এক। কেন যে ধরতে যাই তাকেই, যাকে যায় না ধরা কিছুতেই? যতটা সুখ আসে, কেন দুঃখ আসে তার চাইতে অনেক বেশি? কেন যে ভালোবাসি তাকেই, জীবনে যায় না রাখা যাকে? জীবনের এ কেমন ছন্দ... ঘটে কেবলই আমার বেলায় যা-কিছু মন্দ! দুই। হাসতে গেলে তোমার গালে টোল পড়ে। তা দেখে মনে হয়, বেঁচে থাকাটা মন্দ নয়! তোমাকে ভেবে যখন গান শুনি, যখন কবিতা পড়ি, যখন মুভি দেখি, তখন ভাবি, জীবনটা স্বপ্নের কাছাকাছি। তিন। চাকরি পাই না বলে বেকারভাতা চাইছি না। এই যে তবু বেঁচে আছি, তাই আয়ুভাতা চাইছি। মৃত্যুর আগ অবধি এমন মরতে থাকা ... রাষ্ট্র কি এর ক্ষতিপূরণ দেবে না? চার। একটা সময় আসবে, যখন তুমি আমাকে নিয়ে শুধুই ভাববে আর ভাববে, কিন্তু কাউকেই কিছু বলতে পারবে না। এবং, এই ব্যাপারটি প্রতিদিনই ঘটবে। সময় এলে মিলিয়ে নিয়ো। পাঁচ। প্রায়ই, অনেকটা সময় ধরে, আশেপাশের সব কিছু আমাকে খুব কষ্ট দেয় এবং ঠিক তখনই, আমার ভেতর থেকে কে যেন ক্ষীণস্বরে বলে, সারাক্ষণই এমন কষ্ট পাবার সত্যিই কি কোনও মানে হয়? কিছু একটা করো... কিছু একটা তো করো! প্রতিবারই আমি উত্তর দিই, আমি জানি; এই সহজ কথাটা আমিও জানি। আমি চেষ্টা করছি...আমি খুব করে চেষ্টা করছি! ছয়। পৃথিবী বড়ো বিচিত্র জায়গা। এখানে মরে যেতে কোনও দোষ লাগে না। এখানে বেঁচে থাকতে কোনও গুণ লাগে না। যাদের ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে না, তাদেরকেই ঘরে ফিরতে হয় সবার আগে। যারা ঘরে ফেরার অপেক্ষায় থাকে, তাদের আর ঘরে ফেরা হয় না। এখানে স্বপ্নের ছদ্মবেশে চলে বিষাদযাপনের পূর্বপ্রস্তুতি। এখানে আয়ুর সমস্ত ভার বহন করে নিয়তির ইশারা। পৃথিবীর খাতায় মৃত্যু কোনও ঘটনা নয়, সংখ্যা মাত্র। সাত। এমনকী এতগুলি বছর পরেও, ঘুম ভেঙে অনেকক্ষণ ধরে আমার মাথায়ই আসে না আমার পাশে তুমি নেই কেন! কিছু আলো দেখায় বেশি নিভে যাবার পরেই। আট। আমি আমার অতীত নিয়ে বলতে চাই। 'অতীত নিয়ে পড়ে থেকে কী লাভ?' এই সহজ কথাটি আমাকে শোনানোর মতো মানুষের অভাব আমার এ জীবনে নেই। যা নিয়ে কথা বলে কোনও লাভ নেই, তা নিয়েও আমাকে কথা বলতে দেবে, এমন কাউকেই আমি খুঁজছি খুব করে। আমাকে জ্ঞান দেবার মানুষ অনেক আছে। আমাকে ধৈর্য ধরে শোনার মানুষ কেউ নেই। আমার অতীত জীবনের যতসব ফালতু অকেজো বাসি কথা শোনার ধৈর্য নেই যার, তার বন্ধুত্ব আমার লাগবে না। নয়। মাঝে মাঝে শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই আমাদের করার থাকে না। ছোটাছুটি করে, চেষ্টা করে, অনুশোচনায় ডুবে থেকেও কোনও কাজ হয় না। তখন একটাই কাজ: চুপচাপ অপেক্ষা করা। কাজটা কঠিন, খুব কঠিন। কিন্তু