রাধাতত্ত্ব (আদিপর্ব)

শ্রীমদ্‌ভাগবতের টীকার শুরুতে পূজ্যপাদ শ্রীধরস্বামী বললেন, “এই মহাপুরাণ শ্রীমদ্‌ভাগবত—বেদান্তের ভাষ্য।” এ কথা হতে বুঝতে হবে: প্রথমে তত্ত্ব, তারপর লীলা। পৌরাণিক ঋষি সমাধিস্থ হয়ে তাঁর বর্ণনীয় সকল ব্যাপার জগতে প্রচার করেছেন—আমাদেরকে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে বর্ণিত ব্যাপারসমূহ বুঝতে হবে। শ্রীমদ্‌ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ বললেন, আমার জন্ম ও কর্ম, দুই-ই দিব্য—অপ্রাকৃত ও অলৌকিক; অতএব, এটা তত্ত্বতই বুঝতে হবে।




পুরাণসমূহে যে-সমস্ত ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, তার সবগুলি যে এক শ্রেণীর ঘটনা নয়, তা পুরাণ পড়লেই বোঝা যায়। অনেক পুরাণেই নন্দ, মহাপদ্ম, মৌর্য, চন্দ্রগুপ্ত, বিন্দুসার, অশোক, পুষ্পমিত্র, পুলিমান, শকরাজগণ, অন্ধ্ররাজগণ প্রভৃতি রাজার কথা আছে, পরবর্তীকালের ঐতিহাসিক আরও অনেক ব্যক্তির নামও আছে। এসব নাম ও ঘটনা, সাধারণ ঐতিহাসিক ঘটনারূপেই বিবেচিত হবে। এ তো গেল সাধারণ ঘটনা। এ নিয়ে কোনো গোলমাল নেই। কিন্তু অন্যান্য দ্বীপ বা অন্যান্য মন্বন্তরের অনেক ঘটনাও পুরাণে বর্ণিত হয়েছে, সেই ঘটনাগুলি বোঝার সময় আমাদের কল্পনাশক্তি ও চিন্তাশক্তিকে প্রসারিত করতেই হয়।




বিশ্বচরাচর আজ যে-অবস্থায় রয়েছে, চিরকাল সে অবস্থায় ছিল না; প্রাণশক্তি বা মননশক্তির ক্রিয়া আজ যে-প্রকারে সাধিত হচ্ছে, দশলক্ষ বা দু-কোটি বছর আগে ঠিক সে প্রকারে হতো না। জম্বুদ্বীপের জীবন, আর প্লক্ষদ্বীপের জীবন—একই রকমের নয়, একই দ্বীপের ভিন্ন ভিন্ন কালের মধ্যেই কত বিভিন্নতা। এসব প্রাথমিক বিষয় কিছু কিছু জানা থাকলে, এই দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্যাপারগুলির ভেতরের রহস্য কিছু কিছু ধরতে পারা যায়।




এটা ছাড়াও আর এক শ্রেণীর ঘটনা পুরাণে বর্ণিত হয়েছে, সেগুলিই প্রকৃত প্রস্তাবে 'লীলা'। এই ঘটনাগুলির নায়ক শ্রীভগবান স্বয়ং। এগুলি 'রহস্য' নামে পরিচিত। এই ঘটনাগুলি ঠিকমতো বুঝলে শ্রীভগবানকেই বুঝতে ও ধরতে পারা যাবে। তাই এগুলি উন্নত সাধনশাস্ত্র ও তত্ত্ববাদের সাহায্যে বুঝতে হবে। যোগশাস্ত্রে, জ্ঞানশাস্ত্রে, ভক্তিশাস্ত্রে যে-সকল চরম ও পরমতত্ত্ব কথিত হয়েছে, তা আমরা যে-পরিমাণে আয়ত্ত করতে পারব, এই 'লীলা' আমরা ঠিক সেই পরিমাণেই আস্বাদন করতে পারব।




পুরাণে শ্রীভগবানের অনেক লীলা বর্ণিত হয়েছে, তার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণলীলা, বিশেষত শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা সবচাইতে গভীর ও মধুর এবং এ কারণেই এটা বোঝা আমাদের পক্ষে কঠিন। আবার এই বৃন্দাবনলীলায় শ্রীরাধাতত্ত্বই সবচাইতে গুহ্য। তত্ত্ব না জেনে, তত্ত্বের সাহায্যে হৃদয় মার্জিত না করে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ বা গীতগোবিন্দ প্রভৃতি নিগূঢ় গ্রন্থ তাড়াহুড়ো করে আলোচনা করলে মূলরসটাই পাওয়া যাবে না এবং প্রাচীন ভারতীয় ঋষি-উপলব্ধ সাধনশাস্ত্রের প্রতি অবিচার করা হবে।




ঋগ্‌বেদের পুরুষসূক্ত অনেকেরই পরিচিত। শ্রীরাধাকৃষ্ণতত্ত্ব ও শ্রীকৃষ্ণলীলা ভালো করে বুঝতে হলে এই পুরুষসূক্তের আলোচনা করা আবশ্যক। সেই পুরুষের পরিচয়ে বৈদিক ও পৌরাণিক সাহিত্য পরিপূর্ণ, শ্রীমদ্‌ভগবদগীতাতেও এই পুরুষের কথা আছে। ঋগ্‌বেদে আমরা তাঁর এমন পরিচয় পাই—




সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ।
স ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বা অত্যতিষ্ঠ দশাঙ্গুলম্।।
(ঋগ্‌বেদ, ১০/৯০/১)




শব্দার্থ: (সহস্রশীর্ষা) সকল প্রাণীর অসংখ্য মস্তক যাঁর মধ্যে স্থিত [অথবা যিনি সর্বজ্ঞ] (সহস্রাক্ষঃ) সকল প্রাণীর অসংখ্য চক্ষু যাঁর মধ্যে স্থিত [অথবা যিনি সর্বদ্রষ্টা] (সহস্রপাৎ) সকল প্রাণীর অসংখ্য চরণ যাঁর মধ্যে স্থিত [অথবা যিনি সর্বগত অর্থাৎ সর্বত্র উপস্থিত] (সঃ) তিনি (পুরুষঃ) পূর্ণ পরমাত্মা (ভূমিম্) সম্পূর্ণ জগতের (বিশ্বতঃ) সর্বদিকে (বৃত্বা) ব্যাপ্ত হয়ে (দশাঙ্গুলম্) দশাঙ্গুল [অর্থাৎ পঞ্চস্থূলভূত এবং পঞ্চসূক্ষ্মভূত সম্পন্ন জগৎকে] (অত্যতিষ্ঠ) উল্লঙ্ঘন করে [অনন্ত অসীমে] স্থিত। [এই সমগ্র জগতের ভেতর এবং বাইরেও তিনি পূর্ণরূপে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন]।




সরলার্থ: তাঁর মস্তকাদি অবয়ব অসংখ্য, চক্ষুরাদি জ্ঞানেন্দ্রিয় অসংখ্য, পদাদি কর্মেন্দ্রিয় অসংখ্য। এই প্রকারের বিরাট পুরুষ ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপ্ত করে আছেন। তিনি আবার মানুষের নাভিপ্রদেশ হতে দশাঙুল পরিমিত স্থান অতিক্রম করে হৃদয়ে অবস্থান করছেন।




