বাংলায় লেখা: পাঁচ

৫১। এই যে 'প্রথমে' না লিখে 'প্রথমেই' লেখা হয়, এটা একটা বাজে অভ্যেস, বেশ unidiomatic. লোকে ভুল করে লেখে, 'আসলেই এটা একটা জরুরি ব্যাপার।' ‘আসলেই’ নয়, হবে 'আসলে'। এগুলো বাগ্-ধারার সূক্ষ্ম ব্যাপার, গানের বেসুরের মতো কানে লাগে।
খুবই? খুব? কোনটা? . . . দুটোই।
সত্যিই? না কি সত্যি? এখানে বক্তার অভিপ্রায় অনুসারে দুটোই চলতে পারে। (সত্যি বলছি, সত্যিই আমি তোমাকে ভালোবাসি। সে কি সত্যিই (বা ‘সত্যি সত্যি’) এসেছিল?) 'আসলেই', 'প্রথমেই' এগুলো অন্য ক্ষেত্র। এগুলো ক্রিয়াবিশেষণ, অন্যদিকে খুব ইত্যাদি অব্যয়। “ক্রিয়াবিশেষণ হইতে সাবধান।”




৫২। ‘তাছাড়া/তা ছাড়া’ বড়ো জটিল। যদি পুরোটা নিয়ে একটা ক্রিয়াবিশেষণ মানি, তাহলে 'তাছাড়া'। “ক্রিয়াবিশেষণ হইতে সাবধান।” 'গাছাড়া', 'লাগামছাড়া'? না কি 'গা ছাড়া', 'লাগাম ছাড়া'?
'তা ছেড়ে দিয়ে' এই পদবন্ধ থেকে একপদ হল 'তাছাড়া', সমাসের নিয়মে। ছাড়া একটি কৃদন্ত পদ, ছাড়্ (ধাতু) + আ (প্রত্যয়)। ঠিক যে কারণে 'ঘরছাড়া' (বিশেষণ), 'ঘর ছাড়া' নয়; 'গাছাড়া' (বিশেষণ), 'গা ছাড়া' নয়; 'লাগামছাড়া' (বিশেষণ), 'লাগাম ছাড়া' নয়। তেমনি ক্রিয়াবিশেষণ 'তাছাড়া' থেকে 'ছাড়া' আলাদা ঝুলিয়ে রাখা যায় না। আচ্ছা, ‘তাছাড়া’ যদি এক হয়ে যায়, তবে ‘তাকিছু’-তে আপত্তি কীসের?
মজার ব্যাপার, ‘তা-কিছু’/‘তা কিছু’ বাদ দিয়েও কাজ চালানো যায়।
‘যা-কিছু আনন্দের, তা-কিছু গ্রহণের।’-কে লিখতে পারি, ‘যা-কিছু আনন্দের, তা-ই গ্রহণের।‘ (‘তা-কিছু’/‘তা কিছু’-র বদলে আমরা তা-ই লিখব।)




৫৩। কমা-র দ্বিধা কাটাতে বাক্যের অন্বয়টা ভাবুন, ইংরেজি করে দেখুন। ‘কি না’ হলো whether. I don't know whether it has been done already. ‘কি না’-র পর কমা দেবার তাই কোনো কারণ নেই। তবে 'কি না'-র পর তা/তার, সেটা/সেটার ইত্যাদি থাকলে কমা দিতে হবে। (যাবে কি না বলো। যাবে কি না, তা/সেটা বলো।)
ক্রিয়াবিশেষণ ঠিকভাবে বোঝা মুশকিল, দেখছি! (জানতে ইচ্ছে, কমাটা না দিলে তো চলত না, তাই না?)
উত্তরটা দিই। উপরের বন্ধনীস্থিত বাক্যের বাইরের বাক্যে কমা নিষ্প্রয়োজন। I can see it's difficult to identify adverbs. কমা দিতে হলো কি?
ঝামেলা আরও আছে। ‘কিনা’, না কি ‘কি না’? ‘কি না’ হবে, যদি হ্যাঁ/না দিয়ে উত্তর পেয়ে যাই। যেমন সে যাবে কি না জানতে চাইছি। (সে যাবে কি না, তা জানতে চাইছি।) সে যেতেই চাইছে না, আর তুমি কিনা বলছ, সে যাবার জন্য উদ্‌গ্রিব হয়ে আছে! (বিস্ময় প্রকাশে ‘কিনা’ লিখুন। ‘কিনা’ লিখলে তখন বাক্যটি দিয়ে কিছু জানতে চাওয়া হয় না, এবং ‘হ্যাঁ/না’ দিয়ে তার উত্তরও আসে না। এটা মাথায় রাখবেন। ‘কি না’-কে ভুল করে ‘কিনা’ লিখতে হরহামেশাই দেখি।)




