পরা-বিদ্যা ও অপরা-বিদ্যা

মুণ্ডকোপনিষদ্-এর প্রথম মুণ্ডকের প্রথম খণ্ড থেকে লিখছি।




শুনকের পুত্র মহাগৃহস্থ (ভালো ভালো গুণসম্পন্ন শুদ্ধচিত্তের গৃহী মানুষ) শৌনক ব্রহ্মবিদ্যা জানার জন্য শাস্ত্রবিধি অনুসারে হাতে সমিধ (যজ্ঞের কাঠ) নিয়ে শ্রদ্ধাপূর্বক মহর্ষি অঙ্গিরার কাছে এসে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলেন — ভগবান! যা যথার্থরূপে জানলে এই নিখিল চরাচরের দৃশ্য, শ্রব্য এবং অনুমেয় সবকিছুই জানা হয়ে যায়, সেই পরমতত্ত্ব কী? আমাকে অনুগ্রহ করে সেই শিক্ষা দিন, যাতে আমি বিশ্বজগতের সব‌ই জানতে পারি।




(প্রশ্নটি বিচিত্র। এই জগতে জানবার বিষয় কতই তো রয়েছে। অনন্তকাল অনন্ত জীবন ধরে মানুষ এক-একটা করে বিষয়গুলি জানবার চেষ্টা করে গেলেও শেষ করতে পারবে না। সুতরাং একটি একটি করে জানবার চেষ্টা না করে এমন একটা কিছু জানতে হবে, যাকে জানলে জগতের সব জানা হয়ে যাবে। মূল তত্ত্বকে জানতে হবে।




প্রশ্ন ওঠে, শৌনক কি জানতেন যে, এমন কোনো বিষয় আছে, যাকে জানলে সব জানা হয়ে যায়? তিনি শুনেছেন, শাস্ত্রে পড়েছেন, এরকম সাধারণ ধারণাও আছে — এক জ্ঞানে সর্বজ্ঞান হয় অথবা সাধারণ দৃষ্টিতে জেনেই প্রশ্ন করেছেন। কী জেনে? সোনাকে জানলে সোনার তৈরি সব জিনিসই জানা হয়ে যায়। তাদের আকারগত পার্থক্য থাকলেও উপাদান এক। ছান্দোগ্যোপনিষদে আছে — মাটির ড্যালাকে জানলে মাটির তৈরি যাবতীয় বস্তুকে জানা হয়ে যায়, কারণ সেগুলির নাম ভিন্ন ভিন্ন মাত্র, মাটি ছাড়া তাদের পৃথক সত্তা নেই। মাটিই সত্য, বিকার শুধুমাত্র শব্দাত্মক। বিকার বলতে বোঝায় নানান আকৃতি, যেগুলি নানান নামে তথা শব্দে পরিচিত।




শাস্ত্র নানা উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, উপাদানকে জানলে সেই উপাদানে প্রস্তুত সব বস্তুকে জানা যায়। আকার অনুসারে তাদের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে, কিন্তু তাদের উপাদান এক। উপাদান ছাড়া তাদের কোনো পৃথক অস্তিত্ব নেই, থাকলে তারা সত্য তথা পৃথক পৃথক সত্তা হতো। বিকারের পৃথক অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, তাই তা মিথ্যা। যেমন দড়িতে সাপ দেখা যাচ্ছে; রজ্জু-সত্তা ছাড়া সাপের পৃথক সত্তা নেই। সুতরাং রজ্জুকে জানলেই সেই রজ্জুতে যা কিছু প্রতীত হচ্ছে, তার সবই জানা হয়ে যায়। রজ্জুকে কেউ সাপ, কেউ লাঠি, কেউ ফুলের মালা, জলের ধারা বা মাটিতে ফাটল বলে দেখে। বিভিন্ন রকম দেখালেও রজ্জু ছাড়া পৃথক সত্তা তাদের নেই। এ-ই হচ্ছে সিদ্ধান্ত।




