হাতে সময় থাকলে, ছেলেরা মেয়েদের পাগল বানায়। হাতে সময় থাকলে, মেয়েরা ছেলেদের পাগল বানাতে দেয়। অথচ দ্যাখো, আমরা দু-জনই খুব ব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও দু-জন দু-জনের জন্য পাগল হয়ে থাকি। আমাদের আজ অবধি দেখাই হলো না, তবু এক তোমাকে বাদে আর কিছুই আমি দেখি না, এক আমাকে বাদে আর কিছুই তুমি দেখো না। এর নামই বোধ হয় প্রেম।
আচ্ছা, বাদ দাও ওসব।
প্রথমে আমার আঁচলভরা ভালোবাসা নিয়ো। নিজেকে আজ প্রশ্ন করলাম জানো, তুমি কেমন আছ! মনে পড়ল, সেদিন ছিল অমাবস্যা, তুমি বলছিলে নৈঃশব্দ্যের প্রথম মানুষ কেমন ভালো থাকে সেই গল্প! শুধোলে, নীল, কেমন আছ?
কী কঠিন একটা প্রশ্ন! এর উত্তরে কী বলব! কী বলা যায়! তোমার কাছে শিখেছি, "কেউ ভালো থাকে না, সবাইকে ভালো থাকা শিখতে হয়। ভালো আছি কি নেই, তা নিয়ে কম ভাবাটা ভালো থাকার জন্য জরুরি।"
ভালো থাকাটা মূলত সংক্রমিত হয়; ফুল থেকে ভ্রমরে, মেঘ থেকে রামধনুতে, সবুজ থেকে প্রান্তরে, বরষা থেকে কদমে, নদী থেকে বৃক্ষে, তুমি থেকে আমিতে! আধফোটা জোছনায় তোমার চোখে দেখেছি বিপন্ন স্বপ্নদের ক্রমশ বিলীন হবার আয়োজন!
তুমি ভালো নেই, ভালো নেই শিউলি-শিশির, একটা ভাঙা আয়না, কয়েকটা কাচের চুড়ি ভালো নেই, ভালো নেই একটিও তিথি।
অতঃপর বলা যায়, আমি ভালো আছি, তোমার নিঃশব্দের প্রথম মানুষের মতো ফুরিয়ে যেতে যেতে মনে হয়… ভালোই আছি!
মনে পড়ে, আশ্বিনের চব্বিশ, কথা হচ্ছিল প্রেম নিয়ে... হঠাৎ বললে, প্রেম কি ভিখিরি হয়, নীল? বড়ো দরিদ্র… হয় সে? বলেছিলাম, প্রেম সমৃদ্ধ হয়, ভালোবাসার ঐশ্বর্যে ধনী হয়। বললে, তবে কি আমি প্রেম বুঝি না, নীল?!
এর কোনো উত্তর আমি সেদিন দিতে পারিনি।
একসময় বলতে, তুমি মানুষটা একজনম পরাজিত, একজন নেই-গল্পের মানুষ তুমি। হেসে বলতাম, উঁহু, প্রেমবিজয়ী তুমি। তোমার গল্পের জীবন প্রেমে সমৃদ্ধ। ভাবতাম, একটা কাশবন-প্রেম তোমাকে অনেকখানি ভালো রাখবে। উর্বর পলি সতেজ শব্দে প্লাবিত হবে আরও কয়েকটা যুগ! তুমি তামাটে কৃষক নও, তুমি উর্বর শব্দভূমির চাষী! প্রেম তোমাকে সমৃদ্ধ করবেই অবশেষে।
আজ এই নিশির শেষ প্রহরে, তোমায় লিখতে বসে মনে হলো, আমি ভুল ছিলাম। প্রেম সত্যিই দরিদ্র। নেই কোনো ঐশ্বর্য। নীলপ্রেম কোনো সমৃদ্ধি দিতে পারেনি একজন তোমাকেও! অসময়ী কৃষ্ণচূড়া এসে অসময়ী প্রেম সাজিয়ে দিয়ে গেল তোমার শহরে, অথচ আজও প্রেম শেখা হলো না আমার।
তুমি আগের মতোই পরাজিত মানুষ এক, এই বসন্তে জন্মায়নি একটাও নতুন গল্প! আজও তুমি উর্বর শব্দের জনক, সতেজ শব্দে প্লাবিত তোমার পলিমাটি একই আছে। অথচ তুমি জানলে না, তোমার কাছে হেরে গেছে প্রকাণ্ড এক নীল আকাশ, জমে থাকা নীলদম্ভ, সদ্যফোটা সবকটা নীলপদ্ম, তোমার গহিনে জোনাকআলো খোঁজা একজন নীলমানুষ!