ভাবার্থ: এই মন্ত্রে 'পুরুষ' শব্দে বিশেষ্য এবং অপর সমস্ত পদ তাঁরই বিশেষণরূপে বর্ণিত হয়েছে। যিনি সমগ্র জগতে পূর্ণভাবে বিদ্যমান আছেন, তাঁকেই 'পুরুষ' বলা হয়। 'পুর' শব্দাংশটি ব্রহ্মাণ্ড এবং শরীর, এই উভয়ার্থ প্রকাশ করে। অতএব, যিনি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে ব্যাপকরূপে এবং প্রাণীগণের শরীরস্থ জীবাত্মার অন্তরে অন্তর্যামীরূপে বিরাজমান আছেন, তাঁকে 'পুরুষ' বলা হয়। 'সহস্র' শব্দ দ্বারা ‘হাজার’ নয়, বরং ‘অসংখ্য’ বা ‘বহুসংখ্যক’ বোঝায়। এজন্য যাঁর মধ্যে জগতের সমস্ত প্রাণীর অসংখ্য শির, নেত্র, পদ ইত্যাদি স্থিত রয়েছে অথবা যিনি সর্বজ্ঞ, সর্বদ্রষ্টা এবং সর্বগত, তাঁকে সহস্রশীর্ষা, সহস্রাক্ষ ও সহস্রপাৎ বলা হয়। আকাশের মধ্যে (ব্যাপকতায়) যেমন সমস্ত পদার্থ রয়েছে, অথচ সেই আকাশ সমস্ত পদার্থ থেকে পৃথক—পরমাত্মাকেও তেমনই জানবে। এই মন্ত্রে 'দশাঙ্গুল' শব্দ ব্রহ্মাণ্ড এবং হৃদয়বাচী। এক্ষেত্রে 'অঙ্গুলি' শব্দ অঙ্গের অবয়ববাচী। পঞ্চস্থূলভূত (মৃত্তিকা, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ) এবং পঞ্চসূক্ষ্মভূত (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ)— এই দুই প্রকার ভূত মিলিত হয়ে ব্রহ্মাণ্ডের অবয়ব নির্মিত হয়, সেজন্য ব্রহ্মাণ্ডকে 'দশাঙ্গুল' বলা হয়েছে। অপরপক্ষে পঞ্চপ্রাণ (প্রাণ, আপন, উদান, ব্যান ও সমান), মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহংকার—এই নয় প্রকার পদার্থ এবং দশমটি হৃদয়স্থ জীবাত্মা— এগুলোকেও 'দশাঙ্গুল' শব্দের অর্থরূপে গ্রহণ করা যায়। পরমেশ্বর উপরোক্ত দশাঙ্গুল স্থানকে অর্থাৎ সম্পূর্ণ চরাচর-জগৎকে উল্লঙ্ঘন করে সর্বত্র স্থিরভাবে বিরাজিত।




‘পুরুষ’ শব্দটির ধাত্বার্থক অর্থই হলো 'পূর্ণ'। অন্তঃপুরুষ পরমাত্মাকে ‘পুরুষ’ এজন্য বলা হয় যে, তিনি সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডকে নিজের সত্তা দ্বারা পূর্ণ করে আছেন। নিরুক্তে 'পুরুষ' শব্দের ব্যাখ্যা দিয়ে উদাহরণস্বরূপ যাস্কাচার্য তৈত্তিরীয় আরণ্যক ১০/১০/২৩ তথা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ৩/৭ মন্ত্রটি উল্লেখ করে প্রমাণ দেখিয়েছেন যে, "পুরুষ হলেন সর্বব্যাপী পরমেশ্বর"।




পুরুষ এবেদং সর্ব্বং যদ ভূতং যচ্চ ভাব্যম।
উতামৃত্ত্বস্যেশানো যদন্নেনাতিরোহতি।।
(ঋগ্‌বেদ, ১০/৯০/২)




অর্থ: যা উৎপন্ন হয়েছে, যা উৎপন্ন হবে—এ সব কিছুই পুরুষ [পুরুষাধিষ্ঠিত] এবং অমৃতস্বরূপ মোক্ষের স্বামী, যা অন্ন (খাদ্য) দ্বারা বৃদ্ধি পায় [তারও স্বামী]।




বলতে গেলে, ভূত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান সমস্তই এই পুরুষ। ইনিই মোক্ষের মহান অধিপতি। অন্নের বা খাদ্যের সাহায্যে যা-কিছু পরিবর্ধিত হয়, ইনি তার সব কিছুরই অধিপতি।




এতাবানস্য মহিমাতো জ্যায়াংশ্চ পুরুষঃ।
পাদোস্য বিশ্বা ভূতানি ত্রিপাদস্যামৃতং দিবি।।
(ঋগ্‌বেদ, ১০/৯০/৩)




অর্থ: এই জগতের মহান সামর্থ্য এতই যে, এবং এই পরমেশ্বর তা থেকেও অধিক বড়ো। সমস্ত উৎপন্ন পদার্থ এঁর এক পাদ [একাংশে স্থিত]। এঁর তিন পাদ জ্ঞান প্রকাশস্বরূপ অবিনাশী।




এ সবই তাঁর মহিমা, কিন্তু তিনি এ সকল হতে শ্রেষ্ঠ। বিশ্বভূতগ্রাম তাঁর একপাদ, আর ত্রিপাদ অমৃতস্বরূপ।




বেদ বলেন, সৃষ্টির প্রকাশ হয়েছিল হিরণ্যগর্ভ নামক এক মহাজাগতিক অণ্ড বা ডিম স্বরূপ আদিগর্ভ থেকে, যার মাঝে সমস্ত কিছু সুপ্ত অবস্থায় ছিল। এটি ব্রহ্মাণ্ড নামেও পরিচিত। ঋগ্‌বেদের সূক্তে বর্ণনা করা হয়েছে, পুরুষের ‘বিরাট’ নামক বিশ্বরূপ হলো সৃষ্টির উৎস। বিরাটের মধ্যে সর্বব্যাপী জ্ঞানের আবির্ভাব ঘটে এবং বিরাট থেকে বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়। পুরুষ হতে বিরাট জন্মেছিলেন, আর বিরাট হতে এলেন অধিপুরুষ বা পরমেশ্বর। সেই অধিপুরুষ দেবতা, তির্যক (বা মানুষ বাদে অন্যান্য প্রাণী), মানুষের রূপ ধারণ করলেন, তারপর পঞ্চভূত ও জীবশরীরাদির সৃষ্টি হলো।




ঋগ্‌বেদে যে-পুরুষের কথা পাওয়া যায়, তাঁরই কথা উপনিষদগুলিতেও কীর্তিত হয়েছে।




যঃ পৃথিব্যাং তিষ্ঠন্ পৃথিব্যা অন্তরো যং পৃথিবী ন বেদ।
যস্য পৃথিবী শরীরং যঃ পৃথিবীমন্তরো যময়ত্যেষ ত আত্মা অন্তর্যামী, অমৃতঃ।।
(বৃহদারণ্যকোনিষদ, ৩/৭/৩)




অর্থ: যিনি পৃথিবীতে থেকেও পৃথিবী থেকে ভিন্ন, পৃথিবীর অন্তরে থাকলেও পৃথিবী যাঁকে জানে না, স্থূল সূক্ষ্ম সব কিছু নিয়ে পৃথিবী যাঁর শরীর এবং সেই শরীরের অভ্যন্তরে নিত্যজাগরূক থেকে যিনি তাকে নিয়ন্ত্রিত করছেন, তিনিই আপনার আত্মা। তিনিই অন্তর্যামী, অমৃত।




এভাবে তিনি অগ্নিতে, অন্তরিক্ষে, বায়ুতে, আকাশে, সূর্যে, সকল দিকে, চন্দ্র-তারকায়, আকাশে, অন্ধকারে, তেজে আছেন, কিন্তু এদের কেউই তাঁকে জানে না; এরা তাঁরই শরীর, তিনি ভেতরে থেকে এদের বহন করছেন। ইনি আত্মার অন্তর্যামী পুরুষ। বৃহদারণ্যকোনিষদ এঁকে অধিদৈবত বা অন্তর্যামী পুরুষ বলেছেন, কারণ পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু প্রভৃতি দেবতা-সহ সকল ভূতে সেই আত্মার অন্তর্যামী অমৃত পুরুষ পরিব্যাপ্ত রয়েছেন—তিনি তাই অধিভূত পুরুষ। আর প্রাণে, বাক্যে, চক্ষুতে, কর্ণে, মনে, ত্বকে, বিজ্ঞানে (বিশেষ বা আত্মজ্ঞান অর্থে) ও রেতে (বীর্য, শুক্র, পুরুষের দেহের সন্তানোৎপাদক সার পদার্থবিশেষ) তিনি পূর্বোক্ত উপায়ে থেকে কার্য সম্পাদন করছেন বলে তিনি অধ্যাত্ম পুরুষ।