৫৪। ‘হুম’ বাদ দেবো? এর বদলে কী তবে? অন্য বিকল্প... ‘আচ্ছা’? বাংলায় ‘হুঁ’ আছে, অর্ধসম্মতি, একটু unpleasant; শিষ্টাচারসম্মত অব্যয় হল ‘হ্যাঁ’।
‘আচ্ছা’... চলে না? ‘আচ্ছা’-ও হয়। কিন্তু ওই ‘হুম’; কে আবিষ্কার করল এটা! জানেন তো, হুম্ থেকে হুঙ্কার, ঝম্ থেকে যেমন ঝঙ্কার? ইংরেজি hmm-কে 'আত্তীকরণ' করে নয় তো?




৫৫। তোমার কথা ভাববার/ ভাবার সময় আমার নেই। কোনটা?
জানার আছে অনেক কিছু। জানবার আছে অনেক কিছু। কোনটা?
উত্তরটা হলো, সংক্ষেপে লিখব। ভাবার, ভাবা থেকে সম্বন্ধপদ, -র বিভক্তি।
ভাববার, জানবার, বুঝবার, করবার...সব বাদ তবে?
বুঝার? বুঝবার? বোঝার?...কোনটা প্রমিত?
ভাববার এসেছে ভাবিবার থেকে। ভাব্ + ইবা (প্রত্যয়)। ভাবিবামাত্র, সাধুভাষায় এই প্রয়োগ আছে। ভাবিবা থেকে সম্বন্ধপদ ভাবিবার > ভাববার। তাই ‘ওসব’ও হয়। তবে ভাবার, জানার, বোঝার-ই প্রমিত; একইভাবে ‘শোনার’, ‘শুনার’ নয়।




৫৬। এখন কথা হচ্ছে, ‘এতদিন’ কেন লিখব না ইংরেজি থেকে তর্জমা করে? এত দিন --- till now, adverbial phrase, তাই না? উত্তরটা হচ্ছে, বাংলা সমাসপ্রবণ ভাষা, এখানে phrase-এর দাপট কম। এতদিন-কে একটা lexeme বলা চলে। তবে...এতদিন-ই হোক। এতসময়, এতকাল, এতখানি, এতশত, এতসব, এসব-ও তা-ই, একই নিয়মে!




৫৭। আচ্ছা, “আমি তাঁদের চিনি।”? না কি “আমি তাঁদেরকে চিনি।”? না কি “আমি ওঁদের চিনি।”? না কি “আমি ওঁদেরকে...।”?
দেখা যাক।
তাদেরকে (কর্মকারক) = তাদের (বাংলা বাগ্-ধারাসম্মত)। যারা বলে, তাদেরকে ভুল, তারা ভুল বলে।
মানে, তাঁদের/ তাঁদেরকে...ইচ্ছেমতো দেওয়া যাবে?
শুধু তাদের হল সম্বন্ধপদ। একমাত্র পূর্ণ বাক্যের মধ্যেই তাদের = তাদেরকে হয়ে ওঠে, এটা খেয়াল করেছেন? তাহলে কোনটা বেশি fundamental?




আমি তো তাদেরও দেখলাম ওখানে!
আমি তো তাদেরকেও দেখলাম ওখানে!




তাদের বলে দিয়ো।
তাদেরকে বলে দিয়ো।




৫৮। প্রেমে, প্রতিভায় নজরুল অনন্য।...লিখলে ভালো শোনায়? না কি, প্রেম ও প্রতিভায়… লিখব?
দুটোই ঠিক। যদি ঠিক না হবে, তবে বিনয়, সুনয় ও প্রণয়কে আসতে দেখেছি। এটাতে প্রত্যেকের পর -কে আসছে না কেন?