এত গভীরতা তোমার একান্ত, অনির্ণেয় সীমায় আমি তলিয়ে যাই ক্রমশ। তোমার স্পর্শে সমৃদ্ধ হয়েছে অগাধ জলে নিমজ্জিত কোনো এক আত্মা। তুমি এক বিরাট বিস্ময়, জানো! তোমার ঐশ্বর্য সংক্রমিত ঐশ্বর্য, তোমার সান্নিধ্যে যে আসবে, সে-ই ফলবে; হুম… এইখানে পূর্ণ দাঁড়ি, এবেলা তোমার কোনো অজুহাত খাটবে না গো!
একজন কবি, সে তার শব্দে শব্দে ভাবতে শেখায়, শেখায় জীবনদর্শন, জাগতিক জীবনের জটিলতা খুলে দেয় আয়নার মতো, বিরহ সাজায় জোছনা খুঁটে খুঁটে। বিনয়ী শব্দ পরাজয় মেনে নেয়, নিজস্ব কিছু অপূর্ণতার দিতে জানে সে সরল স্বীকারোক্তি; আত্মমগ্ন শব্দ জানে না কখনও বিবাদ!
তবে কখনো কখনো শক্তিশালী শব্দে বাজে রঙচঙে মুখোশ আঁটা কিছু অসংগতির প্রতিবাদ। একজন তুমি, সে ভালোবাসতে শেখায় শব্দে, বর্ণে, গন্ধে! এত প্রেম যার কবিতায় কবিতায়, সেই তুমিই কিনা বলো, তোমার কলমে হতাশা খেলা করে! মাঝে মাঝে দেখি প্রেম আর বিচ্ছেদের একই ঘরে বসবাস; তুমি পারো, কেননা তুমি ধ্রুপদী অভেদ্য অমাবস্যা! আমআদমি মানুষ তা বুঝবে কেন বলো!
যদি বলো হতাশা, তবে তা-ই। যদি বলো নিরেট অন্ধকার, তবে তা-ই। যদি বলো নিঃসঙ্গতা আর বিবর্ণতা, তবে তা-ই…তা-ই! এই হতাশা, নিঃসঙ্গতা, বিবর্ণতাকেই ভালোবাসতে চাই! তোমার কি কিছু বলার আছে, বলো?
একদিন বললে, "পারবে, নীল, অগোছালো জীবনের দায় নিতে!" তোমার জীবনদায় আমাকে অর্পণ করতে চাও ভেবে ভীষণ চমকে উঠলাম। একটা বৃক্ষের জীবনদায় নড়বড়ে চারাগাছ কী করে বইতে পারে! বৃক্ষের আছে দীর্ঘপথের পদচিহ্ন, আছে সুরভিত ফুলের শপথনামা, তার অভিজ্ঞতার ডালা সাজানো পূর্ণ অক্ষরে; আছে কাশবন-কিশোরী মার্থা এবং নিয়ন আলো; বালিকাবধূ, গৃহবাসী প্রেমিকা এবং বিবিধ সুখ কিংবা অসুখের ফিরিস্তি! আছে কতিপয় গৃহবাদী-ভোরের পসরা। আছে ময়ূরাক্ষী তীরে চন্দ্রমুখী জোছনা; অন্ধকার রাতে বাঁধানো ঘাট এবং মোমেন কিংবা বলা যায়, দুলালদার দোকানের ধূমায়িত বিকেলগুলো!
এত নান্দনিক সুন্দরে গাঁথা গল্পে জীবন যার, তার জীবনদায় নেব; এতটা গভীরতা আমি ধারণ করেছি কবে!
বললাম, তুমি যদি সুখী না হও, আমি যদি ব্যর্থ হই, তবে এই ব্যর্থতার চলনসই মাত্রা হারিয়ে যাবে। হয়তো একটি দীর্ঘশ্বাসে তুমি বললে, "কেউ দায় নিতে চায় না, নীল, এভাবেই জীবন এতটা পথ পার হলো। তোমাকে দায় দিতে চাই, কেননা তুমি দুঃখ পেলে জীবন কষ্টে নীল হয়ে যায়; তোমাকে ভর করে একটু উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা তাই!"
মনে হলো, ভালোবাসলাম, অথচ ভালো রাখার দায়টা নিলাম না, এতটা পানসে করে কেউ ভালোবাসে কাউকে! সেদিন আমি কিছুটা নারী হলাম, কিছুটা সমৃদ্ধ হলাম, আর বাকিটা তোমার জন্য রেখে দিলাম! তুমি আমি 'তুমি' হলে শ্রাবণ আসে পদ্মবিলে, যখন দু-জন মিলে আমরা থাকি, তখন অবেলায় বসন্ত ডাকে! তবে আমরা কেন একসাথে থাকি না! কেনই-বা নিই না একটু ভালো রাখার দায়টুকুও!