"যো রেতসি তিষ্ঠন্ রেতসোহন্তরো যং রেতো ন বেদ যস্য রেতঃ শরীরং যো রেতোহন্তরো যময়ত্যেষ ত আত্মাহন্তর্যাম্য-মৃতোহদৃষ্টো দ্রষ্টাহশ্রুতঃ শ্রোতাহমতো মন্তাহবিজ্ঞাতো বিজ্ঞাতা নান্যোহতোহস্তি দ্রষ্টা নান্যোহতোহস্তি শ্রোতা নান্যোহতোহস্তি মন্তা নান্যোহতোহস্তি বিজ্ঞাতৈষ ত আত্মাহন্তর্যাম্যমৃতোহতো॥" (বৃহদারণ্যকোনিষদ, ৩/৭/২৩)




রেতসি (শুক্রে, অর্থাৎ জননেন্দ্রিয়ে)। [মহাশক্তিশালী পৃথিব্যাদিদেবতাও কেন আপনাদের অন্তরে অধিষ্ঠিত ও আপনাদের নিয়ন্তা অন্তর্যামীকে জানেন না, তা বলা হচ্ছে]—অদৃষ্টঃ ([স্বয়ং অন্য কারও] দৃষ্টির বিষয়ীভূত নন) [অথচ] দ্রষ্টা ([চক্ষুতে সন্নিহিত চৈতন্যস্বরূপ বলে] সাক্ষী); [এরূপে] অশ্রুতঃ শ্রোতা ([সর্বকর্ণে সন্নিহিত] অলুপ্ত শ্রবণ-শক্তি); অমতঃ (মনঃসঙ্কল্পের অবিষয়) মন্তা (মননকারী); অবিজ্ঞাতঃ (নিশ্চয়ের অবিষয়ীভূত) বিজ্ঞাতা। [কিন্তু তাই বলে পৃথিব্যাদিদেবতা পৃথক ও তাঁদের নিয়ন্তা অন্তর্যামী পৃথক নন; কারণ] অতঃ (এই অন্তর্যামী হতে) অন্যঃ (ভিন্ন) দ্রষ্টা ন অস্তি (নেই); অতঃ অন্যঃ শ্রোতান অন্তি; অতঃ অন্যঃ মন্তা ন অন্তি; অতঃ অন্যঃ বিজ্ঞাতান অস্তি। অন্তর্যামী অমৃতঃ এষঃ (অন্তর্যামী ও অমৃত ইনিই) তে আত্মা [ইত্যাদি—৩/৪/২ দ্রষ্টব্য]।




অর্থ: যিনি জননেন্দ্রিয়ে, অর্থাৎ জননেন্দ্রিয়দেবতার অন্তরবর্তীরূপে থাকেন, জননেন্দ্রিয়দেবতা যাঁকে জানেন না, জননেন্দ্রিয় যাঁর শরীর, যিনি অন্তরবর্তীরূপে থেকে জননেন্দ্রিয়দেবতাকে নিয়ন্ত্রিত করেন, তিনিই অন্তর্যামী ও অমৃত এবং আপনার আত্মা। তিনি অদৃষ্ট হলেও দ্রষ্টা, অশ্রুত হলেও শ্রোতা, মননের অবিষয় হলেও মন্তা, অবিজ্ঞাত হলেও বিজ্ঞাতা। তিনি হতে ভিন্ন কোনো দ্রষ্টা নেই, তিনি হতে ভিন্ন শ্রোতা নেই, তিনি হতে ভিন্ন মন্তা নেই, তিনি (যিনি সাক্ষী, সর্ব-সংসারধর্ম-বর্জিত ও সর্বপ্রাণীর কর্মফল বিভাগের কর্তা) হতে ভিন্ন বিজ্ঞাতা নেই। অন্তর্যামী ও অমৃত ইনিই আপনার আত্মা। ইনি হতে যা-কিছু ভিন্ন, তা বিনাশী।




"স হোবাচোষন্তশ্চাক্রায়ণো যথা বিব্রয়াদসৌ গৌরসাবশ্ব ইত্যেবমেবৈতদ্ ব্যপদিষ্টং ভবতি যদেব সাক্ষাদপরোক্ষাদ্ ব্রহ্ম য আত্মা সর্বান্তরস্তং মে ব্যাচক্ষ্বেত্যেষ ত আত্মা সর্বান্তরঃ কতমো যাজ্ঞবল্ক্য সর্বান্তরঃ। ন দৃষ্টের্দ্রষ্টারং পর্শ্যেন শ্রুতেঃ শ্রোতারং শৃণুয়া ন মতের্মন্তারং মন্বীথা ন বিজ্ঞাতের্বিজ্ঞাতারং বিজানীয়াঃ। এষ ত আত্মা সর্বান্তরোহতোহন্যদার্তং ততো হোষস্তশ্চাক্রায়ণ উপররাম॥" (বৃহদারণ্যকোনিষদ, ৩/৪/২)




সঃ চাক্রায়ণঃ উষস্তঃ উবাচー[কোনো ব্যক্তি] যথা (যেমন) বিব্রয়াৎ ([নিজ প্রতিজ্ঞার] বিপরীতভাবে বলে), "গৌঃ অসৌ (গরু এরূপ), অশ্ব অসৌ (ঘোড়া এরূপ)" ইতি, এতৎ ব্যপদিষ্টম্ ([আপনার] এই বিপরীত নির্দেশটি) এবম্ এব (এরূপই) ভবতি (হলো)। যৎ এব [পূর্ববৎ]। দৃষ্টেঃ ([লৌকিক] দৃষ্টির) দ্রষ্টারম্ (দ্রষ্টাকে, [সাক্ষী আত্মাকে]) ন পশ্যেঃ (দেখতে চাইবেন না, কেউ দেখতে পারেন না); শ্রুতেঃ শ্রোতারম্ (শ্রবণের শ্রোতাকে) ন শৃণুয়াঃ (শুনতে চাইবেন না); মতেঃ (মননের, মনোবৃত্তির) মন্তারম্ (মননকারীকে) ন মন্বীথাঃ (মনন করতে চাইবেন না); বিজ্ঞাতেঃ (বিজ্ঞান-ক্রিয়ার, বুদ্ধিবৃত্তির) বিজ্ঞাতারম্ ন বিজানীয়াঃ (জানতে চাইবেন না)। এষঃ [পূর্ববৎ]। অতঃ অন্যৎ (এই আত্মা হতে ভিন্ন [কার্য বা করণ] সমস্ত) আর্তম্ (বিনাশী, মিথ্যা)।




অর্থ: “…কেউ যেমন (প্রতিজ্ঞার) অননুরূপভাবে বলে, "গরু এরূপ, ঘোড়া এরূপ", আপনার এই বিপরীত নির্দেশটিও সেরূপ হলো। যিনি সাক্ষাৎ অপরোক্ষ ব্রহ্ম, যিনি সর্বান্তর আত্মা, তাঁরই কথা আমায় বিশেষরূপে বলুন।" "সর্বান্তরবর্তী ইনিই আপনার আত্মা।" "যাজ্ঞবল্ক্য, কোনটি সর্বান্তর?" "দৃষ্টির দ্রষ্টাকে কেউ দেখতে পারেন না; শ্রবণের শ্রোতাকে কেউ শুনতে পারেন না; মনোবৃত্তির মননকারীকে কেউ ভাবতে পারেন না; বুদ্ধিবৃত্তির বিজ্ঞাতাকে কেউ জানতে পারেন না। সর্বান্তর ইনিই আপনার আত্মা; তা বাদে সমস্ত বিনাশী।"




তাৎপর্য:




: কেউ সাক্ষাৎভাবে গরু বা ঘোড়ার পরিচয় দেবে বলে যদি পরে বলে, "যে চলে, সে গরু", বা "যে দৌড়ায়, সে ঘোড়া", তবে চলনাদিক্রিয়া অবলম্বনে পরোক্ষ পরিচয়প্রদান যেমন প্রতিজ্ঞার অননুরূপ হয়, তেমনি আপনি সাক্ষাৎভাবে আত্মার পরিচয় না দিয়ে প্রাণক্রিয়াদি অবলম্বনে যে-পরিচয় দিলেন, তা ঠিক হলো না।




: আমি যে-উত্তর দিয়েছি, তা-ই ঠিক। ঘোড়া প্রভৃতিকে যেমন সাক্ষাৎ জ্ঞানের বিষয়াধীন করানো চলে, আত্মাকে সেরূপ করানো চলে না; কারণ যে-দর্শন-শ্রবণাদির দ্বারা বিষয়জ্ঞান হবে, আত্মা সেই দর্শনাদিরই স্বরূপ। সুতরাং তাঁকে আপনি কীসের দ্বারা দেখবেন বা শুনবেন?




