রাধাতত্ত্ব (মধ্যপর্ব)

ত্যাগের দ্বারাই ভোগ সিদ্ধ হয়, ভোগের দ্বারা নয়। অতএব, রসরাজকে চাই, রসরাজেরই তৃপ্তির জন্য। তাঁর কামভাব নেই—এটাই একমাত্র সত্য ব্যাপার, আর সব কল্পনা। শ্রীল বৈষ্ণব দাস কর্তৃক সংগৃহীত বৈষ্ণব পদাবলীর অপূর্ব সমাহার শ্রীপদকল্পতরু-তে দেখি—




"কুরু মম বচনং সত্বর-রচনং পুরয় মধুরিপু-কামং।।" (তিমিরাভিসারঃ, অভিসারোৎকণ্ঠা, ১) অর্থাৎ একমাত্র মধুরিপু, তিনিই পুরুষোত্তম, তিনিই সত্য, তাঁর কামনাই একমাত্র সত্য। অতএব, তাঁর কামনা পূর্ণ করো।




কিন্তু তুমি যে নিজের কামনার আগুনে দিনরাত পুড়ছ, এ অবস্থায় তুমি মধুরিপুর কামনা কীভাবে পূর্ণ করবে? তুমি যে কেবল নিজের কথাই ভাবছ, এ অবস্থায় তুমি অন্যের কথা ভাববে কী করে? তুমি যে খণ্ড নিয়েই বেশ মেতে রয়েছ, অখণ্ডের চিন্তা করবে কীভাবে? সাধনা চাই, সৎসঙ্গ চাই, তত্ত্ববিচার চাই; শ্রবণ-মনন-স্মরণ চাই।—এমন মনোভাব খুব জরুরি—কিছু শেখার জন্য, বোঝার জন্য।




রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা, দুই দেহ ধরি'।
অন্যোন্যে বিলসে রস আস্বাদন করি'।।
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪/৫৬)




লীলাপ্রকাশের আগে কৃষ্ণ-আত্মায় রাধার ভাব লুকায়িত ছিল; সেজন্য 'রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা' বলা হয়েছে। শ্রীমতী রাধিকা শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। এটাই রাধাতত্ত্বের প্রথম কথা। হ্লাদিনী শক্তি কী?




আমরা ভগবানকে তিন প্রকারে অনুভব করতে পারি। তাঁর যদিও অনন্ত শক্তি, তবু আমাদের কাছে এই তিনটিই প্রধান। ভগবান আমাদের কাছে সচ্চিদানন্দ। তিনি সৎ—তিনি আছেন, এক তিনিই আছেন। আমি মনে করছি, আমি আছি; আপনি মনে করছেন, আপনি আছেন; আমি ও আপনি মনে করছি, পাহাড় আছে, নদী আছে, সমুদ্র আছে, দেবতা আছে, যক্ষ-রক্ষ-গন্ধর্ব আছে; কিন্তু এই সমস্ত সত্তাই ব্যাবহারিক-সাপেক্ষ। একমাত্র আছেন তিনি সেই এক ও অদ্বিতীয় ভূমা, পরমপুরুষ। তাঁর সত্তায় সত্তাবান হয়ে আমরা আছি। তাঁর জন্য আমরা আছি, তিনি মূলে আশ্রয়তত্ত্বরূপে আছেন বলেই আমার সত্তা সম্ভব হয়েছে। এটাই প্রথম চিন্তাপ্রণালী—তিনি সৎ—তিনি অসীম সত্তা—অসীম এবং পরম অস্তিত্ব। সেই পুরুষোত্তমকে অসীম সত্তারূপে অনুভব করতে গেলে তাঁতে বা তাঁর স্বরূপে যে শক্তির বা বৈশিষ্ট্যের বিলাস বা ক্রিয়া অনুভব করি, তার নাম সন্ধিনী শক্তি। অনন্ত সত্তাসম্পন্ন শ্রীভগবান যে-শক্তির দ্বারা নিজে সত্তাবান হন এবং অন্যকে সত্তাবান করেন, সেই শক্তির নাম সন্ধিনী শক্তি।




সেই পুরুষোত্তমকে অনুভব করার দ্বিতীয় প্রণালী—তিনি চিৎ—তিনি জ্ঞানরূপ; একমাত্র তিনিই জ্ঞানরূপ; অন্য সকলের জ্ঞান, এমনকি হিরণ্যগর্ভেরও জ্ঞান সীমাবদ্ধ ও সাপেক্ষ—একমাত্র তিনিই অসীম ও স্বতঃসিদ্ধ জ্ঞানরূপ—অসীম এবং পরম চেতনা। বাকি সকলেই তাঁর জ্ঞানে জ্ঞানী হয়েছে। শ্রীভগবান তাঁর স্বরূপের যে শক্তিবিলাসের দ্বারা নিজেকে জ্ঞানবান করেন ও অপর সকলকে জ্ঞানযুক্ত করেন, সেই শক্তির নাম সংবিৎ শক্তি। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে, সত্তা ছাড়া চৈতন্য নেই, চৈতন্য ছাড়া সত্তা নেই।




এই দুই শক্তির মূলরূপে শ্রীভগবানের স্বরূপে আর-এক শক্তি রয়েছেন। শ্রীভগবান নিজেই আনন্দ—সমস্ত আনন্দই তাঁর, তাঁর আনন্দের আশ্রয়েই জগৎ আনন্দযুক্ত। শ্রীভগবানের স্বরূপের যে-শক্তিবিলাসের দ্বারা শ্রীভগবান নিজে আনন্দ আস্বাদন করেন এবং অপরকে আনন্দিত করেন, সেই শক্তির নাম হ্লাদিনী শক্তি।




'শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থে গোস্বামী কৃষ্ণদাস কবিরাজ রায় চৈতন্য-সংবাদে শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব ও শ্রীরাধাতত্ত্বের অবতারণা করে বলেছেন—




প্রভু কহে যাঁহা লাগি আইলাম তোমা স্থানে৷
সেই সব রসতত্ত্ব বস্তু হইল জ্ঞানে৷৷
এবে সে জানিল সেব্য সাধ্যের নির্ণয়৷
আগে আর কিছু শুনিবারে মনে হয়৷৷
কৃষ্ণের স্বরূপ কহ রাধার স্বরূপ৷
রস কোন তত্ত্ব প্রেম কোন তত্ত্ব রূপ৷৷




রায় রামানন্দ শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব বিশ্লেষণের পর শ্রীরাধাতত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর অনুবাদে বলেছেন—




কৃষ্ণকে আহ্লাদে তাতে নাম আহ্লাদিনী।
সেই শক্তি দ্বারে সুখ আস্বাদে আপনি।।
সুখরূপ কৃষ্ণ করে সুখ আস্বাদন। 
ভক্তগণে সুখ দিতে সেই হ্লাদিনী কারণ।।




শ্রীভগবান সুখ আস্বাদন করছেন। এটা অনুভব করা একটু কঠিন—ভগবানের স্বরূপ-চিন্তাই বেশ কঠিন একটা কাজ। অধ্যাত্মভাব-চিন্তায় বিশেষভাবে অভ্যস্ত না হলে এটা করা যায় না। চেষ্টা করে করে ধীরভাবে কিছু দিন অভ্যেস করে যদি আমরা এই চিন্তায় অভ্যস্ত হতে পারি, তাহলে শ্রীকৃষ্ণলীলার যে-সব কথা আমাদের কাছে এখন 'অশ্লীল' বলে মনে হয়, সেগুলি অন্য রকমের মনে হবে। ব্যাপারটা এমন—সাধারণ মানুষ শ্রীভগবানের স্বরূপচিন্তায় অভ্যস্ত নয়, তাই ভগবানকে জগতে এনে জগতের মধ্য দিয়ে অর্থাৎ তটস্থ লক্ষণে উপলক্ষিত করে শ্রীভগবানকে দেখে। সে ঈশ্বরকে ঈশ্বরের স্বরূপে দেখে না, বরং ঈশ্বরের প্রতিবিম্বেই দেখে। এটাই সহজ পথ, তাই বহুল-প্রচারিত ও জনপ্রিয়।




এই উপায়ে জগতের নৈতিক শাসনকর্তারূপে শ্রীভগবানকে বুঝতে ও বোঝাতে পারা যায় এবং সাধারণ লোকে মোটামুটি এই পর্যন্তই বোঝে। এর উপরের কথা সাধারণ লোককে বুঝিয়ে দেওয়া খুবই কঠিন, তবে সে ব্যক্তি যদি বুঝতে চায়, অর্থাৎ সে যদি শ্রদ্ধাবান হয় এবং সাধুসঙ্গ করে বা আত্মজ্ঞানের ক্রমাগত অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভজনা করতে প্রস্তুত হয়, তাহলে বোঝাতে পারা যায়। এটা না হলে বোঝাবার চেষ্টাই একধরনের বিড়ম্বনা। এ কারণেই শ্রীরাধাকৃষ্ণের লীলা বুঝতে এত লোকের এত সংশয় ও অসুবিধে। বেদান্তের পথে না হাঁটলে এই তত্ত্ব বোঝা বেশ দুরূহ।




সুখরূপ কৃষ্ণ সুখ আস্বাদন করছেন—এটাই সারকথা। এই বিশ্বপ্রক্রিয়ায় মূলে এক পরমপুরুষের আস্বাদন ও উপভোগ রয়েছে। আমার জীবনে তাঁরই উপভোগ—আমাদের সকলেরই জীবনে তাঁরই উপভোগ। আমরা যে রয়েছি এবং জানছি, সকলেরই মূলে তাঁরই আস্বাদন ও উপভোগ। তাঁরই আস্বাদন ও উপভোগের জন্যই আমরা রয়েছি এবং থাকব। জীবনে আর কোনো প্রয়োজন নেই।—এই বোধই মানুষের চরম বোধ। আমার জীবনে তাঁর উপভোগ ও আস্বাদন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে—আমি অভক্ত; আপনার জীবনে তাঁর উপভোগ ও আস্বাদন অব্যাহত—আপনি ভক্ত, আপনার চরণে কোটি কোটি প্রণাম। যাঁর জীবনে রস-আস্বাদক শ্রীগোবিন্দের আস্বাদন ও উপভোগ যে-পরিমাণে অব্যাহত, তিনি সেই পরিমাণে ভক্ত বা সত্যপথে অগ্রসর।