যখনই উপাদানকে জানা হলো, তখনই তার কাজগুলি সব জানা হয়ে যায়। অর্থাৎ একমাত্র কারণই আছে, কাজগুলি সবই তাতে আরোপিত। এগুলির পৃথক সত্তা থাকলে, তাদের কারণ থেকে আলাদা করে দেখলে তবেই তাদের অস্তিত্ব থাকত। মাটির খেলনা থেকে মাটি সরিয়ে নিয়ে খেলনা থাকবে কি? সেইরকম অলঙ্কার থেকে সোনাকে বাদ দিলে কী রইল আর? কিছুই রইল না। কোনো একটি বস্তুর উপাদান বা অধিষ্ঠান থেকে তার পৃথক সত্তা যখন কল্পনা করা যায় না, তখন তাকে বলি মিথ্যা। সুতরাং এ জগতে যা-কিছু বিকার (অন্য আকৃতিপ্রাপ্ত) বস্তু দেখছি, তার সবই মিথ্যা; একমাত্র যা উপাদান অর্থাৎ আদি কারণ, তা-ই সত্য। সেই কারণটি হলেন ব্রহ্ম বা সৎ। আদিতে জগৎটি সন্মাত্র ছিল, সৎ ছাড়া আর কিছু ছিল না। সুতরাং ব্রহ্মকে যখন জানা হলো, তখন সবই জানা হয়ে গেল।




‘ব্রহ্ম’ শব্দের মানে ব্যাপক। সমস্ত জগতে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে যে মূল তত্ত্ব, জগতের ভিতর যা অনুস্যূত বা অবিভাজ্য হয়ে রয়েছে, সেই বস্তুটিকে জানলে জগতের সব জানা হয়ে গেল, আর কিছু বাকি রইল না। জগতে কতরকম বস্তু আছে, সেসবের কত বৈচিত্র্য, পৃথকভাবে তাদের আর জানার প্রয়োজন কী? জ্ঞাতব্য বস্তুর সংখ্যা অনন্ত, জেনে কখনও শেষ করা যাবে না।




শাস্ত্র বলছেন, অত বিস্তারের মধ্যে গিয়ে লাভ নেই, মূল কারণটিকে জানো, যার উপরে এই জগৎ-বৈচিত্র্য অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছে। নাম এবং রূপ সবই মিথ্যা। একজীবনে অত জানা যায় না।




সেই মূল উপাদান কারণকে জানবার জন্য শৌনক আচার্যের কাছে প্রশ্ন করছেন। প্রশ্ন করছেন, 'কস্মিন্' অর্থাৎ কোনটিকে? তিনি শুনেছেন যে, একটি বস্তুকে জানলে সব জানা হয়ে যায়। এখন সেই বস্তুটি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান লাভ করার জন্য প্রশ্ন করছেন।)




মহর্ষি অঙ্গিরা তখন বললেন — ব্রহ্মজ্ঞানীরা বলেন, দুই রকমের জ্ঞান বা বিদ্যা জ্ঞাতব্য; একটি পরা এবং অন্যটি অপরা।




অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান আর আপেক্ষিক জ্ঞান তথা দৃশ্যমান জগৎ সম্বন্ধে জ্ঞান। অবশ্য একটি জ্ঞান আর-একটি জ্ঞানের পরিপূরক। পার্থিব জ্ঞানকে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সাথে যুক্ত করতে পারলে তবেই পরম জ্ঞান লাভ হয়। পার্থিব জ্ঞান আমাদের সাময়িক শান্তি বা আনন্দ দেয়, কিন্তু আধ্যাত্মিক জ্ঞান চিরস্থায়ী শান্তি ও আনন্দ দিতে পারে। শাস্ত্রে এই দুই শ্রেণীর বিদ্যাকে বলা হয় অপরা-বিদ্যা এবং পরা-বিদ্যা।




অপরা-বিদ্যা হল ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা (আবৃত্তি), কল্প (ক্রিয়ানুষ্ঠান), ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, জ্যোতিষ। (মহর্ষি প্রথমেই অপরা-বিদ্যার ব্যাখ্যা দিলেন কেন, তা নিয়ে পরে বলছি।)