লিখতে লিখতে মনে হলো, তুমি ছাড়া জীবন কেমন হতো! তুমি ছাড়া জীবন কেমন ছিল! হয়তো ভালোই ছিল, যদিও অসাধারণ কিছু নয়। গল্পকথায় আর চরিত্রে মুখর ছিল, নান্দনিক কিছু নয়। কালি-কলমে আঁকিবুঁকি চলে চলে জীবন পড়েছিল রঙিন ক্যানভাসে বাঁধা, তবু ওসব একান্ত কিছু নয় তো! ফুলে-সৌরভে মাখামাখি সাজানো প্লট, অকৃত্রিম সে ছিল না তো!
কেমন ছিল জীবন? সত্যি বলতে, জীবনটাকে কাছে ডেকে, পাশে বসিয়ে নিভৃতে কখনও জানতে চাইনি: জীবন, তুই কেমন আছিস? কেমন ছিলি? কেমন থাকতে চাস? শুধু জীবনের কাছে চেয়েই এসেছি… আমাকে ভালো রাখিস! জীবনের ভালো থাকা, মন্দ থাকা কখনও ভেবে দেখলাম না এ জীবনে।
তুমি শেখালে, আমি আর আমার জীবন কখনোই এক নয়। এরা দু-জন দুই সত্তা, দুই আশ্রয়। জীবনকেও চেখে দেখতে হয়। জানতে হয়, কীসে জীবন কতটা হাসতে পারে, কতটা কেমন বাঁচতে জানে! দেখালে, কতটা ঋণ জমে গেল আমার! কথার পাড়ে হেঁটে কিছুটা ছন্দে ছন্দে বললে, একান্তে কয়েক মুঠো ঋণ রেখে দেবার মতো ঐশ্বর্য সবার থাকে না; তুমি রেখে দিলে, আহা! এই ঋণকে তবে মায়া ডেকো! সমৃদ্ধি একটা শব্দ, যা ঐশ্বর্যের গহিনে বিলীন হয়; পাহাড়ের কান্না যেমন হয় সমুদ্রে! কেউ আসবে, হয়তো এসেছিল; তুমি বেখেয়ালি কৃষ্ণচূড়া, রঙের মিশেলে ব্যস্ত খুব! কয়েক মুঠো ঐশ্বর্য তবে আমার জন্যেও রেখো, কিছুটা ঋণসুখ আমারও যে প্রাপ্য!
মানুষ হিসেবে কী অদ্ভুত সৃষ্টি আমরা, তাই না, মেহু! যাকে ভালোবাসতে চাই, তাকে ভালো রাখার কথা মনেই হয় না! যাকে ভালোবাসতে যাই, তার কাছে কেবলই নিজে ভালো থাকতে চাই, তার একফোঁটা কষ্ট ধার নিতে কেউ চাই না। অথচ আমরা ওই যে বলি না, নিজের কষ্টগুলোর ভাগ কাউকে দিতে চাই না, দিই না… আসলে একান্ত কষ্ট বলে কিছু নেইও। কষ্টের ভাগ কেউ দেয় না, আত্মজ মানুষগুলো নিভৃতে নিজ থেকেই নিয়ে নেয়!
আবার দেখো, যাকে ভালো রাখতে জীবনের এত আয়োজন, তাকেই ভালোবাসা যায় না; আত্মজ মানুষ একদিন দায়িত্বে-লালিত মানুষ হয়ে যায়! খুব নিকটে, অথচ কত আলোকবর্ষ দূরে বসবাস দুটি মানুষের। অন্যদিকে, যে মানুষটা ছোঁয়ারও অতীত… যাকে দেখে পথ বলে, বহুদূর পেরোনোর এখনো বাকি… সেই মানুষটারই কিনা অন্তরে নিবাস, এত দূরে, তবু মনে হয়, এত কাছে যে নিঃশ্বাসে ছুঁয়ে দিতে পারি নিঃশ্বাস!
আহা, কয়েক জনমের প্রতীক্ষিত ভালোবাসা আমার। অদৃষ্ট কেমন খেলে আমাদের সঙ্গে, তাই না, মেহু!
এই যে মানুষটা, এত কথা কইছি তোমায়, ওদিকে যে রাতটা ফুরিয়ে যায়, সে খেয়াল আছে, শুনি! রোজকার মতো লাল-দেঁতো সূর্যটাও যে জানলায় হাজির। আরও কত-কী যে তোমাকে বলা হয়নি জানো, কত লিখতে হবে আরও! আজ তবে আসি গো! অমাবস্যা ফিরে এলে আবার তোমায় নিয়ে নিশি সাজব, কেমন!
প্রিয় পত্রলেখা, চোখের কাজল আমার, ভালো থেকো, খুব গুছিয়ে যত্নে থেকো। একটা মধুপর্ণী-রাত তোমার জন্য।
ইতি অবেলায় ফোটা তোমার জবা
১৪২৯, শরৎসংখ্যা দশ ফুল কুঞ্জলতা, রজনীভাগ চার সুবর্ণগ্রাম, ঝিল রুহিতন