ভক্ত সত্য, ভক্তিই সত্য, আর সব ব্যাবহারিক। ব্রহ্মাণ্ডে অনেক ভক্ত—ভিন্ন ভিন্ন স্তরে রয়েছেন। জল যেমন নানাস্থানে নানা আকারে রয়েছে, ঠিক তেমন। আকাশে মেঘরূপে জল বাতাসে ভেসে যাচ্ছে; বায়ুমণ্ডলে বাষ্পরূপে জল অদৃশ্যভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উঁচু পর্বতের চূড়ায় পাথরের মতো শক্ত হয়ে জল রয়েছে। তা ছাড়া নদীতে জল, সরোবরে জল, প্রস্রবণে জল, আবার নারিকেল গাছের মাথায়‌ও জল! একই জল নানা মূর্তিতে নানাস্থানে বিরাজিত। কিন্তু জল যেখানেই যে-অবস্থাতেই থাকুক না কেন, এটা নিশ্চিত যে, সমস্ত জল সেই এক মহাসমুদ্র হতে এসেছে এবং সমস্ত জল চলার পথ পেলে আবারও সমুদ্রে গিয়ে পরিণতি ও সার্থকতা লাভ করবে।




ঠিক তেমনি এই ব্রহ্মাণ্ডে যত ভক্ত জন্মেছেন এবং ভবিষ্যতে জন্মাবেন, তাঁদের যাঁর যে-ভাব‌ই হোক, সমস্ত‌ই সেই মহাভাবস্বরূপিনী শ্রীরাধারূপ মহাসমুদ্র হতে এসেছেন এবং সকলেই পরিণামে সেই মহাভাবসমুদ্রে সংগতিপ্রাপ্ত হন, তারপর সার্থকতা লাভ করেন। চৈতন্যদেবকে রামানন্দ এভাবে ঈশ্বরতত্ত্ব বলেন—




সচ্চিৎ আনন্দময় কৃষ্ণের স্বরূপ।
অতএব স্বরূপ-শক্তি হয় তিন রূপ।।
আনন্দাংশে হ্লাদিনী, সদংশে সন্ধিনী।
চিদংশে সম্বিত, যারে জ্ঞান করি মানি।।
কৃষ্ণকে আহ্লাদে তাতে নাম আহ্লাদিনী।
সেই শক্তিদ্বারে সুখ আহ্লাদে আপনি।।
সুখরূপ কৃষ্ণ করে সুখ আস্বাদন।
ভক্তগণে সুখ দিতে হ্লাদিনী কারণ।।
হ্লাদিনী যার অংশ, তার প্রেম নাম।
আনন্দ চিন্ময়রূপ রসের আখ্যান।।
প্রেমের পরম সার মহাভাব জানি।
সেই মহাভাবরূপা রাধা ঠাকুরাণী।।
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা)




রাধা ও কৃষ্ণ একই আত্মা—শক্তি ও শক্তিমান পৃথক কিছু নয়। শক্তিকে বাদ দিলে শক্তিমানকে জানা যায় না, আবার শক্তিমানকে বাদ দিলেও শক্তিকে জানা যায় না।




রাধা পূর্ণ শক্তি, কৃষ্ণ পূর্ণ শক্তিমান।
দুই বস্তু ভেদ নাহি শাস্ত্র-পরমাণ।।
মৃগমদ, তার গন্ধ যৈছে অবিচ্ছেদ।
অগ্নি জ্বালাতে যৈছে নাহি কভু ভেদ।।
রাধাকৃষ্ণ ঐছে সদা একই স্বরূপ।
লীলারস আস্বাদিতে ধরে দুইরূপ।।
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, পণ্ডিত শ্রীযুক্ত অতুলকৃষ্ণ গোস্বামী সংকলিত)




যেমন কস্তুরি ও তার গন্ধ, অগ্নি ও তার উত্তাপ, চন্দ্র ও তার জ্যোৎস্না—এমন উদাহরণও দেওয়া যেতে পারে—ঠিক তেমনি শ্রীরাধাকৃষ্ণও। শ্রীরাধিকা শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়ের যেন ঘনীভূতা মূর্তি, প্রণয়-বিকৃতি (প্রণয়ের বিশেষ আকৃতি)।




আগে যা বলা হলো, তার সাহায্যে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের নিচের অংশগুলি বেশ বোঝা যাবে—




রাধিকা হয়েন কৃষ্ণের প্রণয়–বিকার।
স্বরূপশক্তি—‘হ্লাদিনী’ নাম যাঁহার।।
হ্লাদিনী করায় কৃষ্ণে আনন্দাস্বাদন।
হ্লাদিনীর দ্বারা করে ভক্তের পোষণ।।
সচ্চিদানন্দ, পূর্ণ, কৃষ্ণের স্বরূপ।
একই চিচ্ছক্তি তাঁর ধরে তিন রূপ।।
আনন্দাংশে হ্লাদিনী, সদংশে সন্ধিনী।
চিদংশে সম্বিৎ—যারে জ্ঞান করি’ মানি।।
হ্লাদিনী সন্ধিনী সম্বিত্ত্বয্যেকা সর্বসংস্থিতৌ।
হ্লাদতাপকরী মিশ্রা ত্বয়ি নো গুণবর্জিতে।।
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪/৫৯-৬৩)




ভাবার্থ: হে ভগবান, হ্লাদিনী, সন্ধিনী ও সংবিৎ, এই তিনটি বৃত্তিসম্পন্না মুখ্যা শক্তি—সর্বাশ্রয় যে আপনি—সেই আপনাতে অবস্থিতি করছে। কিন্তু হ্লাদকারী যে সাত্ত্বিকী, তাপকরী তামসী এবং উভয়মিশ্রা যে রাজসী শক্তি, তাঁরা—গুণাতীত যে তুমি—সেই তোমাতে অবস্থিত নয়। অর্থাৎ এই তিনটি শক্তি তোমার স্বরূপশক্তি, প্রাকৃত গুণময়ীশক্তি তোমাতে নেই।




সংক্ষেপে, হে ভগবান! তুমি সর্বাশ্রয়; তোমাতে সন্ধিনী, সংবিৎ ও হ্লাদিনী এক অচিন্ত্য স্বরূপশক্তিকে আশ্রয় করে রয়েছে এবং তা বিকৃত হয়ে (বিশেষ আকৃতি পেয়ে) জীবে মিশ্রভাবে কাজ করছে। কিন্তু তুমি গুণবর্জিত; তোমাতে ওরকম সুখ-দুঃখময়ী মিশ্র শক্তি প্রভাব প্রকাশ করতে পারে না।




সন্ধিনীর সার অংশ—‘শুদ্ধসত্ত্ব’ নাম।
ভগবানের সত্তা হয় যাহাতে বিশ্রাম।।
মাতা, পিতা, স্থান, গৃহ, শয্যাসন আর।
এসব কৃষ্ণের শুদ্ধসত্ত্বের বিকার।।
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪/৬৪-৬৫)




(সন্ধিনীর সার অংশই ভগবানের বিশুদ্ধ সত্তা এবং এই সখ্যবন্ধন করেই সন্ধিনী প্রতিষ্ঠিত আছে। মাতা, পিতা, স্থান, গৃহ, শয্যাসন ইত্যাদি চরচরাস্থ যাবতীয় পদার্থ অর্থাৎ প্রকৃতি—সন্ধিনী শক্তির বিকার বা পরিণাম মাত্র।)




শ্রীমদ্‌ভাগবতে চতুর্থ স্কন্ধ তৃতীয় অধ্যায়ে একবিংশ শ্লোকে স্বয়ং শিব সতীকে বলছেন—




সত্ত্বং বিশুদ্ধং বসুদেব শব্দিতং
যদীয়তে তত্র পুমানপাবৃতঃ।
সত্ত্বে চ তস্মিন্ ভগবান্ বাসুদেবো,
হ্যধোক্ষজো মে মনসা বিধীয়তে।




অর্থ: বিশুদ্ধ সত্ত্বের নাম বসুদেব। এই বিশুদ্ধ সত্ত্বে পুরুষ শ্রীভগবান আবরণশূন্য অবস্থায় প্রকাশিত, এজন্য তাঁর নাম বাসুদেব। বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবাপন্ন অন্তঃকরণে আমি ইন্দ্রিয়ের অগোচর সেই শ্রীবাসুদেবকে বিশেষরূপে ভাবনা করে থাকি।




পুরুষোত্তমের চিন্তা কীভাবে এসেছে, তা নিয়ে আগে বলেছি। আমার দেহ একটি পুর, আমি সেই দেহে পুরুষ। আমি পুরুষরূপে বিবিধ ও বিচিত্র সম্পর্কে বিজড়িত হয়ে রয়েছি—আমার পিতা-মাতা-সখা, আমার শয্যা-আসন প্রভৃতি। যিনি যত বড়ো, তাঁর এই সম্পর্কময় জগৎও তত বড়ো। এই সম্পর্কগুলিকে বাদ দিলে আমার কী থাকে? আমার যা পুরুষত্ব বা চৈতন্যময় আত্মত্ব, তার প্রকাশ বা বিলাস কেবল দেহের দ্বারাই হয় না, আমার সন্তানত্ব, বন্ধুত্ব, পতিত্ব প্রভৃতিরও প্রয়োজন। পুরুষ সম্পর্কে এই ধারণাটি আমাদের জগতে সুনির্দিষ্ট করে তা শ্রীভগবানে আরোপ করতে হবে।




শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতার ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ-বিভাগ-যোগে শ্রীভগবান বলছেন—আমি সকল ক্ষেত্রের একমাত্র ক্ষেত্রজ্ঞ পুরুষ। এই চিন্তাপ্রণালীর মধ্য দিয়ে গেলে আমরা বুঝব, পুরুষোত্তম শ্রীভগবানে এই সমস্ত সম্পর্ক‌ও বিদ্যমান। কিন্তু আমি যে অপূর্ণ ও পরিমিত, আর তিনি যে পূর্ণ ও অপরিমিত, সুতরাং এই যে পিতা-মাতা-শয্যা-আসন-দেহ-গেহ এসব—এ প্রভৃতি নিয়ে তাঁতে ও আমাতে বিশেষরূপ প্রভেদ থাকবে। সে প্রভেদ কী? আমার এসব সম্পর্কের বস্তু বা ব্যবহারের বস্তু, আমার হয়েও সম্পূর্ণরূপে আমার নয়, যদিও আমি এদেরকে 'আমার আমার' বলি, কিন্তু এরা আমার হলেও প্রকৃত 'আমার' নয়। এরা আমার 'অনাত্ম' (আত্মসম্পর্কশূন্য বা impersonal), কারণ আমার পক্ষে এই 'আমি' বলাটাই আয়ত্তাধীন কোনো ব্যাপার নয়। 'আমি আমি' বলছি, কিন্তু কাকে 'আমি' বলি, তা জিজ্ঞেস করলেই আমি দ্বিধায় পড়ে যাই।