বেদে নানাপ্রকার যজ্ঞবিধি এবং তার ফল-সহ জগতের সমস্ত পদার্থের এবং বিষয়ের সবিস্তার বর্ণনা বিদ্যমান। বেদপাঠ অর্থাৎ বর্ণ ও শব্দের যথার্থ উচ্চারণ-কৌশল হলো ‘শিক্ষা’। যাতে যাগ-যজ্ঞাদির বিধি বা সাধনপদ্ধতি বলা হয়েছে, তা-ই ‘কল্প’ (গৃহ্যসূত্রাদির গণনাও কল্পমধ্যে হয়)। বৈদিক এবং লৌকিক শব্দের অনুশাসন, প্রকৃতি-প্রত্যয়বিভাগপূর্বক শব্দসাধনের প্রক্রিয়া, শব্দার্থবোধের প্রকার এবং শব্দপ্রয়োগাদির নিয়মের উপদেশের নাম 'ব্যাকরণ'। বৈদিক শব্দের যে কোষ আছে, যাতে অমুক পদ অমুক বস্তুর বাচক, এ কথা কারণ-সহ বলা হয়েছে, তাকে 'নিরুক্ত' বলা হয়। বৈদিক ছন্দের জাতি এবং ভেদকারিণী বিদ্যাই হল 'ছন্দ'। গ্রহ এবং নক্ষত্রের স্থিতি, গতি এবং তার সাথে আমাদের কী সম্বন্ধ — এইসব বিচার যার মধ্যে হয়েছে, তা-ই হলো ‘জ্যোতিষ’ বিদ্যা।




এইভাবে চতুর্বেদ এবং ষড়বেদাঙ্গ — এই দশটি হল অপরা-বিদ্যা।




আর পরা হলো তা-ই, যা দিয়ে অধিগত হয় “অক্ষর” (বা ব্রহ্ম)। তা-ই পরা, যা অদর্শনীয়, অগ্রহণীয়, গোত্রহীন, বর্ণহীন, চক্ষুহীন, শ্রোত্রহীন; সে-ই পরা, যে অপাণি, অপাদ, নিত্য, সর্বব্যাপী, সর্বগত, সুসূক্ষ্মা; তা-ই পরা, যা অব্যয়, যা সর্বতত্ত্বের জঠর, আর তাকেই ধীমানেরা দেখেন সর্বত্র।




আরও একটু ভেঙে বলা যাক। পরা-বিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যাই পরব্রহ্ম-বস্তুটিকে জানাবে। অন্য কোনও উপায় নেই। এর কারণ, ব্রহ্মবস্তু জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অগম্য। কর্মেন্দ্রিয়ের অগ্রাহ্য — গ্রহণাতীত। অগোত্র-মূলহীন, তিনি সকলের কারণ, তাঁহার নিজের কারণ নাই। তিনি অচক্ষু, অশ্রোত্র, অপাণিপাদ। এই বিশেষণগুলি অ-ভাববাচী। সঙ্গে সঙ্গেই ভাববাচী-বিশেষণ — তিনি নিত্য, বিভু, সর্বগত, সুসূক্ষ্ম, অব্যয় ও ভূতযোনি।




পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর জ্ঞানেন্দ্রিয় দ্বারা অধিগম্য হন না, এমনকি কর্মেন্দ্রিয় দ্বারাও অগম্য। এই ব্রহ্ম গোত্রাদি উপাধিশূন্য তথা ব্রাহ্মণাদি বর্ণগত ভেদ তথা পীতাদি বর্ণ এবং আকৃতিশূন্য। ওই ব্রহ্ম নেত্র, কর্ণাদি জ্ঞানেন্দ্রিয় তথা হস্ত পদাদি কর্মেন্দ্রিয়শূন্য। ওই ব্রহ্ম অত্যন্ত সূক্ষ্ম, ব্যাপক, অন্তরাত্মারূপে সর্বত্র প্রসারিত এবং সর্বতোভাবে অবিনাশী অর্থাৎ নিত্য। জ্ঞানীজন সমস্ত প্রাণীর ওই কারণকে সবস্থানে পরিপূর্ণরূপে অনুভব করেন।




