এক। যখন চিঠি লেখা হতো, তখনও কিছু চিঠি লেখা হতো না কখনোই। এখন মেসেজ পাঠানো হয়, তবুও কিছু মেসেজ পাঠানো হয় না কখনোই। যে লিখতে কিংবা পাঠাতে চায় না ওসব চিঠি কিংবা মেসেজ, সে আসলে আড়ালে রেখে দেয় কিছু স্বপ্ন, কিছু অনুভূতি। স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর চিঠি, অনুভূতির চেয়েও সুন্দর মেসেজ পেয়েছে কে কবে? মনের মধ্যে এই যে খেলাটা চলে, তার খোঁজ দ্বিতীয় কেউ রাখে না। সুন্দরতম যা-কিছু, তার সবই নিজেকে রেখে দেয় চোখের আড়ালে। হোক চিঠি, হোক মেসেজ, না-বলা কথার চেয়েও সুন্দর ওদের কেউ কখনও হতে পারে কি? দুই। এখন যখনই দূরে রেখে দূর থেকে দেখি তোমাকে, ভালো লাগে, প্রেম প্রেম লাগে। কাছে রেখে দেখতাম যখন, দেখিনি কখনও সত্যিই তুমি দেখতে কেমন। কাছে না এসে ভালোই করেছ। কাছে এলে প্রেমটা পালায় কামকে রেখে। দূরের বৃষ্টি ঘরে এলে জায়গা কে দেয়? তুমি সুন্দর, দূরে যাবার আগে বুঝিনি। থেকে গেলে দাম থাকে না। চোখের সামনে যখন ছিলে, কষ্ট দিলে চোখ সরাতাম। চোখের আড়ালে এমন না গেলে, কষ্ট না দিলে কি চোখ ঝরাতাম? তিন। তোমাকে দেখার পর কোথা থেকে কোথায় চলেছি, বুঝি না তার কিছুই। শুধু দেখি, নিজের কাছে ক্রমেই অচেনা হচ্ছি। আশ্চর্য লাগে! কখনও পালকের মতন হালকা, কখনওবা পাথরের মতন ভারী। দুটোকেই বয়ে নিতে হয়। এভাবেই বেঁচে আছি। যা যা করে ফেলতে পারছি, তা তা করাও যে যায়, তা-ই ভাবিনি আগে। ভেতরে ভেতরে আমি কি তবে এমনই ছিলাম? কখনও ভাবি, এখন ভালোই তো আছি! কখনও ভাবি, ভালো কি ছিলাম আগেও? তোমাকে দেখার পর ভালো আছি কি না বুঝি না। তোমাকে দেখার আগে খারাপ ছিলাম কি না মনে নেই। চার। দিনগুলি বৃথাই কাটে। একটা, দুইটা, আরেকটা... চলতে থাকে। আয়ুর কোনও স্টপেজ হয় না। দিনের শেষে ভাবি, এক দিনযাপনের গ্লানি বাদে আর কী-ইবা পেলাম? ভাবনা কখনও থামে না। ভাবতে ভাবতে জীবনে আরেকটা দিন ঢুকে পড়ে। এরপর আরেকটা। পুরোনো উটকো জীবনের পেটে নতুন উটকো জীবন। দিন বদলায় না, আফসোস বদলায় না। বয়স বাড়ে, ব্যর্থতা বাড়ে। কী এক বাড়াবাড়ির জীবন! বেঁচে থাকার কোনও মানে নেই জেনেও এই যে বেঁচে আছি আর সাফল্য কি ব্যর্থতা ভেবে ভেবে মগজ পেটাচ্ছি, এমন একটা নিরর্থক আয়ুর জন্যই পৃথিবীর সৌন্দর্যে এই যে অনর্জিত ভাগ... তার চাইতে বেশি কিছু পাবার কথা ছিল কি? পাঁচ। স্পর্শের একটা শক্তি আছে। সেই শক্তির সাম্রাজ্য বিস্তৃত স্পর্শের অতীত সমস্ত নগরেও। প্রথম ছোঁয়া, প্রথম চুম্বন, প্রথম আলিঙ্গন, প্রথম সঙ্গম মানুষকে দ্বিতীয় বার জন্ম দেয়। যার জন্ম হয় না, তার মানুষ হতে অনেক বাকি। যাকে ছুঁতে গেলেই পালিয়ে