৫৯। 'কী করে বুঝব...' এমন কিছু লিখতে দেখি। ‘কীভাবে’ অর্থে ‘কীকরে’ হওয়ার কথা নয়?
অসমাপিকা ক্রিয়াটা আলাদা লিখতে হয়।
কী করে এখানে এলেন? (করিয়া>করে) … এরকম।




৬০। ‘এ-ই’ লিখি, তাহলে কি ‘এ-টা’ লিখব?
না, লিখব না। ওটা তো ইহাই>এ-ই। এ-টা'তে তেমন কিছু কই?
এই ঘর, এই সংসার আর ভালো লাগে না।
আমার এ-ই বলার আছে। (ইহাই>এ-ই)
...হাইফেন বাদে আলাদা করবেন 'কী করে'? উল্লেখ্য, ‘এই-ই’ বলে কিছু নেই।




৬১। কথায়-কথায়, হাট-বাজার, মাঝে-মধ্যে — শব্দদ্বৈত সাধারণত (সাধারণতঃ নয়, শেষে বিসর্গ বর্জনীয়) হাইফেন দিয়ে জোড়া হয়।
অলংকারের মতো বড়ো শব্দের অনুকার (টলংকার) ব্যবহার করব, না কি ইত্যাদি বলে চালাব, সেটাও প্রশ্ন। আমরা দেখেছি, দুই-ই চলে। তিনি অলংকার-টলংকার তেমন পরেন না। কিংবা, তিনি অলংকার ইত্যাদি তেমন পরেন না।
ফলটল/চা-টা — দু-রকমই বোধ করি চলে।
বলতে বলতে (পার্টিসিপল অর্থে) হাইফেন ছাড়াই। (‘কথায়-কথায়’ পার্টিসিপল অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে না কিন্তু। এটা একই শব্দের বীপ্সা বা পুনরুক্তি, এবং সেটি য় (এ)-বিভক্তিযুক্ত শব্দ, একসঙ্গে 'কথায়কথায়' হবে না। আলাদা করে 'কথায় কথায়' হতে পারে, অথবা 'কথায়-কথায়' চলতে পারে।)




৬২। নানা, নানান, হরেক - এসবের পরে স্পেস পড়বে। ইত্যাদি-এর আগে কমা হবে না। আধুনিক বাংলায় নেওয়া, দেওয়া গ্রহণীয়।




৬৩। স্বরবর্ণ দিয়ে শেষ হলে -তে ব্যবহার্য। 'নৈবেদ্য'-তে।
ব্যঞ্জনবর্ণে শেষ হলে -এ ব্যবহার্য। 'যোগাযোগ'-এ।
এখানে শ্রুতিমাধুর্য একটা বড়ো ফ্যাক্টর। যজ্ঞে ঘি বলা যায়, মোচার ঘন্টে ঘি বলা মুশকিল। তখন ঘন্ট-তে বলতে হয়। 'নৈবেদ্য'-তে বলার চেয়ে 'নৈবেদ্য' কাব্যগ্রন্থে বলা বোধ হয় বাঞ্ছনীয়।
‘বইতে’ আর ‘বইয়ে’ দুটোই চলা উচিত। কারণ ইনসিডেন্স ফিফটি-ফিফটি।




৬৪। পদাশ্রিত নির্দেশক হিসেবে ‘টা ও টি’-এর ব্যবহার অবিকল্প। লেখক স্বেচ্ছায় যেখানে যেটা ইচ্ছা, সেটাই ব্যবহার করবেন। তবে, সাধারণত কোমলতা বা স্নেহ প্রকাশে -টা না লিখে -টি লেখা হয়। যেমন:
“ডানপাশের ছেলেটা বড্ড নাছোড়বান্দা! কিন্তু বাঁপাশের ছেলেটিকে দেখো, কত সুন্দর শান্তভাবে বসে আছে!”