দৃষ্টি দুই প্রকার—লৌকিক ও পারমার্থিক। চক্ষুর সাথে সংযুক্ত অন্তঃকরণবৃত্তি-বিশেষকে লৌকিকদৃষ্টি বলে। লৌকিক দৃষ্টি বিষয়াকারে রঞ্জিত হয়, এবং তার উৎপত্তি ও বিনাশ আছে। সেটি পারমার্থিক দৃষ্টির সাথে সংসৃষ্ট আছে বলে বোধ হয়। বস্তুত সেটি আত্মদৃষ্টিরই প্রতিচ্ছায়ামাত্র এবং আত্মদৃষ্টির দ্বারাই সেটি ব্যাপ্ত। আত্মদৃষ্টি কিন্তু আত্মারই স্বরূপ; তার উৎপত্তি বা বিনাশ নেই (৪/৩/২৩)। প্রদীপ যেমন লৌকিক জ্ঞানের দ্বারা প্রকাশ্য, অথচ নিজে ওই জ্ঞানকে প্রকাশ করতে পারে না, তেমনি লৌকিক দৃষ্টি আত্মদৃষ্টির দ্বারা উদ্‌ভাসিত হলেও সে সাক্ষীস্বরূপ ওই দৃষ্টিকে প্রকাশ করতে পারে না। লৌকিক দৃষ্টির সাথে সম্পর্ক ঘটে বলে, অর্থাৎ লৌকিক দৃষ্টি আত্মার দ্বারা ব্যাপ্ত হয় বলে, সাক্ষী আত্মাকে দ্রষ্টা, অদ্রষ্টা ইত্যাদি বলে বোধ হয়; বস্তুত তিনি ক্রিয়াহীন (৪/৩/৭)। শ্রবণ প্রভৃতি সম্বন্ধেও এরূপ বুঝতে হবে। লৌকিক দৃষ্টি প্রভৃতি হতে পৃথক করে নিত্যদৃষ্টিস্বরূপ আত্মাকে বুঝতে হবে।




এরূপে স্থির হলো—আত্মা আছেন এবং তিনি সর্বান্তর, কূটস্থ ও নিত্যজ্ঞানস্বরূপ।




"সুষুপ্তিতে তিনি যে দেখেন না (বলে মনে হয়), তখন তিনি (বস্তুত) দেখেও দেখেন না; কারণ (দ্রষ্টা) অবিনাশী বলে দ্রষ্টার দৃষ্টির বিনাশ নেই; পরন্তু তিনি হতে পৃথক আকারে বিভক্ত সেই দ্বিতীয় বস্তু থাকে না, যা তিনি দেখবেন।" (বৃহদারণ্যকোনিষদ, ৪/৩/২৩)




ব্যাখ্যা: অগ্নি ও অগ্নির প্রকাশ যেমন অভিন্ন, তেমনি আত্মা ও আত্মার জ্যোতি অভিন্ন। বস্তুত দ্রষ্টা হচ্ছেন কূটস্থ (অপরিবর্তনীয়, নিত্য, চিরস্থায়ী) দৃষ্টি। সূর্য ও তাঁর প্রকাশ অভিন্ন হলেও লোকে যেমন মুখে বলে সূর্যকে প্রকাশ করেন, তেমনি জ্ঞানরূপী দ্রষ্টা আত্মা এবং তাঁর দৃষ্টি বা চৈতন্য অভিন্ন হওয়ায় তিনি দর্শনক্রিয়ার কর্তা না হলেও বলা হয়—আত্মা দর্শন করেন। অবিদ্যাবস্থায় জাগরণ ও স্বপ্নে যখন দ্বৈতবস্তুর বোধ হয়, তখন আত্মার বিশেষজ্ঞান হয় বলে মনে হয়; কিন্তু সুষুপ্তিতে তিনি পরমাত্মার সাথে একত্বপ্রাপ্ত হলে দ্বৈতভাব প্রতিরুদ্ধ হওয়ায় তিনি স্বয়ংজ্যোতি হয়েও বিশেষজ্ঞানশূন্য হন।




"আত্মা কোনটি?" "যিনি বুদ্ধিতে উপহিত, ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে অবস্থিত, এবং বুদ্ধির অভ্যন্তরস্থ (স্বয়ং) জ্যোতিপুরুষ। তিনি (বুদ্ধির) সমানাকার হয়েও ইহলোক ও পরলোকের মধ্যে যথাক্রমে বিচরণ করেন, এবং মনে হয়, যেন ধ্যান করেন ও সচল হন, কারণ তিনি স্বপ্নে উপহিত হয়ে অবিদ্যার বিবিধ পরিণামস্বরূপ এই (জাগ্রৎ-কালীন) জগৎকে অতিক্রম করেন।" (বৃহদারণ্যকোনিষদ, ৪/৩/৭)




ব্যাখ্যা:




“সূর্য যেমন আপনার সমজাতীয় বস্তুকেই প্রকাশ করেন, তেমনি হয়তো কোনো একটি ইন্দ্রিয় তার সমজাতীয় অপর ইন্দ্রিয়গুলিকে উদ্‌ভাসিত করে।"—জনক এই ভ্রমে পড়ে বললেন, "ইন্দ্রিয়গুলির মধ্যে কোনটি আত্মা?” অথবা সকল ইন্দ্রিয়ই যখন বিজ্ঞানময় বলে বোধ হচ্ছে, তখন জনকের প্রশ্ন এই—"এই বিজ্ঞানময়দের মধ্যে কোনটি বিজ্ঞানময় আত্মা?"




'বুদ্ধিতে উপহিত' শব্দগুচ্ছ বিকারার্থে ব্যবহৃত হয়নি; কারণ আত্মা বুদ্ধির বিকার নন। দর্পণাদিতে প্রতিবিম্বিত আলোক যেমন দর্পণের আকার ও বর্ণাদি প্রাপ্ত হয়, বুদ্ধিতে উপহিত আত্মাও তেমনি বুদ্ধিসদৃশ হন।




কাচের ভেতরের আলো যেমন কাচ ও তার চারপাশের বস্তুকে জ্যোতির্ময় করে, আত্মজ্যোতিও তেমনি বুদ্ধি, মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয় প্রভৃতিকে সচেতনপ্রায় করে।




অবভাস্য ও অবভাসক অনেক স্থলে পৃথকরূপে প্রতিভাত হয় না; যেমন লাল কাচে প্রতিফলিত আলোককে কাচের রক্তিমা হতে পৃথক করা যায় না। বুদ্ধির সাথে আত্মা এরূপ অভিন্ন হন। বুদ্ধিকে অবভাসিত করে আত্মা বুদ্ধি অবলম্বনে দেহেন্দ্রিয়-সংঘাতকেও অবভাসিত করেন, অর্থাৎ তাদের সমানাকার বলে প্রতিভাত হন।




আত্মাতে ক্রিয়া না থাকলেও বুদ্ধিসাদৃশ্যবশত তাঁতে ক্রিয়া আরোপিত হয়। এরূপে বুদ্ধির সাথে একাত্মতা বা নিবিড় ঐক্য বা অভেদবশত আত্মার স্বপ্ন এবং জাগরণ হয়। জাগরণে যিনি বুদ্ধিকে উদ্‌ভাসিত করেন এবং স্বপ্নেও যিনি জাগ্রত অবস্থার অতীত হয়ে বুদ্ধিকে উদ্‌ভাসিত করেন, তিনি নিশ্চয়ই বুদ্ধি হতে ভিন্ন এবং কর্তৃত্বাদিশূন্য ও শুদ্ধ।