এসব দোষ বা ত্রুটি পুরুষোত্তমে বা শ্রীভগবানে নেই, সুতরাং তাঁর পিতা-মাতা-শয্যা-আসন প্রভৃতি তাঁরই চিচ্ছক্তির বা সন্ধিনী শক্তির মূর্তি বা বিকার। শ্রীভগবানের নিত্যলীলায় বা স্বরূপে এমন অনুভব করা তো কঠিন নয়; আবার চিন্তা করলে দেখা যায়, এমন অনুভবই স্বাভাবিক। শ্রীভগবান সম্পর্কে এমন চিন্তাই স্বভাবত মানুষের মনে এসে থাকে। যাদের না আসে, তারা স্বভাব হতে বিচ্যুত হয়েছে, অস্বাভাবিক বা কৃত্রিম চিন্তায় অভ্যস্ত হয়েছে। নিত্যলীলার প্রাকট্য অর্থাৎ সেই নিত্য পিতা, নিত্য মাতা, নিত্য সন্তান যখন প্রপঞ্চে আসবেন, তখন তাঁদের প্রপঞ্চে আগমন বা আবির্ভাবের পদ্ধতি বোঝা একটু কঠিন। অন্য প্রকারের চিন্তাপদ্ধতি, যাকে অবরোহন বা অবরোহী পদ্ধতি বলা হয়, তাতে অভ্যস্ত হতে হবে। উল্লেখ্য, কোনো বিবৃতি থেকে সেটির মূল বক্তব্যে পৌঁছার জন্য গৃহীত প্রক্রিয়াকে অবরোহী পদ্ধতি নামে গণ্য করা হয়। এর জন্য ভক্তির নয়, বরং বেদান্তের পথ অবলম্বন করা বিশেষ সুবিধাজনক।




কৃষ্ণের ভগবত্তা–জ্ঞান—সংবিতের সার।
ব্রহ্মজ্ঞানাদিক সব তার পরিবার।।
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪/৬৭)




জ্ঞানকে, সামান্য জ্ঞান ও বিশেষ জ্ঞান, এই দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়। সামান্য জ্ঞান বিশেষ জ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত; অতএব সামান্য জ্ঞানকে বিশেষ জ্ঞানের পরিবারভুক্ত বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। শ্রীকৃষ্ণই ভগবান, এই জ্ঞানই চরম ও পরম জ্ঞান—ব্রহ্মজ্ঞান বা পরমাত্মাজ্ঞান ওই চরমজ্ঞানের ভিন্ন ভিন্ন স্তর মাত্র।




এই যে জ্ঞান-কৃষ্ণে ভগবত্তা–জ্ঞান, এই জ্ঞান কার? এই জ্ঞানের জ্ঞাতা কে? যদি বলি, ভগবান বা কৃষ্ণ ছাড়া অন্য কেউ, তাহলে ভুল হবে, কারণ কৃষ্ণ বা ভগবান তাহলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লেন। কে কৃষ্ণকে জানেন? এর উত্তর: কৃষ্ণই কৃষ্ণকে জানেন। Who knows the Divine? It is the Divine who knows the Divine. আপনি যদি কৃষ্ণকে জানেন, তাহলে বুঝবেন—কৃষ্ণেরই স্বরূপশক্তি আপনাকে আশ্রয় করে বা আপনার মধ্য দিয়ে কৃষ্ণকে জানছে। ভগবদ্‌গীতা বলছেন—




স্বয়মেবাত্মনাত্মানং বেত্থ ত্বং পুরুষোত্তম।
ভূতভাবন ভূতেশ দেবদেব জগৎপতে।। (১০/১৫)




তাৎপর্য: কেবল সংকল্প দ্বারা সমস্ত প্রাণী ও দেবতার অধীশ্বর হওয়ায় আপনি 'ভূতেশ' এবং 'দেবদেব'; জড়-চেতন, স্থাবর-জঙ্গম ইত্যাদি সমস্ত জগতের পালন-পোষণকারী হওয়ায় আপনি 'জগৎপতি'; এবং সকল পুরুষের উত্তম হওয়ায়, ত্রিলোকে ও বেদে আপনাকে 'পুরুষোত্তম' নামে উল্লেখ করা হয় (গীতা, ১৫/১৮)। কাব্যেও ভগবানকে 'পুরুষোত্তম' বলা হয়েছে—'হরির্যথৈকঃ পুরুষোত্তমঃ স্মৃতঃ' (রঘুবংশ, ৩/৪৯)—একমাত্র ভগবান হরিকেই ‘পুরুষোত্তম’ বলা হয়।




এই শ্লোকে পাঁচটি সম্বোধন আছে। সমগ্র গীতাতে এত সম্বোধন অন্য কোনো শ্লোকে নেই। কারণ হলো এই যে, ভগবানের বিভূতি এবং ভক্তদের প্রতি কৃপা করার কথা শুনে ভগবানের প্রতি অর্জুনের এক বিশেষভাব উৎপন্ন হয়, সেই ভাবে বিভোর হয়ে তিনি ভগবানের প্রতি একসঙ্গে পাঁচটি সম্বোধনের প্রয়োগ করেছেন। এখানে ভূতভাবন, ভূতেশ, দেবদেব, জগৎপতে ও পুরুষোত্তম—এই পাঁচটি সম্বোধন ক্রমশ সূর্য, শিব, গণেশ, শক্তি ও বিষ্ণু—ঈশ্বরকোটির এই পঞ্চ দেবতার বাচক বলেও মানা যেতে পারে। এই সম্বোধনগুলি প্রয়োগ করে অর্জুন যেন ভগবানকে বলেছেন যে, এই পঞ্চদেবতা মূলত আপনিই।




ভগবান নিজেই নিজেকে নিজের দ্বারা জানেন। নিজেই নিজেকে জানার জন্য তাঁর কোনো প্রাকৃত সাধনের প্রয়োজন হয় না, নিজেকে জানতে তাঁর কোনো বৃত্তির প্রয়োজন নেই, কোনো সন্দেহও হয় না, কোনো করণের (অন্তঃকরণ এবং বহিঃকরণের) প্রয়োজন হয় না। তাঁর কোনো শরীর বা শরীরী ভাবও নেই। তিনি স্বতঃ স্বাভাবিকভাবে নিজেই নিজেকে নিজের মধ্যে থেকে জানেন। তাঁর এই জ্ঞান করণ-নিরপেক্ষ, করণ-সাপেক্ষ নয়।




এই শ্লোকটির ভাব হলো এই যে, ভগবান যেমন নিজেই নিজের দ্বারা নিজেকে জানেন, তেমনই ভগবানের অংশ জীবেরও নিজের দ্বারা নিজেকে অর্থাৎ নিজেই নিজের স্বরূপ জানা উচিত। নিজের দ্বারা নিজ স্বরূপের যে-জ্ঞান হয়, তা সম্পূর্ণভাবে করণ-নিরপেক্ষ। তাই ইন্দ্রিয়াদি, মন ও বুদ্ধির সাহায্যে নিজ স্বরূপ জানা যায় না। ভগবানের অংশোদ্‌ভূত হওয়ায় ভগবানের মতোই জীবের স্বরূপ-জ্ঞানও করণ-নিরপেক্ষ হয়।




আপনি নিজেই নিজেকে জানেন—এর অর্থ হলো যে, জ্ঞাতাও আপনি, জ্ঞানও আপনি এবং জ্ঞেয়ও আপনি অর্থাৎ সব কিছু আপনিই। আপনি ছাড়া যখন আর কিছুই নেই, তখন কে কাকে জানবে?




তত্ত্বকে জানার চেষ্টা করলে তত্ত্ব থেকে দূরে সরে যেতে হয়, কারণ তত্ত্বকে জ্ঞেয় (জানার বিষয়) করলে, তাহলেই তো তাকে জানতে চাওয়া হয়! তত্ত্ব সকলের জ্ঞাতা, জ্ঞেয় নয়। সকলের জ্ঞাতার জ্ঞাতা আর কেউ হতে পারে না। তত্ত্বকে আশ্রয় করেই আমরা নিজেকে জানি, তাই এখানে তত্ত্বই জীবের জ্ঞাতা।




"নান্যোহতোহস্তি দ্রষ্টা" (বৃহদারণ্যকোনিষদ, ৩/৭/১৩) অর্থাৎ "ইনি ছাড়া দ্রষ্টা আর কেউ নেই।" "বিজ্ঞাতারমরে কেন বিজানীয়াৎ" (বৃহদারণ্যকোনিষদ, ২/৪/১৪) অর্থাৎ "সকলের বিজ্ঞাতাকে কেমন করে জানা যায়?" যেমন, চোখের দ্বারা সব কিছু দেখা যায়, কিন্তু চোখ দিয়ে চোখকে দেখা সম্ভব নয়, কেননা চোখকে দেখার শক্তি ইন্দ্রিয়ের বিষয় নয়, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়াদি নিজেই অতীন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয়াদিকে ইন্দ্রিয়গুলি দেখে না, দেখে মন। মনকে যে দেখে, সে হলো বুদ্ধি, মন নিজে নয়। বুদ্ধিকে বুদ্ধি দ্বারা দেখা যায় না, যে দেখে, সে হলো অহং। অহংকেও অহং দেখে না, দেখেন সেই স্বয়ং স্ব-স্বরূপ। কিন্তু স্ব-স্বরূপ নিজেই নিজেকে দেখেন। অতএব এই পরমাত্মতত্ত্ব নিজেই নিজের জ্ঞাতা। এখানে কর্তা, কর্ম, করণ ও ক্রিয়া একই—পরমেশ্বর।




