গীতার শ্লোকার্থ: ৩/৪২ (শেষ অংশ)

গীতার এই শ্লোকে ‘পর’ কথাটি গভীর অর্থপূর্ণ। মানবব্যক্তিত্বের তিনটি মাত্রার, যথা ইন্দ্রিয়াণি, মনঃ, বুদ্ধি সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে এই শ্লোকে ব্যবহৃত ‘পর’ পদটির প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে—ইন্দ্রিয়ানি পরাণ্যাহুঃ, 'ইন্দ্রিয়ের বিষয় বা দৃশ্য থেকে ইন্দ্রিয়গুলি উচ্চতর' ইত্যাদি। এখন কঠোপনিষদের (১/৩/১০-১১) অনুরূপ দুটি শ্লোকের, শাঙ্কর-ভাষ্যের ভাবালোকে, তাৎপর্য দেখা যাক:




এখন যে-স্বরূপ প্রাপ্য বা লক্ষ্যরূপে নির্দিষ্ট হয়েছে, তাকে স্থূল ইন্দ্রিয় হতে আরম্ভ করে সূক্ষ্মত্বের তারতম্যক্রমে [সর্ব] আভ্যন্তর বস্তুরূপেই ধারণা করতে হবে—এই কথা বলার জন্য এই মন্ত্রদুটি আরম্ভ অর্থাৎ বলা হচ্ছে। [কারণরূপ ভূতসূক্ষ্ম হতে কার্যরূপ] সকল ইন্দ্রিয় স্থূলই। আর যে-সকল ভূতসূক্ষ্ম কর্তৃক নিজেদের [স্থূল] স্বরূপ প্রকাশের জন্য এ ইন্দ্রিয়সকল উৎপাদিত, নিজ কাজ সেই সকল ইন্দ্রিয় হতে [কারণরূপ] সেই সকল ভূতসূক্ষ্ম শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ সূক্ষ্ম, ব্যাপক এবং আভ্যন্তর সত্তাবিশিষ্ট। আর [ইন্দ্রিয়োৎপাদক] সেই ভূতসূক্ষ্ম হতে মন শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ সূক্ষ্মতর, ব্যাপক এবং আভ্যন্তর সত্তাবিশিষ্ট। এখানে ‘মন’ বলতে ‘মন’ শব্দের অভিধাবোধ্য অর্থ মনের উৎপাদক ভূতসূক্ষ্মকে বুঝতে হবে, কারণ ওই ভূতসূক্ষ্মই সঙ্কল্প-বিকল্পাত্মক বৃত্তির (অর্থাৎ মনের) উৎপাদক। আর ওই মন হতেও বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ সূক্ষ্ম, ব্যাপক এবং আভ্যন্তর বস্তু। এখানেও বুদ্ধি বলতে বুদ্ধি শব্দের অভিধাবোধ্য অর্থ নিশ্চয়াত্মক বৃত্তির উৎপাদক ভূতসূক্ষ্মকে বুঝতে হবে। আর সেই বুদ্ধি হতেও মহান্ আত্মা (আভ্যন্তর সত্তাবিশিষ্ট) অর্থাৎ সমস্ত প্রাণির বুদ্ধির মূলসত্তাস্বরূপ বলে আত্মা সকল বুদ্ধির চেয়ে ব্যাপক বলে মহান্—অর্থাৎ অব্যক্ত হতে প্রথমে উৎপন্ন হিরণ্যগর্ভতত্ত্ব, যা জ্ঞানশক্তি ও ক্রিয়াশক্তিস্বরূপ, সেই মহান্ আত্মা (সমষ্টিবুদ্ধি হিরণ্যগর্ভ), ওই বুদ্ধি-উৎপাদক ভূতসূক্ষ্ম অপেক্ষা [সূক্ষ্ম, ব্যাপক ও আভ্যন্তরবস্তু বলে] শ্রেষ্ঠ—এরূপ বলা হয়। (১/৩/১০)




আর মহৎ (হিরণ্যগর্ভ) হতেও [অব্যক্ত] শ্রেষ্ঠ, অর্থাৎ [মহৎ হতে অব্যক্ত] সূক্ষ্মতর ও আন্তরসত্তাস্বরূপ এবং [ব্যাকৃত বা স্পষ্টভাবে যুক্ত বা অভিব্যক্ত] সকলের অপেক্ষাও ব্যাপকতর এই অব্যক্ত, যা সম্পূর্ণ জগতের উপাদান কারণস্বরূপ, অব্যাকৃত নাম ও রূপের সত্তাস্বরূপ, সমস্ত কাজ ও কারণশক্তির সমষ্টি, অব্যক্ত অব্যাকৃত আকাশাদি নামে [প্রলয়কালে] কথনীয় এবংবটবীজকণিকায় নিহিত বটবৃক্ষের শক্তির মতো পরমাত্মাতে ওতপ্রোতভাবে সম্যক্-আশ্রিত।




আর সেই অব্যক্ত হতেও পুরুষ, যিনি সমস্ত কারণের কারণ ও মূলসত্তা বলে তা হতে শ্রেষ্ঠ, অর্থাৎ সূক্ষ্মতর ও ব্যাপক এবং এজন্যই তিনি পুরুষসংজ্ঞক, কেননা সকলকে যেহেতু তিনি ব্যাপ্ত করে থাকেন। তা ছাড়া অপর কোনো উৎকৃষ্টতর বস্তুর প্রসঙ্গ নিবারণ করার জন্য বলছেন যে, পুরুষ অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর আর কিছু নেই; এবং যেহেতু চিন্ময়-স্বরূপমাত্র পুরুষ হতে আর কোনো শ্রেষ্ঠবস্তু নেই, সে কারণে ওই চৈতন্যস্বরূপই সূক্ষ্মতা, ব্যাপকতা ও অন্তরাত্মতার শেষসীমা অর্থাৎ নিষ্পত্তি বা সমাপ্তিভূমি। আর যেহেতু ইন্দ্রিয় হতে আরম্ভ করে সূক্ষ্মত্বাদি ধর্মসমূহ এখানে (অর্থাৎ আত্মস্বরূপে) পরিসমাপ্ত হয়েছে, অতএব গমনকারিগণের অর্থাৎ গতিবিশিষ্ট সমস্ত সংসারির এটাই চরম লক্ষ্য। "যাঁকে প্রাপ্ত হয়ে আর ফিরে আসে না—মোক্ষলাভ হয়।"—এই স্মৃতি হতেও এ কথা সিদ্ধ হয়। (১/৩/১১)




তাৎপর্য: আর সেই লক্ষ্যবস্তুরূপ পরমাত্মা, যা মুমুক্ষুর নিজেরই স্বরূপ, সেই প্রত্যগাত্মাকে বিচারের মাধ্যমে যেভাবে নির্ধারণ করতে হবে, সেই পদ্ধতি এই মন্ত্রদুটিতে পর পর দেখানো হচ্ছে। ইন্দ্রিয় হতে আরম্ভ করে একের মূল অপর—এভাবে ক্রমশ সর্বমূল সত্তারূপে প্রত্যগাত্মাকে বুঝতে হবে। তবে এই মন্ত্রে ইন্দ্রিয় হতে আরম্ভ করে হিরণ্যগর্ভ পর্যন্ত তত্ত্বসমূহের বিচারপদ্ধতি দেখানো হলো। (১/৩/১০)