হৃদয়পুণ্ডরীক বুদ্ধির আবাসস্থান। সেখানে থেকে বুদ্ধি ইন্দ্রিয়বর্গকে নিয়ন্ত্রিত করে। এই নিয়ন্ত্রণের জন্য বুদ্ধি আবার জীবের কর্মফলের অধীন। জাগরণকালে বুদ্ধি ওই কর্মবশে শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়কে নাড়ীপথে কর্ণচ্ছিদ্রাদি পর্যন্ত বিস্তৃত করে এবং তারপর তাদেরকে পরিচালিত করে। জীবাত্মা আপনাতে অভিব্যক্ত চৈতন্যের আভাসের দ্বারা ওই বুদ্ধিকে পরিব্যাপ্ত করেন, এবং বুদ্ধি যখন সংকুচিত হয়, তখন জীবও সংকুচিত হন। এটাই জীবের নিদ্রা। জাগরণকালে জীব বুদ্ধির বিকাশ অনুভব করেন—ওটাই জীবের ভোগ। কারণ জলাদির প্রকৃতি অনুযায়ী যেমন চন্দ্রাদির প্রতিবিম্ব হয়ে থাকে, জীবাত্মাও তেমনি সর্বদা স্বরূপে অবস্থিত থাকলেও স্বীয় উপাধি, বুদ্ধি প্রভৃতির অনুসরণ করেন। এরূপে জীব স্বভাবত আপনার আত্মায় বর্তমান থাকলে কর্মানুগামী বুদ্ধির অনুসরণ করেন বলে…"তিনি শরীরে অবস্থান করেন।"—এরূপ বর্ণনা করা হয়। বস্তুত সুষুপ্তিকালে শরীরের সাথে আত্মার সম্বন্ধ নেই, কারণ তিনি "তখন হৃদয়ের সমস্ত শোক বা কাম (ইষ্টবিষয়ক কামনাই ইষ্টবিয়োগ বা ইষ্টের অপ্রাপ্তিতে শোকে পরিণত হয়) অতিক্রম করেন।" (৪/৩/২২) কিন্তু দেহ ছেড়ে অন্য কোথাও যান না; প্রদীপ যেমন এক স্থানে থেকে সব জায়গায় আলোক ছড়ায়, আত্মাও তেমনি হৃদয়ে থেকে সারাশরীর চৈতন্যব্যাপ্ত করে রাখেন।




বৃহদারণ্যকোনিষদ এমন বিভিন্ন প্রকারে সেই অন্তর্যামী পুরুষের কথা বলেছেন। উপনিষদের আলোয় গড়া মানুষ রবীন্দ্রনাথের নিম্নোদ্ধৃত পূজা পর্যায়ের সংগীতটি সেই পুরুষেরই ধ্যানসম্ভূত—




নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে॥




বাসনার বশে মন অবিরত
ধায় দশ দিশে পাগলের মতো,
স্থির-আঁখি তুমি মরমে সতত জাগিছ শয়নে স্বপনে॥




সবাই ছেড়েছে, নাই যার কেহ,
তুমি আছ তার আছে তব স্নেহ—
নিরাশ্রয় জন, পথ যার গেহ, সেও আছে তব ভবনে।




তুমি ছাড়া কেউ সাথি নাই আর,
সমুখে অনন্ত জীবনবিস্তার—
কালপারাবার করিতেছ পার, কেউ নাহি জানে কেমনে॥
জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি,
তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,
যত পাই তোমায় আরো তত যাচি, যত জানি তত জানিনে।
জানি আমি তোমায় পাবো নিরন্তর
লোকলোকান্তরে যুগযুগান্তর—
তুমি আর আমি মাঝে কেউ নাই, কোনো বাধা নাই ভুবনে॥




বৃহদারণ্যকোনিষদেই আছে—




ইদং সত্যং সর্বেষাং ভূতানাং মধ্বস্য সত্যস্য সর্বাণি ভূতানি মধু যশ্চায়মস্মিন্ সত্যে তেজোময়োমৃতময়ঃ পুরুষো যশ্চায়মধ্যাত্মং সাত্যস্তেজোময়োমৃতময়ঃ পুরুষোহয়মেব স যোহয়মাত্মেদমমৃতমিদং ব্রহ্মেদং সর্বম্।। (২/৫/১২)




এই যে সত্য আচাররূপে, যা ধর্মই জেনো হয়,
সর্বভূতের মধুও সর্বভূতও মধু সত্যতে হয়।




সত্যের মাঝে স্থিত সেইজন,
পুরুষরূপী যে পরশ রতন,
মধুময় তিনি এ দেহমধ্যে সমবেত ব্রতী হন,
আচার রূপেতে ধর্মাভিমানী মধুময় চারজন।




সত্য এবং সর্বভূতের মধুময় দুইজন,
পুরুষরূপেতে আর দুইজন মধুময় যাঁরা হন,
এই চারিজনে আত্মাই কয়।




আত্মজ্ঞান অমৃতময়,
ইনিই ব্রহ্ম, এঁরে জানলেই সব কিছু জানা যায়,
ব্রহ্মে পেলে সব পাওয়া যায় সবই হয় মধুময়।




অর্থাৎ, এই সত্য (অর্থাৎ অনুষ্ঠিয়মান, আচাররূপ ধর্ম) সর্বভূতের মধু, সর্বভূত এই সত্যের মধু। এই সত্যে যিনি তেজোময়, অমৃতময় পুরুষ এবং এই যিনি দেহে সমবেত সাত্য (অর্থাৎ আচাররূপ ধর্মে অভিমানী), তেজোময়, অমৃতময় পুরুষ—এঁরাও মধু। এই সত্যাদি চতুষ্টয় তিনিই, যিনি আত্মা (বলে প্রতিজ্ঞাত হয়েছেন)। এই আত্মজ্ঞান অমৃত। ইনি ব্রহ্ম। এই ব্রহ্মজ্ঞানই সব।




ধর্মের মতো সত্যও সামান্যাকারে ও বিশেষাকারে বিভক্ত। সামান্যাকার সত্যটি পৃথিব্যাদিতে সমবেত ক্রিয়াস্বরূপ, এবং বিশেষাকার সত্যটি দেহেন্দ্রিয়ে সমবেত আচার-স্বরূপ; "সত্যেন বায়ুঃ আবাতি"। (মহানারায়ণোপনিষদ, ২২/১)




পুরুষ—অন্তর্যামী পুরুষ—তেজোময়, অমৃতময় পুরুষ, তিনি মধু। তাঁর পর আনন্দ ব্রহ্ম, রস ব্রহ্ম;—এই সমস্ত উপনিষদের বা বেদান্তের তত্ত্ব যাঁরা হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছেন, তাঁদের পক্ষে শ্রীকৃষ্ণের ও শ্রীরাধার তত্ত্ব ও লীলার মধ্যে প্রবেশ করা খুব কঠিন কাজ নয়। কিন্তু বেদান্ত বা উপনিষদের তত্ত্বসমূহ ধ্যানযুক্ত হয়ে যাঁরা হৃদয় দ্বারা গ্রহণ করতে পারেননি, তাঁদের পক্ষে শ্রীরাধাকৃষ্ণের তত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করা কেবল কঠিনই নয়, অসম্ভব বললেই হয়। কেবলই ভক্তির সাহায্যে শ্রীরাধাকৃষ্ণ তত্ত্ব বোঝা যাবে না।




ভগবদ্‌গীতাতে বেদের পুরুষ সম্পর্কে অনেক আলোচনা আছে এবং শ্রীকৃষ্ণকে পুরুষোত্তম বলা হয়েছে। গীতার অষ্টম অধ্যায়ের চতুর্থ শ্লোকের ভাষ্যে পুরুষের সংজ্ঞা লিখতে গিয়ে আচার্য শংকর এভাবে ব্যাখ্যা করছেন—"পুরুষঃ পূর্ণমনেন সর্বমিতি পুরিশয়নাদ্‌ভা পুরুষঃ।" অর্থাৎ "যাঁর দ্বারা সকলই পূর্ণ অথবা যিনি পুরে (ভূতে বা দেহে) শয়ন করেন, তিনি পুরুষ।"




