প্রবর্তিত (প্রবৃত্ত) ও নিয়ন্ত্রিত করছে। ঈশ্বর অন্য কোনোভাবে জীবকে কর্মে প্রবৃত্ত করেন না, কেবল তাঁর চৈতন্যরূপে উপস্থিতিই কর্মের প্রেরক। এই জগৎ-ব্যাপার থেকে তিনি সম্পূর্ণ পৃথক, এর সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক হচ্ছে না, অথচ তাঁর প্রকাশের দ্বারাই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রকাশিত। এভাবে একটি পাখি ফলভোক্তা, অপরটি সাক্ষীরূপে যখন একই বৃক্ষে অবস্থিত থাকে, তখন—
সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহ নীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ। জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশম্ অস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ।। (৩/১/২)
পুরুষঃ (ভোক্তা জীব) সমানে (একই) বৃক্ষে (বৃক্ষে, অর্থাৎ দেহে) নিমগ্নঃ (আসক্ত বা দেহাত্মভাবে মগ্ন হয়ে) অনীশয়া (দীনভাব প্রাপ্ত হওয়ায়) মুহ্যমানঃ (দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে) শোচতি (সন্তাপ করে থাকে); যদা ([পরে] যখন) জুষ্টম্ ([ধার্মিকগণের] সেবিত বা আরাধিত) অন্যম্ ([শরীর বা জীব থেকে] বিলক্ষণ বা ভিন্ন) ঈশম্ (ঈশ্বরকে) [এবং] অস্য (এরই অর্থাৎ আমারই) ইতি (এই বিশ্বব্যাপী বা এরূপ [উপলব্ধি করে[) মহিমানম্ ([এবং বিশ্বব্যাপী] বিভূতি বা মহিমাকে) পশ্যতি (দর্শন বা উপলব্ধি করে) [তখন] বীতশোকঃ (শোকমুক্ত হয়, সংসার অতিক্রম করে)।
জীবও ওরকম একই (সংসার) বৃক্ষে আসক্ত হয়ে শোকে মুহ্যমান হয় এবং সন্তাপ করে থাকে। যখন সে বহুজন দ্বারা আরাধিত এবং দেহ থেকে স্বতন্ত্র ঈশ্বরকে এবং তাঁর এরকম মহিমাকে (নিজের দেহ থেকে অভিন্ন) দর্শন করে, তখন শোকমুক্ত হয়।
সেই ভোক্তা পাখিটি অর্থাৎ জীব সংসারে নিমগ্ন হয়ে পরতন্ত্রতাবশত শোকে মুহ্যমান হয়। 'অনীশয়া'—যিনি নিয়ন্তা বা ঈশ, তাঁর থেকে ভিন্ন—এই বুদ্ধিবশত জীব কর্মফলে যে-আসক্তি, তাতে ডুবে যায়। দেহ ইন্দ্রিয়াদিতে আত্মবুদ্ধি থাকায় সে ডুবে যাচ্ছে, নানাপ্রকার দুঃখাদি ভোগের ফলে শোকগ্রস্ত ও চিন্তাগ্রস্ত হচ্ছে। এজন্য সে নিয়ন্তা না হয়ে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তার এই দীনভাব তার ‘অনীশা’।
এরকম কর্তৃত্ব-ভোক্তৃত্ববশত স্বাধীনতা হারিয়ে যখন সে নিজেকে হীনমন্য এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে করে, সেসময় অন্য পাখিটিকে দেখে তার মনে বিচার উঠছে—সুখ-দুঃখাদি যাঁকে অভিভূত করছে না, কোনো কর্মফল যাঁকে লিপ্ত করছে না, যিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ও উপাস্য হয়ে এখানে বিরাজ করছেন, তিনি কে? তখন সে ধীরে ধীরে উপরের পাখিটির দিকে অগ্রসর হতে আরম্ভ করে এবং শেষকালে দেখে যে, তারা দু-জনে যেন একই হয়ে গিয়েছে। তখন তার নিজের পৃথক সত্তার লোপ হয়ে যায়। সে উপলব্ধি করে যে, যাকে সে এতক্ষণ পৃথক পাখিরূপে দেখছিল, যার বিভূতিতে সে বিমোহিত হচ্ছিল, সেই পাখির সঙ্গে তার কোনো পার্থক্যই নেই। অপর পাখিটির মহিমা তার নিজেরই মহিমা—এটি অনুভব করে সে তখন শোকের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেল।