কে কৃষ্ণকে ভালোবাসে? কে কৃষ্ণকে তুষ্ট ও তৃপ্ত করে? Who loves the Divine? It is the Divine that loves the Divine. এই ভালোবাসার ও তৃপ্তিবিধানের যিনি পূর্ণতা, তিনিই শ্রীরাধা।




হ্লাদিনীর সার ‘প্রেম’, প্রেমসার ‘ভাব’।
ভাবের পরমকাষ্ঠা, নাম—‘মহাভাব’।।
মহাভাবস্বরূপা শ্রীরাধা–ঠাকুরাণী।
সর্বগুণখনি কৃষ্ণকান্তাশিরোমণি।।
কৃষ্ণপ্রেম–ভাবিত যাঁর চিত্তেন্দ্রিয়–কায়।
কৃষ্ণ–নিজশক্তি রাধা ক্রীড়ার সহায়।।
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪/৬৮-৬৯, ৭১)




শ্রীমতী রাধিকা শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তির সাররূপা। শ্রীকৃষ্ণের যাঁরা কান্তা, শ্রীমতী রাধিকা হতেই তাঁদের বিস্তার হয়ে থাকে। লক্ষ্মীগণ শ্রীরাধিকার অংশবিভূতি, মহিষীগণ শ্রীরাধিকার বিম্ব ও প্রতিবিম্বরূপা। লক্ষ্মীগণকে বৈভব বিলাসাংশরূপ আর মহিষীগণকে প্রাভব প্রকাশস্বরূপ বলা হয়ে থাকে। ব্রজগোপীগণ শ্রীরাধার কায়ব্যূহরূপা।




কৃষ্ণকান্তাগণ দেখি ত্রিবিধ প্রকার।
এক লক্ষ্মীগণ, পুরে মহিষীগণ আর।।
ব্রজাঙ্গনা–রূপ, আর কান্তাগণ–সার।
শ্রীরাধিকা হৈতে কান্তাগণের বিস্তার।।
অবতারী কৃষ্ণ যৈছে করে অবতার।
অংশিনী রাধা হৈতে তিন গণের বিস্তার।।
বৈভবগণ যেন তাঁর অঙ্গ–বিভূতি।
বিম্ব–প্রতিবিম্ব–রূপ মহিষীর ততি।।
লক্ষ্মীগণ তাঁর বৈভব–বিলাসাংশরূপ।
মহিষীগণ বৈভব–প্রকাশস্বরূপ।।
আকার স্বভাব–ভেদে ব্রজদেবীগণ।
কায়ব্যূহরূপ তাঁর রসের কারণ।।
বহু কান্তা বিনা নহে রসের উল্লাস।
লীলার সহায় লাগি’ বহুত প্রকাশ।।
তার মধ্যে ব্রজে নানা ভাব–রস–ভেদে।
কৃষ্ণকে করায় রাসাদিক–লীলাস্বাদে।।
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪/৭৪-৮১)




'অংশবিভূতি' অর্থ বৈভবাংশ বা বিলাস। বিম্ব–প্রতিবিম্ব–রূপ—'বিম্ব' অর্থ দেহ; 'প্রতিবিম্ব' অর্থ প্রতিচ্ছবি, অর্থাৎ প্রতিমূর্তিস্বরূপ। 'লক্ষ্মীগণ'—যেমন শ্রীকৃষ্ণের বিলাস পরব্যোমনাথ নারায়ণ; এইরূপ পরব্যোম-নাথ নারায়ণের কান্তা শ্রীলক্ষ্মীও শ্রীরাধিকার বিলাস এবং অন্য জায়গার লক্ষ্মীগণ শ্রীরাধিকার বিলাস—পরব্যোমনাথ-নারায়ণের কান্তা লক্ষ্মীর অংশ, তা-ই বললেন—লক্ষ্মীগণ তাঁর বৈভব বিলাসাংশরূপ।




'কায়ব্যূহ'—একশরীরের বহুতর শরীর প্রকটকরণের নাম 'কায়ব্যূহ'। ব্রজদেবীগণ শ্রীরাধার কায়ব্যূহ রূপ, অর্থাৎ কায়ব্যূহসদৃশ। একই শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণকে রসবিশেষ আস্বাদন করাবার জন্যই শ্রীমদ্‌ব্রজদেবী রূপে বহু হয়েছেন। 'তার মধ্যে'—বহু কান্তার মধ্যে—নানান ভাবরসভেদে।




গোবিন্দানন্দিনী, রাধা, গোবিন্দমোহিনী ।
গোবিন্দসর্বস্ব, সর্বকান্তা–শিরোমণি।।
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪/৮২)




শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীমতী রাধারাণীর সমস্ত লীলাই প্রেমময়, কামময় নয়। কাম ও প্রেম এক নয়—




আত্মেন্দ্রিয়প্রীতি–বাঞ্ছা—তারে বলি, ‘কাম’।
কৃষ্ণেন্দ্রিয়প্রীতি–ইচ্ছা ধরে ‘প্রেম’ নাম।।
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪/১৬৫)




'বৃহৎ-গৌতমীয়-তন্ত্রম'-এ বর্ণিত আছে–
দেবী কৃষ্ণময়ী প্রোক্তা রাধিকা পরদেবতা ।
সর্বলক্ষ্মীময়ী সর্বকান্তিঃ সম্মোহিনী পরা।।




অর্থাৎ শ্রীরাধিকা দেবী কৃষ্ণময়ী, পরদেবতা, সর্বলক্ষ্মীময়ী, সর্বকান্তি, সম্মোহিনী এবং পরা (ব্রহ্মময়ী) বলে কথিত হন।




স্তোত্রং রাধানাং পতে গির্বাহো বীর যস্য তে। বিভূতিরস্তু সুনৃতা।। (সামবেদ সংহিতা, উত্তরার্চিক—ষোড়শ অধ্যায়, ৩/১৫/২)




উপাস্যগণের শ্রেষ্ঠ, দুষ্প্রবৃত্তি দমনকারী, স্তুতিমন্ত্রের প্রাপক, হে দেব! রাধা-যুক্ত বা সত্ত্বভাবসম্বন্ধ-যুক্ত আমাদের স্তোত্র আপনাকেই প্রাপ্ত হয়। আপনার ঐশ্বর্যবিভূতি আমাদের পক্ষে অক্ষয় হোক। (ভাব এই যে, আমার স্তোত্র সত্ত্বভাবসম্পন্ন হোক; তার দ্বারাই আমার অভ্যুদয় হয়)। [এই মন্ত্রের ‘যস্য’ পদটি পূর্ব-মন্ত্রের সম্বন্ধ খ্যাপন বা ঘোষণা করছে। মন্ত্রে শুদ্ধসত্ত্বভাবের সাথে ভগবানের যে অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধ, এখানে সেই উক্তিরই প্রতিধ্বনি দেখতে পাওয়া যায়]।




শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের চতুর্থ পরিচ্ছেদে (আদিলীলায়) এই শ্লোকটি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যাত বা আস্বাদিত হয়েছে—




দেবী কহি দ্যোতমানা পরমসুন্দরী।
কিম্বা কৃষ্ণ-ক্রীড়া-পূজার বসতি নগরী।।
কৃষ্ণময়ী কৃষ্ণ যাঁর ভিতরে বাহিরে।
যাহা যাহা নেত্র পড়ে তাহা কৃষ্ণ স্ফুরে।।
কিম্বা প্রেমরসময় কৃষ্ণের স্বরূপ।
তাঁর শক্তি তাঁর সহ হয় একরূপ।।
কৃষ্ণবাঞ্ছা পূর্তিরূপ করে আরাধনে।
অতএব রাধা নামে পুরাণে বাখানে।।




ব্যাখ্যা: 'দেবী' শব্দের অর্থ 'দ্যোতমানা' অর্থাৎ দীপ্তিময়ী, এটা দ্বারা শ্রীরাধা পরমাসুন্দরী; অথবা দিব্ ধাতুর অর্থ পূজা, ক্রীড়া, গতি প্রভৃতি হেতু শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণের পূজা ও ক্রীড়ার আধারস্বরূপা। 'কৃষ্ণময়ী' শব্দের অর্থ এই যে, শ্রীরাধার ভেতরে এবং বাইরে যে-কোনো স্থানে নেত্রপাত হয়, সেই স্থানেই তাঁর সম্বন্ধে শ্রীকৃষ্ণের স্ফুর্তি হয়ে থাকে; অথবা শ্রীকৃষ্ণ প্রেমরসময়, এ কারণে শ্রীরাধাও তাঁর স্বরূপ, কেননা শ্রীকৃষ্ণের শক্তি শ্রীকৃষ্ণের সাথে অভিন্ন রূপ হয়ে প্রকাশিত। 'রাধা' শব্দের অর্থ এই যে, যিনি শ্রীকৃষ্ণের বাঞ্ছাপূর্তিরূপ আরাধনা করেন—এ কারণে তাঁর নাম রাধা—পুরাণ এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।




অতএব সর্বপূজ্যা পরমদেবতা।
সর্বপালিকা সর্বজগতের মাতা।।
সর্বলক্ষ্মী শব্দ পূর্বে করিয়াছি ব্যাখ্যান।
সর্বলক্ষ্মীগণের তিঁহো হয় অধিষ্ঠান।।
কিম্বা সর্বলক্ষ্মী কৃষ্ণের ষড়বিধ ঐশ্বর্য।
তাঁর অধিষ্ঠাত্রী শক্তি সর্বশক্তিবর্য।।
সর্ব সৌন্দর্য কান্তি বসয়ে তাঁহাতে।
সর্বলক্ষ্মীগণের শোভা হয় যাহা হৈতে।।




ব্যাখ্যা: অতএব, শ্রীরাধা সর্বপূজ্যা, পরমদেবতা, সর্বপালিকা ও পুরো জগতের মাতা। শ্রীরাধা সর্বলক্ষ্মীগণের অধিষ্ঠানস্বরূপা। অথবা ‘সর্বলক্ষ্মী’ শব্দে শ্রীকৃষ্ণের ছয় প্রকার ঐশ্বর্য (সৌন্দর্য, সম্পদ, শক্তি, খ্যাতি, জ্ঞান এবং ত্যাগ)—শ্রীরাধা ওই ছয় প্রকার ঐশ্বর্যের অধিষ্ঠাত্রী শক্তি, এ কারণে তিনি সকল শক্তির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। 'কান্তি' শব্দের অর্থ সৌন্দর্য, ঐ সৌন্দর্য রাধাতে বসতি করে। অতএব, শ্রীরাধা হতেই সর্বলক্ষ্মীগণের শোভা হয়ে থাকে।