আদিত্যমণ্ডলের অন্তর্বর্তী হিরণ্যগর্ভ অধিদৈবত পুরুষ, তিনি সকল প্রাণির সকল ইন্দ্রিয়কে অনুগ্রহ করে শক্তিযুক্ত করেন। অধিযজ্ঞপুরুষ বিষ্ণু সকল যজ্ঞের অভিমানিনী (গর্বিত) দেবতা। এই সকল শ্রুতিবাক্য শ্রীমদ্‌ভগবদগীতার টীকাভাষ্যে আচার্যগণ বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। শ্রীমদ্‌ভাগবতে পুরুষের যাবতীয় লক্ষণ শ্রীকৃষ্ণে আরোপিত হয়েছে। সুতরাং 'পুরুষ' সম্পর্কে ভালোভাবে আলোচনা করলে শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব বোঝা যাবে এবং শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব বুঝলে শ্রীরাধাতত্ত্ব বোঝা সহজ হবে।




শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে দেখি—




মহান্ প্রভুর্বৈ পুরুষঃ সত্ত্বস্যৈষ প্রবর্তকঃ। সুনির্মলামিমাং প্রাপ্তিমীশানো জ্যোতিরব্যয়ঃ॥ (৩/১২)




এষঃ (ইনি) মহান্ (মহান), প্রভুঃ বৈ (সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়কার্যে অবশ্যই সমর্থ), পুরুষঃ (হৃদয়শায়ী), ইমাম্ সুনির্মলাম্ (এই বিশুদ্ধ পরমপদ) প্রাপ্তিম্ (লাভের প্রতি), সত্ত্বস্য (অন্তঃকরণের) প্রবর্তকঃ (প্রেরয়িতা), ঈশানঃ (ঈশ্বর), জ্যোতিঃ (বিজ্ঞানস্বরূপ), অব্যয়ঃ (অবিনাশী)।




অর্থ: ইনি অবশ্যই মহান, সামর্থ্যশালী, হৃদয়শায়ী, পরমপদপ্রাপ্তির জন্য অন্তঃকরণের প্রেরয়িতা, সর্বাধীশ, বিজ্ঞানপ্রকাশ-স্বরূপ এবং অবিনাশী।




ব্যাখ্যা: নিশ্চয়ই তিনি সমস্ত কিছুর প্রশাসক; মহান প্রভু তথা অবিনাশী এবং প্রকাশস্বরূপ পরমপুরুষ পুরুষোত্তম পূর্বোক্ত এই সুনির্মল প্রাপ্তির প্রতি অর্থাৎ নিজ আনন্দময় বিশুদ্ধস্বরূপ প্রাপ্তির জন্য মানুষের অন্তঃকরণকে প্রেরিত করেন; প্রত্যেক মানুষকে তিনি নিজের দিকে আকৃষ্ট করেন। তথাপি এই মূর্খ জীব সর্বপ্রকার সুযোগ পেয়েও তাঁর প্রেরণানুসারে তাঁকে প্রাপ্তির জন্য তৎপর হয় না।।




তিনিই মহান পুরুষ, পুরুষোত্তম। প্রত্যেক মানুষই অনুভব করে, আমি পুরুষ। আমাদের সাংখ্যদর্শনে বহুপুরুষবাদ স্বীকৃত হয়েছে। কঠোরভাবে দ্বৈতবাদী এ দর্শনের মতে, জগৎ দুটি সত্যের দ্বারা গঠিত—পুরুষ (সাক্ষ্য-চৈতন্য) ও প্রকৃতি (আদি-পদার্থ)। এখানে ‘পুরুষ’ হচ্ছে চৈতন্যময় সত্তা, যা পরম, স্বাধীন, মুক্ত এবং ইন্দ্রিয়ের উপলব্ধির বাইরে, যাকে কোনো অভিজ্ঞতা অথবা শব্দের দ্বারা বর্ণনা করা অসম্ভব। আর প্রকৃতির সত্তা হচ্ছে জড়রূপা। এটি নিষ্ক্রিয় বা অচেতন এবং সত্ত্ব (মঙ্গল, ভারসাম্য) , রজঃ (আবেগ, উত্তেজনা) ও তমঃ (নিস্তেজতা বা নিষ্ক্রিয়তা, উদাসীনতা, জড়তা বা অলসতা)—এই ত্রিগুণের সাম্যাবস্থা। কেউ কেউ সাংখ্যদর্শনের ভূমি হতেই শ্রীরাধাকৃষ্ণ তত্ত্ব বুঝতে ও বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। তবে তা অভ্রান্ত নয়। মানুষ বোঝে, “আমি পুরুষ।”—এর অর্থ, আমি এই দেহপুরের অধিবাসী, কর্তা, ভোক্তা ও শাসক। এই দেহ, ইন্দ্রিয়, প্রাণ, মন ও বুদ্ধি আমার জন্য। আমার ইচ্ছাশক্তি, ক্রিয়াশক্তি, জ্ঞানশক্তি আছে, আমার দায়িত্ব আছে, কর্ম আছে, ধর্মাধর্ম ও পাপপুণ্য আছে। জন্মজন্মান্তরে এই বোধ বিকশিত হচ্ছে। এই বোধ বিকশিত হলে, আরও গভীর চিন্তার উদয় হয়, তখন চিন্তা হয়—আমার জ্ঞান, তোমার জ্ঞান, অন্য সকলের জ্ঞান; আমার ইচ্ছা, তোমার ইচ্ছা, অন্য সকলের ইচ্ছা; আমার প্রেম, তোমার প্রেম, অন্য সকলের প্রেম—এসব আসেই-বা কোথা হতে, আর এদের পূর্ণতাই-বা কোথায়?




তখন আমরা আমাদের অন্তরেই অন্তর্যামীরূপে সেই পুরুষোত্তমের সাক্ষাৎ পাই। ক্রমশ বুঝি, তিনিই চিরকাল অবিশ্রাম আমাদের প্রত্যেকের সাথে লীলা করেছেন ও করছেন। এর পরের অবস্থা লীলা; সেই পুরুষোত্তম, যিনি অন্তরে পরিপূর্ণরূপে চিরদিন রয়েছেন, তিনি ভেতরের ও বাইরের বিরোধ মিটিয়ে, ভেতর ও বাহির এক করে প্রকট হয়েছেন। এরই নাম লীলা বা নিত্যের প্রাকট্য। শ্রীমদ্‌ভাগবতের বহু শ্লোকে এই কথা বলা হয়েছে। পুরুষোত্তম মানে 'সর্বোচ্চ পুরুষ', 'সর্বোচ্চ সত্তা', বা 'সর্বোচ্চ ঈশ্বর', যিনি ক্ষর (প্রকৃতি) ও অক্ষর (আত্মা)-এর বাইরেও পরম পুরুষ। ভগবদ্‌গীতার পঞ্চদশ অধ্যায় অনুসারে, পুরুষোত্তমকে সবার উপরে স্থিত সত্তা এবং ক্ষর ও অক্ষরকে পুরুষ বা সর্বশক্তিমান মহাজাগতিক সত্তা হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ক্ষরকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে 'ধ্বংসযোগ্য', প্রকৃতি, মায়া দ্বারা আবদ্ধ; এবং অক্ষরকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে 'অবিনশ্বর', 'অপরিবর্তনীয়', 'অবিনাশী', আত্ম, যিনি অপরিবর্তনীয়, চিরকাল মায়ার বাইরে হিসেবে।




এবার দেখা যাক, বৈষ্ণবাচার্যগণ শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে কী বলেছেন।




শ্রীকৃষ্ণ‌ই একমাত্র নায়ক।—গীতার পুরুষোত্তম-বাদ হতে এই তত্ত্বটি অনুভব করা কঠিন নয়।




নায়কানাং শিরোরত্নং কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্।
যত্র নিত্যতয়া সর্বে বিরাজন্তে মহাগুণাঃ॥
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, ২৩/৬৭)




অর্থ: শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান, তিনি নায়কগণের শিরোরত্ন। কৃষ্ণের মধ্যে সকল নিত্য ও শুদ্ধ গুণ স্থায়ীভাবে প্রকটিত।




প্রেমলীলাই শ্রীকৃষ্ণের একমাত্র কাজ। এটা ছাড়া তাঁর আর দ্বিতীয় কোনো কাজ নেই। আমাদের যখন মনে হয়, এটা ছাড়া অন্য কিছু আছে, তখন আমরা মিথ্যায় জড়িয়ে পড়ি। এই প্রেমলীলাই তাঁর স্বভাব—তাঁর স্বরূপ।