যায়, তাকে ছুঁয়ে ফেললে আঙুলে শব্দ ঝরে। স্পর্শের আগে ও পরে প্রতিটি মানুষই দু-রকমের। স্পর্শের শক্তি এমনই, এমনকী স্পর্শ করতে না পারার যে বোধ, তা-ও শব্দপ্রসবিনী। কিছু শব্দ কাগজে ঝরে, কিছু শব্দ হৃদয়ে ক্ষরে। স্পর্শ গর্ভধারণ করার অসীম ক্ষমতা রাখে। সেই গর্ভে কারও জন্ম হয়, কারওবা মৃত্যু ঘটে। ছয়। তুমি আমায় একা ফেলে যাবার সময় সঙ্গে রেখে গেছ সময়কে। আমার সেই একাকিত্ব দেখে জ্ঞানী সময় আমায় ছুড়ে মেরেছে অন্ধকারের মধ্যে। সেই অন্ধকারে পথ চলতে চলতে আমি শিখেছি, জীবনে কোথাও আলো নেই। মানুষ যা চেনে, তাকেই আলো ভাবে। আলো বলে কিছু হয় না। অন্ধকারে হাঁটতে শিখে গেলে মানুষের সঙ্গে আলোর দেখা হয়। অন্ধকারে ডুবতে ডুবতেই আমার এই অন্ধকার ছিঁড়তে শেখা... প্রিয়, তোমায় ধন্যবাদ আমায় একা ফেলে চলে যাওনি বলে। সাত। তোমায় যা যা বলতে পারিনি, সেইসব কথা খুব পোড়ায়! দেরি হয়ে গেলে কিছুই আর বলা যায় না। অথচ দেখো, চাইলেই তখন কত কিছুই তো বলা যেত! বলেছি যা-কিছু, তার চাইতে অনেক ভারী বলিনি যা যা। আমরা কেবলই অপেক্ষায় থাকি দেরি হয়ে যাবার। বলতে না পারার যে জ্বালা, তার নামই কি তবে দূরত্ব? আট। প্রিয় মানুষটি দূরে চলে গেলে যেমন শূন্যতা ভর করে, ঠিক তেমন ধরনের শূন্যতা নিয়ে বেঁচে আছি। অথচ যাকে যেতে দিয়েছি, তাকে ধরে রাখিনি সে প্রিয় নয় ভেবেই। মানুষ কি তবে দূরে চলে গেলে প্রিয় হয়ে ওঠে? না কি দূরে গেলে পরেই মানুষ চেনা যায়? যে কাছে এল না এসেও, কেন তাকে রাখি কাছে সব ফেলে দূরে? পাখি উড়ে যায় মায়া ফেলে পিছে... নয়। অপেক্ষায় থাকি, কেউ আসে না। আবারও অপেক্ষায় থাকি... আসার কথা আছে, এমনটা নয় যদিও, তবু তো ইচ্ছে করে, কেউ আসুক! আমিও যে মানুষ! মানুষ হয়ে জন্ম নিলে অনেক অসুবিধে। একলা চলা গেলেও একলা চলা যায় না। পাশে কেউ থাকলে ভালো হতো, এই ভাবনাতে বসবাস করার নাম আয়ু। সময় অবশ্য খারাপ কাটছে না। জীবনে কিছুই করার নেই যার, সে-ই মৃত। আমি আজও বেঁচে আছি। মন বার বার বলে, এই বুঝি কেউ এল...! দশ। ওরা কেউ কোনও কথা বলে না। চাঁদের আলো, বিকেলের রৌদ্র, ফুলের গন্ধ, বিচ্ছেদের দাগ, প্রেমের আবেশ, হাওয়ার পরশ... বলে না কিছুই। এইসব নির্বাকদের দিয়ে কথা বলায় যে, তার কণ্ঠস্বর রোধ করে স্বর্গ পেতে আজ মরিয়া সবাই। এ কি ঈর্ষা? না কি জয়? এগারো। বন্ধ জানলার তোয়াক্কা না করেই ফড়িংটা দরোজা দিয়ে ঘরে ঢুকল। কিছুক্ষণ ওড়াউড়ি মনের আনন্দে; তারপর এখানে বসে, ওখানে বসে। সেই ঘরের প্রেমে পড়ে যায়, তাই আর বেরোতে পারে না। হঠাৎ ফ্যানের ব্লেডের ঘায়ে সেই ঘরেই শেষ আশ্রয়, যে ঘর থেকে সে বেরোতে