এর তাৎপর্য এই, যতক্ষণ আমরা নিজেদের ঈশ্বর থেকে ভিন্ন বলে মনে করি, নিজেদের কর্মের কর্তা ও সুখ-দুঃখের ভোক্তা বলে দেখি, ততক্ষণই আমাদের পরতন্ত্রতা। বহুজন্মের দ্বারা শুভ সংস্কার অর্জন করে চিত্তশুদ্ধি হলে গুরু বা শাস্ত্রনির্দিষ্ট সাধনপন্থা অনুসরণ করে মানুষ যখন পরমতত্ত্বে মনকে সমাহিত করে, তখনই সে জানতে পারে—আমিই সেই অসংসারী আত্মা—যিনি শুদ্ধস্বরূপ ও সর্বব্যাপী। সে আরও জানবে যে, এই জগতে যা-কিছু অর্থাৎ নামরূপাদি সব আমারই মহিমা, বিভূতি আমারই প্রভা।
কর্তৃত্ব-ভোক্তৃত্ববোধ দূর হলেই আমরা বীতশোক হই, কারণ ভোক্তৃত্ব যে আমার নয়, এটি জানলেই কর্মফল আমাদের লিপ্ত করতে পারে না। রোগ-শোক সুখ-দুঃখাদি দেহমনের ধর্ম। যে আমি দেহমন থেকে ভিন্ন, তার আর শোক-মোহ কোথায়? রামকৃষ্ণ বলতেন, শরীর দুঃখ জানে; মন, তুমি আনন্দে থাকো। সে তখন বোঝে, সে নয়, তার দেহমনই সুখ-দুঃখের আশ্রয় এবং এভাবে সুখ-দুঃখের পারে যায়। এরই নাম বিবেকজ্ঞান অর্থাৎ পৃথকজ্ঞান। এই বিবেকজ্ঞানের দ্বারাই ঈশ্বরের মহিমা যে তার নিজেরই মহিমা, এটিও সে উপলব্ধি করে—'পশ্যত্যন্যমীশম্ অস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ।’
বেদান্ত থেকে জানা যায়, মানব-সম্ভাবনা-বিজ্ঞানের গভীর দেশে অনুসন্ধান চালিয়ে ঋষিরা তাঁদের প্রবুদ্ধ মনে উপলব্ধি করেছিলেন এই সত্যটি—মুক্তির সম্ভাবনা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে—এটাই হলো বেদান্তের শিক্ষা। তাই আমরা কখনও কোনো মানবসত্তাকে পাপী বলি না। বৈদান্তিক শিক্ষায়—মানবসত্তা পাপী—এ ভাবটি কোথাও পাওয়া যাবে না, তবে নিঃসন্দেহে মানুষ পাপাচরণ করতে পারে, কিন্তু সে পাপী নয়। কারণ আপন প্রকৃত স্বরূপ না জেনে কেউ পাপাচরণ করতে পারে, কিন্তু আমাদের উদ্ধারের প্রাপ্তিযোগও আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে নিহিত রয়েছে।
স্বামী বিবেকানন্দ এই মহান সত্যের কথাই উল্লেখ করেছিলেন ১৮৯৩ খ্রি. চিকাগোতে অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে প্রদত্ত তাঁর ভাষণে:
“প্রচণ্ড বাতাসের মুখে ক্ষুদ্র নৌকা যেমন একবার ফেনিল তরঙ্গের মাথায় উঠছে, পরক্ষণেই তরঙ্গ-গহ্বরের হাঁ-মুখে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, তেমনি আত্মাও কি সৎ-অসৎ কর্মের একান্ত বশবর্তী হয়ে ক্রমাগত একবার উঠছে ও একবার পড়ছে? আত্মা কি নিত্যপ্রবাহিত প্রচণ্ড গর্জনশীল অদম্য কার্যকারণ-স্রোতে দুর্বল অসহায় অবস্থায় ইতস্তত বিতাড়িত হচ্ছে?... এ কথা ভাবলে মন দমে যায়, কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মই এমন। তবে কি কোনো আশা নেই? পরিত্রাণের কি কোনো পথ নেই? মানবের হতাশ হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে এরকম ক্রন্দনধ্বনি উঠতে লাগল, করুণাময়ের সিংহাসনের কাছে ওই ধ্বনি পৌঁছল, সেখান থেকে আশা ও সান্ত্বনার বাণী নেমে এসে এক বৈদিক ঋষির হৃদয়কে উদ্বুদ্ধ করল। বিশ্বের সামনে দাঁড়িয়ে ঋষি উচ্চৈঃস্বরে জগতে এই আনন্দ-সমাচার ঘোষণা করলেন:
“শোনো, শোনো, অমৃতের পুত্রগণ! শোনো, দিব্যলোকের অধিবাসিগণ! আমি সেই পুরাতন মহান পুরুষকে জেনেছি। আদিত্যের মতো তাঁর বর্ণ, তিনি সকল অজ্ঞান-অন্ধকারের পারে; তাঁকে জানলেই মৃত্যুকে অতিক্রম করা যায়, আর অন্য পথ নেই।”
‘অমৃতের পুত্র’—এ কী মধুর ও আশার নাম! হে ভ্রাতৃগণ, এই মধুর নামে আমি তোমাদের সম্বোধন করতে চাই—তোমরা অমৃতের অধিকারী—হিন্দুগণ তোমাদের পাপী বলতে চায় না। তোমরা ঈশ্বরের সন্তান, অমৃতের অধিকারী—পবিত্র ও পূর্ণ। মর্ত্যভূমির দেবতা তোমরা! তোমরা পাপী? মানুষকে পাপী বলাই এক মহাপাপ; মানবের যথার্থ স্বরূপের ওপর এটি মিথ্যা কলঙ্কারোপ। ওঠো, এসো, সিংহস্বরূপ হয়ে তোমরা নিজেদের মেষতুল্য মনে করছ, এ ভ্রমজ্ঞান দূর করে দাও। তোমরা অমর আত্মা, মুক্ত আত্মা—চিরআনন্দময়। তোমরা জড় নও, তোমরা দেহ নও; জড় তোমাদের দাস, তোমরা জড়ের দাস নও।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে ধার করছি: শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থূ॥ (শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ, ২/৫)
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম্ আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ। তমেব বিদিত্বাতিমৃত্যুমেতি নান্যঃ পনথা বিদ্যতে অয়নায়॥ (শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ, ৩/৮)
শোনো বিশ্বজন, শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে জ্যোতির্ময়। তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহি মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পারো, অন্য পথ নাহি।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ঋষি গ্রীসদেশীয় আর্কিমেডিসের মতো বলতে পেরেছিলেন, 'ইউরেকা! ইউরেকা!' অর্থাৎ পেয়েছি, পেয়েছি! “আমি এক চমৎকার সত্য আবিষ্কার করেছি।” আর আমেরিকাবাসী শ্রোতাদের কাছে ওই শ্লোকটির পূর্বোল্লিখিত অর্থ যখন স্বামী বিবেকানন্দের মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছিল, তখন তিনি ওই বিরাট আবিষ্কারের শক্তি ওই জনগোষ্ঠীর সামনে এনে ফেললেন। 