শ্রীকৃষ্ণ ধীরললিত, সুতরাং নিরন্তর কামক্রীড়াশীল। কাম অর্থ প্রেম। প্রেমবতীগণের শিরোমণি শ্রীমতী রাধার প্রেমে তিনি সততই তাঁর অধীন। এজন্য তিনি নিরন্তর শ্রীরাধাপ্রেমে প্রমত্ত। শ্রীউজ্জ্বলনীলমণি গ্রন্থে এর দৃষ্টান্ত—




গহনাদনুরাগতঃ পিতৃভ্যামপনীতব্যবহারকৃত্য ভাবঃ।
বিহরন্ সহ রাধয়া মুরারি যমুনাকুলবনানন্যলঞ্চকার।




প্রৌর্ণমাসী বললেন, “নান্দিমুখি, শ্রীকৃষ্ণের নিশ্চিন্ততা দেখ, প্রগাঢ় অনুরাগ নিমিত্ত পিতামাতা এঁকে কোনো ব্যাবহারিক কাজের ভার অর্পণ করেন না। তিনি নিরন্তরই শ্রীরাধার সাথে ক্রীড়া করতে করতে যমুনাকূলবর্তী বনসমূহকে অলংকৃত করে থাকেন।”




তাই শ্রীল কবিরাজ গোস্বামী লিখেছেন:




"রায় কহে, কৃষ্ণ হয়ে ধীরললিত।
নিরন্তর কামক্রীড়া যাঁহার চরিত।।"
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, ৮/১২৮)




শ্রীপাদ শ্রীজীব গোস্বামী বলেন, বিহারের অনবচ্ছেদত্বই প্রেয়সীবশত্বের পরিচায়ক এবং এটাই ধীর ললিতানুকূলত্বের লক্ষণ। এই ব্যাখ্যাই শ্রীল কবিরাজের ব্যবহৃত 'নিরন্তর কামক্রীড়া'-র তাৎপর্য। শ্রীকৃষ্ণ আনন্দ; তিনি রস, তিনি মধু।




শ্রীরূপগোস্বামী 'উজ্জ্বলনীলমণি' গ্রন্থে দেখিয়েছেন, নায়কের ছিয়ানব্বই প্রকার গুণ ও অবস্থার প্রতিটিই পরিপূর্ণরূপে শ্রীকৃষ্ণে বিদ্যমান।




প্রথমত নায়ক চার প্রকার। ধীরোদাত্ত, ধীরললিত, ধীরোদ্ধত, ধীরশান্ত। এর প্রত্যেকটি পূর্ণ, পূর্ণতর ও পূর্ণতমভেদে তিন প্রকার। এই বারো প্রকারের প্রত্যেকটি আবার পতি ও উপপতি ভেদে দুই ধরনের। এই চব্বিশ প্রকারের প্রত্যেকটি অনুকূল, দক্ষিণ, শঠ ও ধৃষ্ট এই চার প্রকার। এই প্রকারে নায়ক ছিয়ানব্ব‌ই প্রকার।




শ্রীকৃষ্ণে এই সমস্ত গুণ‌ই লীলায় প্রকট হয়েছে, বৈষ্ণবাচার্যগণ তা ভক্তদের আস্বাদিত বিবিধ গ্রন্থ হতে দেখিয়েছেন। আদিরসই যখন মূলরস, তখন পূর্ণতম ও একমাত্র নায়করূপে সেই রসরাজ ও রসিকশেখরের চিন্তা নিতান্তই স্বাভাবিক। অতএব, আমরাও ভক্তের ভাষায় সেই নায়ক-শিরোরত্নের বন্দনা করি নিম্নরূপে—




ধীরোদাত্ত: গম্ভীর, বিনয়ী, ক্ষমাশীল, করুণ, আত্মশ্লাঘাশূন্য ও অপ্রকাশিত-গর্ব—এই গুণসমূহ শ্রীকৃষ্ণে লক্ষণীয়।




ধীরললিত: রসিকতা, নবযৌবন, পরিহাসপটুতা ও নিশ্চিন্ততা—এ সকল গুণের দ্বারা প্রেয়সীদের বশীভূত হন বলে শ্রীকৃষ্ণ ধীরললিত।




ধীরশান্ত: শান্ত-প্রকৃতি, ক্লেশসহিষ্ণু, বিবেচক ও বিনয়াদি গুণযুক্ত বলে কৃষ্ণ ধীরশান্ত-নায়ক হয়েছেন।




ধীরোদ্ধত: কোনো কোনো লীলাভেদে মাৎসর্যযুক্ত, অহংকারী, মায়াবী, ক্রোধপরবশ, চঞ্চল ও আত্মশ্লাঘী হওয়ায়, শ্রীকৃষ্ণ ধীরোদ্ধত-নায়ক হিসেবে পরিচিত। (নিজের সম্পত্তি এবং অন্যান্য বস্তুগত বস্তু উপভোগ করতে অক্ষম হওয়া সত্ত্বেও সেগুলিকে আঁকড়ে ধরে থাকা এবং সেগুলি অন্যদের সাথে ভাগ করতে অনিচ্ছুক হওয়াই মাৎসর্য।)




যিনি অন্যললনাস্পৃহা পরিত্যাগ করে এক নায়িকায় অতিশয় আসক্ত, তিনি অনুকূল নায়ক। সীতার প্রতি রামের এমন ভাব ছিল, রাধিকায়‌ও কৃষ্ণের তেমন অনুকূল ভাব।




ধীরোদাত্তানুকূল নায়ক গম্ভীর, বিনয়ী, ক্ষমাশীল, করুণ, দৃঢ়ব্রত, আত্মশ্লাঘাশূন্য, গূঢ়গর্বী ও উদারচিত্ত হয়েও সে সমস্ত গুণ পরিত্যাগ করে নিজের নায়িকার অভিসরণ করেন।




রসিকতা, নবযৌবন, পরিহাসপটুতা, নিশ্চিন্ততাদি ধীরললিতের গুণ—তাতে অবিচ্ছেদ বিহার-লক্ষণ সংযুক্ত হলে নায়ক ধীরললিতানুকূল হয়।




শান্তপ্রকৃতি, সহিষ্ণু, বিবেচক ও বিবেকাদি গুণযুক্ত নায়ক ধীরশান্তানুকূল।




মৎসর (দ্বেষযুক্ত, ঈর্ষাযুক্ত, পরশ্রীকাতর), অহংকারী, মায়াবী, ক্রোধান্বিত এবং আত্মশ্লাঘী নায়ক অনুকূল হলে ধীরোদ্ধতানুকূল নায়ক হন।




'দক্ষিণ' শব্দের অর্থ সরল। আগের নায়িকার প্রতি গৌরব, ভয়, প্রেমদাক্ষিণ্য অপরিত্যাগে অন্য নায়িকার প্রতি যিনি চিত্ত সংলগ্ন করেন, তিনি দক্ষিণ নায়ক। অনেক নায়িকাতে তুল্যভাব রাখলেও দক্ষিণ নায়ক বলা যায়।




যে-নায়ক সামনে প্রিয় আচরণ এবং পেছনে অপ্রিয় আচরণ করে নিগূঢ় অপরাধ করেন, তিনি শঠ।




অন্য নায়িকার ভোগ-চিহ্ন অভিব্যক্ত থাকলেও যিনি নির্ভয় রূপে মিথ্যাবচনে দক্ষ, তিনি ধৃষ্ট।




তাহলে সাকল্যে নায়ক কত প্রকার হলো? এক শ্রীকৃষ্ণ বাদে আর কেউ নায়ক নেই। সেই কৃষ্ণ দ্বারকায় পূর্ণ, মথুরায় পূর্ণতর এবং ব্রজে পূর্ণতম। সেই কৃষ্ণ পতিত্ব ও উপপতিত্ব-ভেদে দুই প্রকার বলে ছয় প্রকারের হন। ধীরোদাত্তাদি চার-প্রকার-ভেদে নায়ক চব্বিশ প্রকারের। অনুকূল, দক্ষিণ, শঠ ও ধৃষ্ট-ভেদে চব্বিশকে চতুর্গুণ করে ছিয়ানব্বই প্রকারের নায়ক হন। এখন বুঝতে হবে যে, স্বকীয় রসে চব্বিশ প্রকার এবং পরকীয় রসে চব্বিশ প্রকার নায়ক। স্বকীয় রসের সংকোচভাব ও পরকীয় রসের প্রাধান্যপ্রযুক্ত ব্রজরসলীলায় পরকীয় রসের চব্বিশ প্রকার নায়কত্ব শ্রীকৃষ্ণে নিত্য বর্তমান। লীলার যে প্রকারে ও যে অংশে যে প্রকার নায়কত্বের প্রয়োজন, সেই প্রকারের নায়ক তিনি সময়ানুযায়ী অনুভূত হন।




