গীতার শ্লোকার্থ: ৩/৪২ (২য় অংশ)

আমাদের পৃথকত্বের কারণ হলো উপাধি, যার দ্বারা আত্মাকে ঢেকে রাখা হয়েছে। যা আমার স্বরূপ নয়, অথচ তার ধর্ম আমার উপরে আরোপিত আছে, তাকে বলা হয় উপাধি। যেমন, জবা ফুলের ধর্ম লাল রংটি স্ফটিকে আরোপিত হলে স্ফটিককে লাল দেখায়, তেমনি দেহেন্দ্রিয়াদিরূপ উপাধি আত্মার উপরে আরোপিত হয়ে আত্মার স্বরূপকে ঢেকে রেখেছে। বাস্তবিক বিচারে, আত্মাতে এই দেহেন্দ্রিয়াদির ধর্মই নেই। শুদ্ধ জলবিন্দুর শুদ্ধ জলরাশিতে পতিত হওয়ার মতো আত্মা যদি সমস্ত উপাধি-ধর্ম থেকে মুক্ত হয়, তাহলে তার পৃথকতা কিছু আর থাকে না, সে পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়। মুনেঃ বা মননশীল যিনি, যিনি নিজের স্বরূপকে বিশেষরূপে জানেন, নিজেকে শুদ্ধ, নির্মল ও সকল ধর্মের অতীতরূপে জানেন, তাঁর কী অবস্থা হয়? তিনি অর্থাৎ তাঁর আত্মা পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যান। এই অভিন্নতা-প্রাপ্তির ফলে তাঁর কোনো পরিবর্তন ঘটে না, কিন্তু তাঁর প্রকৃত স্বরূপ তখন প্রকাশিত হয়। স্ফটিকের কাছ থেকে জবাফুলকে সরিয়ে নিলে স্ফটিকের স্বচ্ছতা প্রকাশ পায়।




এটাকে যে ‘পরা গতিঃ’—চরম goal বা লক্ষ্য বলা হলো, তার কারণ কী? এর চলার সামর্থ্য বা ইচ্ছে নেই বলেই কি? তার উত্তরে বলছেন: ইচ্ছেও থাকে না সত্য, আবার সামর্থ্যও থাকে না; কারণ যেখানে আমি ছাড়া আর কিছু নেই, সেখানে আর কোথায় যাবে, কে যাবে, আর কী উপায়েই-বা যাবে? সেখান থেকে কোথাও যেতে হলে তো ‘আমি’ থেকেই বেরিয়ে যেতে হবে, যা অসম্ভব। সুতরাং সেখানে আর কিছুই করণীয় থাকে না।




ব্যাখ্যা: ইন্দ্রিয়কে বাদ দিলে দেহ একটি জড়পদার্থ মাত্র। ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই অনুভব করা যায়, এই দেহটি চেতন। আবার, মনই ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যাবতীয় কাজকর্ম করিয়ে থাকে। অবশ্য এখানে জ্ঞানেন্দ্রিয়ের কথাই বলা হয়েছে এবং বুদ্ধি আড়ালে থেকে নিঃশব্দে মনকে নাচাচ্ছে—এটা ভালো নয়, ওটা ভালো; এটা করব না, ওটা করব—এভাবে। মন সঙ্কল্প-বিকল্পাত্মক (একইসাথে বাসনা ও সংশয় দ্বারা পূর্ণ) বলে সবসময়ই সে কিছু জিনিস গ্রহণ করছে, আবার কিছু জিনিস বর্জন করছে।




কিন্তু ‘আমি’ এই সব কিছুর সাক্ষী। অথচ এই ‘আমি’-ই বুদ্ধির সাথে মিলেমিশে সুখ-দুঃখ বোধ করে থাকে। আমরা জন্মজন্মান্তরে এভাবেই চলছি, তাই সবসময় কাম-ক্রোধ-লোভের সাথে একাত্ম হয়ে রয়েছি। এটা হতে নিস্তার পেতে হলে সমগ্র ঘটনার স্রোতকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে নিয়ে আসতে হবে; অর্থাৎ, বুদ্ধি তখন মন ও ইন্দ্রিয়ের উপর হুকুম করা বন্ধ করবে। মন ও ইন্দ্রিয়গুলি অচঞ্চল স্থির হলে অন্তরে একটি ‘আমি’, ‘আমি’ ধারা বইতে থাকবে; এই ধারাই অস্মিতা বা আমিত্ববোধ বা অহম্‌। এই অস্মিতার সাহায্যে ধ্যানে বসলে দেহ, মন, বুদ্ধি হতে নিজেকে পৃথক বোধ করা সহজ হবে। আর তখনই কাম-ক্রোধের কর্মপদ্ধতি, অর্থাৎ কেমন করে তারা মন-বুদ্ধিকে বশীভূত করছে, সেই ব্যাপারে সম্যক জ্ঞানলাভের মাধ্যমে কাম-ক্রোধাদি জয় করা সহজসাধ্য হবে। তবে অনেকসময় “আমি দেহ নই, মন নই” ইত্যাদি ভেবে ভেবে শরীরকে অযথা কষ্ট না দিয়ে শাস্ত্রমুখে এবং গুরুমুখে শুনে যথার্থ নিয়ম মেনে সাধনভজন করাই ‘সাধনা’। একলাফে গাছে ওঠার চেষ্টা করা সিরিয়াসনেস নয়, বোকামি; ওতে কেবল পা-ই ভাঙে, গাছে ওঠা আর হয় না।




শ্লোকটিকে এভাবেও ভাঙা যায়:
‘শ্রেষ্ঠ হয় ইন্দ্রিয়েরা’—স্থূল দেহ হতে সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ। তারা ব্যাপক ও বলবান বলেই শ্রেষ্ঠ, কেননা ইন্দ্রিয় সূক্ষ্ম, প্রকাশক ও দেহের চালক, তাই স্থূল দেহের নাশে ইন্দ্রিয়ের নাশ হয় না। ইন্দ্রিয় দ্বারা এখানে ইন্দ্রিয়শক্তি বোঝানো হচ্ছে। চোখে কোনো বস্তুর প্রতিবিম্ব পড়লে যে-শক্তির সাহায্যে আমরা সেই বস্তু দেখতে পাই, তা-ই দর্শনেন্দ্রিয়। তা চোখ নামের পদার্থ নয়, তা দর্শনেন্দ্রিয়ের ক্রিয়ার স্থূল যন্ত্রমাত্র। এরকম অন্যান্য ইন্দ্রিয় সম্বন্ধেও বুঝতে হবে।




