কবিতার মতো সত্য: ২

এক। ভালোবাসার মানুষটা
আজ অনেক দূরে।

তবু এক সে বাদে
কিছুই আর নেই কাছে।

মানুষটা এখানে থাকে না,
অনেক দূরে থাকে।
আমিও এখানে থাকি না,
অনেক দূরে থাকি।

দুই। চোখ দিয়ে ছুঁয়েছি যতটা,
মন দিয়ে ছুঁয়েছি ততোধিক,
... তুমি যার বোঝোনি কিছুই!

হ্যাঁ, এমন‌ই তো হবার কথা ছিল!

তিন। যে রাজা তোমার কপালে নেই,
যদি সারাক্ষণই কেঁদে মরো তার রানি হবার আশায়,
তবে নিশ্চিতভাবেই জেনো,
তুমি হারাবে তাকে,
যে খুব সহজেই রাজা হয়ে উঠত,
যদি তুমি তার রানি হতে।

চার। যার বেয়াদবি দেখে
ব্লক করে দিই,
ফিরে আসে সে-ই
ফেইক আইডিতে;
ওয়ালে এসে
মেজাজ দেখায় গরম।

দেখি আর ভাবি,
বেচারা কেবল
বেয়াদব‌ই নয়,
তদুপরি বেশরম!

পাঁচ। কখনও কখনও,
ফুলটাও খুব সাবধানে ফোটে;
এতটাই সাবধানে...
যেন প্রস্ফুটিত হবার চাইতে
বড়ো পাপ আর নেই!

ভাবে,
কুঁড়ি থাকতেই যদি
মরে যাওয়া যেত,
তবে আর থাকত না ভয়
পদপিষ্ট হবার!

সৌন্দর্যের পাপেই
ফুলের নিয়তি
জুতোর তলায়!

ছয়। পরে খাবে ভেবে
ফ্রিজে যে আইসক্রিম
রেখে দিয়েছিলে,
তা আমি
গতকাল মধ্যরাতে
খেয়ে ফেলেছি।

জিভে ঠোঁটে দাঁতে
গলতে গলতে
ক্রমাগত উষ্ণ হবার
প্রতীক্ষায়-থাকা
আইসক্রিমকে
অমন হিমশীতল
রেখে দেবার
কী মানে?

আমায় ক্ষমা কোরো।
তোমায় ধন্যবাদ,
আইসক্রিমটা
দারুণ ছিল!

সাত। যে-কোন‌ও কিছু দেখতে চাইলে
সবার আগে তা নিয়ে জানতে হয়।
অনেকক্ষণ ধরে তা দেখতে হয়;
এবং সবচাইতে জরুরি যা:
নিজেকে ঠিক সে জায়গাতেই বসাতে হয়,
যা আমি সত্যিই দেখতে চাইছি।

দু-চোখ ভরে সবুজ তো কেবল ওরাই দেখতে পারে,
যারা সেই সবুজের মধ্যে নিজেকে বাঁধতে পারে।
ঈশ্বরকে অনুভব করতে চাইলে
নিজের হৃদয়ে ঈশ্বরকে রাখতে জানতে হয়।
নীরবতা উপভোগ করতে চাইলে
নিজেকে নীরব করতে হয় সবার আগে।

শান্তির খোঁজে হাঁটছে যারা,
তারা যেন নিজেকে রাখে শুধু সেখানেই,
যেখান থেকে শান্তি মেলে।
শান্তির উৎস থেকে দূরে সরে থেকে
নিজেকে শান্ত রাখা যায় কি আদৌ?

আট। এখানে আর নয়!
এই অমানুষের সঙ্গে আর নয়!
এত অপমান, এত কষ্ট সহ্য করা যায়?

ফিরে যাবার রাস্তা খোলা তো থাকে বরাবরই!
সব কিছু ছাড়তে ছাড়তে
আজ প্রাণটাও ছাড়ার সময় সমাগত!
এভাবেও বাঁচা যায়? আর কত?

হঠাৎ বাচ্চাটার ঘুম ভেঙে যায়।
হঠাৎ তার সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

এই হঠাৎ-টাই ঘটে হররোজ!

নয়। যাকে ভালো লাগে,
কোনও এক মেঘলা বিকেলেও
তাকে তা বলতেই যদি না পারি,
তবে আমার আর গাছের মধ্যে
তফাতটা কোথায়?