আর এই মন্ত্রে হিরণ্যগর্ভ হতে আরম্ভ করে পুরুষ বা প্রত্যগাত্মা পর্যন্ত তত্ত্বসমূহের বিচারপদ্ধতি দেখানো হচ্ছে। যেহেতু এই প্রত্যগাত্ম স্বরূপেই সংসারপথের নিবৃত্তি ঘটে, সে কারণে প্রত্যগাত্মার স্বরূপোপলব্ধি হলেই সব ধরনের গমনাগমন অর্থাৎ সংসারগতির অবসান হয়ে থাকে, তথা মোক্ষ বা মুক্তিলাভ হয়। (১/৩/১১)




শঙ্করাচার্য বলেন, যা-কিছু স্থূলের তুলনায় সূক্ষ্ম, তা-ই পর। স্থূল হলো সাধারণ; সূক্ষ্ম হলো উচ্চতর, উন্নততর স্থূলের চেয়ে। ইন্দ্রিয়ের বিষয় হলো স্থূল, সেগুলিকে স্পর্শ করা যায়, সেগুলিকে হাতে ধরে কাজে লাগানো যায়; কিন্তু ইন্দ্রিয়গুলি স্থূল নয়, তারা অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্মতর আর আমরা সবসময় বুঝে থাকি যে, স্থূল শক্তি সূক্ষ্ম শক্তি অপেক্ষা নিকৃষ্ট। অতএব, ‘পর’ শব্দকে ‘সূক্ষ্ম’ অর্থে গ্রহণ করতে হবে। পর-এর দ্বিতীয় গুণ হলো, পর বিস্তার ও শক্তিতে গুরুতর। শক্তির পরিমাণগত অস্তিত্ব রয়েছে; কিন্তু সূক্ষ্ম অবস্থায় শক্তির বিকাশ বেশি হয়। পর আপন অন্তরাত্মার আরও নিকটে। এই শরীর বহিঃস্থ—স্নায়ুতন্ত্র ও ইন্দ্রিয়-তন্ত্র আন্তর বা আত্মার নিকটতর—মন আত্মার আরও নিকটে; বুদ্ধি আত্মার নিকটতম। এ সবই বেদান্তে উদ্ভূত বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা। (ব্রহ্ম বা পরমাত্মা সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞানই বিজ্ঞান। এই ‘বিজ্ঞান’ কিন্তু ‘science’ নয়।) যখন ‘প্রত্যগাত্মা’ কথাটি ব্যবহার করা হয়, তখন এর অর্থ হলো: আত্মন্ বা অন্তরাত্মা। বাহ্যজগৎ হচ্ছে আত্মন্-এর বহিঃপ্রকাশ—পরাক্‌-স্বরূপ; পরাক্‌ শব্দ ব্যবহারে বাস্তব সত্যের দিকেই অঙ্গুলিসঙ্কেত করা হচ্ছে। কিন্তু যখনই অঙ্গুলিসঙ্কেত করা হয় নিজের দিকে, তখন লক্ষ্য হলো সত্যের প্রত্যক্ মাত্রা, সাক্ষী হলো বিষয়ী বা আত্মা। ওই বাহ্যবস্তু হলো পরাক্‌ আর এই ভেতরের বস্তু হলো প্রত্যক্‌।




প্রকৃতির দুটি মাত্রা আছে: পরাক্‌ মাত্রা এবং প্রত্যক্‌ মাত্রা। পরাক্‌ মাত্রার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে ভৌত বিজ্ঞানের মাধ্যমে, কারণ ওই মাত্রাই হলো বস্তু, যাকে ‘বিষয়’ বলা হয় এবং যা পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিকশিত হয়। ইন্দ্রিয়গুলির দ্বারা সংগৃহীত তথ্যই হলো ভৌতবিজ্ঞানের ভিত্তি। কিন্তু সেই পরীক্ষা শেষ হলে অঙ্গুলিসঙ্কেত ফেরে অন্তরের দিকে, নিজের দিকে, মানবের চেতনার দিকে, সাক্ষী-মানবের দিকে, যাকে বলা হয় ‘বিষয়ী’, কর্তা, জ্ঞাতা বা আত্মারূপে; সেখানে এক গূঢ় রহস্য উন্মেষের প্রতীক্ষায় গুপ্তভাবে রয়েছে। আধুনিক ভৌতবিজ্ঞান আজ পর্যন্ত ওই সত্যকে বোঝেনি, একে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনেনি। কিন্তু এখন এই বিংশ শতাব্দীতে, যে-সব বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটেছে—বিশেষত আণবিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, তাতে ওই সাক্ষী বা কর্তা বা বিষয়ী ধীরে ধীরে আধুনিক বিজ্ঞানের দৃশ্যপটের দিগন্তে দেখা দিচ্ছেন। কোয়ান্টাম সংক্রান্ত ব্যাপারগুলি বুঝতে চেতনার খানিকটা কাজ রয়েছে—বৈজ্ঞানিক এভাবেই ব্যাপারটাকে তুলে ধরেন। অতএব ভৌতবিজ্ঞানের সামনে চেতনার এক নতুন মাত্রা, সত্যোপলব্ধির এক নতুন মাত্রা খুলে যাচ্ছে। বেদান্ত চার হাজার (মতান্তরে সাড়ে ছয় হাজার) বছর আগে এটি অনুমান করেছিলেন এবং বলেছিলেন, পরাক্‌ তত্ত্বের পর্যালোচনার পর আমাদের প্রত্যক্‌ তত্ত্বের আলোচনা করতে হবে। প্রত্যক্‌ চৈতন্যের জাগরণ অপরাবিদ্যার উপলব্ধি ও বিকাশে ভূমিকা রাখে।




‘তত্ত্ব’ মানে সত্য। পরাক্‌ তত্ত্ব হলো বাহ্য সত্য বা বাহ্য প্রকৃতি; প্রত্যক্‌ তত্ত্ব হলো সকলের অন্তরে যে-সত্য নিহিত আছে বা আন্তর প্রকৃতি। এটিই পর্যালোচনার একটি বিরাট ক্ষেত্র। আর আজকাল, পাশ্চাত্য মনস্তত্ত্বে চেতনাবিষয়ক পর্যালোচনা গুরুত্ব পাচ্ছে। এতকাল ওখানে তার স্থান ছিল না। এখন বিষয়টি দিন দিন গুরুত্ব পাচ্ছে নানা দিক থেকে। তাত্ত্বিক দিক থেকে পদার্থবিদ্যা বা জীববিদ্যা পর্যালোচনার সময় মানবসত্তায় নিহিত কিছু নিগূঢ় বস্তুর সত্যতা সম্বন্ধে ইঙ্গিত পাওয়া যায়; কার্যকারিতার দিক থেকে মানবীয় পরিস্থিতিও নজরে পড়ে; এদিকে মানবীয় মনস্তত্ত্ব অত্যন্ত বিকৃত রূপ নিয়েছে—প্রযুক্তিবিদ্যার প্রভূত উন্নতির কারণে। ভৌতবিজ্ঞান এই সমস্যাকে বেশিদিন উপেক্ষা করে চলতে পারবে না। যদি কেউ শান্তি চায়, যদি কেউ জীবনে পূর্ণ সাফল্য চায়, তবে তাকে নিজ মন ও চেতনা নিয়ে পর্যালোচনা করতে হবে। এই প্রত্যক্‌ তত্ত্বেই এর উত্তর আছে, প্রতিকারও আছে। কাজের সুবিধার জন্য আরও ছোটোখাটো সাজসরঞ্জাম, নিত্যপ্রয়োজনের জন্য আরও কিছু ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়িয়ে তা পাওয়া যাবে না। তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক, দু-দিকের বিবেচনায় এরকম জোরালো যুক্তি থাকায় এই বিষয়টির গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে।