'শোনো, শোনো'—’শৃণ্বন্তু’! ‘বিশ্বে’ মানে 'জগতের সর্বত্র’। ঋষি তাঁর দিক থেকে জগৎবাসীকে আহ্বান করে বললেন: ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’, 'অমৃতের সন্তানগণ'! হে অমৃতের সন্তানগণ! আমার কথা শোনো, তোমাদের বলার জন্য সুসমাচার রয়েছে আমার কাছে। শুধু তা-ই নয়, সর্বব্যাপক উপলব্ধিজনিত দুঃসাহস দেখুন ঋষির; তিনি তাঁর সমাচার পাঠাচ্ছেন 'স্বর্গের দেবতাদের ও দেবদূতদের কাছেও, স্বর্গের অস্তিত্ব অনুমান করে'—’আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থূঃ’। সে সমাচারটি কী? তা কি কোনো গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত, অথবা উর্বর কল্পনাশক্তি প্রসূত? না! ‘বেদ অহম্ এতম্’—আমি জেনেছি এই সত্যকে—আমি একে উপলব্ধি করেছি, এই সত্যের অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।
এই ‘বেদাহমেতম্’ ভাবটিই একটি চমৎকার সত্য, যা থেকে পরবর্তীকালে নানা ধর্মীয় বিকাশ ঘটেছে। উপনিষদের এই ধর্ম—'আমি বিশ্বাস করি'—এমন নয়; বরং—'আমি উপলব্ধি করেছি'—এমন—এ বিষয়ে আমি অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। পরে তিনি বলবেন: 'তুমিও উপলব্ধি করতে পারো।' সেটি কী বস্তু? ‘পুরুষম্ মহান্তম্’— 'সীমাবদ্ধ পুরুষের পারে, অসীম পুরুষ'। ‘অল্প’ ও ‘মহা’, এ দুটি সংস্কৃত শব্দের অর্থ ‘ক্ষুদ্র’ আর ‘বৃহৎ’। অহং বা আমি হলো অল্প, আর আত্মা হলো মহা। যখন আমরা অল্প, তখন আমাদের অপরাধপ্রবণতা থাকে; যখন আমরা মহা, তখন সেরকম কিছু হতে পারে না। সবরকম অপরাধ, কর্তব্যপালনে সবরকম ত্রুটি আসে অল্পভাবাপন্ন অহং থেকে, নিজ মহান বা বিরাট স্বরূপ সম্বন্ধে অজ্ঞানতা থেকে। উপনিষদ শেখাচ্ছেন, প্রত্যেকেই মহাত্মা হতে পারে—এ আমাদের জন্মগত অধিকার। ঋষি বলেছেন: 'আমি সীমিত অহং-এর পারে অবস্থিত অসীম আত্মাকে উপলব্ধি করেছি'—’বেদাহমেতম্ পুরুষম্ মহান্তম্’। ‘আদিত্যবর্ণং’—'সূর্যের মতো দ্যুতিমান বা সমুজ্জ্বল', ‘তমসঃপরস্তাৎ’—'সব অন্ধকার ও ভ্রান্তির পারে'—এই সত্যকে আমি উপলব্ধি করেছি; কিন্তু সে সময়ে তিনি বলেননি: 'উদ্ধার পাবার জন্য, কেবল আমাকে বিশ্বাস করলেই হলো।' তিনি বলেছিলেন: ‘তমেব বিদিত্বা অতিমৃত্যুমেতি’—'তুমিও অমৃতত্ব লাভ করার জন্য' এই সত্যকে উপলব্ধি করো, কারণ এ তোমার জন্মগত অধিকার। এ সত্য লাভের জন্য তোমাকে অন্য কারও কাছে ভিক্ষা করতে বা ধার করতে হবে না। এমন উদার ও সাহসী বাণী খুব কম ধর্মদর্শনেই দেখা যায়।