শ্রুতি বা উপনিষদ ব্রহ্মকে জগতের যোনি, ভূতগণের যোনি, পঞ্চভূতের কারণ বলে বর্ণনা করেছেন। তাতে ব্রহ্মই যে বিশ্বের উপাদান কারণ, তা জানা যায়। নিমিত্ত-কারণও ব্রহ্মই। মুণ্ডক উপনিষদ পরা-বিদ্যার সাহায্যে যে অক্ষর-পুরুষকে জানতে হবে, তার স্বরূপ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন, এই বিশ্ব-সংসার অক্ষর-পুরুষ হতেই উৎপন্ন হয়েছে।




নৈয়ায়িক-পণ্ডিতেরা আবার বললেন, সমজাতীয় কারণ হতে সমজাতীয় ফলের উৎপত্তি সম্ভব, এই যেমন, জড় মাটি হতে জড় নানান বস্তু। কিন্তু ব্ৰহ্ম চৈতন্যময়, জগৎ জড়। চেতন হইতে জড় কীভাবে হলো? উত্তরটা দিচ্ছেন মুণ্ডক উপনিষদ — যেমন মানুষের দেহে কেশ-লোমাদি হয়, ঠিক তেমনি অক্ষর হতেও বিশ্ববস্তু ‘এখানে’ জন্মগ্রহণ করে। ‘এখানে’ অর্থ, নিজের আত্মায়, হৃদয়ে, বোধে, চৈতন্যে। এর নামই ব্রহ্মজ্ঞান। অর্থাৎ চেতন হতে অচেতনের উৎপত্তির দৃষ্টান্ত মূণ্ডক দিলেন।




আরও একটি পূর্বপক্ষ এসে উপস্থিত হলো — উপাদান-কারণ ছাড়া ব্রহ্ম কিভাবে সৃষ্টি করলেন? মুণ্ডক উপনিষদ আবারও উত্তর দিচ্ছেন — মাকড়সা যেমন জাল তৈরি করে নিজদেহ হতে, কোনও উপাদান লাগে না। আবার ওই সুতা মাকড়সা নিজদেহে বিলীন করে।




ন্যায়শাস্ত্র বলেন, একই বস্তু উপাদান-কারণ ও নিমিত্ত-কারণ হতে পারে না। ঘটের উপাদান-করণ মাটি ও নিমিত্ত-কারণ কুম্ভকার। ব্রহ্ম নিজেই নিজেকে কীভাবে সৃষ্টি করলেন? মুণ্ডক-উপনিষদ দৃষ্টান্ত দিয়ে উত্তর দিচ্ছেন, যেমন একমাত্র পৃথিবীই ওষধি (যে গাছ এক বার ফল দিয়ে মরে যায়) গাছেদের উপাদান ও নিমিত্ত কারণ — ব্রহ্মও ঠিক তেমন। উল্লেখ্য, মাকড়সার দৃষ্টান্ত ছান্দোগ্য উপনিষদও দিয়েছেন।




বেদবাহ্য (বেদের বাইরে অবস্থিত) স্মৃতিসমূহের কোনও প্রামাণ্য দলিল নেই। অতএব বেদসমূহকে অপরা-বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত করায় সন্দেহ হতে পারে যে, উপনিষদসমূহ বেদবাহ্য ও অগ্রাহ্য; অথবা বেদের অন্তর্ভুক্ত হলেও সেগুলি পরা-বিদ্যার বহির্ভূত। বস্তুত ‘বেদ’ শব্দ দিয়ে এখানে শব্দরাশিকে বোঝাচ্ছে, জ্ঞানকে নয়; সুতরাং বেদের অংশবিশেষ বা বেদের বিধেয় তথা সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য উপনিষদ হতে উৎপন্ন জ্ঞানকে পরা-বিদ্যা বলাতে কোনও অসামঞ্জস্য নাই, যদিও উপনিষদ নিজে অপরা-বিদ্যার অংশ।