পরাক্‌ ও প্রত্যক্‌, কথা দুটির গুরুত্ব লক্ষণীয়। কেবল একটি মাত্রার পর্যালোচনা করে থেমে গেলে চলবে না। ঋষিগণ প্রথমে পরাক্‌-মাত্রা তথা বাহ্যজগৎ সম্পর্কিত পর্যালোচনা করে ভৌতবিজ্ঞানের অনেকগুলি বিভাগ গড়ে তুলেছিলেন। তার পরেই তাঁরা প্রত্যক্‌-মাত্রা তথা আন্তরজগতের পর্যালোচনায় মনোনিবেশ করেন। আর তারই ফলে তাঁদের কাছে ধরা পড়েছিল সত্যের সামগ্রিক সত্য—’একমেবাদ্বিতীয়ম্’ সত্যটির অদ্বৈত দৃষ্টির এক সমন্বয়রূপ, যা বাহ্য-প্রকৃতিরূপে যেমন প্রকাশ পায়, তেমনি পায় মানবের আন্তর-চেতনারূপে। এই কারণেই বেদান্ত পাশ্চাত্য বিজ্ঞানকে অন্তরের সঙ্গে গ্রহণ করতে বা স্বীকৃতি দিতে পেরেছিল; যে-স্বীকৃতি লাভের জন্য পাশ্চাত্য বিজ্ঞানকে ইউরোপীয় ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রের সঙ্গে ক্রমাগত সংগ্রাম চালাতে হয়েছে এবং এর সাফল্য এসেছিল একটু একটু করে। তাই বেদান্তে আত্মাকে প্রত্যগাত্মা, প্রত্যক্‌ স্বরূপ, প্রত্যক তত্ত্ব—এমন আখ্যা দেওয়া হয়। এই সবকটি শব্দই বেদান্ত সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে।




কোন সত্যটি আমার ভেতরে স্পন্দিত হচ্ছে? সদ্যোজাত শিশুর চোখদুটির দিকে তাকালে দেখা যায়, ওই চোখদুটির মাধ্যমে কিছু গভীর মাত্রার বিকাশ ঘটে। সেই মাত্রাগুলি কী? একটি পুতুল-শিশুর চোখের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাতে কোনো গভীরতা নেই; কেবল উপরের তলদেশই দেখা যায়। যে-কোনো সজীব শিশুতে, তার চোখদুটি এক নিগূঢ় গভীর মাত্রার বিকাশ ঘটায়। এই অনুসন্ধানের ফলেই ঋষিদের কাছে উদ্ঘাটিত হয়েছিল আত্মারূপে অন্তরে অবস্থিত সেই সত্য—প্রত্যক্‌ তত্ত্বের এই তিনটি কোষ বা আবরণ—ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি।




তাই প্রত্যক্‌ ও পরাক্‌ শব্দদুটি তাৎপর্যপূর্ণ। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান কেবল প্রকৃতির পরাক্‌ বা বাহ্যদিকটি পর্যালোচনা করেছে। এখন প্রত্যক্‌ বা আন্তর দিকটি ধীরে ধীরে পদার্থবিজ্ঞানের দিক্‌চক্রবালে উঁকিঝুঁকি মারছে। তাই, পরাণ্যাহুঃ শব্দটি বোঝাচ্ছে—আরও সূক্ষ্ম, আরও মহান্তঃ, আরও প্রত্যগাত্মভূতঃ। এই সূক্ষ্ম—ব্যাপ্তিতে ও শক্তিতে বিরাট এবং নিজ সত্য তথা আত্মার, অন্তরাত্মার, আরও নিকটে। শব্দ তিনটি ব্যবহৃত হয়েছে ‘পর’ শব্দটির অর্থের পরিপ্রেক্ষিতে। ‘প্রত্যাগাত্মা’ শব্দের অর্থ হলো ‘অন্তরাত্মা’।




সংজ্ঞাতন্ত্র বা ইন্দ্রিয়জ্ঞান তন্ত্র থেকে মনের স্তরে গেলে দেখা যায়, তা সংজ্ঞা-তন্ত্র অপেক্ষা আরও সূক্ষ্ম, 'ইন্দ্রিয়ের অগোচর'; মহান্তশ্চ—'ব্যাপ্তিতে ও শক্তিতে আরও বিরাট' এবং প্রত্যগাত্মভূতশ্চ—'আরও গভীর, যেমন মানবের অন্তরাত্মা'। মনকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, হাতে করে নাড়াচাড়া করা যায় না। স্নায়ুতন্ত্রকে নাড়াচাড়া করা যায়, ইন্দ্রিয়-তন্ত্রকে নাড়াচাড়া করা যায়, যেমন চোখ, কান ইত্যাদি; কিন্তু মনকে নাড়াচাড়া করা যায় না। তবু মনের অস্তিত্ব রয়েছে। এতে ইন্দ্রিয়-তন্ত্রের থেকে অনেক বেশি শক্তি রয়েছে। যদি মন দুর্বল হয়, ইন্দ্রিয়-তন্ত্রেরও জোর কমে যায়। এভাবে ঋষিগণ মনকে 'সূক্ষ্মতর', 'ব্যাপ্তিতে ও শক্তিতে বিরাটতর' ‘মহান্তশ্চ এবং প্রত্যগাত্মভূতশ্চ’, 'মানবের অন্তরাত্মার নিকটতর' রূপে বুঝেছিলেন।