উপনিষদে মানুষের মহত্ত্ব ও গৌরব খ্যাপনকারী যে-সব মৌলিক উক্তি রয়েছে, তেমনটি বিশ্ব-সাহিত্যে আর কোথাও পাওয়া যায় না। এগুলি এমনই দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলা হয়েছে যে, তা শ্রোতার মনেও দৃঢ় প্রত্যয় জাগিয়ে তোলে। এই কথার পর ঋষি আরও বললেন: ‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়’—'এ ছাড়া আর অন্য পথ নেই, মুক্তির জন্য আর অন্য কোনো পথ নেই'। ভাষাটি লক্ষণীয়: নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে—অন্য কোনো পথ নেই। এই সত্যের সামান্য উপলব্ধি হলেও এর চকিত দর্শন লাভেও জীবন পালটে যাবে। আজ আমি এক অপরাধপ্রবণ মানুষ। কোনো-না-কোনো লোকের মাধ্যমে এই সত্যের সামান্য দর্শন পেলেও আমার জীবন মানবহিতে আর সেবা-প্রবণতায় প্রভাবিত এক ভালো মানুষের জীবনে পরিণত হয়ে যাবে।
বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ, যিশুর জীবনে আমরা দেখেছি, কীভাবে ওই মহাত্মাদের একটু স্পর্শে, একটি কথায়, একঝলক দৃষ্টিতে পাপী হয়ে গেছে সাধু; এর ফলে ওই সব লোকের মধ্যে ওই দৈবীমাত্রা জেগে ওঠে। 'যাও, আর পাপ কোরো না'—এই কথা যিশু বলাতেই পাপীটি এক সাধুতে পরিণত হয়েছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল, কারণ আমরা মূলত নিষ্পাপ। আমরা যদি বাস্তবে পাপী হই, তবে কেউই আমাদের পরিবর্তন সাধন করতে পারবে না। কোনো বস্তুই তার মৌলিক চরিত্রকে পরিবর্তিত করতে পারে না। ‘স্বভাবম্ ন জহাতি সা’, অর্থাৎ 'কোনো বিষয় তার মৌলিক চরিত্র বা গুণ ত্যাগ করতে পারে না।' তবে যদি তা বাহ্যরূপ হয়, যার পেছনে তার প্রকৃত গুণ ঢাকা রয়েছে, তা হলে তার পরিবর্তন হতে পারে। বিষয়টি তার স্বরূপে ফিরে আসতে পারে। আগুন কখনও তার তাপ ত্যাগ করতে পারে না। জল কখনও তার আর্দ্রতা ত্যাগ করতে পারে না। এ-ই হলো তাদের স্বভাব, প্রকৃতি। তাই শঙ্করাচার্য ‘স্বভাবং ন জহাতি যা’ (গৌড়পাদ রচিত মাণ্ডূক্য উপনিষদের ভাষ্য মাণ্ডূক্য কারিকা, ৪/৯ থেকে সংগৃহীত) বাক্যটির উল্লেখ করেছেন, যার অর্থ: ‘কোনো বিষয়ই তার প্রকৃত স্বরূপ ত্যাগ করতে পারে না।’ সাময়িকভাবে মনে হয়, সে যেন ত্যাগ করে থাকে। এক টুকরো লোহা স্পর্শ করলে ঠান্ডা বোধ হয়। এটিকে আগুনে দিলে গনগনে লাল হয়ে ওঠে; বের করে রাখলে ওটি আবার আগের মতো ঠান্ডা হয়ে যাবে।
বেদান্ত সমগ্র মানবজাতির সম্বন্ধে এক মহান সত্যের কথা ঘোষণা করেছে। তাই বর্তমান জগৎ উৎসুক হয়ে আছে সেই সত্যটি জানার ও সে অনুযায়ী জীবনযাপন করার জন্য। ওই সত্য ঠিক ভৌতবিজ্ঞানের সত্যের মতোই; তার জন্য ঋষিগণ সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য এক ঘোষণার প্রবর্তন করেছেন। আর সমগ্র জগৎ ভৌতবিজ্ঞানের পেছনে ছুটছে; এটি তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। সত্য সবসময়ই সর্বজনীন, সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়ে থাকে। কোনো বিষয়ে অভিমত এবং সাম্প্রদায়িক মত কেবল সীমিত ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এখানে