কিম্বা কান্তি শব্দে কৃষ্ণের সব ইচ্ছা কহে।
কৃষ্ণের সকল বাঞ্ছা রাধাতেই রহে।।
রাধিকা করেন কৃষ্ণের বাঞ্ছিত পূরণ।
সর্বকান্তি শব্দের এই অর্থ বিবরণ।।
জগৎমোহন কৃষ্ণ, তাঁহার মোহিনী।
অতএব সমস্তের পরা ঠাকুরাণী।।
রাধা পূর্ণশক্তি, কৃষ্ণ পূর্ণ শক্তিমান।
দুই বস্তু ভেদ নাহি শাস্ত্র পরমাণ।।




ব্যাখ্যা: কিংবা 'কান্তি' শব্দে শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত ইচ্ছেকে বলে, এ কারণেই শ্রীকৃষ্ণের সকল ইচ্ছেই শ্রীরাধাতে অবস্থান করছে। অথবা শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণের বাঞ্ছা পূর্ণ করেন, 'সর্বকান্তি' শব্দের এই অর্থ বিবরণ করলাম। যিনি জগৎমোহন শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধা তাঁর মোহিনী, তাই শ্রীরাধা সকলের পূজ্যতমা। শ্রীরাধা পূর্ণশক্তি এবং কৃষ্ণ পূর্ণশক্তিমান—এই দুই এক বস্তু, শাস্ত্রের প্রমাণানুসারে এঁদের পরস্পরের ভেদ নেই।




শক্তিতত্ত্বের আলোচনায় একটি কথা মনে রাখতে হবে। শক্তিমাত্রেই অমূর্ত, শক্তিমানকে আশ্রয় করেই শক্তির বিলাস হয়। ভগবৎ-সন্দর্ভে শ্রীজীবগোস্বামী মহোদয় বলেছেন—তত্র তাসাং কেবল শক্তিমাত্রত্বেনামূর্তানাং ভগবদ্‌ বিগ্রহাদ্বৈকাত্বেন স্থিতিঃ—শক্তি যখন কেবল শক্তিমাত্র, তখন তা ভগবানের বিগ্রহের সাথে এক হয়ে অবস্থিত। লীলা-বিলাসে শক্তি ভিন্ন হয়েও অভিন্ন। তখন তার দ্বিরূপত্ব সাধিত হয়।




হ্লাদিনী শক্তির সারাংশ-প্রধানকে গুহ্যবিদ্যা, সংবিৎ শক্তির সারাংশ-প্রধানকে আত্মবিদ্যা, আর সন্ধিনী শক্তির সারাংশ-প্রধানকে অব্যয়শক্তি বলে। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত বলছেন—




ব্রজেন্দ্রনন্দন কৃষ্ণ নায়ক শিরোমণি।
নায়িকার শিরোমণি রাধা ঠাকুরাণী।।




শ্রীল রায় রামানন্দের সাথে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কথোপকথন, যা শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের মধ্যলীলার অষ্টম পরিচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে, তাতে শ্রীরাধাতত্ত্ব সম্পর্কে আছে—




কৃষ্ণের অনন্ত শক্তি তাতে তিন প্রধান।
চিচ্ছক্তি মায়াশক্তি জীবশক্তি নাম।।
অন্তরঙ্গা বহিরঙ্গা তটস্থা কহি যারে।
অন্তরঙ্গা স্বরূপশক্তি সবার উপরে।।




ব্যাখ্যা: শ্রীকৃষ্ণের অনন্ত শক্তি, তাতে তিনটি প্রধান, তাদের নাম—চিৎশক্তি, মায়াশক্তি ও জীবশক্তি; এই তিনকে অন্তরঙ্গা, বহিরঙ্গা ও তটস্থা শক্তি বলা যায়। অন্তরঙ্গা শক্তিকে স্বরূপ-শক্তি বলে, এই শক্তি সকল শক্তির প্রধান।




সৎ চিৎ আনন্দ হয় কৃষ্ণের স্বরূপ।
অতএব স্বরূপশক্তি হয় তিনরূপ।।
আনন্দাংশে হ্লাদিনী, সদংশে সন্ধিনী।
চিদংশে সম্বিৎ যারে জ্ঞান করি মানি।।




ব্যাখ্যা: শ্রীকৃষ্ণ সৎ, চিৎ ও আনন্দময় স্বরূপ—তাই স্বরূপ-শক্তি তিন প্রকারের হয়—আনন্দ অংশে হ্লাদিনী, সৎ (নিত্য) অংশে সন্ধিনী এবং চিৎ (জ্ঞান) অংশে সংবিৎ অর্থাৎ জ্ঞানশক্তি বলে যাকে মানা যায়। এ বিষয়ের প্রমাণ ভক্তিরসামৃতসিন্ধুর পূর্ব বিভাগে রতিলহরীর ১ শ্লোকের ব্যাখ্যায় ধৃত বিষ্ণুপুরাণের প্রথমাংশীয় ১২ অধ্যায়ে ৬৯ শ্লোক, যথা—ধ্রুব বললেন, হে ভগবান! তুমি সকলের আধার, তোমাতে হ্লাদিনী, সন্ধিনী ও সংবিৎ, এই ত্রিবিধ শক্তি সাম্যাবস্থায় অবস্থিতি করছে। হ্লাদিনী শক্তি আহ্লাদকারী (মনোপ্রসাদ-জনক সত্ত্ব গুণ) সন্ধিনী শক্তি তাপকারী (বিষয়-বিয়োগাদিতে দুঃখ-জনক তমোগুণ) এবং সংবিৎ শক্তি উভয়ের মিশ্রিত রূপ (উভয়াত্মক রজোগুণ)।




কৃষ্ণকে আহ্লাদে তাতে নাম আহ্লদিনী।
সেই শক্তিদ্বারে সুখ আস্বাদে আপনি।।
সুখরূপ কৃষ্ণ করে সুখ আস্বাদন।
ভক্তগণে সুখ দিতে হ্লাদিনী কারণ।।
হ্লাদিনীর সার অংশ তার প্রেম নাম।
আনন্দ চিন্ময়রস প্রেমেয় আখ্যান।।
প্রেমের পরমসার মহাভাব জানি।
সেই মহাভাবরূপা রাধাঠাকুরাণী।।




ব্যাখ্যা: হ্লাদিনী শক্তি শ্রীকৃষ্ণকে আহ্লাদ দেন বলে তাঁর নাম আহ্লাদিনী। শ্রীকৃষ্ণ এই শক্তি দ্বারা স্বয়ং সুখ আস্বাদন করেন। স্বয়ং সুখময় শ্রীকৃষ্ণও সুখ আস্বাদন করেন, যাতে ভক্তগণকে সুখ দিতে সেই আহ্লাদিনী কারণ-স্বরূপা হন। হ্লাদিনীর যে-সার-অংশ, তার নাম প্রেম; ওই প্রেম-আনন্দ চিন্ময়-স্বরূপ, প্রেমের সর্বোত্তম সারভাগের নাম মহাভাব, শ্রীরাধা ঠাকুরাণী সেই মহাভাবের স্বরূপ। এই বিষয়ের প্রমাণ উজ্জ্বলনীলমণির রাধাপ্রকরণে রাধা-চন্দ্রাবলীর শ্রেষ্ঠত্ব কথনে ২ শ্লোকে শ্রীরূপগোস্বামির বাক্য, যথা: রাধা ও চন্দ্রাবলী, এই দুইয়ের মধ্যে সর্বপ্রকারে রাধিকা অধিকারিণী, ইনি মহাভাবস্বরূপা এবং গুণ দ্বারা অতিশয় গরিয়সী।




প্রেমের স্বরূপ দেহ প্রেমে বিভাবিত।
কৃষ্ণের প্রেয়সী-শ্রেষ্ঠা জগতে বিদিত।।
সেই মহাভাব হয় চিন্তামণি সার।
কৃষ্ণবাঞ্ছা পূর্ণ করে এই কার্য তার।।
মহাভাব চিন্তামণি রাধার স্বরূপ।
ললিতাদি সখী তাঁর কায়ব্যূহরূপ।।




ব্যাখ্যা: শ্রীরাধার দেহ প্রেমের স্বরূপ ও প্রেম দ্বারা ভাবিত (মিশ্রিত)। এই বিষয়ের প্রমাণ ব্রহ্মসংহিতায় ৩৭ শ্লোকে, যথা—আনন্দ-চিন্ময়রস দ্বারা প্রতিভাবিত স্বীয়শক্তিস্বরূপা গোপরামাদের সাথে যিনি নিত্য গোলোকে বাস করছেন, সেই নিখিল জীবের আত্মস্বরূপ গোবিন্দ আদিপুরুষকে আমি ভজনা করি। সেই মহাভাব-রূপ চিন্তামণি সকলের সারস্বরূপ এবং কৃষ্ণবাঞ্ছা পূর্ণ করাই যাঁর কাজ, সেই মহাভাবচিন্তামণি শ্রীরাধার স্বরূপ, ললিতাদি সখিগণ তাঁর কায়ব্যূহ অর্থাৎ শরীরের প্রকাশবিশেষ।




রাধা প্রতি কৃষ্ণস্নেহ সুগন্ধি উদ্বর্তন।
তাতে অতি সুগন্ধি দেহ উজ্জ্বলবরণ।।
কারুণ্যামৃতধারায় স্নান প্রথম।
তারুণ্যামৃতধারায় স্নান মধ্যম।।
লাবণ্যামৃতধারায় তদুপরি স্নান।
নিজলজ্জা শ্যাম পট্ট শাড়ী পরিধান।।
কৃষ্ণ-অনুরাগ রক্ত দ্বিতীয় বসন।
প্রণয়মান কঞ্চুলিকায় বক্ষ আচ্ছাদন।।
সৌন্দর্যকুঙ্কুম সখী প্রণয়চন্দন।
স্মিত কান্তি কর্পূর তিনে অঙ্গ বিলেপন।।