খুব অল্প কথায় বলি। শৌনক মুনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কাকে জানলে সবকিছু জানা হয়ে যায়?" এর উত্তরে সমস্ত জগতের পরম কারণ তথা পরমব্রহ্ম তথা পরমাত্মা থেকেই জগত, স্পষ্টভাবে, অন্তর্জগতের উৎপত্তি জানিয়ে সংক্ষেপে একথা বোঝানো হয়েছে যে, ওই সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সকলের কর্তা-ভর্তা-ধর্তা পরমেশ্বরকে জানলে অর্থাৎ নিজের চৈতন্যকে জাগালে অর্থাৎ নিজের আত্মার সাথে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সবকিছুই জানা হয়।




ছান্দোগ্য উপনিষদের ষষ্ঠ প্রপাঠকে প্রথম খণ্ডে পিতা ঋষি আরুণি পুত্র শ্বেতকেতুকে বলছেন, “তুমি কি তোমার গুরুদেবের কাছে সেই শিক্ষা পেয়েছ, যে-শিক্ষায়, “অন্য যাবতীয় অশ্রুত বিষয়ও শ্রুত হয়; যুক্তি ও তর্ক দ্বারা যা পূর্বে বিচারিত ও নির্ণীত হয়নি, তা-ও বিচারিত ও নির্ণীত হয়ে যায়; যা-কিছু অজ্ঞাত, তা জ্ঞাত হওয়া যায়; সমস্ত বেদ, বিজ্ঞান প্রভৃতি শেখা যায়?” মুণ্ডক উপনিষদের প্রথম প্রশ্ন এবং ছান্দোগ্য উপনিষদের উক্ত প্রশ্ন একই কথা। বলতে কী, সকল উপনিষদেরই এই একটিই লক্ষ্য; তাঁকে অর্থাৎ নিজেকে জানা। যাঁকে জানিলে সকল জানা হয়, যাঁকে পেলে সকল পাওয়া হয়। অজানা-অপাওয়া আর কিছুই থাকে না। জ্ঞানের তৃপ্তিই কর্মচেষ্টার সিদ্ধি।




যদিও বলা হয়েছে, পরা-বিদ্যার সাহায্যে নিজেকে বা ব্রহ্মাকে চেনা যায় এবং এটাই মানবজীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য, কিন্তু অপরা-বিদ্যারও প্রয়োজন রয়েছে। অপরা-বিদ্যাও ব্রহ্ম থেকেই এসেছে; এই বিদ্যার অধিভুক্ত চতুর্বেদ ও ষড়বেদাঙ্গের সৃষ্টিই হতো না যদি মানুষের আত্মায় বা অন্তর্জগতে অক্ষরব্রহ্মের জাগরণ না ঘটত। জগতে উপাদান-কারণ এবং নিমিত্ত-কারণ উভয়ই ব্রহ্ম, সেরকম পরা-বিদ্যা এবং অপরা-বিদ্যা উভয়ই ব্রহ্ম থেকে উদ্‌গত। সর্বজ্ঞ বা সর্ববিৎ হতে গেলে তাঁকে সবকিছু জানতে হবে, জ্ঞানই তাঁর একমাত্র তপস্যা। পরা-ব্রহ্ম হচ্ছে পরম অবস্থা অর্থাৎ নির্গুণ ব্রহ্ম এবং অপরা-বিদ্যা হচ্ছে পরা-ব্রহ্মের সাথে মিলনের জন্য একটি মাধ্যম, যা অপরা-ব্রহ্ম বা সগুণ-ব্ৰহ্ম। সগুণ-ব্রহ্মকে ঈশ্বরও বলা হয়ে থাকে। আধুনিক যুগে দেখি, তোতাপুরী শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে সগুণ-ব্রহ্ম (কালীসাধনা) থেকে নির্গুণ-ব্রহ্মে উত্তরণের দীক্ষা দিয়েছিলেন। ভক্তিযোগে সগুণ-ব্রহ্মের সাথে লীন হওয়াকে চরমতম অবস্থা বলা হয়। ভক্তিশাস্ত্রমতে, ভক্ত অনন্তকাল ধরে সবিশেষ রূপেরই আস্বাদন করে থাকে, কারণ এতেই ভক্তের পরিতৃপ্তি – পরম প্রাপ্তি। অথচ অদ্বৈতবাদীগণ রূপবিশেষে প্রভাবিত হন না। সেখানে প্রেম, প্রেমিক এবং প্রেমাস্পদ এক — স্বামী বিবেকানন্দর পথ ও মত ঠিক যেমন ছিল। উভয় পথই যথার্থ, যার জন্য যে পথে চলাটা সহজ। সেজন্য ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, তাঁর ইতি করা যায় না, তিনি নির্বিশেষ, আবার সবিশেষও।