‘তা হতে মন শ্রেষ্ঠ’—শ্রেষ্ঠ (মূলে আছে 'পর') অর্থাৎ উৎকৃষ্ট ও অতীত। এই শ্লোক সম্বন্ধে ব্যাখ্যাকারকগণ ভিন্ন ভিন্ন অর্থ করেন। আনন্দগিরি, শঙ্করাচার্য, মধুসূদন প্রমুখ ভাষ্যকারগণ বলেন, ইন্দ্রিয়ের পরিচালক বা প্রবর্তক বলে বিকল্প ও সংকল্পাত্মক মন ইন্দ্রিয় হতে শ্রেষ্ঠ। আর অধ্যবসায় বা নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি মনের সংকল্পাদি নিয়মিত বা বাস্তবায়িত করে, এজন্য মন হতে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ। আর জীবাত্মা বুদ্ধি হতেও শ্রেষ্ঠ, অর্থাৎ যিনি সাক্ষীরূপে বুদ্ধিকে প্রকাশ করেন এবং সকলের অন্তরে অবস্থিত হয়ে, মন-ইন্দ্রিয় প্রভৃতিকে নিজ নিজ ব্যাপারে বা কাজে নিযুক্ত করে তাদেরকে এই কাম বা বাসনা দ্বারা বিমোহিত করেন, তিনিই আত্মা।




ওদিকে রামানুজ এই শ্লোকের একেবারেই ভিন্ন অর্থ করেন। তিনি বলেন, জ্ঞানীদের চিরশত্রু কে? তা-ই এই শ্লোকে উল্লিখিত হয়েছে। অর্থাৎ যারা জ্ঞানের অবরোধক, তাদের মধ্যে ইন্দ্রিয়ই প্রধান, ইন্দ্রিয় অপেক্ষা মন অধিক প্রবল, আর মন অপেক্ষাও বুদ্ধি প্রবল। কেননা, মনকে বিষয়-বিমুখ করলেও, বুদ্ধি বিপরীত-অধ্যবসায়-বলে আমাদের জ্ঞান-লাভে বাধা দেয়। আর এই বুদ্ধি হতে শ্রেষ্ঠ বা প্রধান যা, অর্থাৎ সবচাইতে অধিক জ্ঞান-বিরোধী যা, তা-ই এই কাম বা বাসনা। এই ব্যাখ্যা অনুসারে, এই শ্লোকের ‘তা-ই তো সেই’ অর্থে—তা-ই এই কাম—এটা রামানুজ বুঝিয়েছেন।




অন্য টীকাকারগণ বলেন, কী উপায়ে বা কীসের আশ্রয়ে কামকে জয় করা যেতে পারে, তা-ই এ শ্লোকে দেখানো হয়েছে। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৫৮শ শ্লোক বলছেন:
যদা সংহরতে চায়ং কূর্মোহঙ্গানীব সর্বশঃ।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।




অর্থ: কচ্ছপ যেমন নিজ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সব দিক থেকে সংকুচিত করে রাখে, তেমনি কর্মযোগীও ইন্দ্রিয়াদির বিষয়সমূহ থেকে ইন্দ্রিয়গুলিকে সর্বতোভাবে সংহরণ করে নেন (অপসারণ করে নেন); তখনই তাঁর বুদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হয় (তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ হন)।।




(এখানে কচ্ছপের দৃষ্টান্ত দেবার অর্থ এই যে, যখন কচ্ছপ চলতে থাকে, তখন তার ছয়টি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখা যায়—চারটি পা, একটি লেজ এবং একটি মাথা; কিন্তু যখন সে তার অঙ্গগুলি লুকিয়ে ফেলে, তখন কেবল তার পৃষ্ঠদেশটি দেখা যায়। তেমনি স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তিও পঞ্চইন্দ্রিয় ও মন—এই ছয়টিকে তাদের নিজ নিজ বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে নেন। যদি তাঁর ইন্দ্রিয়গুলির সঙ্গে কোনোরূপ মানসিক সম্পর্ক বজায় থাকে, তাহলে তাঁকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলা যায় না। এখানে 'সংহরতে' শব্দ ব্যবহারের তাৎপর্য হলো এই যে, স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি বিষয়গুলি থেকে ইন্দ্রিয়কে প্রত্যাহার করে নেন, অর্থাৎ তিনি বিষয়গুলি নিয়ে কখনও মনে কোনো চিন্তা আসতে দেন না। যেমন, আকাশে সূর্য প্রকাশমান থাকলেও চোখ বন্ধ করলে সূর্যকে দেখা যায় না। আবার চোখ খুললেই সূর্য দেখা যায়। এখানে সূর্য এবং চোখের মধ্যে কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক নেই, অর্থাৎ চোখ খোলার ফলে সূর্য প্রকাশিত হয়নি; সূর্য প্রথম থেকেই যেমন তেমনই আছে। চোখ বন্ধ করার আগেও সূর্য যেমন ছিল, চোখ বন্ধ করার পরেও তেমনই আছে। কেবল চোখ বন্ধ করায় আমাদের সূর্যের অনুভবটুকু ছিল না। ঠিক তেমনি ইন্দ্রিয়গুলিকে বিষয় হতে প্রত্যাহার করায় পরমাত্মতত্ত্বের যে স্বতঃসিদ্ধ অনুভূতি হয়েছে, সেই অনুভূতি মনঃসংযোগে ইন্দ্রিয়ের বিষয় নয়। অর্থাৎ এই স্বতঃসিদ্ধ তত্ত্ব বিষয়ভোগের চিন্তা করা-কালীন, ভোগাস্বাদনে ব্যাপৃত থাকা-কালীনও তেমনই আছে। তবে ভোগ ইত্যাদির সঙ্গে সম্বন্ধরূপ আচ্ছাদন থাকায় তা অনুভূত হয় না, এই আচ্ছাদন অপসারিত হলেই এটি অনুভূত হয়।)