কিছু করার নেই। সময়ের আগে কিছু হয় না। সময়ের আগে খুব চেষ্টা করেও মানুষ কিছু পায় না, এমনকী হারায়ও না। নদীতে সময়ের আগে জোয়ার আসে না, সময়ের আগে ভাটা আসে না। পৃথিবীর সব কিছুই ওরকম। সঠিক সময়ের অপেক্ষায় সকলকেই থাকতে হয়। রাজাকেও থাকতে হয়, ভিখারিকেও থাকতে হয়। সব কিছুই সময়ে হয়। একমুহূর্ত আগেও নয়, একমুহূর্ত পরেও নয়। সুখী মানুষের জন্যও এই নিয়তি নির্ধারিত, দুঃখী মানুষের জন্যও এই নিয়তি নির্ধারিত। যখন হাসার কথা, তখন কাঁদতে চাইলেও কান্না পায় না। যখন কাঁদার কথা, তখন হাসতে চাইলেও হাসি পায় না। সময়ই এই পৃথিবীর একমাত্র নিয়ম, একমাত্র নিয়তি। দশ। একদিন আমি লিখতে চেয়েছিলাম, আমার মনে যা ছিল। দীর্ঘসময় ধরে চেষ্টা করেও কিছুই লিখতে পারলাম না; কাগজ সাদা পড়ে রইল। ওইদিন আমি লিখতে পেরেছিলাম, আমার মনে যা ছিল। এগারো। মাঝে মাঝে ভুলে যাই, আজ তুমি নেই। ঘরে ফেরার পথে সারাক্ষণই অপেক্ষা করতে থাকি, কখন ঘরে ফিরব আর তোমাকে বলব, সারাদিনে কী কী ঘটল। আমাদের শূন্যঘরে ফেরার পর মনে পড়ে, আজ তুমি নেই। বয়স বাড়ছে, তবু তুমি কমছ না। বারো। আমি জানি, তুমি চলে গেছ, আর কখনোই ফিরে আসবে না। তবুও মানুষের ভিড়ে তোমাকেই খুঁজি। বার বার মনে হয়, এই বুঝি তুমি আমাকে দেখে ফিক্ করে হেসে ফেলবে পুরোনো দিনের মতো... আমার ঠোঁটে যত হাসি লেপটে থাকে, তার সবই তুমি। আজও বাঁচতে আমার শুধু তোমাকে লাগে। এ জীবনে এক তুমিই সময়ের চেয়েও বড়ো! তেরো। জীবনে এমন দিনও আসে, যখন হাসতে কষ্ট হয়, বিছানা ছেড়ে উঠতে কষ্ট হয়, খেতে কষ্ট হয়, ঘুমোতে পর্যন্ত কষ্ট হয়। এবং জীবনে এমন দিনও আসবে, যখন কষ্টের দিনগুলির কথা ভেবে তৃপ্তির হাসি পাবে, যখন বেঁচে থাকার জাদুতে বিশ্বাস করতে মন চাইবে। চৌদ্দ। আমি মানুষটা অদ্ভুত। আমি বরাবরই কীরকম মাঝখানে থেকে যাই... আমার নিজেকে লুকিয়ে ফেলতেও ইচ্ছে করে; আবার আমি এ-ও চাই, আমাকে সবাই দেখুক। অনিশ্চিত সব যাত্রা আমাকে টানে; আবার নির্ভার যা-কিছু, তা-ও আমাকে বাঁধে। আমি সব ছেড়েছুড়ে মুক্ত হতে চাই, আবার শেকড়ের টানে স্থির হয়ে থাকি। আমি সেই নদী, যে ক্ষণে ক্ষণেই দিক বদলায়; আবার সেই স্রোতেও আমাকে পাবে, যে আছড়ে পড়ে বিশ্বস্ত কোনও কিনারে। আমি ঘড়ির সেই কাঁটা, যে ঘুরতেই থাকে আজীবন; আবার সেই ঘড়িটিও আমিই, যে স্থির কাঁধে সময়কে এগিয়ে নেয়। পনেরো। সে আমার মনের সমস্ত গোপন কথা একটা একটা করে জেনে নিল। সে নীরবে দেখল আমার ব্যথাগুলি, আমার ক্ষতগুলি, আমার ভুলগুলি। তার পরে সে আমাকে একা রেখে চলে গেল। ষোলো। হয়তোবা দুঃখ অতটা খারাপও নয়। ভালোবাসা ও যন্ত্রণার মধ্যে এক