শ্রীল কবিবর বিল্বমঙ্গল বিরচিত 'কৃষ্ণকর্ণামৃতম্' গ্রন্থের ৯৩ নং শ্লোকে পাচ্ছি:




শৃঙ্গাররসসর্ব্বস্বং শিখিপিঞ্ছবিভূষণং।
অঙ্গীকৃত নরাকারমাশ্রয়ে ভুবনাশ্রয়ং।




অর্থ: যাঁর শৃঙ্গাররসই সর্বসম্পত্তি, ময়ূরপুচ্ছই যাঁর বিভূষণ, যিনি নরাকার আশ্রয় করেছেন, সেই ত্রিভুবনাশ্রয় শ্রীকৃষ্ণকে আশ্রয় করি।




শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব নিয়ে সংক্ষেপে যা বলা হলো, তা হতে শ্রীরাধাতত্ত্বের আলোচনা করা যেতে পারে। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে আছে—




দামোদর কহে,—কৃষ্ণ রসিকশেখর।
রস-আস্বাদক, রসময়-কলেবর॥
প্রেমময়-বপু কৃষ্ণ ভক্ত-প্রেমাধীন।
শুদ্ধপ্রেমে, রসগুণে, গোপিকা—প্ৰবীণ॥
গোপিকার প্রেমে নাহি রসাভাস-দোষ।
অতএব কৃষ্ণের করে পরম সন্তোষ॥




‘বামা’ এক গোপীগণ, ‘দক্ষিণা’ এক গণ।
নানা-ভাবে করায় কৃষ্ণে রস আস্বাদন॥
গোপীগণ-মধ্যে শ্রেষ্ঠা রাধা-ঠাকুরাণী।
নির্মল-উজ্জ্বল-রস-প্রেম-রত্নখনি॥
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যভাগ, ১৪/১৫৫-১৫৭, ১৫৯, ১৬০)




সংসারে মানুষ মাত্রেই সুখের জন্য পরিশ্রম করছে। এই সুখ আস্বাদন মূলত রসের‌ই আস্বাদন। ভাবের দ্বারা রসের আস্বাদন হয়, এটা সামান্যমাত্র চিন্তা করলেই লোকে বুঝতে পারে। খাদ্যদ্রব্য অতি উপাদেয় ও মধুর, তাতে রস আছে এবং সেই রস আস্বাদনের জন্য মানুষ লোলুপ। খাদ্য জুটল, পাবার অধিকারও পেলাম, কিন্তু মোটেই ভালো লাগল না, রসের আস্বাদন হলো না। এর কারণ কী? তাতে ভাব ছিল না। যেরূপ অবস্থায় থাকলে রসের আস্বাদন হয়, আমি সেরূপ অবস্থায় ছিলাম না। আমার ক্ষুধা ছিল না, দেহ সুস্থ ছিল না, মনও ভালো ছিল না। একে ইংরেজিতে বলা যায়—Mood। প্রত্যেক সুখাস্বাদনেই একটা অনুকূল ভাব বা Mood দরকার। সংসারে প্রকটিত প্রত্যেক খণ্ড ও ক্ষয়শীল সুখ বা রস, এক পরম রসের খণ্ড খণ্ড প্রতিবিম্বমাত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'মনুষ্যত্ব' প্রবন্ধে এদিকেই ইঙ্গিত করছেন—




"...দুঃখই মানুষকে বৃহৎ করে, মানুষকে আপন বৃহত্ত্বসম্বন্ধে জাগ্রত-সচেতন করিয়া তোলে, এবং এই বৃহত্ত্বেই মানুষকে আনন্দের অধিকারী করিয়া তোলে। কারণ, ভূমৈব সুখং, নাল্পে সুখমস্তি—অল্পে আমাদের আনন্দ নাই।"




এই যে খণ্ড খণ্ড সুখ, এরা প্রবঞ্চক, এদের চাই না, আমরা চাই সেই নিত্য সুখ। সেই নিত্য সুখের নামই অমৃত। বেদে এই অমৃত-পিপাসার কথা আছে। বেদে যিনি তেজোময় অমৃতময় পুরুষ, তিনিই রসরাজ রসিকশেখর শ্রীকৃষ্ণ। অতএব, সেই রসরাজকেই চাই। কিন্তু সেই রসরাজকে পায় কে? রসকে পেতে ভাবের দরকার, সুতরাং রসরাজকে পেতে মহাভাবের দরকার। এই মহাভাবই শ্রীমতী রাধিকা।




আমি চাই রসরাজকে। কীজন্য চাই? আমার ভোগের জন্য? তাহলে পাবো না। আমার ভোগের জন্য যখন লোলুপ হয়ে জীবনের পথে চলেছি, তখন বঞ্চিত হয়ে মিথ্যার পেছনে ছুটছি। যা খুঁজছি, তা পাবো না।




শুক্ল-যজুর্বেদের চল্লিশতম অধ্যায় থেকে ঈশোপনিষদে গৃহীত হয়েছে—তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ ধনম্। (ঈশোপনিষদ, শ্লোক ১) ঈশোপনিষদের এই শ্লোকের অংশবিশেষের অনুবাদ করা হয়েছে—‘ত্যাগের দ্বারা ভোগ করো।’—‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা’। এই শ্লোকাংশটির তিনটি অর্থ আছে। সবকটি অর্থই ব্যাপক ও গভীর। রবীন্দ্রনাথ এই তিনটি অর্থকেই মান্যতা দিয়েছেন।




প্রথম অর্থ— ত্যাগের দ্বারা ভোগ করো। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে ‘বিশ্ববোধ’ প্রবন্ধে এই অর্থ গ্রহণ করেছেন।




দ্বিতীয় অর্থ— ঈশ্বর স্বেচ্ছায় তাঁর নিজের সম্পত্তির যে-অংশ আমাদের জন্য ত্যাগ করেছেন, সেটুকু অংশ নিয়ে আমাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করা উচিত। এখানে, তেন: সেই ঈশ্বর কর্তৃক; ত্যক্তেন: ত্যাগপূর্বক প্রদত্ত বস্তুসমূহ দ্বারা; ভুঞ্জীথা: ভোগের কার্য নির্বাহ করা উচিত। এই অর্থটি শ্রীগীতায় গ্রহণ করা হয়েছে। এই অর্থটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ধর্ম’ গ্রন্থের ‘ততঃ কিম্’ প্রবন্ধে গ্রহণ করেছেন।




তৃতীয় অর্থটি শঙ্করাচার্য ব্যাখ্যা করেছেন, ত্যাগের দ্বারা (আত্মাকে) পালন বা রক্ষা করা উচিত, অর্থাৎ এখানে সংযমের কথাই বলা হয়েছে। এই অর্থটি শঙ্করাচার্য তাঁর নানা গ্রন্থের নানা স্থানে বৈদিক তত্ত্ব ব্যাখ্যায় গ্রহণ করেছেন। ‘ভুঞ্জীথা’র অর্থ ‘পালনীয়’। (‘ভুজ্’ ধাতুর অর্থ পালন করা, ভোগ করা প্রভৃতি।) রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পথের সঞ্চয়’ গ্রন্থে ‘অন্তর বাহির’ প্রবন্ধে অর্থটি গ্রহণ করে বলেছেন—"সংযমই অন্তরলোকে প্রবেশের সিংহদ্বার। মানবজীবনের সাধনাতেও যাঁহারা আধ্যাত্মিক সত্যকে উপলব্ধি করিতে চান, তাঁহারাও বাহ্য উপকরণকে সংক্ষিপ্ত করিয়া সংযমকে আশ্রয় করেন।"