রামানুজ বাদে অন্যরা বলেন, তা-ই তো সেই, অর্থাৎ তা-ই তো আত্মা, অর্থাৎ আত্মাই সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি বুদ্ধির দ্রষ্টা বা সাক্ষী। সাংখ্যদর্শন হতে জানা যায় যে, পুরুষের সান্নিধ্যে প্রকৃতি হতে প্রথমে বুদ্ধি উৎপন্ন হয়। বুদ্ধি হতে অহঙ্কার, অহঙ্কার হতে মন ও তা হতে ইন্দ্রিয়। কারণ কাজ হতে শ্রেষ্ঠ। বুদ্ধি মনের কারণ বলে, তা মন হতে শ্রেষ্ঠ; মন ইন্দ্রিয়গণের কারণ বলে, তা ইন্দ্রিয় হতে শ্রেষ্ঠ। ইন্দ্রিয় সূক্ষ্ম শরীরের অন্তর্গত বলে, তা স্থূল শরীর হতে শ্রেষ্ঠ। বুদ্ধি, মন, অহঙ্কার, ইন্দ্রিয় এরা প্রকৃতিজ। পুরুষ এই প্রকৃতির অতীত ও প্রকৃতি হতে শ্রেষ্ঠ। এই পুরুষই এস্থানে ‘সঃ’ শব্দ দ্বারা বাচ্য। এটাই আত্মা। অতএব, সাংখ্যদর্শন অনুসারেও শঙ্করাচার্য প্রমুখের ব্যাখ্যা সংগত। কাজেই রামানুজের ব্যাখ্যা গ্রহণ করা যায় না।




কাম—রজোগুণ-সমুদ্ভব (সত্ত্ব: ধর্মজ্ঞান, রজঃ: অহংকার, তমঃ: অন্ধকারাচ্ছন্নতা) সত্তা, যা বুদ্ধি, মন ও ইন্দ্রিয়গণকে আশ্রয় করে অবস্থান করে। আশ্রিত (object) কখনও আশ্রয় (subject) অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হয় না। বুদ্ধির সাহায্যে এই কামকে যেহেতু দমন করা যায়, সেহেতু এটা বুদ্ধি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নয়। অবশ্য এ কথা বলা যেতে পারে যে, জীবের নিম্নাবস্থায় কাম প্রবল থাকে। তখন কাম চিত্তকে জয় করে তাকে পরিচালিত করে; কিন্তু জীব যখন (মানুষের) উন্নত অবস্থা প্রাপ্ত হয়, তখন এই কাম আর বুদ্ধি হতে শ্রেষ্ঠ থাকতে পারে না। তখন চিত্তে সত্ত্বগুণের বিশেষ স্ফুরণ হলে ‘কাম’ অভিভূত বা স্তিমিত বা পরাভূত হয়ে আসে। অতএব, এখানে কামের শ্রেষ্ঠতার কথা বলা হয়নি।




এখন দেখা যাক, আত্মা কীভাবে আপাত-উপলব্ধ হন। কঠোপনিষদ (১/৩/১২) বলছেন:
এষ সর্বেষু ভূতেষু গূঢ়ো আত্মা ন প্রকাশতে।
দৃশ্যতে ত্বগ্র্যয়া বুদ্ধ্যা সূক্ষ্ময়া সূক্ষ্মদর্শিভিঃ।।




অন্বয়: এষঃ (পূর্বনির্দিষ্ট এই) আত্মা (শ্রেষ্ঠতম প্রত্যক্ চৈতন্যস্বরূপ পুরুষ বা প্রত্যগাত্মা) সর্বেষু ভূতেষু (আব্রহ্মস্তম্ব সমস্ত প্রাণীতে) গূঢ়ঃ (অবিদ্যা দ্বারা আচ্ছন্ন বা প্রচ্ছন্ন হয়ে অবস্থিত) [সেজন্য] ন প্রকাশতে (সকলের কাছে স্বরূপে প্রকাশিত হন না) তু (পরন্তু বা কিন্তু) সূক্ষ্মদর্শিভিঃ (সূক্ষ্মতম বস্তুর অবধারণায় নিপুণ, প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের দ্বারা) সূক্ষ্ময়া (সূক্ষ্ম-তত্ত্ব গ্রহণযোগ্যা বা সূক্ষ্মবস্তু নির্ধারণক্ষম) অ্যয়া (তীক্ষ্ণ ও একাগ্র) বুদ্ধ্যা (নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি দ্বারা) দৃশ্যতে (উপলব্ধ বা জ্ঞাত হন)।




এই যে পুরুষ, ইনিই আত্মা। ‘পুরুষ’ শব্দের দ্বারা বোঝায় ‘পূর্ণম্ অনেন সর্বম্’ (কঠোপনিষদ, শাঙ্করভাষ্য-২/১/১২)—যাঁর দ্বারা সব কিছু পূর্ণ হয়ে আছে; অথবা ‘পুরুষঃ পুরিষাদঃ পুরিশয়ঃ পুরয়তের্বা’ (নিরুক্তম্-২/১/৪)—যিনি এই দেহরূপ পুরে (আবাসে) বা জগৎরূপ পুরে অবস্থান করছেন, অথচ যিনি জগৎ থেকে ভিন্ন, যিনি জগতের আদি কারণ; তিনি সকলের ব্যক্তিত্বের ভেতরে ওতপ্রোত, সর্বব্যাপক ও সর্বানুস্যূত। তিনিই আত্মা। আত্মা শব্দের এখানে দুটি তাৎপর্য—একটি হচ্ছে প্রত্যত্ব অর্থাৎ তিনি অন্তরে, আর দ্বিতীয় হচ্ছে পরাত্ব, তিনি বাইরেও—এককথায়, তিনি সর্বত্র। যে-পুরুষের বর্ণনা করা হলো, তিনি আর ব্যক্তি অর্থাৎ সাধক যদি ভিন্ন হন, তাহলে সেই পুরুষকে জেনে সাধকের লাভ কী? কাজেই শ্রুতি বলছেন, আত্মা সমস্ত জগতের অধিষ্ঠান হলেও তিনি আমাদের থেকে ভিন্ন নন, দূরে নন বা বাহ্য বস্তু নন। তিনিই আমার স্বরূপ। এখন, আমি যদি আমার স্বরূপ বলে তাঁকে বুঝতে পারি, তাহলেই আমার পরম সার্থকতা লাভ, কারণ তাহলেই আমি বুঝতে পারব, আমি সেই পরমেশ্বর, শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মা, আমিই সেই পরাকাষ্ঠা (চরম অবস্থা), পরাগতি (সর্বোত্তম গতি); আমার থেকে শ্রেষ্ঠতর, সূক্ষ্মতর কিছু নেই। সুতরাং আমার আর গন্তব্য, প্রাপ্তব্য কিছু নেই। অতএব আমার করণীয়ও কিছু নেই।