হ্যাঁ, তফাত তো আছেই!
দু-জনের প্রাণ থাকলেও
আমি হাঁটতে পারি,
গাছ যা পারে না।

দশ। যা-কিছু হারিয়ে ফেলি,
তা-কিছুই আগলে রাখি
সবচে অধিক যতনে।

ফিরে আসবে না যা আর,
তা-ই ফিরিয়ে আনি প্রতিদিনই,
সব‌ পিছে ফেলে, বারে বার।

নতুন যা আসতে চায়,
তার দিকে ফিরেও না চাই,
আঁকড়ে ধরে পুরাতনে।

তাই তো আমি একলাই র‌ই,
যা আমার নয়, তা-ও সই,
রাখি যেটুক, তা বিগতের‌ই অবয়বে।

এগারো। চোখের জলে মানুষ চেনা যায়।
চোখের জলের ফোঁটায় ফোঁটায় থাকে
মানুষের সমস্ত পুণ্যের হিসেব।

রাতে যখন ঘুম ভেঙে যায় শেয়ালদের সভা শুরু হলে,
তখন নিঃশব্দে ঝরে
বিগত পুণ্যের দীর্ঘশ্বাস, অকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত।

মশারির ফাঁকে ফাঁকে আটকে যায়
একেকটা রাতের ইতিহাস।
সেখানে অপরিমেয় দূরত্বে স্তব্ধ হয়ে বসে রয়
কত অকেজো স্বপ্ন, ব্যর্থতার দূষণ!

কান্না গেলার ধরন দেখে মানুষ চেনা যায়।
কান্নায় কান্নায় লেপটে থাকে যন্ত্রণার মাতৃপরিচয়।

বারো। যতটুকু ভালোবাসো, ততটুকুই দেখাও।
দেখাতে না পারো যদি,
তবে নিবৃত্ত হ‌ও, মনকে জোর কোরো না।

ওভাবে হয় না।
যে বোঝার, সে বুঝে নেবে।
না যদি বোঝে, তবে
তাকে আটকে রাখার চেষ্টা কোরো না।
ব্যর্থ হবে, আয়ুর সঙ্গে অহেতুক কলহ বাড়বে।

ভালোবাসা কোনও স্বেচ্ছাসেবী হবার আসর নয়।
চিতায় ওঠার আগে জীবনের স্বাদ যদি
না-ও জোটে ভাগ্যে, তবু বুক চাপড়ে চাপড়ে কেঁদো না
ভালোবাসা পাওনি বলে।
সবার মতো বাঁচতে পারোনি,
সবার মতো মরতে তো পারবে!
এ-ওবা কম কীসে?

যে ভালোবাসা পায়নি,
তার কেঁদেও-বা কী হয়?
কে তার চোখের জল মুছে দেয়?

কেউ এল না যখন,
তখন কাজ কী হবে যদি
একাকিত্বে শুকিয়েও মরো?

চোখদুটোকে বিশ্রাম দাও,
ঠোঁটদুটোকে বিশ্রামে রাখো।
মরার সময় চোখ বুজতে যে চোখ লাগে!
মরার আগে ঠোঁট ভেজাতে যে ঠোঁট লাগে!

তেরো। গোটা একটা জীবন ভুলেই কাটল!
যেভাবে কথা বলো, যেভাবে হাসো, যেভাবে ভালোবাসো,
তার কিছুই আসে না আমার লেখার খাতায়।

যা যা বলে চলো,
যা যা করে চলো,
যা যা আগলে রাখো,
যা যা মাথায় রাখো,
তার কিছুই লাগে না
আমার নিজস্ব যাপনে।

যখন কাঁদো, তখন দেখি,
তোমার অশ্রুতে যে নুন,
তা আমার অপরিচিত।

যার চোখের জলে
আমার কিছুই যায় না এসে,
তার সঙ্গেই কাটছে জীবন!

যে ঘরে থাকি,
সে ঘর থেকেই
নিজেকে বাঁচিয়ে চলি।
এত সতর্ক হয়ে বাঁচা যায়?

এইভাবে বাঁচা!
সেই আশ্রয়ে ফিরতে হ‌ওয়া
যে আশ্রয়ে আমি ফিরি না আদৌ।

নিজের গলা নিজেই ধরি চেপে।
তারপর মতামত দিই
জীবন কেমন কাটছে, জীবনের অর্থ কীরকম, জীবন কতটা সুন্দর...
আরও কত-কী নিয়ে!

চৌদ্দ। রৌদ্রে রৌদ্রে
পাতারা সবাই
সম্পর্ক গড়ে।

একফালি রোদ
একপাতা ছেড়ে
আরেক পাতায়।

পাতায় পাতায়
সখ্য পাতে
রোদের সুতোয়।

এ জগতে
আছে যা-কিছু,
সখ্য‌ই কেবল
থাকে বেঁচেবর্তে।

হাওয়ায় হাওয়ায়
রোদের দোল,
গাছে গাছে
ঠাসবুনোটের রোল।

পাতায় ডালে
দূরত্ব ভাঙে
আলোর পোশাকে
ফালি-ফালি রোদ।

পনেরো। মাঝে মাঝে
মনের মধ্যে ঢুকে পড়ি।
দেখি, সেখানে তুমি নেই।

মাঝে মাঝে
মগজের মধ্যে ঢুকে পড়ি।
দেখি, সেখানে আমি নেই।

মাঝে মাঝে
জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়ি।
দেখি, সেখানে জীবন নেই।

মাঝে মাঝে
মৃত্যুর মধ্যে ঢুকে পড়ি।
দেখি, সেখানে কেউই নেই।

এরপর ভাবি,
আমি তবে এ কাদের নিয়ে আছি?