তারপর আসে বুদ্ধিস্তর—মানব-তন্ত্রের তৃতীয় স্তর। বুদ্ধি আরও বেশি সূক্ষ্ম, ব্যাপ্তি ও শক্তিতে আরও বেশি বিরাট এবং ইন্দ্রিয়তন্ত্র বা মনঃতন্ত্র থেকে স্বীয় আত্মারূপে আরও বেশি সত্য; সূক্ষ্ম মহান্তশ্চ প্রত্যগাত্মভূতশ্চ। এই তিনকে আমরা পর্যালোচনা করতে পারি; আর তা থেকে একটি সত্য জানা যায়, তা হলো—যতই অন্তরে প্রবেশ করা যায়, ততই আরও বেশি শক্তি-সংস্থানের সন্ধান পাওয়া যায় নিজেরই অন্তরাত্মাতে। মনে করা হয়, বুদ্ধি হলো 'আত্মার নিকটতম'—নেদিষ্ঠম্ ব্রহ্মা। ব্রহ্ম, যাঁকে আত্মাও বলা হয়, তিনিই হলেন আমাদের সত্তা, আমাদের আত্মা। বুদ্ধি আন্তর দৃষ্টিসম্পন্ন হবার মতো শুদ্ধি অর্জন করলে সে ব্যক্তি অনন্ত আত্মাকে তথা ব্রহ্মকে উপলব্ধি করে, আর যে-ব্যক্তির এই অভিজ্ঞতা লাভ হয়, সে হয়ে যায় বুদ্ধ অর্থাৎ পূর্ণজ্ঞানী। শঙ্করাচার্য বলেন, এই সূক্ষ্মত্ব, মহান্তত্ব, প্রত্যগাত্মভূতত্ব তাদের অনন্তত্ব লাভ করে এই চিরমুক্ত সত্তায়, আত্মায়। প্রত্যেক মানবীয় দেহ-মন-তন্ত্রে বিকশিত কর্মশক্তি—সামান্য মাত্রায় এবং অন্তর্নিহিত কর্মশক্তি—অনন্ত মাত্রায় বর্তমান থাকে। যা বিকশিত কর্মশক্তি, তা পাওয়া যায় শরীরে, মাংসপেশীতে, স্নায়ুতে, মনে, বুদ্ধিতে; অন্তর্নিহিত কর্মশক্তি রয়েছে আত্মার পশ্চাতে। তাই আমরা প্রত্যেকে মাত্র সামান্য কিছু শক্তিসম্ভার নিয়েই নাড়াচাড়া করে থাকি, যদিও এর পেছনে অনন্ত শক্তিসম্ভার বর্তমান, যা আমাদের জানাই নেই।




বেদান্ত প্রত্যেক মানুষকে বলতে চায়, এমন আত্মিক শক্তির ভাণ্ডার মানুষের মধ্যে নিহিত রয়েছে। এই আত্মা সদামুক্ত। কোনো পাপ বা কোনো অপরাধ একে কলুষিত করতে পারে না। এমনই হলো আমাদের প্রকৃত স্বরূপ। এই পরম সত্যই বেদান্ত বহন করে নিয়ে যায় মানবজাতির কাছে। “আমি তো এ কথা জানি না।” বলে যে-কেউই প্রতিবাদ করতে পারে; কিন্তু কেউ না জানলেই সত্যের অবলুপ্তি হয় না। পৃথিবী যে গোল, এ সত্য শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষের জানা ছিল না। পরে বিজ্ঞানই এ সত্যকে আবিষ্কার করে—সৃষ্টি করেনি। তেমনি আত্মা সম্বন্ধে এই নিগূঢ় সত্য মহান ঋষিরা আবিষ্কার করেছিলেন সমগ্র মানবজাতির হয়ে। গীতার ৩/৪১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে: পাপ ও অপরাধ ইন্দ্রিয়-তন্ত্রে, মনঃতন্ত্রে ও বুদ্ধিতে সংক্রমিত হতে পারে, কিন্তু আত্মাতে কখনোই নয়। প্রত্যেকের মধ্যে এই আপতন বিন্দুটি সম্পূর্ণরূপে সদাশুদ্ধ ও সদামুক্ত থাকে। তাই আমাদের উদ্ধারের ব্যবস্থা আমাদের অন্তরেই করা আছে। আমাদের কেবল এই সত্যটিকে আবিষ্কার করতে হবে। এ সত্যকে কেউই ধ্বংস করতে পারে না। শঙ্করাচার্য তাঁর গীতাভাষ্যে বলেছেন, “ঈশ্বরও পারেন না সৎস্বরূপ মানবাত্মাকে ধ্বংস করতে।” হ্যাঁ, ঠিক এই ভাষাই তিনি ব্যবহার করেছেন! সুতরাং, এই তিনটি ভাব—সূক্ষ্ম, মহান্তশ্চ, প্রত্যগাত্মভূতশ—তাদের অনন্ত মাত্রায় পৌঁছে যায় এই আত্মাতে। আহা, কী সুন্দর আর শক্তিদায়ী এই ধারণা!




মানুষ যখন এই সত্যের বিষয় জানতে পারে—এই বুদ্ধি, এই মন, ওই ইন্দ্রিয়-তন্ত্র তখন নতুন পবিত্রতায়, নতুন প্রেম ও করুণাগুণে বিভূষিত হয়। কী আনন্দদায়ক পরিবর্তনই-না তখন আসে মানবজীবনে ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কে—যখন এই সত্যের সামান্যটুকুও উপলব্ধ হয়। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বিতীয় অধ্যায়ে এই কথাই বলছেন—স্বল্পমপস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ (২/৪০)—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদে: “কেন্দ্রস্থলে যদি স্বল্পমাত্রও ধর্ম থাকে, তবে পরিধির দিকে রাশি রাশি ভয়কেও ভয় করিবার দরকার নাই।” (‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত)




শুদ্ধ চৈতন্যরূপ আত্মা কখনও বিভাজ্য হতে পারেন না। গীতা বলছেন: অবিভক্তং চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম্ (১৩/১৬)—অবিভক্তং = without division চ = also ভূতেষু = in all living beings বিভক্তং = divided ইব = as if চ = also স্থিতং = situated—’এই আত্মা সর্বভূতে অবিভক্তই আছেন, তবে মনে হয় যেন বিভক্ত’; আবার ‘অবিভক্তং বিভক্তেষু তজ্জ্ঞানং বিদ্ধি সাত্ত্বিকম্’ (গীতা, ১৮/২০)—অবিভক্তং = undivided বিভক্তেষু = in the numberless divided তত্ = that জ্ঞানং = knowledge বিদ্ধি = know সাত্ত্বিকং = in the mode of goodness—’বিভক্তরূপে আপাত প্রতীয়মান এই বস্তুগুলিতে তিনি অবিভক্তই আছেন’।




এই গূঢ় আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করে গীতা আমাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন জীবন ও কর্ম সম্বন্ধে এক নিগূঢ় দর্শন। মানবনিয়তির কার্যবিধি অনুসারে গীতা মানবজীবনে অপরাধপ্রবণতা দমনে এবং সমাজে অপরাধ প্রশমনের উপায় নির্ধারণে—এই সত্যের কার্যকর প্রয়োগের কথাও তুলে ধরেছেন। অত্যন্ত অপরাধপ্রবণ সমাজে কেউই সুখী হয় না। সুস্থ সমাজে সকলেই সুখী হয়। তাই অপরাধমুক্ত সমাজের জন্য, যে-সমাজে সকলে সমান, সে সমাজে একাত্মবোধ সহকারে ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে পারা মানুষের পক্ষে এক বিশেষ অধিকার লাভ করার সমান। এই জন্য মহান আধ্যাত্মিক আচার্যগণ বার বার আসেন—মানবজাতিকে-দ্বন্দ্ব, হিংসা ও অপরাধ থেকে দূরে রেখে সহমর্মিতা, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সহযোগিতার পথে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে।