এই যে পরম তত্ত্ব, তিনি আমার আত্মা হলেও তাঁকে আমরা জানি না, বুঝি না, তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিচয় নেই। যে-আমি ভেতরে বাইরে সব জায়গাতেই ওতপ্রোত, পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছি, সেই নিজ-স্বরূপকেই আমি জানি না—একথা নির্বোধের কাছেও হাস্যকর বোধ হয়। তবুও, এ কথা যে অমোঘ সত্য, তা অস্বীকার করি কী করে?




‘এষ সর্বেষু ভূতেষু’—এই আত্মা আব্রহ্মস্তম্ব অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকে তৃণ পর্যন্ত সকল প্রাণীতে অবস্থিত হলেও ‘গূঢ়ঃ’—অর্থাৎ অবিদ্যা বা অজ্ঞান দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ায় ‘ন প্রকাশতে’—প্রকাশ পাচ্ছেন না। তাহলে তিনি যে আছেন, তার প্রমাণ কী? তাঁর প্রকাশ নেই, তবু শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে তাঁকে ‘আছেন’ বলতে হবে? উত্তরে শ্রুতি বলছেন, তিনি সকলের কাছে প্রকাশ পাচ্ছেন না বটে, কিন্তু ‘দৃশ্যতে তু অগ্র্যয়া বুদ্ধ্যা সূক্ষ্ময়া’—তীক্ষ্ণ, একাগ্র যে-বুদ্ধি, সেই বুদ্ধির দ্বারা (বুদ্ধির প্রকাশেই আত্মার প্রকাশ) তিনি পরিদৃশ্যমান হন। ‘সূক্ষ্মদর্শিভিঃ’—সূক্ষ্মতম বস্তু অবধারণ করতে নিপুণ আত্মতত্ত্বদর্শী পণ্ডিতদের কাছে ইনি ‘দৃশ্যতে’—সাক্ষাৎ-উপলব্ধ হন (অপরোক্ষ প্রক্রিয়া)।




‘একাগ্রবুদ্ধি’ কথাটি আমাদের ভালো করে বোঝা দরকার। বুদ্ধির কোনো বিশেষ অবয়ব নেই। তাকে অস্ত্রের (ক্ষুরের) সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়—ক্ষুরধার বুদ্ধি। এগুলি উপমা মাত্র। এর তাৎপর্য হচ্ছে: বুদ্ধি সমগ্রভাবে একটি বিষয়ে কেন্দ্রিত বা কেন্দ্রীভূত হতে পারে। তাকে শ্রুতি অগ্র্যাবুদ্ধি বলছেন। সেই বুদ্ধি কীরকম হবে? স্থূল, না সূক্ষ্ম? বুদ্ধির স্থূলতা, সূক্ষ্মতা নির্ভর করে বিষয়কে ধারণা করার শক্তির উপরে। বুদ্ধিকে কেউ দেখে না, তা অনুমানগম্য এবং দৃশ্যের অস্তিত্ব থেকেই ক্রমে বুদ্ধির দ্রষ্টাত্ব। বলা বাহুল্য, আমাদের কোনো ইন্দ্রিয়কেই সেই ইন্দ্রিয়ের দ্বারা দেখা বা উপলব্ধ করা যায় না। এজন্য সেগুলি কাজের দ্বারা অনুমেয়। যে-ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখছি, তাকে বলি দর্শনেন্দ্রিয়; যা দিয়ে শুনছি, তাকে বলি শ্রবণেন্দ্রিয়। প্রতিটি ইন্দ্রিয় তার কাজের দ্বারা অনুমিত হয়। তেমনি যার দ্বারা বোধ হয়, তাকে বুদ্ধি বলি। তাকে না দেখলেও তার কাজ থেকে তাকে অনুমান করি। আর সেই বুদ্ধির ভেতরেও যে তারতম্য করি, তা-ও তার নিজের স্থূলতা বা সূক্ষ্মতার জন্য নয়। কীরকম বিষয় ধারণা করতে সমর্থ, তার দ্বারা নির্ণীত হবে বুদ্ধি স্থূল, না সূক্ষ্ম। এজন্য আত্মবস্তুর ব্যাখ্যা করে শ্রুতি বলছেন, সকলে আত্মবস্তু সম্পর্কে ধারণা করতে পারে না। যাঁরা সূক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন, তাঁরা পারেন। কী করে পারেন? অগ্র্যা অর্থাৎ সূক্ষ্ম ও একাগ্র বুদ্ধির দ্বারা।