৬৫। মনে করিয়ে দিই লেখার কিছু ধরন।
• কথায়-কথায় বলুন না! কখনও-কখনও ‘মাঝে-মাঝে’ লিখলে হঠাৎ-হঠাৎ ‘কখনো-কখনো’ লেখা যেতেই পারে।
• সমাসবদ্ধ পদ হওয়ায় ‘হাট-বাজার’ লেখাটাই যৌক্তিক।
• হাইফেনের ব্যবহারে দ্বিধা কেন? ‘মাঝে-মধ্যে’ তো লেখা যায়ই।
• ‘অলংকার-টলংকার’ লেখা হোক, কারণ ‘টলংকার’ শব্দটি নিরর্থক, আর, একসাথে লেখা দৃষ্টিকটু।
• দেয়া ও নেয়া শব্দ দুটো অপ্রমিত, লেখা হোক ‘দেওয়া ও নেওয়া’।
• একই জাতীয় কোনো কিছুর উদাহরণে ব্যবহৃত ‘এবং’ শব্দটি কমা ছাড়া, কিন্তু বাক্যের সংযোজক অব্যয় হিসেবে ব্যবহৃত ‘এবং’-এর পরে কমা হবে। (সে এল, এবং তুমি গেলে। সে এবং তুমি এলে।)
• ঙ/ং-এর ব্যবহার নিয়ে প্রণীত নিয়মানুযায়ী প্রমিতরূপ ‘এবঙের’ হওয়ার কথা, যদিও তা বড্ড বেমানান। আমার মতে, ‘এবং-এর’ লেখা বরং ভালো।
• ‘নৈবেদ্য’-তে লিখব। ‘বইয়ে’ আছে অধিকতর শ্রুতিমধুর। তবে কাব্যিক প্রয়োজনে ‘বইতে’ লেখা যেতে পারে।
• বাড়িটি রহিমের, করিমের ও জসিমের। আমার মতে, এ বাক্যে “বাড়িটি রহিম, করিম ও জসিমের।” হবে। আলাদা আলাদা করে প্রতিটি উদাহরণে বিভক্তি যোগ করা, না-করা ক্ষেত্রবিশেষে দুটোই প্রমিত। এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন। জ্ঞানে, ধৈর্যে, প্রজ্ঞায় তিনি অতুলনীয়। (কিংবা, জ্ঞান, ধৈর্য ও প্রজ্ঞায় তিনি অতুলনীয়।)
• কফি, না কি চা? (এভাবেই লিখব, ‘কফি? না কি চা?’ এভাবে না লিখে।)
• “এলেই-বা কী?” “কীই-বা বলা যেত?” “গেলেই-বা কী এমন হতো?” (‘-বা’ এভাবে লিখতে হয়।)
• সে আদৌ এসব জানে কি না জানতে চাই। (…জানে কি না, তা জানতে চাই।)
• আম, জাম, লিচু ইত্যাদি। (উদাহরণ লেখার কমায় শেষ উদাহরণের পর কমা দিতে হয় না। আর, নিশ্চয়ই ‘ইত্যাদি’ শব্দটি এখানে উদাহরণ নয়।) আরেকটি উদাহরণ লক্ষ করি: সে বলেই চলল, “ছেলের বাড়ি আছে, গাড়ি আছে ইত্যাদি ইত্যাদি।”
• সাধু > চলিত
এই > এ
সেই > সে
সুতরাং, এই দিন > এদিন
সেই দিন > সেদিন
তবে, আলোচ্য শব্দগুলো “চলিতভাষাতেও ব্যাপক প্রচলিত।” এ যুক্তিতে দু-ভাবেই ব্যবহার করা যেতে পারে।
• Which day = কোনদিন
Someday = কোনোদিন
One of the days = কোনও একদিন