যখন কোনো লোক নিজের হাতে ক্ষমতা পেয়ে তার অসদ্ব্যবহার করতে থাকে, তখন ওই ক্ষমতাকে গঠনমূলক কাজে নিয়োগ করতে হলে যে-শক্তি প্রয়োগ করতে হয়, তা হলো সৎ-অসৎ বিচারশক্তি; আর একমাত্র যখন সে শক্তি আত্মার সঙ্গে সমন্বয় ঘটাতে পারে, তখনই তা বুদ্ধিপর্যায়ে উঠে আসে। তাই শ্রীকৃষ্ণ সমগ্র মানবজাতিকে বলছেন, যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ, 'বুদ্ধির পারে যা, তা-ই আত্মা', যেখানে এই সূক্ষ্মতা, বিশালতা, অন্তর্মুখিনতা—তাদের অনন্ত মাত্রায় পৌঁছে যায়। এ-ই হলো মানবজাতির স্বভাব। ‘তৎ ত্বং (ত্বম্) অসি’ বা ‘তত্ত্বমসি’ (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৬/৮/৭), 'তুমিই সেই'—শ্রুতিতে এই মহাবাক্য বিঘোষিত হয়েছে। যত বেশি লোকে এ সত্য উপলব্ধি করবে, মানবসমাজের পক্ষে ততই মঙ্গল। এতে কোনো ধর্মমত নেই, ধর্মবিশ্বাস বলে কিছু নেই। এ হলো মানবের অন্তরতম সত্তা-সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান, যা ঋষিরা আবিষ্কার করেছিলেন, পরে অন্যান্য ঋষি তা পুনরাবিষ্কার করে সকলের কাছে তুলে ধরেছেন, যাতে আমরাও এ তত্ত্বকে পুনরাবিষ্কার করি—–এটি বোঝার জন্য উপস্থাপিত কোনো ধর্মমত নয় বা মেনে নেবার মতো কোনো তত্ত্বও নয়।




এভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মানবজাতিকে তার অন্তরতম সত্তা সম্বন্ধীয় দর্শনটির বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছেন, যার দ্বারা আমরা এক সার্থক জীবন উপভোগে সক্ষম হব এবং অন্যদেরও তেমন জীবনযাপনের সুযোগ করে দেব। এ-ই হলো মানবীয় ক্রমবিকাশের লক্ষ্য। আন্তর্জাতিক শান্তি কি আন্তর্জাতিক মানবকল্যাণ—এ সবই সম্ভব, কারণ সকল মানুষের মধ্যেই এই গুণগুলি বিদ্যমান; কেবল তার অবশ্যকর্তব্য হবে মানবীয় ক্রমবিকাশকে ইন্দ্রিয়স্তরের পারে উচ্চতর নৈতিকতা, পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া।




তাই এই ‘পর’ শব্দটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত এটি ‘উচ্চতর’ বলে অনূদিত হয়। কিন্তু 'উচ্চতর' বলতে কী বোঝায়? উচ্চতর স্থান বোঝাতে পারে, যেমন কোনো জিনিসকে ওপর-তলায় রাখা—তবে এখানে অর্থটি তা নয়। তাই একটি বাক্যে সমগ্র বিষয়টিকে উপস্থাপিত করা যায়, সেটি হলো—মানবীয় শক্তি সংস্থানগুলি বিন্যস্ত আছে তাদের সূক্ষ্মতা, বিশালতা ও অন্তর্মুখিনতা, এই তিন গুণের ক্রমবর্ধমান মাত্রানুসারে—শঙ্করাচার্যের মুখনিঃসৃত এই সুন্দর বাক্যটি তাঁর কঠোপনিষদ-ভাষ্যে রয়েছে। এই ক্রমবর্ধমান মাত্রার শেষ পর্যায়টি হলো—যখন আমরা—যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ, অর্থাৎ 'বুদ্ধির পারে ও তদূর্ধ্বে সেই অনন্ত সত্তা’, আত্মায় পৌঁছে যাই। আমরা এখন কেবল জগতের পরাক্‌ প্রকৃতিকে বুঝতেই ব্যস্ত, আর প্রত্যক্‌ প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে চলেছি। এখন সময় এসেছে এই প্রত্যক্‌ মাত্রার দিকে একটু মনোযোগ দেবার আর সেখানে যে-তত্ত্বম্ রয়েছে, তাকে আবিষ্কার করার। পরাক্‌ ও প্রত্যক্‌ দুটি তত্ত্বই সত্য। একটি মাত্র অনন্ত সত্যই বিদ্যমান—তা-ই কখনো বহিঃস্থ, কখনোবা আন্তর সত্যরূপে প্রতীয়মান হয়। এ-ই হলো বেদান্তের ভাষা।




গৌড়পাদের মাণ্ডুক্যোপনিষদ্ কারিকার একটি মহান শ্লোকেও (২/৩৮) এটি ব্যাখ্যাত হয়েছে:
তত্ত্বমাধ্যাত্মিকং দৃষ্টা তত্ত্বং দৃষ্টা তু বাহ্যতঃ।
তত্ত্বীভূতস্তদারামস্তত্ত্বাদ অপ্রচ্যুতো ভবেৎ।।




অর্থ: ‘তোমার অন্তরে যে-তত্ত্ব নিহিত আছে, তাকে উপলব্ধি করে’—’তত্ত্বম্ আধ্যাত্মিকম দৃষ্টা’ এবং 'বাহ্য প্রকৃতিতে যে-তত্ত্ব নিহিত আছে, তাকে উপলব্ধি করে’—’তত্ত্বম্‌ দৃষ্টা তু বাহ্যতঃ’, ‘তত্ত্বীভূতঃ’—'তত্ত্বের সত্যের সঙ্গে একীভূত হয়ে', ‘তদারামঃ’—’সত্যেই আনন্দ অনুভব করে’, ‘তত্ত্বাদ অপ্রচ্যুতো ভবেৎ’—’তুমি সত্য থেকে কখনও বিচ্যুত হবে না’।




এভাবে তুমি চিরকালের মতো সবরকম অশুভের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত থাকতে পারো। কোনো বিষয়ের সম্বন্ধে যা সত্য, তা-ই তত্ত্বম্—এ কথা বলছেন শঙ্করাচার্য। ‘তত্ত্বান্বেষণ’ বলে কিছু আছে—সেটি বাহ্যজগতে থাকতে পারে, আবার অন্তর্জগতেও থাকতে পারে। এ বিষয়ে শেষ কথা হলো—তত্ত্ব একটি। তত্ত্বের ব্যাপারে বাহ্য বা আন্তর শব্দের কোনো অর্থ নেই। ঠিক যেমন বলা যায় এমন—পৃথিবী কেবল একটি সমুদ্রের দ্বারা বেষ্টিত, কিন্তু সুবিধার জন্য আমরা একে ভারত মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর নামে ভাগ করে থাকি। তবে মহাসাগর একটাই, একাধিক নয়। তাই, বাহ্য তত্ত্বম্, আন্তর তত্ত্বম্—এগুলির ব্যবহার কেবলই পর্যালোচনা ও গবেষণার ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। স্ব-স্বরূপে তত্ত্বম্ এক, অনন্ত, অদ্বিতীয়। আর বেদান্ত মতে একে উপলব্ধি করাই মানবীয় ক্রমবিকাশের লক্ষ্য। তত্ত্বমের দিকে অগ্রসর হওয়াকেই বেদান্ত জীবনের লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেছেন। যিশু বলেছেন, “তোমাকে সত্য জানতে হবে, আর সত্য তোমাকে মুক্ত করবে।”