ষোলো। একটুকরো জীবন।
একটুকরো নদী।
একলা থাকার দুপুর।
এই তো আমি!

পৃথিবীর সব রূপ, রস, গন্ধ
ফিরিয়ে দিয়ে
আমি নিজের সঙ্গে বাঁচি।

একটুখানি মানুষ আমি,
থাকতে গেলে
জায়গা লাগে অল্প।
তবু আমায় রাখার
জায়গা কারুর নেই।

বস্তুত আমি একা নই,
আমি আমার সঙ্গে জড়িয়ে থাকি।
আমি অনন্য‌ও ন‌ই,
আমি একলা মানুষদের মতোই।

যে একা, সে আলাদা কিছু নয়।
একারা সবাই এক‌ই রকমের,
এবং ওদের সবার‌ই ধারণা,
সে সবার থেকে আলাদা।

আমার আশেপাশে যারা আছে,
আমি ওদের কারুর‌ই ন‌ই,
ওদের কেউই আমার নয়।
আমি মানুষের ভিড়ে একা...

সতেরো। জন্ম নেবার জন্য ছটফট করে দুঃখ,
সুখেরা অবসরে যায় মৃত্যু হবার আগেই।
সেই প্রসববেদনায় কিছু অজুহাত এসে জোটে,
স্তূপ স্তূপ কষ্ট অমনিই পেরোয় কী অবলীলায়!

পৃথিবীর সীমা বদলে গেছে বুঝি,
তাই আজ ছুটে পালানোর পথ
হারিয়ে গিয়েছে পথে।

আমার এই জীবনের সমস্ত ক্রোধ
এসে জল হয়ে রয় সময়ের হিমে।

আজ আমি ছায়া হয়ে ছায়ার খোঁজে মরি।

আঠারো। হঠাৎ অমন করে চলে গেলে!
হঠাৎ থেমে গেল পুরোনো আদর, অভ্যেস, আহ্লাদ!
আমি ক্রমশই ডুবে যেতে লাগলাম গভীর শব্দহীনতায়।
সেই ডুবে যাবার পথে-পথে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছিলাম
কষ্টের একেকটি পাথর, যেন ফিরতে পারি।

কোথা থেকে তীব্র এক জলস্রোত এল, আর অমনিই
কোথায় যেন ভেসে গেল পাথরের প্রতিটি টুকরো।
এখন আমি ফিরি কী করে?

নিজেকে আজ আর চিনতে পারি না।
আমার চেহারার শেষ চিহ্নগুলিও আজ
হারিয়ে গেছে!

উনিশ। যে থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে নিত্য অভ্যেসে,
তাকে ফেলে ছোটে লোকে
সেই নতুন টানে, যে টানের উৎস
সমাজের বিপরীতে, উলটো ধারায়।

পুরোনো মানুষ ভাত পায় না,
নতুন মানুষ বিরিয়ানি খায়।

এ কি ভ্রম, না কি সুখের‌ই আসল ঠাঁই,
তা নিয়ে অল্প ভেবে লোকে অবশেষে
সমর্পিত হয় নতুনের গোপন কোলে, যদি
সেই নতুন না-ও হয় পুরাতনের নখের‌ও তুল্য!

বিশ। ফিরে আসে। সে ফিরে ফিরে আসে।
সন্ধে নামলে কাজের শেষে লোকে ঘরে ফেরে যেভাবে,
সমস্ত দিনের ক্লান্তি ঝরাতে পাখি নীড়ে ফেরে যেভাবে,
সেভাবে নয়, একটুও সেভাবে নয়।

সে ফিরে আসে মায়া হয়ে,
সে ফিরে আসে স্মৃতি হয়ে,
সে ফিরে আসে ছায়া হয়ে।

আলো ফুটলে,
আলো নিভলে,
আঁধার কি আলোর
পরোয়া না করেই
সে ফিরে আসে।

ঘরের মেঝেতে তার পায়ের আওয়াজ পাই।
জানালার হাওয়ায় তার গায়ের ঘ্রাণ পাই।
বিছানার চাদরে তার শরীরের মানচিত্র পাই।
রোদে বৃষ্টিতে শীতে তার স্পর্শ খুব টের পাই।

আজ সব মুছে গেছে।
সব‌ই অতীত, সব‌ই বিগত।
তবু সে ঠিকই ফিরে আসে
মায়া হয়ে, স্বস্তি হয়ে, ঠাঁই হয়ে।