এখানে স্মর্তব্য, আত্মাকে বুদ্ধির সাহায্য ছাড়া বোঝার উপায় নেই। জগতের সব কিছুই আমরা বুদ্ধি দিয়ে বুঝি, আত্মাকেও তারই সাহায্যে বুঝতে হবে। এখন, বুদ্ধি যদি আত্মাকে প্রকাশ করতে পারে, তাহলে তো আত্মা স্বপ্রকাশ হলেন না, বুদ্ধির দ্বারা প্রকাশিত হলেন। অথচ শাস্ত্রই তাঁকে স্বপ্রকাশ বলছেন। বলা হয়েছে: ‘যন্মনসা ন মনুতে’ (কেনোপনিষদ্, ১/৬)—মনের দ্বারা যাঁকে মনন করা যায় না (কিন্তু মন যাঁর দ্বারা উদ্ভাসিত হয়—অর্থাৎ, আত্মা হতে ভিন্ন যা, যাকে লোকে আত্মভিন্নরূপে বা উপাধিবিশিষ্ট করে ঈশ্বর হিসেবে পূজা করে থাকেন—তিনি ব্রহ্ম নন)। মন মানে অন্তঃকরণ, বুদ্ধি যার একটি অবস্থাবিশেষ মাত্র। সুতরাং এখানে আত্মা সূক্ষ্মবুদ্ধির গোচর হন বললে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, শাস্ত্র যেন নিজেই নিজের বক্তব্যবিরোধী কথা বলছেন। বস্তুতপক্ষে এখানে শাস্ত্রের অভিপ্রায় কী, তা সূক্ষ্মকৌশলে ভাষ্যকাররা বুঝিয়েছেন। আমরা যখন বলি, আত্মাকে জানা যায়, তখন মন ছাড়া আর কোনো যন্ত্র নেই, যার দ্বারা জ্ঞান হতে পারে। বস্তু ও জগৎ তথা ঘটপটাদিকে জানতে হলে যেমন মনের প্রয়োগ হয়, সেরকম আত্মাকে জানতে হলেও মনকেই আমরা ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু সাধারণ বস্তুকে জানা আর আত্মাকে জানার প্রক্রিয়া একটু ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে।




কেন হয়? জড় বস্তুকে জানতে হলে তাকে চৈতন্যের দ্বারা উদ্ভাসিত করে জানতে হয়, কিন্তু চেতন বস্তুকে জানতে হলে তাকে আর চৈতন্যের দ্বারা উদ্ভাসিত করতে হয় না। সূর্যকে দেখাতে হলে প্রদীপ জ্বেলে দেখাতে হয় না, কারণ তিনি স্বপ্রকাশ। তেমনি স্বপ্রকাশ আত্মাকেও বুদ্ধির দ্বারা প্রকাশ করতে হয় না। কিন্তু বুদ্ধি যখন বিষয়ের মতো আত্মাকেও প্রকাশ করতে যায়, তখন আত্মচৈতন্যের প্রকাশে অভিভূত হয়ে যায়। কাজেই সে আর আত্মাকে সেভাবে প্রকাশ করে না, যদিও প্রক্রিয়াটা সাধারণ প্রকাশের অনুরূপ হয়। অর্থাৎ কোনো একটি বস্তুকে জানতে হলে অন্তঃকরণ উক্ত বস্তুর আকারে আকারিত হয়। অন্তঃকরণের তেমন আকারকে বলি বৃত্তি। যেমন ঘটের আকারে অন্তঃকরণকে বলা হয় অন্তঃকরণের ঘটাকারা বৃত্তি। আকার মানে এখানে বুঝতে হবে স্থূল আকার নয়—অন্তঃকরণ সূক্ষ্মবস্তু, সে কখনও স্থূলরূপ পরিগ্রহ করে না। ঘটাকার অন্তঃকরণ যখন বলছি, তখন অন্তঃকরণটি একটি ঘটের মতো আকার নেয়—ব্যাপারটা এরকম নয়। আর যদি কেউ এরকম স্থূল অর্থে আকার বোঝে, তখন প্রশ্ন ওঠে: সুখাকার বৃত্তি বলতে তাহলে বুঝব? সুখের তো কোনো আকার নেই। যখন সুখকে অনুভব করি, তখন অন্তঃকরণের সুখাকার বৃত্তি হয়, দুঃখ অনুভব করবার সময় অন্তঃকরণের দুঃখাকার বৃত্তি হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আকার মানে রূপ বোঝাচ্ছে না। আকার মানে স্বরূপ—যার দ্বারা কোনো একটি অনুভবকে অন্য অনুভব থেকে পৃথক করা যায়। এই পৃথক করার সামর্থ্য বা বিশেষ গুণকেই বলা হলো ‘আকার’।




বৈশেষিক দর্শনে ‘বিশেষ’ বলে একটি পদার্থ স্বীকার করা হয়, যার কাজ হলো এরকম পৃথক করা—যার থেকে এই বুদ্ধি হয় যে, একটি বস্তু আর একটি থেকে পৃথক। এখানে আকারের সেই একই কাজ। সুখাকার বৃত্তি মানে মনের সুখের মতো গঠন নয়, কিন্তু মনের এমন অবস্থা, যাতে অন্য বস্তু থেকে পৃথক করে সুখকে বুঝতে পারছি। এইভাবে প্রত্যেক বস্তু সম্বন্ধে বোঝা যায়। জড়বস্তুই হোক বা সূক্ষ্মবস্তুই হোক বা মনের ভেতরে প্রতিভাত বিশেষ ভাবই হোক, সবগুলির সম্বন্ধেই ‘আকার’ শব্দটি প্রযুক্ত হতে পারে। আত্মা, যাঁকে পুরুষ বলছি, তাঁকেও জানার সময় তাঁর আকারের একটি বৃত্তির জন্ম হয়। ঘটজ্ঞানের বেলায় ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে ঘটের সন্নিকর্ষ হয়। অন্তঃকরণ ইন্দ্রিয়প্রণালী দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে ঘটাকারে আকারিত হয়। ঘটবিষয়ক অজ্ঞান নষ্ট হলো ঘটজ্ঞানের দ্বারা, আর ঘটের প্রকাশ হলো আভাসচৈতন্যের দ্বারা—’তত্রাজ্ঞানং ধিয়া নশ্যেদাভাসেন ঘটঃ স্ফুরেৎ’ (পঞ্চদশী, ৭/৯১)।




আভাসচৈতন্য কাকে বলে? অন্তঃকরণে প্রতিবিম্বিত যে-চৈতন্যের দ্বারা অন্তঃকরণ উদ্ভাসিত, তাকে বলা হয় আভাসচৈতন্য। আভাস কেন? সর্বব্যাপী প্রকাশের সর্বব্যাপিত্বের ধারণা করতে না পেরে যখন অন্তঃকরণে পরিচ্ছিন্নরূপে তার ধারণা করি, তখন তার ভাস অর্থাৎ প্রকাশ খণ্ডিত, সীমিত হয়—এজন্য তাকে আভাস বলে, কখনো চিদাভাসও বলে। 'চিদাভাস' শব্দের অর্থ 'চিৎ' অর্থাৎ চৈতন্যের যে-আভাস অর্থাৎ সীমিত প্রকাশ।