ব্যাখ্যা: শ্রীরাধার প্রতি যে শ্রীকৃষ্ণের স্নেহ, তা-ই সুগন্ধি উদ্বর্তন (অঙ্গমার্জন) এবং তার সাহায্যে শ্রীরাধার শরীর অতি সুগন্ধিযুক্ত ও উজ্জ্বলবর্ণ হয়। কারুণ্যরূপ অমৃতধারায় শ্রীরাধার প্রথম স্নান। তারুণ্যরূপ অমৃতধারায় মধ্যম স্নান, লাবণ্যরূপ অমৃতধারায় তার উপর স্নান, অর্থাৎ শ্রীরাধার দেহ প্রথমত করুণায় পরিপূর্ণ, দ্বিতীয়ত তরুণিমায় (যৌবনে) এবং তৃতীয়ত লাবণ্যে পরিশোভিত। অপরদিকে, শ্রীরাধা নিজের লজ্জারূপ যে-শ্যামবর্ণ, তা-ই পট্টবস্ত্ররূপে পরিধান করেছেন অর্থাৎ লজ্জা দ্বারা সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত, সেখানে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি যে অনুরাগ, তা-ই রক্ত অর্থাৎ অরুণবর্ণ দ্বিতীয় উত্তরীয় বসন অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণানুরাগই তাঁর অঙ্গের আচ্ছাদন। প্রণয়মান দ্বারা বক্ষোদেশ আচ্ছাদিত; অপর শ্রীরাধার নিজের যে-সৌন্দর্য, তা-ই কুঙ্কুম (ফুল); সখিদের যে-প্রণয়, তা-ই চন্দন; এবং নিজের ঈষৎ হাস্যের যে-কান্তি, তা-ই কর্পূর—এই তিন দ্বারা শ্রীরাধার অঙ্গবিলেপন অর্থাৎ তাঁর নিজের সৌন্দর্য, সখিদের প্রণয় ও নিজের ঈষৎ হাস্য—এই তিন দ্বারা শ্রীরাধার মূর্তি পরিলিপ্ত।




'স্নেহ' অর্থ: ভক্তিরসামৃতসিন্ধুর পশ্চিমবিভাগের প্রীতি ভক্তিরস দ্বিতীয় লহরীতে ৩৩ অঙ্কে এক চমৎকার কথা বলা হয়েছে—
সান্দ্রশ্চিত্তদ্রবং কুর্বন্ প্রেমা স্নেহ ইতীর্যতে।
ক্ষণিকস্যাপি নেহ স্যাদ্বিশ্লেষস্য সহিষ্ণুতা।।




অর্থ: প্রেম গাঢ় হয়ে চিত্তকে দ্রবীভূত করলে তাকে স্নেহ বলে। এই স্নেহে ক্ষণকালও বিচ্ছেদ সহ্য হয় না।




'প্রণয়মান' অর্থ: উজ্জ্বলনীলমণির বিপ্রলম্ভপ্রকরণে ৪০, ৪১ অঙ্কে, যথা—
অকারণাদ্দুয়োরেব কারণাভাসতা তথা।
প্রোদ্যন্ প্রণয় এবায়ং ব্রজের্ন্নিহেতুমানতাং।।
আদ্যং মানং পরীণামং প্রণয়স্য জগুর্বুধাঃ।
দ্বিতীয়ং পুনরস্যৈব বিলাসভরবৈভবং।
বুধৈঃ প্রণয়মানাখ্য এষ এব প্রকীর্তিতঃ।।




অর্থ: কারণের অভাব অথবা দুইয়ের অর্থাৎ নায়ক ও নায়িকার কারণাভাস হেতু যে-প্রণয় উদিত হয়, তা-ই নির্হেতুমানতা প্রাপ্ত হয়ে থাকে। পণ্ডিতগণ প্রণয়ের পরিণামকে আদ্যমান অর্থাৎ সহেতুক মান বলেন, আর ওই প্রণয়ের বিলাসজনিত বৈভবকে দ্বিতীয় অর্থাৎ নির্হেতুমান বলেন। বিদ্বানেরা একেই প্রণয়মান বলে প্রচার করেছেন।




কৃষ্ণের উজ্জ্বলরস মৃগমদভর।
সেই মৃগমদে বিচিত্রিত কলেবর।।
প্রচ্ছন্ন-মান বাম্য ধম্মিল্ল বিন্যাস।
ধীরাধীরাত্বগুণ অঙ্গে পট্টবাস।।
রাগতাম্বুলরাগে অধর উজ্জ্বল।
প্রেমকৌটিল্য নেত্রযুগলে কজ্জল।।
সূদ্দীপ্ত সাত্ত্বিকভাব হর্ষাদি সঞ্চারী।
এই সব ভাবভূষণ প্রতি অঙ্গে ভরি।।




ব্যাখ্যা: শ্রীকৃষ্ণের যে উজ্জ্বল (শৃঙ্গার) রস, তা-ই মৃগমদ (কস্তুরী), সেই মৃগমদে শ্রীরাধার অঙ্গ চিত্রবিচিত্র। প্রচ্ছন্ন (আচ্ছাদিত) মান ও বাম্য (বামতা) এই দুই ধম্মিল্ল অর্থাৎ সংযত কেশপাশের বিন্যাস। আর ধীরাধীরত্ব যে-গুণ, তা-ই অঙ্গে পটবাস অর্থাৎ সুগন্ধিচূর্ণ। রাগরূপ তাম্বুলরক্তিমায় অধর উজ্জ্বল, আর প্রেমের যে-কুটিলতাভাব, তা-ই নেত্রে কজ্জল বা কাজল স্বরূপ। সেখানে সূদ্দীপ্ত সাত্ত্বিক ভাব ও হর্ষ প্রভৃতি সঞ্চারি ভাব—এ সমস্ত ভাবরূপ অলংকারে শ্রীরাধার প্রত্যেক অঙ্গ পরিপূর্ণ।




'মান' অর্থ: উজ্জ্বলনীলমণির বিপ্রলম্ভ প্রকরণে ৩১ অঙ্কে, যথা—




দম্পত্যোর্ভাব একত্র সতোরপ্যনুরক্তয়োঃ।
স্বাভীষ্টাশ্লেষবীক্ষাদি নিরোধী মান উচ্যতে।।
সঞ্চারিণোহত্র নির্বেদশঙ্কামর্ষাঃ সচাপলাঃ।
গর্বাসূয়াবহিত্থাশ্চ গ্লানিশ্চিন্তাদয়োহপ্যমী।।




অর্থ: পরস্পর অনুরক্ত এবং একত্রে অবস্থিত যে-দম্পতি অর্থাৎ নায়ক-নায়িকা, তাদের স্বীয় অভিমত আলিঙ্গন ও বীক্ষণাদির রোধকারীকে মান বলে। সূত্রে আদি শব্দ প্রয়োগহেতু পৃথক অবস্থানেও মান সম্ভব হয়। এই মানে নির্বেদ, শঙ্কা, অমর্ষ (ক্রোধ), চপলতা, গর্ব, অসূয়া, অবহিত্থা (ভাবগোপন) গ্লানি এবং চিন্তা প্রভৃতি সঞ্চারিভাব হয়।




'ধীরাধীরা' অর্থ: উজ্জ্বলনীলমণির নায়িকাভেদ প্রকরণে ২২ অঙ্কে দেখি—"ধীরাধীরা তু বক্রোক্তা সবাষ্পং বদতি প্রিয়ং" অর্থাৎ যে নায়িকা অশ্রু বিমোচনপূর্বক প্রিয়তমের প্রতি বক্রোক্তি প্রয়োগ করে, তাকে ধীরাধীরা বলা যায়।




'রাগঃ' অর্থ: উজ্জ্বলনীলমণির স্থায়ীভাব প্রকরণে ৮৪ অঙ্কে আছে—
দুঃখমপ্যধিকং চিত্তে সুখত্বেনৈব ব্যজ্যতে।
যতস্তু প্রণয়োৎকর্ষাৎ স রাগ ইতি কীর্ত্যতে।।




অর্থ: প্রণয়ের উৎকর্ষহেতু যখন চিত্তের মধ্যে অতিশয় দুঃখও সুখত্বরূপে অনুভূত হয়, তখন তার নাম রাগ।




'প্রেম' অর্থ: উজ্জ্বলনীলমণির স্থায়ীভাব প্রকরণে ৪৬ অঙ্কে, যথা—
সর্বথা ধ্বংসরহিতং সত্যপি ধ্বংসকারণে।
যদ্ভাববন্ধনং যূনোঃ স প্রেমা পরিকীর্তিতঃ।।




অর্থ: ধ্বংসের কারণ সত্ত্বেও যার ধ্বংস হয় না, এমন যুবক-যুবতীর পারস্পরিক ভাববন্ধনকে প্রেম বলে।




'উদ্দীপ্ত' ও 'সূদ্দীপ্ত সাত্ত্বিক ভাব' অর্থ: ভক্তিরসামৃতসিন্ধুর দক্ষিণ বিভাগে তৃতীয় সাত্ত্বিক লহরীর ৪৬/৪৭ অঙ্কে, যথা—




একদা ব্যক্তিমাপন্নাঃ পঞ্চষাঃ সর্ব এব বা।
আরূঢ়াঃ পরমোৎকর্ষাঃ সূদ্দীপ্তা ইতি কীর্তিতাঃ।।




অর্থ: এককালীন যদি পাঁচ, ছয় অথবা সমস্ত ভাব উদিত হয়ে পরম উৎকর্ষ প্রাপ্ত হয়, তবেই তাদেরকে সূদ্দীপ্ত ভাব বলে।




সাত্ত্বিক ভাব সকল মহাভাবে পরম উৎকৃষ্টতা ধারণ করে, এ কারণে উদ্দীপ্ত সকল ভাবই মহাভাবে সূদ্দীপ্ত (সু+উদ্দীপ্ত) হয়।




'সাত্ত্বিক' অর্থ: ভক্তিরসামৃতসিন্ধুর দক্ষিণবিভাগে তৃতীয় সাত্ত্বিক লহরীর ১/২ শ্লোকে, যথা—




কৃষ্ণ সম্বন্ধিনী সাক্ষাৎ কিঞ্চিদ্বা ব্যবধানতঃ।
ভাবৈশ্চিত্তমিহাক্রান্তং সত্ত্বমিত্যুচ্যুতে বুধৈঃ।।
সত্ত্বাদস্মাৎ সমুৎপন্না যে-ভাবা স্তেতু সাত্ত্বিকাঃ।
স্নিগ্ধা দিগ্ধা স্তথা রুক্ষা ইত্যমী ত্রিবিধা মতাঃ।।