এক গূঢ় সত্য উল্লেখ করা হয়েছে: শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ, অর্থাৎ 'শোনো আমার কথা, হে অমৃতের সন্তানগণ!' প্রত্যেকটি শিশুই অমৃতের সন্তান। বিবেকানন্দ বলেছেন: এই কল্যাণকর ভাবগুলি ছোটো থাকতে থাকতেই শিশুদের কাছে পৌঁছে দাও। রানী মদালসার মতো, যাঁর কথা আমাদের অধ্যাত্মসাহিত্যে রয়েছে। রানী তাঁর সন্তানদের প্রত্যেককেই দোলনায় শুইয়ে দোল দিতে দিতে গাইতেন: নিত্যোহসি, শুদ্ধোহসি, নিরঞ্জনোহসি, সংসার মায়ামল বর্জিতোহসি, অর্থাৎ 'শিশুটি আমার, কেন কাঁদছ? তুমি সেই শুদ্ধ, চিরমুক্ত, সংসার-কালিমা মুক্ত।' এভাবেই মদালসা তাঁর শিশুদের শিক্ষা দিতেন। স্বামীজিও এ পদ্ধতির উচ্চপ্রশংসা করতেন—তুমি শিশুকে ব্যক্তি হিসাবে মান্য দাও; আরও কিছু গূঢ় মাত্রাও এর অন্তরে রয়েছে, আর গূঢ়তম মাত্রা হলো এই সত্য—অমৃতস্য পুত্রাঃ। এতে রয়েছে শিক্ষা ও ধর্ম দুই-ই, কারণ এখানে ধর্মকে শিক্ষার প্রসার হিসাবে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে—যাকে বলা যেতে পারে ইন্দ্রিয়জ্ঞানের স্তর থেকে অতীন্দ্রিয় স্তর পর্যন্ত সকল স্তরের অভিজ্ঞতা। ছোটোবেলাতেই মানবসন্তানের উপর মানুষ হবার দায়িত্ব ও প্রেরণা আরোপ করার শিক্ষা উপনিষদই আমাদের দিয়েছেন।
বুদ্ধির ঠিক ওপরে ও পেছনে রয়েছেন আত্মা, আমাদের নিজ অসীম আত্মা। তাই শঙ্করাচার্য বলেন, বুদ্ধি হলো ‘নেদিষ্ঠং ব্রহ্মা’, অর্থাৎ 'ব্রহ্মা বা আত্মার নিকটতম’। কেবল এক বার পিছু ফিরে তাকালেই ব্রহ্ম নয়নগোচর হবেন। কিন্তু এই পিছন ফিরে তাকাতে যুগ যুগ তপস্যার দরকার হয়; এ কাজ সহজ নয়; তাই উপনিষদ এসব শিক্ষা দিচ্ছেন। এইসব শিক্ষা থেকে যে একটি সত্য প্রতিভাত হয়, তা হলো: শরীর-তন্ত্রের যে-কোনো অঙ্গেই, তা যতই দোষদুষ্ট হোক না কেন—সেখানে এমন একটি মাত্রা আছে, যা এরকম সব দোষ থেকে চিরমুক্তই থাকে—তা হলো আমাদের নিজের সত্য-আত্মা। অন্যথায়, পাপীদের কোনো আশাই থাকত না। মানবজাতির সম্বন্ধে সেই সত্যটি সব থেকে স্বচ্ছ ও সব থেকে যুক্তিযুক্ত ভাষায় বোঝানো হয়েছে কেবল একটি সাহিত্যেই—উপনিষদে। পৃথিবীর অন্য কোথাও এমনটি পাওয়া যায় না। তাই উপনিষদে এর নাম হলো—ঔপনিষদং পুরুষং—শিষ্য উপনিষদের আচার্যের কাছে গিয়ে বলেন: ‘ঔপনিষদং পুরুষং পৃচ্ছামি’ (বৃহদারণ্যকোপনিষদ, ৩/৯/২৬), অর্থাৎ 'আমাকে সেই পুরুষ সম্বন্ধে বলুন, যাঁর বিষয় একমাত্র উপনিষদেই শেখানো হয়ে থাকে'। উপনিষদের ভাষ্য লিখতে গিয়ে শঙ্করাচার্য তাই এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে: ‘উপনিষৎসু এব বিজ্ঞাতে, ন অন্যত্র’ অর্থাৎ 'কেবল উপনিষদেই এ বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়, অন্য কোথাও নয়'।
(পরবর্তী অংশে সমাপ্য)