ব্রহ্মকে যখন এভাবে জ্ঞানের বিষয় করতে যাই, তখন আমাদের কাজ: ব্রহ্মবিষয়ক বৃত্তির দ্বারা ব্রহ্মবিষয়ক অজ্ঞানের নাশ করে দেওয়া। তারপর আর ব্রহ্মকে প্রকাশ করার দরকার হয় না। স্বপ্রকাশ ব্রহ্ম প্রকাশমান থাকেন। এরকমভাবে ব্রহ্মজ্ঞানের প্রক্রিয়াটি বোঝানো হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই এখানে বলা হলো সূক্ষ্মদৃষ্টি, সূক্ষ্মমন, সূক্ষ্মবুদ্ধির দ্বারা আত্মা জ্ঞেয় হন, মানে আত্মবিষয়ক অজ্ঞান দূর হয়। অজ্ঞান দূর হলেই স্বপ্রকাশ আত্মা প্রকাশিত হয়ে পড়েন। কাজেই উপনিষদ যখন বলছেন, ‘যন্মনসা ন মনুতে’ (কেনোপনিষদ, ১/৬)—মন যাঁকে মনন করতে পারে না, বুদ্ধি যাঁকে প্রকাশ করতে পারে না, তখন বুঝতে হবে, স্বপ্রকাশ ব্রহ্মের প্রকাশ মন, বুদ্ধি প্রভৃতি জড় বস্তুর প্রকাশের উপর কখনোই নির্ভরশীল নয়; বরং মন-বুদ্ধির প্রকাশই ব্রহ্মের উপরই নির্ভর করে। আবার যখন তাঁকে মন-বুদ্ধি দ্বারা গম্য বলা হচ্ছে—’মনসৈবেদম্ আপ্তব্যং’ (কঠোপনিষদ, ২/১/১১): ‘আচার্য এবং শাস্ত্রের উপদেশ দ্বারা সুসংস্কৃত, নির্মল মনের দ্বারাই এই ব্রহ্ম উপলব্ধ’ কিংবা আলোচ্য শ্রুতিবাক্যে 'দৃশ্যতে তু অগ্র্যয়া বুদ্ধ্যা’, সেখানে বুঝতে হবে, এই বুদ্ধির দ্বারাই আত্মবিষয়ক অজ্ঞান নাশ হয়ে যাবে। তখন প্রতিবন্ধক না থাকার জন্য নিত্যপ্রকাশমান আত্মাই প্রকাশিত থাকবেন। তাঁকে নতুন করে প্রকাশ করতে হবে না।




এখানে বলা হলো, সূক্ষ্মবুদ্ধির দ্বারা তিনি অনুভবগম্য হন। কারা অনুভব করেন? সূক্ষ্মদর্শিগণ সাধনার বলে সূক্ষ্মবস্তু দেখার সামর্থ্য অর্জন করেন। আত্মা গোপন, প্রচ্ছন্ন হয়ে আছেন বলে সাধারণ মানুষ তাঁকে দেখতে অর্থাৎ অনুভব করতে পারে না—একথা সত্য হলেও কেউ অনুভব করতে পারেন না—একথা বলা চলে না। বুদ্ধির নির্মলতার ফলে তাঁরা আত্মবস্তুকে অনুভব বা প্রত্যক্ষ করেন। দার্শনিকগণের পরিভাষায় প্রত্যক্ষ না বলে একে বলা হয় অপরোক্ষ অনুভব। প্রত্যক্ষ শব্দের যৌগিক অর্থ: ‘ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গ্রাহ্য’। আত্মা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গ্রাহ্য হন না বলে দার্শনিকগণকে 'অপরোক্ষ' শব্দটি ব্যবহার করতে হয়েছে। যাকে আমি সাক্ষাৎ দেখি না, তাকে বলি পরোক্ষ। যেমন নিউইয়র্ক বলে একটি জায়গা আছে, যা শোনা কথা, কেননা সেখানে আমি যাইনি। শোনা কথা থেকে সে সম্বন্ধে জ্ঞান হলে তাকে পরোক্ষ জ্ঞান বলে। আত্মসম্বন্ধীয় জ্ঞান কখনও পরোক্ষ হতে পারে না। আবার এ জ্ঞান ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যও নয়, তাই বলা হলো এ জ্ঞান অপরোক্ষ। প্রশ্ন উঠতে পারে—আত্মা সম্বন্ধে পরোক্ষ জ্ঞান হয় না, এটা বলা হলো। বুদ্ধি সূক্ষ্ম না হওয়া সত্ত্বেও শাস্ত্র থেকে জানা যায়: আত্মা সর্বব্যাপী এবং অদৃশ্যম্‌ বা জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অগম্য, অগ্রহণীয় বা কর্মেন্দ্রিয়ের অবিষয়, মূলরহিত বা অনন্বিত, রূপহীন বা আকারহীন—'অদ্রেশ্যম্ অগ্রাহ্যম্ অগোত্রম অবর্ণম্’ (মুণ্ডকোপনিষদ, ১/১/৬), তার দ্বারা যে-জ্ঞান হয়, সেটা কী জ্ঞান?