অর্থ: সাক্ষাৎ কৃষ্ণসম্বন্ধীয় অথবা কিঞ্চিৎ ব্যবধানহেতু ভাবসমূহে, চিত্ত আক্রান্ত হলে পণ্ডিতগণ তাকে সত্ত্ব বলে থাকেন। সত্ত্ব হতে উৎপন্ন যে-সকল ভাব, তাদেরকে সাত্ত্বিক বলে। এই সাত্ত্বিক তিন প্রকার: স্নিগ্ধ, দিগ্ধ এবং রুক্ষ।




রুক্ষ সাত্ত্বিক ভাব আট প্রকার, উক্ত প্রকরণের ৭ অঙ্কে—
তে স্তম্ভ স্বেদ রোমাঞ্চাঃ স্বরভেদোহথ বেপথুঃ।
বৈবর্ণ্য মশ্রু প্রলয় ইত্যষ্টৌ সাত্ত্বিকাঃ স্মৃতাঃ।।




স্তম্ভ, স্বেদ (ঘাম), রোমাঞ্চ, স্বরভেদ, কম্প, বৈবর্ণ্য, অশ্রু ও প্রলয়, এই আটটিকে সাত্ত্বিক ভাব বলে।




হর্ষ কী? ভক্তিরসামৃতসিন্ধুর দক্ষিণ বিভাগে চতুর্থ ব্যভিচারি লহরীর ৭৮ অঙ্কে—




অভীষ্টেক্ষণলাভাদিজাতা চেতঃপ্রসন্নতা।
হর্ষঃ স্যাদিহ রোমাঞ্চঃ স্বেদোহশ্রু মুখফুল্লতা।
আবেগোন্মাদ জড়তা স্তথা মোহাদয়োহপিচ।।




অর্থ: অভীষ্টবস্তুর দর্শন ও লাভাদিজনিত চিত্তের প্রসন্নতার নাম হর্ষ। এতে রোমাঞ্চ, ঘাম, অশ্রু, মুখ প্রফুল্ল, ত্বরা, উন্মাদ, জড়তা এবং মোহ প্রভৃতি হয়ে থাকে।




'সঞ্চারী' অর্থ: উপরোক্ত প্রকরণের ২ শ্লোকে, যথা—
বাগঙ্গসত্ত্বসূচ্যা যে জ্ঞেয়াস্তে ব্যভিচারিণঃ।
সঞ্চারয়ন্তি ভাবস্য গতিং সঞ্চারিণোহপি তে।।




অর্থ: বাক্য, ভ্রূ, নেত্রাদি অঙ্গ এবং সত্ত্বোৎপন্ন ভাব দ্বারা যে-সকল ভাব প্রকাশিত হয়, তারাই ব্যভিচারী। এ সমস্ত ব্যভিচারী ভাবের মধ্যে গতিসঞ্চার করে বলে এদেরকে সঞ্চারি ভাবও বলা যায়।




কিলকিঞ্চিতাদি ভাব বিংশতি ভূষিত।
গুণশ্রেণী পুষ্পমালা সর্বাঙ্গে পূরিত।।




ব্যাখ্যা: কিলকিঞ্চিৎ প্রভৃতি বিশটি ভাবরূপ অলংকার দ্বারা শ্রীরাধা বিভূষিতা এবং গুণশ্রেণীরূপ পুষ্পমালা দ্বারা তাঁর সমস্ত অঙ্গ পরিপূরিত।




'কিলকিঞ্চিতাদি বিংশতি অলংকার' অর্থ: উজ্জ্বলনীলমণির অনুভাবপ্রকরণে ৫৮ থেকে ৭১ অঙ্ক পর্যন্ত—
ভাবো হাবশ্চ হেলাচ, প্রোক্তাস্তত্র ত্রয়োহঙ্গজাঃ।
শোভা কান্তিশ্চ দীপ্তিশ্চ মাধুর্যঞ্চ প্রগ্‌লভতা।।
ঔদার্যং ধৈর্যমিত্যেতে সপ্তৈব স্যুরযত্নজাঃ।
লীলাবিলাসো বিচ্ছিত্তি বির্ভ্রমঃ কিলকিঞ্চিতং।।
মোটায়িতং কুট্টমিতং বিব্বোকো ললিতং তথা।
বিকৃতং চেতি বিজ্ঞেয়া দশ তাসাং স্বভাবজাঃ।।




অর্থ: উক্ত নায়িকাদের যৌবনাবস্থায় কান্তের প্রতি সর্বপ্রকারে অভিনিবেশ জন্য যে-সকল সত্ত্বগুণজনিত অলংকার উদিত হয়, তাদের সংখ্যা বিশ। সেগুলির মধ্যে ভাব, হাব ও হেলা, এই তিনটি অঙ্গজ। আর শোভা, কান্তি, দীপ্তি, মাধুর্য, প্রগ্‌লভতা, ঔদার্য ও ধৈর্য, এই সাতটি অযত্নজ অর্থাৎ শোভাদির কারণেই বেশাদি প্রযত্নের অভাবেও আপনাআপনিই প্রকাশ পায়। আর লীলা, বিলাস, বিচ্ছিত্তি (তিলকাদি রচনা), বিভ্রম, কিলকিঞ্চিত, মোট্টায়িত, কুট্টমিত, বিব্বোক, ললিত ও বিকৃত, এই দশটি স্বভাবজ অর্থাৎ নায়িকাদের মধ্যে স্বভাবতই ঘটে থাকে।




'ভাব' অর্থ:
প্রাদুর্ভাবং ব্রজত্যেব রত্যাখ্যে ভাব উজ্জ্বলে।
নির্বিকারাত্মকে চিত্তে ভাবঃ প্রথম বিক্রিয়া।।




অর্থ: শৃঙ্গাররসে নির্বিকারচিত্তে 'রতি' নামক স্থায়ীভাবের প্রাদুর্ভাব হলে যে প্রথম বিক্রিয়াটি (চিত্তবিকার) পরিলক্ষিত হয়, তাকে ভাব বলা যায়।




এই বিষয়ে প্রাচীনদের উক্তি, যথা—
চিত্তস্যাবিকৃতিঃ সত্ত্বং বিকৃতেঃ কারণে সতি।
তত্রাদ্য বিক্রিয়া ভাবো বীজস্যাদি বিকারবৎ।।




অর্থ: বিকারের কারণ সত্ত্বেও যে-অবিকৃতি, তাকে সত্ত্ব বলে এবং ওই সত্ত্বে যে প্রথম বিকার, তার নাম ভাব, যেমন বীজের আদি বিকার অঙ্কুর, তেমনি।




'হাব' অর্থ:
গ্রীবা রেচক সংযুক্তো ভ্রূনেত্রাদি বিকাশকৃৎ।
ভাবাদীষৎ প্রকাশো যঃ স হাব ইতি কথ্যতে।।




অর্থ: যা গ্রীবা বক্রকরণ ও ভ্রূনেত্রাদির বিকাশকারী, তথা ভাব হতে কিঞ্চিৎ উত্তম প্রকাশক বা যা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়, তাকে হাব বলা যায়।




'হেলা' অর্থ:
হাব এব ভবেদ্ধেলা ব্যক্তঃ শৃঙ্গার সূচকঃ।।




অর্থ: ওই হাব যদি স্পষ্টরূপে শৃঙ্গারসূচক হয়, তবে তাকে হেলা বলে।




'শোভা' অর্থ:
সা শোভা রূপভোগাদ্যৈ র্যং স্যাদঙ্গ বিভূষণং।।




অর্থ: রূপ ও ভোগাদি দ্বারা অঙ্গের যে-বিভূষণ, তাকেই শোভা বলে।




'কান্তি' অর্থ: 
শোভৈব কান্তি রাখ্যাতা মন্মথাপ্যায়নোজ্জ্বলী।।




অর্থ: কন্দর্প বা কামদেবের তৃপ্তির জন্য যে উজ্জ্বল শোভা, তাকে কান্তি বলে।




'দীপ্তিঃ' অর্থ: 
কান্তিরেব বয়োভোগদেশকালগুণাদিভিঃ।
উদ্দীপিতাতিবিস্তারং প্রাপ্তা চেদ্দীপ্তি রুচ্যতে।।




অর্থ: বয়স, ভোগ, দেশ, কাল ও গুণাদি দ্বারা যে-কান্তি অতিশয় রূপে বিস্তৃতা হয়, তাকে দীপ্তি বলে।




'মাধুর্য' অর্থ:
মাধুর্যং নাম চেষ্টানাং সর্বাবস্থাসু চারুতা।




অর্থ: সর্বাবস্থায় সকল চেষ্টার যে-মনোহারিত্ব, তাকে মাধুর্য বলে।




'প্রগ্‌লভতা' অর্থ:
নিঃশঙ্কত্ব প্রয়োগেষু বুধৈরুক্তা প্রগল্‌ভতা।




অর্থ: সম্ভোগ বিষয়ে যে-নিঃশঙ্কত্ব, পণ্ডিতগণ তাকেই প্রগ্‌লভতা বলেন।




'ঔদার্য' অর্থ:
ঔদার্যং বিনয়ং প্রাহুঃ সর্বাবস্থাগতং বুধাঃ।




অর্থ: সকল অবস্থাতেই যে-বিনয় প্রদর্শন করা হয়, পণ্ডিতগণ তাকেই ঔদার্য বলেন।




'ধৈর্য' অর্থ:
স্থিরা চিত্তোন্নতি র্যাতু তদ্ধৈর্য্যমিতি কীর্ত্যতে।




অর্থ: উন্নতি-অবস্থায় চিত্তের যে-স্থিরতা, তাকে ধৈর্য বলে।




'লীলা' অর্থ:
প্রিয়ানুকরণং লীলা রম্যৈ বেশক্রিয়াদিভিঃ।




অর্থ: রমণীয় বেশ ও ক্রিয়া দ্বারা প্রিয় ব্যক্তির যে-অনুকরণ, তাকে লীলা বলে।




'বিলাস' অর্থ:
গতিস্থানাসনাদীনাং মুখনেত্রাদি কর্মণাং।
তাৎকালিকন্তু বৈশিষ্ট্যং বিলাসঃ প্রিয়সঙ্গজং।।