গীতার ৩/৪২ শ্লোকটি নিয়ে আরও কিছু বলা যাক। সকল ইন্দ্রিয়ের বশ মন। মন ইন্দ্রিয়গণের বশে থাকে, ইন্দ্রিয়গণ যে-সকল বিষয় এনে উপস্থিত করে, মন বিনা বিচারে তা-ই গ্রহণ করতে উদ্যত হয়। ইন্দ্রিয়গুলি জড় পদার্থ বললেই হয়, মনের বাহন হয়ে এরা মনকে বিষয় ভোগ করায়। মন যতদিন ইন্দ্রিয়যুক্ত থাকবে, ততদিন এদের এমন দৌরাত্ম্য থামবে না। এজন্য কাজ করা আবশ্যক, কাজ করতে করতে মন স্থির হয়ে আসে, মন স্থির হয়ে এলেই আর তাকে ‘মন’ বলা যায় না, তখন তা নিরুদ্ধ-রূপা হয়ে একাগ্রতা লাভ করে—এর নামই বুদ্ধি। এই বুদ্ধি মনের মতো চঞ্চল নয়, তাই মন যেমন বহু বিষয়ে ধাবিত হয়, বুদ্ধি তেমন বহুমুখী হতে পারে না। এই বুদ্ধিকে সাধন ও বিচার সহযোগে আত্মমুখী করতে পারলে তাতে তখন আত্মা ব্যতীত আর কোনো বস্তু ভাসতে পারবে না। যোগাদি সাধন অভ্যাসে বুদ্ধি আত্মমুখী হলেই আর ইন্দ্রিয়াদির চাঞ্চল্যবিক্ষেপ থাকে না, সুতরাং ইন্দ্রিয়সংযম তখন অনায়াস-সাধ্যই হয়। এই ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়বিষয়ে মনের গতি নিরুদ্ধ হলেই আত্মস্বরূপের বিকাশ হয়, অর্থাৎ বাসনামুক্ত হয়ে মন কৈবল্যপদে স্থিতিলাভ করে। তখন বাসনা ও তার সংস্কার চিত্তের উপর আর দাগ রাখতে পারে না এবং তেলশূন্য প্রদীপের আগুনের মতো স্বয়ং কামাগ্নিও নষ্ট হয়ে যায়। এই সাধনটি আয়ত্ত করার জন্য একদিকে যেমন শ্রদ্ধাভক্তির সাথে কাজ করা আবশ্যক, তেমনি বিবেক-বুদ্ধিযুক্ত মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গণকে সংযত করার চেষ্টাও করতে হবে। মনকে সমাহিত করতে না পারলে প্রকৃত বিবেকবুদ্ধি কিন্তু জাগ্রত হবে না। উপনিষদ্‌ বলছেন:
বিজ্ঞানসারথির্যস্তু মনঃপ্রগ্রহবান্ নরঃ।
সোহধ্বনঃ পারমাপ্নোতি তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং।। (কঠোপনিষদ, ১/৩/৯)




অর্থ: 'যঃ ত' কিন্তু যে 'বিজ্ঞানসারথিঃ' বিবেকযুক্তবুদ্ধি যাঁর সারথি 'মনঃ প্রগ্রহবান' যিনি মনরূপ রজ্জুযুক্ত, 'সঃ অধ্বনঃ পারম্‌ আপ্নোতি' তিনি সংসারপথের পরপারে উপস্থিত হন, 'বিষ্ণোঃ' ব্যাপনশীল ব্রহ্মের 'তৎ পরমং পদং' সেই পরম পদ (ব্রহ্মের পদ অর্থাৎ ব্রহ্মই—যেমন রাহুর শির রাহুই)। এককথায়, উত্তম বুদ্ধি ও মন যুক্ত ব্যক্তি, সংসারপথের পরপারে পরমাত্মার স্বরূপকে প্রাপ্ত হয়।




যে-ব্যক্তি বিবেকবুদ্ধিরূপ সারথিযুক্ত এবং সেই সারথির হাতে মনরূপ প্রগ্রহ অর্থাৎ অশ্বপরিচালনরজ্জু থাকে, চোখ-কান ইত্যাদি ইন্দ্রিয় এই শরীররূপ রথের ঘোড়া এবং সে সকল ঘোড়ার এই শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধরূপ বিষয়ই তাদের বিচরণ স্থান। সুতরাং যাঁর বিবেক-বুদ্ধিরূপ সারথী মনরূপ রজ্জু দ্বারা সকল ইন্দ্রিয়কে সংযত করে রাখতে পারেন—এই সংসাররূপ পথের, অর্থাৎ পুনঃ পুনঃ জন্ম যাতায়াতের পারে তিনিই যেতে পারেন—এই সংসারপথের অপর পারই হলো ভগবানের পরমপদ।




গীতার আলোচ্য শ্লোকে ‘ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুঃ’—ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধিকে কামের অধিষ্ঠানভূমি বলা হয়েছে, অতএব কামকে জয় করতে হলে এদের অতীত অন্য কোনো বস্তুকে আশ্রয় করতে হবে, এখানে তা-ই বলা হচ্ছে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, গীতা আমাদের আভ্যন্তরীণ জীবনের যে-ক্রম নির্দেশ করেছেন, তা হচ্ছে সাংখ্য অনুযায়ী। এর এক দিকে রয়েছে পুরুষ—স্থির, নিষ্ক্রিয়, অক্ষর, অদ্বিতীয় আত্মা—তার মধ্যে বিবর্তন বা বিকাশ নেই, তা চিরদিন যেমন তেমনই আছে; অন্য দিকে রয়েছে প্রকৃতি—চৈতন্যময় পুরুষ ব্যতীত সে নিশ্চল, সে নিষ্ক্রিয়—কেবল পুরুষের সান্নিধ্যে, পুরুষের সংস্পর্শে এলেই সে কাজ করতে পারে, তখন তার বিবর্তন ও নিবর্তন দুই-ই হয়। পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ হতেই আমাদের আভ্যন্তরীণ জীবন ও বাহ্যজগৎ উদ্ভূত হয়; আমাদের পক্ষে যা আভ্যন্তরীণ, তা-ই প্রথমে উদ্ভূত হয়, কারণ পুরুষের চৈতন্যই হচ্ছে প্রথম ও মুখ্য কারণ, প্রকৃতি হচ্ছে দ্বিতীয় ও আপেক্ষিক কারণ, তবুও আমাদের ইন্দ্রিয়াদি আভ্যন্তরীণ করণসমূহ প্রকৃতি হতে উদ্ভূত হয়, পুরুষ হতে নয়।