ব্রহ্মবিদেরা বলেন, পরা ও অপরা এই দুটি বিদ্যা জানতে হয়। পরমাত্মবিদ্যা হচ্ছে পরা-বিদ্যা — ধর্ম ও অধর্মের অনুষ্ঠান এবং ফলবিষয়ক বিদ্যা অপরা-বিদ্যা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, অঙ্গিরা যেন প্রশ্নের অনুরূপ উত্তর দিলেন না। শৌনক প্রশ্ন করেছিলেন, কোনটিকে জানলে? তার উত্তরে অঙ্গিরা কাকে জানলে সব জানা যাবে, তা না বলে দুটি বিদ্যার কথা বলেছেন। এতে দোষ হয়নি, উত্তরটি আসলে ক্রমসাপেক্ষ। অপরা-বিদ্যা অবিদ্যা, সেই অবিদ্যাকে নিরাকরণ অর্থাৎ দূর করতে হবে। অপরা-বিদ্যার বিষয়কে জানলে কোনো জিনিসকেই তত্ত্বপূর্বক স্বরূপেতে জানা হলো না। পূর্বপক্ষকে নিরাকরণ করে নিবৃত্ত করে তারপর সিদ্ধান্ত যা, তা বলতে হবে। সিদ্ধান্ত নির্দেশ প্রথমে করেননি, প্রত্যাখ্যেয় বিষয় বলে পরে সিদ্ধান্তের কথা বলছেন — আগে অপরা-বিদ্যা কী, তা জানো, জেনে তার থেকে নিবৃত্ত হয়ে পরা-বিদ্যার অনুসরণ করো। সেজন্য পরা-বিদ্যার আগে অপরা-বিদ্যা বিস্তার করে তথা বুঝিয়ে বলছেন।




উপনিষদ নিজেই বলছেন, অপরা-বিদ্যা তথা বেদ-উপনিষদ ও বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করাই যথেষ্ট নয় যদি না পরা-বিদ্যা তথা আত্মজ্ঞান বা পরমব্রহ্মজ্ঞান তথা পরমাত্মাজ্ঞান তথা আত্মাস্থিত ঈশ্বর বা চৈতন্যের সাথে যোগাযোগস্থাপন হয়। অপরা-বিদ্যা নিম্নস্তরের বিদ্যায় পরিণত হয় যদি তার সাহায্যে পরা-বিদ্যায় দীক্ষিত হওয়া না যায়। জীবনের লক্ষ্য অপরা-বিদ্যা অর্জন করা নয়, বরং তার উপর ভর করে পরা-বিদ্যা (বা পরমাত্মা-সংক্রান্ত বিদ্যা) অর্জন করা। পরা-বিদ্যায় (বা আত্মজ্ঞানে বা ব্রহ্মজ্ঞানে) পৌঁছতে না পারলে অপরা-বিদ্যার (উপনিষদের নিজেরও) অধ্যয়ন পুরোপুরি নিরর্থক। এতটা সৎসাহস নিয়ে অকপটে নিজেরই আশ্রয় ৪টি বেদের ও ৬টি বেদাঙ্গের উপরে চৈতন্যের জাগরণকে স্থান দিতে পেরেছেন উপনিষদ, যা সত্যিই অভিনব; তাই উপনিষদের চাইতে নির্ভার ঘর আর হয় না।




ফুটনোট। উপনিষদ, উপনিষদ্‌, উপনিষৎ তিনটি বানানই শুদ্ধ।