এর উত্তর হলো এ-ই: প্রত্যক্ষ আত্মজ্ঞানের দ্বারা মানুষ সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যায়, তখন সে জীবন্মুক্ত হয়। জীবন্মুক্তিই প্রকৃত আত্মজ্ঞানের ফল। কিন্তু শাস্ত্র থেকে আত্মা সম্বন্ধে জেনেও আমাদের অজ্ঞানের নিবৃত্তি হচ্ছে না, আমরা মুক্ত হচ্ছি না। কাজেই শাস্ত্র থেকে আত্মা সম্বন্ধে যে-জ্ঞান হচ্ছে, তা প্রকৃত আত্মজ্ঞান নয়। তাকে পরোক্ষ জ্ঞানই বলতে হবে।




বলা হলো: অতি সূক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন মুষ্টিমেয় কেউ কেউ আত্মা সম্বন্ধে ধারণা করতে পারেন। পূর্বে বলা হয়েছে, বুদ্ধি যে-বিষয়কে ধারণা করতে সক্ষম, সেই বিষয়ের সূক্ষ্মতা ও স্থূলতা অনুযায়ী আমরা সাধারণত বুদ্ধির সূক্ষ্মতা ও স্থূলতার নিরূপণ করে থাকি। অনেকসময় দেখা যায়, লৌকিক বিষয়ে একজন খুব বুদ্ধিমান ব্যক্তি যুক্তির দ্বারা প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করে দিতে পারে। আমরা বলি, এরূপ ব্যক্তির বুদ্ধি খুব সূক্ষ্ম। কিন্তু আবার অনেকসময় এক বিষয়ে বুদ্ধির সূক্ষ্মতা দেখা গেলেও অন্য বিষয়ে তেমন সূক্ষ্মতা দেখা যায় না। কারণ, সকলে সব বিষয়ের অনুশীলন করেন না বা সব বিষয়ে সকলের রুচি থাকে না। খুব নামী লেখক তাঁর বিষয়টি খুব ভালো জানেন, কিন্তু তিনি চিকিৎসার বিষয়ে কিছু বোঝেন না। আবার চিকিৎসায় যিনি সূক্ষ্মবুদ্ধি, তিনি লেখালেখির বিষয়ে কিছু না-ও বুঝতে পারেন। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম বৃদ্ধির অর্থ ভিন্ন। এখানে সূক্ষ্মবুদ্ধি হলো শুদ্ধবুদ্ধি—যে-বুদ্ধি রাগ-দ্বেষাদির দ্বারা আচ্ছন্ন নয়।




যাঁদের মন-প্রাণ ঈশ্বরে সমর্পিত, তাঁরা সূক্ষ্মতত্ত্ব থেকে মনকে নামিয়ে নিয়ে এসে তা অন্য বস্তুতে দিতে চান না। এজন্য অন্য বিষয় তাঁরা বুঝতে পারেন না। শ্রীরামকৃষ্ণের কৌতূহল ছিল অপরিসীম, এমনকি অনেক জাগতিক বিষয়েও তিনি জানতে চাইতেন। অনেক বিষয়েই তাঁর বালকের মতো কৌতূহল ছিল। একদিন একজন ডাক্তারের সঙ্গে তাঁর কথা হচ্ছে, খালি চোখে যা দেখা যায় না, এমন সব ছোটো ছোটো জিনিস যন্ত্রের সাহায্যে কী করে দেখা যায়? শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, “আমায় দেখাতে পারো?” ভদ্রলোক তাঁর জন্য একটি মাইক্রোস্কোপ নিয়ে এসে set করলেন। বললেন, “মশাই, এবার দেখুন।” তিনি বললেন, “মন এখন এত উঁচুতে উঠে রয়েছে যে, কিছুতেই তাকে নামিয়ে নিচের দিকে দেখতে পারছি না।” মনকে তখন তিনি কিছুতেই তার ঊর্ধ্বগতি থেকে নামিয়ে এনে এই জাগতিক বস্তুটি, তা সে যতই সূক্ষ্ম হোক, তাকে দেখার জন্য আনতে পারছেন না।




এর দ্বারা আর-একটু স্পষ্ট হবে সূক্ষ্ম আর স্থূলের তফাতটা আসলে কোনখানে। যন্ত্রের সাহায্যে দৃষ্ট সূক্ষ্মবস্তু স্থূলবস্তুরই ভগ্নাংশ। কিন্তু আত্মাকে যে-অর্থে সূক্ষ্মবস্তু বলা হচ্ছে, তা স্থূলবস্তুর ভগ্নাংশ নয়। স্থূল মানে তার উপাদান স্থূল, আর সূক্ষ্ম মানে তার উপাদানই সূক্ষ্ম। কাজেই আত্মার সূক্ষ্মতার সঙ্গে জড়ের সূক্ষ্মতার কোনো তুলনাই হতে পারে না। যদি বলা হয়, সূক্ষ্মতম আত্মা থেকে তো এই স্থূল জগতের উৎপত্তি হয়েছে, আত্মা থেকে আকাশাদি পঞ্চভূত এবং পঞ্চভূত থেকে জগতের সমস্ত বস্তুর উৎপত্তি হয়েছে, তাহলে সূক্ষ্ম উপাদান থেকেই তো স্থূল জগতের উৎপত্তি হয়েছে—এ কী করে ব্যাখ্যা করা যাবে? এর উত্তর হলো এই—বেদান্তের দৃষ্টিতে স্থূল হবার মানেটা ভিন্ন। আরম্ভ করতে হবে এই জগৎ থেকে।




ধরা যাক, জগৎ আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু। তাকে বিচার করে করে তার কারণে পৌঁছাই। যা জগতের শেষ অবস্থা এবং যার থেকে জগতের উৎপত্তি, দুটোই সমস্ত ইন্দ্রিয়ের অতীত, অগোচর। এই দুইকে বলা হচ্ছে সূক্ষ্ম। যদি তাকে magnify করে, বহুগুণ করে দেখার চেষ্টা করি, তবুও সূক্ষ্মবস্তু কখনও স্থূল হয় না। যতই শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কার করি, যতক্ষণ কোনো বস্তু তার সীমার ভেতরে, ততক্ষণ বুঝতে হবে, তা স্থূলবস্তু—লৌকিক দৃষ্টিতে তা যতই সূক্ষ্ম হোক না কেন। সূক্ষ্মদর্শী বুদ্ধির যে microscopic power রয়েছে, এই অর্থে বলা হচ্ছে না, কিন্তু তার এমন শক্তি আছে যে, ইন্দ্রিয়ের অতীত, অগোচর বস্তুতেও সে কেন্দ্রিত হতে পারে। শাস্ত্রে মনের এইরকম সূক্ষ্মতা আর শুদ্ধি সমার্থক। রাগদ্বেষাদি থেকে মুক্ত মনকে বলা হয়েছে শুদ্ধ মন, সেই মনই কেবল আত্মবস্তুকে ধারণ করতে পারে। রাগদ্বেষাদি দ্বারা চঞ্চল মন আত্মবস্তুতে স্থির হতে পারে না, একথা এখানে বোঝানো হয়েছে।