চিরন্তন সেতুবন্ধন এই দুঃখ। মানুষ তো কেবল তার কথা ভেবেই দুঃখ পায়, যাকে ছাড়া বাঁচতে তার খুব কষ্ট হয়। যে থাকা না থাকায় কিছুই এসে যায় না, তার কথা ভেবে কে-ইবা দুঃখ পায়? যদি এমন হয়, আমরা ভালোবাসার মানুষটির কথা যখন ভাবি, তখন দুঃখ পাই, তবে ওই যন্ত্রণাটুকু তো হাসিমুখে মেনে নেওয়াই যায়। সতেরো। হারিয়ে গেছে যা-কিছু। আঘাত এসেছে যতটুকু। মৃত্যুপরবর্তী স্মরণসভা। সমস্ত ব্যস্ততা এবং হুল্লোড়। হঠাৎ নৈঃশব্দ্য এবং তার পরের নৈঃসঙ্গ। যেখানে যা যা ভুল বোঝাবুঝি। জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেবার যত ইচ্ছে। পৃথিবী পৃথিবীর মতোই, যতই যা-কিছু হয়ে যাক...এই বোধ। একদিন এইসব দুঃস্বপ্ন কেটে যাবে...এই স্বপ্ন। যারা চলে যায়, ওরা চিরতরেই হারিয়ে যায়...এই অনুভূতি। কিছু গভীর কষ্ট, কিছু নিবিড় যাতনা। প্রিয় মানুষের খোঁজে প্রতিদিনই হাতড়ে বেড়ানো। অচেনা সময়ের প্রতি নিবেদিত ভয়। এমন কিছু প্রশ্ন, যেগুলির কোনও উত্তর হয় না। লোকের ভিড়েও একা হয়ে থাকা। নিজেকে বোঝানোর অবিশ্রান্ত চেষ্টা। যাকে এ পৃথিবীর কেউই বোঝে না, তার নিজেকে আড়াল করে ফেলার অভিমান। এইসবের নামই দুঃখ। আঠারো। নির্ভর করা যায়, তেমন কেউ আমি নই। আমার শুধুই দেরি হয়ে যায়। আমার সব কিছুই বড্ড এলোমেলো। আমার সারাক্ষণই খুব কান্না পায়। অনেক সময় ধরে ভেবেও কোনও সিদ্ধান্তে আমি আসতে পারি না। আমি এমন এমন কারণে রাগ করি, যা হয়তো তুমি বুঝতেই পারবে না... বুঝবে কোত্থেকে? আমি নিজেই তো বুঝি না! আমি হারিয়ে গিয়েছি। আমার ভেতরের মানুষটা আজ মৃত। আয়নার সামনে আমি ভয়েই আর দাঁড়াই না, কেননা আয়নাও আমার সঙ্গে মিথ্যে বলে। তুমিই বলো, এ-ও কি জীবন? যদি বলো, এ যে দুঃখই কেবল, তবে উত্তর পাবে, হ্যাঁ, আমি দেখতে অবিকল দুঃখের মতন! আমাকে ঠিক এভাবেই গ্রহণ করতে না পারো যদি, তবে কখনও ভালোবাসার দাবিতে কাছে এসো না। উনিশ। যদি জানতে, আমি যা-কিছুই করি, সেখানে কতটা মায়ায় জড়িয়ে থাকো তুমি! খুব ছোটো কোনও কাজ, যা আমি করি; খুব ছোটো কোনও কথা, যা আমি বলি; নিতান্তই তুচ্ছ কিছু, নিতান্তই সাদামাটা কিছু, এরকম যা যা আছে... তার সব কিছুর সাথেই তুমি কোথায় যেন ঠায় থেকে যাও! যদি জানতে, আমি যেখানেই যাই, সেখানেই কী যে মায়ায় তোমাকে সঙ্গে রাখি! বিশ। আমি তোমাকে নিয়ে যা যা ভাবি এবং যা যা অনুভব করি, সেসব দিয়ে আমি কী করব, কোথায় যাব, আমি সত্যিই জানি না। নিজেরই চামড়ার নিচে রক্তের বদলে সমুদ্রকে কীভাবে লুকিয়ে রাখতে হয়, তা আমাকে কেউ কখনও দেখিয়ে দেয়নি। আজ অবধি কেউ আমাকে কখনোই বলে দেয়নি, ভালোবাসলে ডুবতে হয়।