ছেঁড়াটিপ

আমার কাছে একটাও খাম নেই। কেউ চিঠি দেয়নি বা দেবে, তেমনও না।
সেদিন মেঘলার স্কুল থেকে একটা নিমন্ত্রণপত্র এসেছিল, আমাদের স্মৃতিবিগত সেই পাতলা হলদে খামে করে!
হলুদ রঙ আমার কখনোই পছন্দের ছিল না। স্মৃতিভুক মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি কি না আমি জানি না, তবে হলদে খামের হলুদটা ছুঁয়ে আমি কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়েছিলাম, অস্বীকার করছিনে!
আঁকিবুঁকি খামটা হলদে স্ম‍ৃতিতে রেখে দিলাম।




অবশ্য, চিঠি আসবে, চিঠি যাবে, এমন কোনো ফ্যান্টাসিও আমার ছিল না।
ওসব ঝিমানো যুগের হিসেব। তবে চিঠি লিখি না, তা-ও কিন্তু নয়; লিখি।
কিবোর্ড-সহযোগে সাদা স্ক্রিনে দু-আঙুলের বাচালতায় মাঝে মাঝেই টুপটাপ শব্দ ঝরে।
সুনসান নীরবতায় যখন যামিনী জাগে, আলমারি খুললে চাপা পড়ে নাভিশ্বাস-ওঠা কচি কলাপাতা রঙের শাড়িটা…উহুঁ,আমার এমন কোনো শাড়ি নেই, রাতের কালোয়, পাড়ে উদাসীন ধূসর মেশানো একটা শাড়ি আছে বটে, সে যা-ই হোক, চোখে কাজল দিয়ে, শাড়িখানা জড়িয়ে, ছোট্ট একটা ছেঁড়াটিপ কপালে গুঁজে, বেশ খানিকটা নরম আলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পাতাভর্তি শব্দ আর খামভর্তি চিঠির আমেজ; এ যে হৃদয় নিঃসৃত ভালোবাসার সুখ!
আরেকটু কাছে ঘেঁষে ফিসফিসিয়ে বলতে ইচ্ছে করে,
এত সুখ তুমি লুকোলে মৃদুসুরের আড়ালে আড়ালে!
জলেশ্বরীতে পা ডুবিয়ে, দেখো, পত্রলেখা যামিনী জাগে।




না, আমি এতটা কল্পনামদির নই। সেই সময়ই যে নেই!
ক্লান্ত চোখে নিদ্রানিবাস সবসময়ই ফাঁক খোঁজে, আলুথালু পায়ে স্বপ্ন এমন চৌকাঠ পেরুবে, সে অবকাশ কই!
সময় বাড়ি এলে আপ্যায়ন করিনে, তা কিন্তু নয়; রং-পেনসিল, সাদাকাগজ, হরেক রকম অসামাজিক শখ, বই, বন-জঙ্গল আর একজন ল্যাসি।
আর হ্যাঁ, ল্যাসিকে মোটেও একঘরে করে দেখবেননে যেন!




ব্যক্তিনিষ্ঠ সত্য বলতে ঝাড়ুগোছের লেজবিশিষ্ট, সম্ভ্রান্ত আসলে বিভ্রান্ত, সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী প্রকৃতপক্ষে মৃগীরোগী, মিস্টার জাস্টিন টিম্বারলেক মার্জার মহাশয়ের অসংখ্য কিন্তু একমাত্র প্রেমিকা হলো আমার ল্যাসি! 
ল্যাসিটা একটু বাচাল; এই হয়েছে কি সেই হয়েছে, মুখে যেন কথার ফোয়ারা ছোটে।
না, না, আমি উদাসীন মা নই। বলি যে, ল্যাসি, সোনা-মা আমার, এবার একটু থিতিয়ে যা না! জাস্টিনের মা মিসেস পাস্তুর, মোটেও ভালো চোখে দেখে না তোকে। 




কে কার কথা শোনে কি শোনে না, আমি জানি না। তবে আড়পাকা ল্যাসি যে আমার কথা কানে তোলে না, বেশ বুঝতে পারি। 
মানুষের হাড়ে দূর্বা গজায়, আমার ঘটে দেবদারু গজিয়েছে সেই কবে; বয়সের আর গাছপাথর নেই, বুঝলে! 




সে যাকগে, আমিওবা কার কথা কোনকালে শুনেছি! একদিন ভুল করে কপালে একটা টিপ আঁকতে গিয়ে সীমানা পেরিয়ে চলে গেল উত্তরে! 
খুব হেসেছিলাম সেদিন দু-জনে! ও 'ছেঁড়াটিপ' নাম দিয়েছিল ভালোবেসে!




তারপর একদিন, আমি চলে এলাম সবকিছু ছেড়েছুড়ে, ছেঁড়াটিপ উত্তরের পথে ওর হাত ধরে সেই থেকে দাঁড়িয়ে!
ও কতবার বলত, একটা ছেঁড়াটিপ কপালে দাও না গো,
হৃদয়ের ছেঁড়া অংশটা ওখানটায় পেতে দেবো! আমি বসব, পাশে তুমিও।
তুমি লিখবে আমায়, আমি পড়ব তোমায়, চিঠিতে আদর বাঁচবে আজীবন আমাদের হয়ে!
দু-পাশের হাওয়া মাখামাখি হবে, কপাল ছুঁয়ে, রাত বেয়ে, নেমে আসবে কোলজুড়ে!
আমি ঠাঁই নেব, তুমি ঠাঁই পাবে, তারপর আমরা আমাদের ঘর হব নিভৃতে।




আর আমি, কখনও আঁকিনি একটাও ছেঁড়াটিপ কপালে সাজিয়ে। সেই ছবিখানা দেখি, পুরোনো আমি, ছেঁড়াটিপ চিঠির খামে। 
তুমি ও আমি, ছেঁড়াটিপ কপালের গহীনে।