পর্যায়ক্রমে প্রথমেই আসে বুদ্ধি, প্রকৃতি হতে বিবর্তিত নির্ণয়াত্মিকা ও নিশ্চয়াত্মিকা শক্তি, পরে দ্বিতীয় বিবর্তনরূপে বুদ্ধি হতে উদ্ভূত হয় মন; তৃতীয় বিবর্তনরূপে মন হতে দশটি ইন্দ্রিয়ের উদ্ভব হয়—চোখ ইত্যাদি পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং হাত ইত্যাদি পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়, তারপর আসে জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলির আপন আপন বিশিষ্ট শক্তি, রূপ, রস ইত্যাদি এবং এদের স্থূল আধারস্বরূপ ক্ষিতি ইত্যাদি পঞ্চভূত। এই পঞ্চভূতই বিভিন্নভাবে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত হয়ে বাহ্যজগতের সকল বস্তু উৎপন্ন করে।




জড়জগতে যে ক্রম-বিবর্তন, তা উল্লিখিত ক্রমের বিপরীত বলেই মনে হয়। জড়-প্রকৃতি হতে ক্রমান্বয়ে হয় দেহ, ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধির বিকাশ। কিন্তু জড়জগৎ পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞান যে আধুনিকতম সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছে, তা হতে জানা যায়, জড় অণু-পরমাণুর মধ্যেও একটা বুদ্ধির ক্রিয়া চলছে। জড়ের সূক্ষ্মতম উপাদান ইলেক্ট্রনের (electrons) গতিবিধি পরীক্ষা করতে গিয়ে হাইজেনবার্গ প্রমুখ আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছেন—প্রকৃতির নিয়মগুলি ঠিক যন্ত্রের মতো চলে না, ওতে একটু অসম্পূর্ণতা আছে। এটাই হলো বর্তমান যুগের অনির্দিষ্টতাবাদ বা অনিশ্চয়তাবাদ (Indeterminism of Nature)। সূক্ষ্ম জড়জগতে কোন বিশেষ মুহূর্তে কোন বস্তু কীভাবে কাজ করবে, তার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, তা তার ভেতর হতেই নির্ণীত হয় এবং এটাই বুদ্ধির ক্রিয়া। সূক্ষ্ম ইলেক্ট্রনের রাজ্যের এই অনির্দিষ্টতা শুধু বৃহৎ রাজ্যেই সমষ্টিগতভাবে নির্দিষ্ট নিয়মের আকারে কার্যকারণ সম্বন্ধরূপে দেখা দেয়।




অতীতের অনেক বছরের হিসেব দেখে মোটামুটি বলতে পারা যায় যে, এ বছর আনুমানিক কতজন লোক আত্মহত্যা করবে, কিন্তু বস্তুত কোন কোন লোক আত্মহত্যা করবে, তা নির্ণয় করার কোনো উপায় নেই। বিজ্ঞান জড়জগৎ সম্বন্ধে যত নিয়ম (Laws) নির্ধারণ করছে, সেসব এমন‌ই statistical বা গড়পড়তায় সত্য, তাদের পেছনে প্রকৃতির সূক্ষ্মরাজ্যে একটা অনিশ্চয়তার ক্রীড়া চলছে, সেখানে এক বুদ্ধিই নিজ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নিগূঢ়ভাবে প্রকৃতির কার্যপরম্পরাকে চালিত করছে। প্রকৃতির বিবর্তনে প্রথমেই বুদ্ধির আবির্ভাব হয়েছে এবং তার ক্রিয়াতেই প্রকৃতির পরবর্তী বিবর্তন সাধিত হয়েছে। অতএব আমরা দেখছি, সাংখ্যের বিশ্লেষণের সাথে আধুনিক জড়বিজ্ঞানের মিল রয়েছে। কিন্তু জড়ের ক্রিয়াবুদ্ধিতে কীরূপে চৈতন্যের আভাস হয়, আধুনিক বিজ্ঞান তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। সাংখ্য সে ব্যাখ্যা দিয়েছে, জড় প্রকৃতির এসব ক্রিয়া পুরুষের চৈতন্যে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের সচেতন বুদ্ধি, মন, ইন্দ্রিয়রূপে প্রতিভাত হয়, এবং এসব নিয়েই হয় আমাদের অন্তঃকরণ। অবশিষ্ট যা-কিছু, তা-ই ইন্দ্রিয়গোচর বিষয় তথা বাহ্যজগৎ।




জীব পুরুষেরই অংশ, ‘মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ’ (গীতা, ১৫/৭)—’এই জড়জগতে বদ্ধ জীবসমূহ আমার সনাতন বা নিত্য বিভিন্নাংশ’, প্রকৃতিতে অবতীর্ণ হয়ে তার মধ্য হতে জীব ইন্দ্রিয়াদি কর্ষণ করে এবং সে সকলের সাথে নিজেকে এক করে দেখে বদ্ধ হয় অথবা বদ্ধ হয়েছে বলে মনে হয়। প্রকৃতির বন্ধন হতে পুরুষের শুদ্ধ চৈতন্যে ফিরে যেতে হলে যে-পর্যায়ক্রমে সে প্রকৃতির মধ্যে নেমেছে, তার বিপরীত পর্যায়ক্রম অনুসরণ করতে হয়; উপনিষদে আমাদের আভ্যন্তরীণ শক্তি—সকলের বিকাশের এই ক্রমই বর্ণিত হয়েছে এবং গীতাও এখানে প্রায় উপনিষদের ভাষাতেই সেই ক্রমের বর্ণনা দিয়েছেন। ইন্দ্রিয়গণ যখন বিষয়ের দিকে ধাবিত হতে যাবে, তখন তাদেরকে ভেতরের দিকে টেনে নিতে হবে, তাদের উৎপত্তিস্থল মনের মধ্যেই তাদেরকে শান্ত করে ধরতে হবে, মনকে বুদ্ধির মধ্যে নিয়ে শান্ত করতে হবে, বুদ্ধিকে আত্মার মধ্যে নিয়ে শান্ত করতে হবে, তখন জীব আত্মজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে প্রকৃতির ক্রিয়া সাক্ষীরূপে দেখবে, কিন্তু তার অধীন হবে না—বাহ্যজগৎ বা বাহ্যজীবন দিতে পারে, এমন কোনো জিনিসেরই কামনা করবে না।