অর্থ: গতি, স্থান, আসন, মুখ ও নেত্রাদির কর্মসমূহের প্রিয় সঙ্গমহেতু উক্ত মুহূর্তের যে-বৈশিষ্ট্য, তাকে বিলাস বলে।




'বিচ্ছিত্তি' অর্থ:
আকল্পকল্পানালাপি বিচ্ছিত্তিঃ কান্তিপোষকৃৎ।




অর্থ: বেশরচনার অল্পতা হলেও শরীরে যার উপস্থিতি পুষ্টিকারী হয়, তাকে বিচ্ছিত্তি অর্থাৎ তিলকাদি রচনা বলে।




'বিভ্রম' অর্থ:
বল্লভপ্রাপ্তিবেলায়াং মদনাবেশসম্ভ্রমাৎ।
বিভ্রমো হারমাল্যাদি ভূষাস্থান বিপর্যয়ঃ।।




অর্থ: বল্লভসমীপে অভিসার করার সময় মদনাবেশবশতঃ হারমাল্যাদির যে অযথাস্থানে ধারণ, তার নাম বিভ্রম।




'কিলকিঞ্চিতং' অর্থ:
গর্বাভিলাষ রুদিত স্মিতাসূয়া ভয়ক্রুধাং।
সঙ্করীকরণং হর্ষাদুচ্যতে কিলকিঞ্চিতং।।




অর্থ: গর্ব, অভিলাষ, রোদন, অসূয়া, ভয়, ক্রোধ ও হর্ষ, এই সাতটি ভাবের যে এককালীন প্রাকট্যকরণ অর্থাৎ এককালে সাতটি ভাবের উদয়কে কিলকিঞ্চিত বলে।




'মোট্টায়িত' অর্থ:
কান্তস্মরণবার্তাদৌ হৃদি তদ্‌ভাবভাবতঃ।
প্রাকট্যমভিলাষস্য মোট্টায়িতমুদীৰ্যতে।।




অর্থ: কান্তের স্মরণ ও তাঁর সম্পর্কে নানান বার্তা শুনলে কান্ত বিষয়ক স্থায়ীভাবের ভাবনাহেতু হৃদয়মধ্যে অভিলাষের যে-প্রকটতা, তাকে মোট্টায়িত বলে।




'কুট্টমিত' অর্থ:
স্তনাধরাদিগ্রহণে হৃৎপ্রীতাবপি সংভ্রমাৎ।
বহিঃ ক্রোধো ব্যথিতরৎ প্রোক্তং কুট্টমিতং বুধৈঃ।।




অর্থ: স্তন ও অধরাদি গ্রহণ করায় হৃদয়ের প্রীতি হলেও সঙ্গমবশত ব্যথিতের মতো বাহ্যে ক্রোধ প্রকাশ করার বিষয়টিকে পণ্ডিতগণ কুট্টমিত বলেন।




'বিব্বোক' অর্থ:
ইষ্টেহপি গর্বমানাভ্যাং বিব্বোকঃ স্যাদনাদরঃ।




অর্থ: গর্ব ও মানের ফলে ইষ্ট অর্থাৎ কান্তদত্ত বস্তুর প্রতি যে-অনাদর, তার নাম বিব্বোক।




'ললিত' অর্থ:
বিন্যাসভঙ্গিরঙ্গানাং ভ্রূবিলাসমনোহরা।
সুকুমারা ভবেদ্‌যত্র ললিতং তদুদাহৃতং।।




অর্থ: যাতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিন্যাসভঙ্গি, সুকুমারত্ব ও ভ্রূ-বিক্ষেপের মনোহারিত্ব প্রকাশ পায়, তাকে ললিত বলা যায়।




'বিকৃত' অর্থ:
হ্রীমানের্ষ্যাদিভি র্যত্র নোচ্যতে স্ববিবিক্ষিতং।
ব্যজ্যতে চেষ্টয়ৈবেদং বিকৃতং তদ্বিদুর্বুধা।।




অর্থ: লজ্জা, মান, ঈর্ষা ইত্যাদি দ্বারা যে-স্থানে বিবক্ষিত (যা বলতে ইচ্ছা করা হয়েছে এমন) বিষয় প্রকাশিত হয় না, পণ্ডিতগণ তাকে বিকৃত বলে নির্দেশ করেন।




সৌভাগ্য তিলক চারু ললাটে উজ্জ্বল।
প্রেমবৈচিত্ত্য রত্ন হৃদয়ে তরল।।
মধ্যবয়স্থিতা সখি স্কন্ধে করন্যাস।
কৃষ্ণলীলা মনোবৃত্তি সখি আশ পাশ।।
নিজাঙ্গ সৌরভালয়ে গর্ব-পর্যঙ্ক।
তাতে বসিয়াছে সদা চিন্তে কৃষ্ণসঙ্গ।।
কৃষ্ণনাম গুণ যশ অবতংশ কানে।
কৃষ্ণনাম গুণ যশ প্রবাহ বচনে।।
কৃষ্ণকে করায় শ্যামরস মধুপান।
নিরন্তর পূর্ণ করে কৃষ্ণের সর্বকাম।।
কৃষ্ণের বিশুদ্ধ প্রেম রত্নের আকর।
অনুপম গুণগণে পূর্ণ কলেবর।।




ব্যাখ্যা: সৌভাগ্যরূপ তিলকে শ্রীরাধার ললাটদেশ উজ্জ্বল এবং প্রেমবৈচিত্ত্য নামক রত্নটি হৃদয়ে তরল অর্থাৎ হারমধ্যস্থ মণিবিশেষ। শ্রীরাধা মধ্যবয়স অর্থাৎ পূর্ণযৌবন রূপ সখির কাঁধে হাতটি বিন্যস্ত করে রেখেছেন এবং কৃষ্ণলীলারূপ যে-মনোবৃত্তি, তা-ই সখিস্বরূপ হয়ে চারিদিকে অবস্থিত আছে। নিজ-অঙ্গের সৌরভ অর্থাৎ কীর্তিস্বরূপ অন্তঃপুর-মধ্যে গর্বরূপ পর্যঙ্কে (পালঙ্কে) উপবেশন করে সর্বদা কৃষ্ণসঙ্গ চিন্তা করছেন। শ্রীকৃষ্ণের নাম, গুণ ও যশ শ্রবণই অবতংস (কানের অলংকার; গৌরব বা গৌরবের বস্তু) তথা কর্ণভূষণ এবং কৃষ্ণনাম, কৃষ্ণগুণ ও কৃষ্ণযশ, এসবই বাক্যে প্রবাহিত হচ্ছে অর্থাৎ শ্রীরাধা নিরন্তর তা-ই বলছেন। সেখানে তিনি শ্যামরস অর্থাৎ শৃঙ্গাররস দ্বারা কন্দর্পমত্ততারূপ মধু পান করিয়ে নিরন্তর তাঁর সমস্ত কামনা পূর্ণ করেন। শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণের বিশুদ্ধ প্রেমরত্নের আকর (খনি) স্বরূপ এবং নিরুপম গুণসমূহে তাঁর সমস্ত অঙ্গ পরিপূর্ণ।




'প্রেমবৈচিত্ত্য' অর্থ: উজ্জ্বলনীলমণির বিপ্রলম্ভ প্রকরণে ৫৭ অঙ্কে আছে—
প্রিয়স্য সন্নিকর্ষে হপি প্রেমোৎকর্ষস্বভাবতঃ।
যা বিশ্লেষধিয়ার্তি স্তৎ প্রেমবৈচিত্ত্যমুচ্যতে।।




অর্থ: প্রেমের উৎকর্ষহেতু প্রিয় ব্যক্তির সন্নিধানে অবস্থিত হয়েও তার সাথে বিচ্ছেদভয়ে যে-পীড়া অনুভূত হয়, তাকে প্রেমবৈচিত্ত্য বলে।




'পূর্ণযৌবন' অর্থ: উজ্জ্বলনীলমণির উদ্দীপন প্রকরণে ১৪ অঙ্কে পাচ্ছি—
নিতম্বো বিপুলো মধ্যং কৃশমঙ্গং বরদ্যুতিঃ।
পীনৌ কুচা বুরুযুগ্মং রম্ভাভং পূর্ণযৌবনে।।




অর্থ: যে-বয়ঃক্রমে কামিনীদের নিতম্ব বিপুল, মধ্যদেশ ক্ষীণ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উজ্জ্বলকান্তি, স্তনযুগল স্থূল ও ঊরুযুগল রম্ভাবৃক্ষের বা কলাগাছের মতো হয়, তাকেই পূর্ণযৌবন বলে।




'গর্ব' অর্থ: ভক্তিরসামৃতসিন্ধুর দক্ষিণ বিভাগের ব্যভিচারি চতুর্থ লহরীর ২০ অঙ্কে দেখি—
সৌভাগ্যরূপতারুণ্যগুণঃ সর্বোত্তমাশ্রয়ৈঃ।
ইষ্টলাভাদিনা চান্যহেলনং গর্ব ঈর্যতে।।




অর্থ: সৌভাগ্য, রূপ, তারুণ্য, গুণ, সর্বোত্তম আশ্রয় এবং ইষ্টবস্তুর লাভাদি দ্বারা অন্যকে অবজ্ঞা করাকে গর্ব বলে।




'গুণ' অর্থ: উজ্জ্বলনীলমণির উদ্দীপন প্রকরণে ২/৩/৪ অঙ্কে—
গুণাস্ত্রিধা মানসাঃ স্যু র্বাচিকাঃ কায়িকা স্তথা।
গুণাঃ কৃতজ্ঞতাক্ষান্তিকরুণাদ্যাশ্চ মানসাঃ।।
বাচিকান্ত গুণাঃ প্রোক্তাঃ কর্ণানন্দকতাদয়ঃ।
তে বয়ো রূপলাবণ্যে সৌন্দর্যমভিরূপতা।।




অর্থ: গুণ তিন প্রকার হয়—মানসিক, বাচিক ও কায়িক। কৃতজ্ঞতা (প্রত্যুপকার করার ইচ্ছে), ক্ষান্তি (ক্ষমা) ও করুণাদি গুণগণকে মানসিক বলে। যে-বাক্য কানের জন্য আনন্দজনক হয়, তা বলার গুণকেই বাচিক গুণ বলে। বয়স, রূপ, লাবণ্য, সৌন্দর্য, অভিরূপতা, মাধুর্য ও মৃদুতা ইত্যাদিকে কায়িক গুণ বলে।