আমরা মনের অনুশীলন করে তার তীক্ষ্ণতা বাড়াতে পারি, আরও বেশি সূক্ষ্ম অর্থাৎ বস্তুর অভ্যন্তরে বেশি করে প্রবেশ করবার সামর্থ্য বাড়িয়ে নিতে পারি। এমনি করে দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়ের অনুশীলন করতে পারি। এ মনের একরকম সামর্থ্য। মনের শুদ্ধি হলো অন্যদিকের কথা। মন শুদ্ধ করতে হলে তাকে রাগদ্বেষাদি থেকে মুক্ত করতে হবে। জাগতিক বিষয়ে নৈপুণ্য অর্জন করতে গেলে মনকে রাগদ্বেষ হতে মুক্ত না করলেও চলে, কিন্তু আত্মজ্ঞানের পক্ষে রাগদ্বেষাদি-বিমুক্ত শুদ্ধ মনই একমাত্র অবলম্বন। গীতা (২/৬৪) বলছেন—
রাগদ্বেষবিযুক্তৈস্তু বিষয়ানিন্দ্রিয়েশ্চরন্‌।
আত্মবশ্যৈর্বিধেয়াত্মা প্রসাদমধিগচ্ছতি।।




অর্থ: যিনি নিজ মনের প্রভু, তিনি অনুরাগ ও বিদ্বেষ থেকে বিমুক্ত; আত্মবশীভূত ইন্দ্রিয়সমূহ দ্বারা অনাসক্তভাবে বিষয় গ্রহণ করে তিনি আত্মপ্রসাদ লাভ করেন; অর্থাৎ চিত্তের সাম্যভাব রক্ষা করেন।




অতএব রাগদ্বেষাদি-বিমুক্ত শুদ্ধ, একাগ্র বুদ্ধিকেই বর্তমান মন্ত্রে 'অগ্র্যা-বুদ্ধি' বলা হয়েছে। এরকম শুদ্ধবুদ্ধি-সম্পন্ন মানুষই সূক্ষ্মদর্শী, তাঁরাই আত্মজ্ঞান লাভ করার অধিকারী। বুদ্ধি শুদ্ধ, একাগ্র না হলে এই সূক্ষ্ম আত্মতত্ত্বের ধারণা কখনও সম্ভব নয়। এই তত্ত্বের সাহায্যে চেতনাকে ধাপে ধাপে তুলতে হবে। যত উঁচুতে উঠব, ততই মুক্ত হব। ইন্দ্রিয়চালিত হলে আমরা সবচেয়ে কম স্বাধীন। মন দ্বারা চালিত হলে তার চেয়ে বেশী স্বাধীন, আবার মন ও বুদ্ধি উভয় দ্বারা চালিত হলে তার থেকেও বেশি অবাধ, আর বুদ্ধি যদি আত্মজ্যোতি দ্বারা উদ্ভাসিত হয়, তখন তার দ্বারা চালিত যে-কোনো ধরনের কাজ আমাদের সবচেয়ে অবাধ স্বাধীনতা দেবে।




শঙ্করাচার্য বৃহদারণ্যক উপনিষদের (১/৪/৭) ভাষ্যে বলেছেন, “অনন্ত অদ্বৈত, শুদ্ধ চৈতন্যের স্বরূপকে, চরম সত্যকে, নাম দিয়ে, এমনকি ‘আত্মা’ বা ‘ব্রহ্ম’ শব্দ দিয়ে সীমিত করা যায় না।” বুদ্ধির ঠিক পেছনে রয়েছেন আত্মা। আত্মা বা ব্রহ্ম সম্বন্ধে এই সত্য বেদান্তে নানাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ওঁ তৎ সৎ—ওঁ সেই সত্য। তেমনি আবার ‘তৎ ত্বম্ অসি’—'তুমিই সেই'। এই সত্যের বিশেষ লক্ষণ হলো: ইনি নিত্যশুদ্ধ, নিত্যমুক্ত, নিত্যবুদ্ধ। এই হলো বেদান্তের চরম শিক্ষা। আত্মা অপাপবিদ্ধ—কোনো পাপের দ্বারা ইনি প্রভাবিত হন না। কোনো রোগ আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। সেজন্য একে বলা হয় নিত্যমুক্ত। কেবল বেদান্তে ও সুফিমতে—খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু প্রভৃতি জগতের সব ধর্মের মরমিয়া সাধনার উপদেশে এই শিক্ষা পাওয়া যায়। মরমি সাধকগণ এই সত্য উপলব্ধি করে থাকেন এবং সবসময় বলেন যে, মানুষের অন্তরাত্মা নিত্যশুদ্ধ, নিত্যমুক্ত, নিত্যবুদ্ধ। ব্যাধি বা বাধাসমূহ আসে নিম্নস্তর থেকে; তারা ওই উচ্চস্তরে পৌঁছয় না। এটিই হলো মানুষের কাছে এক নিগূঢ় সত্য এবং পরম অনুপ্রেরণাদায়ী সত্য। যদি সবই মলিন হয়, তবে ময়লা সরানো যাবে কীভাবে? ধরে নিই, আমার চারিদিকে প্রচুর ময়লা জমে রয়েছে, ময়লা ধোবার জন্য আমি জল নিয়ে এলাম, সে জলেও ময়লা। তাহলে ময়লা পরিষ্কার করা যাবে কী করে? ময়লা পরিষ্কার করতে পরিষ্কার জল চাই। তাই বৈদান্তিক চিন্তায় অন্তর্মুখীন হয়ে সর্বান্তরাত্মার গভীরে অনুপ্রবেশ করে ঋষিরা দেহ-মন-বুদ্ধি সংঘাতের পারে অবস্থিত শুদ্ধ, অনন্ত আত্মাকে আবিষ্কার করেছিলেন।




(পরবর্তী দুই অংশে সমাপ্য)