‘ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ’—আমরা দেখেছি, প্রকৃতির বিবর্তনে প্রথমেই বুদ্ধির আবির্ভাব হয়। কিন্তু জড় অণু-পরমাণুতে বুদ্ধির যে-ক্রিয়া, তা খুবই সীমাবদ্ধ, কারণ সেখানে বুদ্ধির প্রকাশের উপযোগী যন্ত্র নেই। প্রকৃতি মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশ করেই জড়জগতে বুদ্ধির ক্রিয়ার উপযোগী যন্ত্র পেয়েছে, কিন্তু তার আগে তাকে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তনের বহু ধাপ অতিক্রম করতে হয়েছে। জড়জগতে প্রাণের আবির্ভাব হওয়াতেই মনের বিকাশ সম্ভব হয়েছে। উদ্ভিদের মধ্যে আমরা দেখতে পাই সংবেদন, সুখ-দুঃখ বোধ, স্মৃতি, আভ্যন্তরীণ প্রেরণা প্রভৃতির স্থূল উপাদান। বিবর্তনের কোনো এক স্তরে বিশিষ্ট ইন্দ্রিয়গণের বিকাশ হওয়ায় মনেরও উচ্চতর প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। বুদ্ধির বিকাশেই মানুষ পশুস্তরের ঊর্দ্ধে উঠেছে। এরও উপরে উঠে মানুষ অতিমানবত্ব লাভ করবে, এটাই পৃথিবীতে মানবজীবনের লক্ষ্য এবং তার জন্য বুদ্ধির উপরে যে-আত্মা রয়েছে, যা আমাদের আভ্যন্তরীণ জীবনের শ্রেষ্ঠতম কারণ, তাকে বুদ্ধির দ্বারা জানতে হবে, তাতেই আমাদের সকল সঙ্কল্প নিবদ্ধ করতে হবে। ‘যঃ বুদ্ধেঃ পরতন্ত্র সঃ’—বুদ্ধির উপরে যে-আত্মা, তাকেই গীতায় ‘অক্ষরপুরুষ’ বলা হয়েছে। ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি নিয়েই আমাদের সাধারণ মানবজীবন। আধুনিক পাশ্চাত্য আদর্শ হচ্ছে, বুদ্ধিরই পূর্ণ বিকাশ করে তার সাহায্যে কর্তব্যাকর্তব্য নির্ণয় করা, ব্যক্তির ও সমাজের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করা। কিন্তু গীতা দেখিয়েছেন যে, যতক্ষণ আমরা ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ, ততক্ষণ আমাদের জীবনের মূলনীতি হবে কামনা এবং তা আমাদেরকে জীবন সম্বন্ধে, জগৎ সম্বন্ধে সকল সত্য জ্ঞান হতে দূরে রেখে দেবে। প্রথমেই প্রয়োজন হচ্ছে কাম-ক্রোধাদি রিপুগণকে সংযত করে এক নৈর্ব্যক্তিক শান্তভাব নিয়ে অহংকারশূন্য হয়ে সকল বস্তুকে দর্শন করা। কারণ কামনা-মেঘের ঊর্দ্ধে সেই শান্ত নির্মল আকাশেই আমরা সত্য আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারি, জগৎ ও প্রকৃতির সত্য সমুজ্জ্বল আলোককে দর্শন করতে পারি।




এই যে আমাদের ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্ব, যার পরাকাষ্ঠাকে আমরা শ্রেষ্ঠ গতি বলে মনে করি, এটা হচ্ছে প্রকৃতির সৃষ্টি, প্রকৃতির হাতের অক্ষম পুতুল। এর পেছনে রয়েছে এক নৈর্ব্যক্তিক আত্মা—সকলের মধ্যে একই, তা সব জিনিসকেই যেন দেখছে, জানছে—এক সম, নিরপেক্ষ, বিশ্বব্যাপী সত্তা সৃষ্টিকে ধরে রয়েছে, এক সাক্ষীচৈতন্য প্রকৃতিকে সমস্ত জিনিসের স্বভাব অনুযায়ী বিকাশ করতে দিচ্ছে, কিন্তু প্রকৃতির কাজের মধ্যে বদ্ধ হচ্ছে না, নিজেকে হারিয়ে ফেলছে না। ‘অহং’ এবং ‘বিক্ষোভময়’ ব্যক্তিত্ব হতে সরে এই শান্ত, সম, সনাতন, বিশ্বগত, নৈর্ব্যক্তিক আত্মার মধ্যে আসাই হচ্ছে দৃষ্টিসম্পন্ন যৌগিক বা যোগ-সম্বন্ধীয় কাজ করার প্রাথমিক সাধনা।




প্রকৃতির বিকাশে বুদ্ধিই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ তত্ত্ব, কিন্তু যতক্ষণ না আমরা প্রকৃতির ঊর্দ্ধে যে-পুরুষ রয়েছে, তাকে জানছি, ততক্ষণ আমাদের এই প্রাকৃত জীবনকে দিব্যভাবে রূপান্তরিত করা সম্ভব নয়। বুদ্ধিই মুক্তি এনে দেয়, বুদ্ধির দ্বারাই মানুষ তার বিক্ষুব্ধ চঞ্চল মানসিক সত্তা হতে তার শান্ত শাশ্বত অধ্যাত্ম সত্তায় ফিরে গিয়ে অবশেষে জন্ম ও কর্মের চিরবন্ধন হতে মুক্ত হয়। সেই মুক্তিতে দিব্যভাবে কাজ করাই গীতার কর্মযোগের আদর্শ; যে ভাগবত সত্তা ও অব্যর্থ ইচ্ছে আমাদের কাছে এখন অপরিস্ফুট হলেও বিশ্বমাঝে নিজেকে প্রকট করছে, তার সাথে সজ্ঞান যোগেই এমন কাজ সম্পাদিত হয়।




ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলতে চাইছেন, ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধির দাস হয়ো না, কারণ এদের কোনো পৃথক অস্তিত্ব নেই। চোখ, কান, নাক—এরা কি স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারে? না, তা পারে না। তাই এদের শরীরের সঙ্গে যুক্ত থাকা দরকার। আবার মন ছাড়াও ইন্দ্রিয়গুলি কাজ করতে পারে না। সেই মন আবার বুদ্ধির অধীন। সুতরাং এরা একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এদের সবাইকে ধরে আছেন আত্মা। আত্মা স্বতন্ত্র, কোনো কিছুর অধীন নন। তিনি সাক্ষী, দ্রষ্টা। সেই আত্মাকে ধরে থাকতে হবে। একটা জাহাজের নোঙর ফেলা আছে। নোঙর থেকে আলাদা হলে জাহাজ কোথায় যাবে, তার ঠিক নেই। অথচ এত বড়ো জাহাজ। কত তার শক্তি! কিন্তু খুঁটি থেকে সরে গেলেই সে অসহায়। নিজে নিজে কিছুই করতে পারে না। আত্মা যেন ওই নোঙর। যতক্ষণ আত্মাকে ধরে আছি ততক্ষণ নিশ্চিন্ত। আত্মাই সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বোচ্চ। আত্মার চেয়ে বড়ো আর কিছুই নেই। মহাত্মা লালন সাঁইও তাঁর গানে আত্মার ঘরকে ‘আরশিনগর’ এবং (নিজের) জীবাত্মাকে ‘পড়শি’ বলছেন:
বাড়ির কাছে আরশিনগর,
সেথা এক পড়শি বসত করে।
আমি এক দিনও না দেখিলাম তাঁরে।।




—পড়শিকে দেখতে না পাবার এই চিরন্তন আকুতি তথা সেই আরশিনগরে পৌঁছনোর তীব্র আত্মিক ক্ষুধাই মানুষকে মানুষ হিসেবে বাঁচিয়ে রাখে।