পারেনি, কিংবা চায়নি। ফড়িংটাকে মরতে দেখে কী ভেবে যেন আয়না দেখি! বারো। আমি সেই বুনোফুলের মতন, যে কোনও পুজোয় লাগে না, যে কোনও ফুলদানিতে আশ্রয় পায় না, যে কোনও লোকের আদর পায় না, যার কোনও নাম নেই, পরিচয় নেই, তবু যে ফুটে চলে বিধাতার খেয়ালে, তবু যে দুলে চলে নিজের আনন্দে। তেরো। ইদানীং প্রত্যাখ্যাত হতে ভয় লাগে। বুঝতে পারি, বয়স বেড়েছে যত, অভিমান বেড়েছে ততোধিক। কে দূরে ঠেলল, কে কাছে টানল, কে এসবের করল না কিছুই, মনে আসছে কেন এই বয়সেও? জীবনের ক্রমাগত প্রত্যাখ্যানেই যার আয়ুর হিসেব, তার কীসের অত ভয় জীবনের যে-কোনও যাপনে? আবেগ ও অনুভূতি কাঁদায় যাকে, তার জীবনে শীত এসে চলে যায়, বসন্ত এসে চলে যায়; তবু তার বয়স স্থির থাকে ষোলোতে। চৌদ্দ। যে গান গেয়েছিলাম শুধুই তোমার জন্য, তা শোনার সময় হয়নি যখন, তখন কেন এলে সে গান শুনে যে গান গেয়েছি ভুলতে তোমাকে? পনেরো। ভালো যা বেসেছ, তা ভাসা-ভাসা। নিজেও জানো না, আদৌ বেসেছ কি না। যখন একা লাগে, যখন কাউকে লাগে, যখন আঁধার নামে, তখন আমাকে ভাবো। ভালোবাসো, এমনটা খুব করে দাবি করলেও আমি বুঝতে পারি, আমি নিছকই তোমার এক গোপন জীবন। ষোলো। মুখের রেখাগুলি আঁকাবাঁকা, দুষ্পাঠ্য। বরাবরের মতোই ঘামে ভেজা সেই মানচিত্র। রেখায় রেখায় জীবনের কিছু প্রাপ্তি, মৃত্যুর কিছু ভার। দৃষ্টিতে গভীরতা; সেখানে তৃপ্তির বদলে দিনশেষে মেনে নেবার বাধ্যতা। বোঝা টানতে টানতে বোঝা হয়ে যায় নিজেই বোঝা হয়ে বেঁচে থাকতে। এমন মানুষের নাম বাবা। সতেরো। দেখলাম, মানুষ বদলায়; দিনের পর দিন বদলাতেই থাকে। নানান রং ও ঢং এসে মানুষের গায়ে ভর করে। প্রশ্ন করি না, শুধুই বিস্মিত হই নীরবে। কৈফিয়তের মানে যখন প্রস্থান, তখন প্রশ্নহীনতাই একমাত্র উত্তর। মানুষটাকে বুঝতে না দিয়েই মানুষটার সঙ্গে একা একা থাকার নাম প্রেম নয়, অভিনয়ও নয়, অভিমান। অগভীর আয়ুর মতন ভালোবাসা বেঁচে থাকে শুধুই অভিমানে। আঠারো। তোমার ডাকে ঘর ছেড়ে বাইরে এলাম। এসে দেখি, যার ডাকে ঘর ছেড়েছি, সে পালিয়ে গেছে, রেখে গেছে ভুল কাউকে। মানুষ বোধ হয় মানুষ থাকে ততক্ষণই, যখন অন্য মানুষ ঘর না ছাড়ে। ঘর ছেড়েছি, আর অমনিই দেখি, যাকে আমি ঘর ভেবেছি, সে-ই আমায় পর করেছে সবার আগে। উনিশ। কিছু মানুষ কখনও কোনও কাজে আসে না। কাজের সময় যতই খুঁজুন, ওদের পাবেন না। তারা যখন চায়, তাদের কাজে আসি, তাদের কাজ করে দিই, তখন সেই চাওয়া কোনও কাজে আসে না। বিশ। এসো, একদিন গল্প করি। আমরা দু-জন দু-জনকে ভালোবেসেছি, দু-জন দু-জনের পাশে থেকেছি, কিন্তু আমাদের কখনও গল্প করা হয়নি। এসো, একদিন পরিচিত হই।