• Once = একসময়
One time = এক সময়




• Once = একদিন
One day = এক দিন




• এক-এক করে • কত কিছু • ক্ষেত্রবিশেষে, ‘এই তো’ ও ‘এ-ই তো’। (এ-ই তো খুঁজছিলাম! এই তো এবার ঠিক আছে!) • ‘না কি’ লিখে কমা না-দিলেও চলে। তবে পরের অংশটি বাক্য হলে দেওয়া যেতে পারে। • ফাঁক ছাড়া ‘নাকি’ প্রশ্ন বা বিস্ময় প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। (যাবে নাকি? মারবে নাকি আমায়?) না লিখে ফাঁকসহ ‘না কি’ লিখলে ‘হ্যাঁ’/’না’ উত্তর দেওয়া যায়। (হুইস্কি, না কি ভদকা? এখানেই থাকবে? না কি আমার সাথে যাবে?)
• ‘কোনটা’ লিখব? না কি, ‘কোনটি’ লিখব? দুটোই লেখা যায়।
* কথায় কথায় তিনি এটা বললেন। তুলনীয়: কখনো কখনো, মাঝে মাঝে, হঠাৎ হঠাৎ ইত্যাদি। হাট-বাজার বা হাটবাজার। (হাট ও বাজার একই বা কাছাকাছি অর্থ প্রকাশ করে বিধায় হাইফেন না দিলেও চলে। তবে অন্য ক্ষেত্রে হাইফেন দিতে হবে।) মাঝেমধ্যে বা মাঝে-মধ্যে। অলংকার-টলংকার। বলতে বলতে। * ‘মানুষ মাত্রই’ নয়, ‘মানুষ মাত্রেই’। লক্ষণীয়: কেবলমাত্র। নামমাত্র। শুধুমাত্র। এইমাত্র। করামাত্র। দেওয়ামাত্র। দেখামাত্র। (ক্রিয়াপদ+(স্পেস ছাড়া) মাত্র) সবেমাত্র। অংশ মাত্র। আভাস মাত্র। ইঙ্গিত মাত্র। একটি মাত্র। দশটি মাত্র। জীব মাত্রেই। ইত্যাদি।
* ‘এবার আমার নেওয়ার পালা।‘ না লিখে লিখব, ‘এবার আমার নেবার পালা।’ একইভাবে, ‘দেওয়ার’ নয়, ‘দেবার’; ‘হওয়ার’ নয়, ‘হবার’; 'শোওয়ার' নয়, 'শোবার'। তবে কাব্যে ও সাহিত্যে দুটোই চলে।
* এবং-এর আগে কমা ব্যবহার না করাই ভালো এবং দাঁড়িও; ব্যতিক্রম আছে যদিও।
* “নির্ঝর সেখানে আসলেই-বা কী?” ভুল। ‘আসা’ অর্থে আসল নয়, এল; আসলে নয়, এলে।
* “তোমাকে দেবার মতো আমার কী-ইবা আছে?” বাক্যে ‘কীই-বা’ হবে।
* সে আদৌ ব্যাপারটা জানে কি না জানতে চাই। সে আদৌ ব্যাপারটা জানে কি না, তা জানতে চাই।
দু-ভাবেই লেখা যায়।
* কোন দিন, কিন্তু কোনোদিন। কোনকালে, কোনোকালে। কোনখানে, কোনজন, কোনো কিছু, কোনোভাবে, কোনোভাবে, কোনোমতে, কোনোরকম, কোনোপ্রকারে ইত্যাদি।
* একসময়/এক সময়; (দুটোই হয়)। (একসময় এসে বইটা নিয়ে যেয়ো। এক সময়ে দুই কাজ হয়, বলো?)
* একদিন/এক দিন; (দুটোই হয়)। (কাজটা করতে এক দিন লাগবে। একদিন গাইবে আমার জন্যে?)




৬৬। 'বইয়ে আছে? না কি, বইতে আছে?' --- বাঙালি হিসেবে এ প্রশ্ন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কি কিছু আছে? অধিকরণ কারকে তে-বিভক্তি ও এ-বিভক্তি দুই-ই আছে। এ-বিভক্তিই ই+এ থেকে (ই)য়ে হয়ে যাচ্ছে। অতএব, বইয়ে/বইতে দুটোই সিদ্ধ।




৬৭। 'অলংকারটলংকার? না কি অলংকার-টলংকার?' টলংকার একটি অনুকার শব্দ, মূলত অর্থহীন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর মহাগ্রন্থ The Origin and Development of the Bengali Language-এ লক্ষ করেছেন যে, মূল শব্দের প্রথম স্বরবর্ণটি ট-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনুকার শব্দ তৈরি হয়। এখানেও তা-ই, আবার 'বইটই'-তেও তা-ই। সাধারণত বই-এর মতো ছোটো শব্দ হলে অনুকার শব্দটি একসঙ্গে লেখা চলে, কিন্তু অলংকার-এর মতো বড়ো শব্দে অলংকার-টলংকার হাইফেন দিয়ে লেখা শ্রেয়।




৬৮। 'একদিন/এক দিন' --- রবীন্দ্রনাথ যে গান লিখেছিলেন 'একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে' সেরকম ক্ষেত্রে 'একদিন'-এর অর্থ 'একদা', এবং সেই কারণেই তা সমাসবদ্ধ পদ। কিন্তু 'এক দিন যাক, তারপর চিন্তা করব।' এই বাক্যে 'এক' সংখ্যাবাচক শব্দ (এখানে বিশেষণ), অর্থ 'একটি দিন'। অতএব প্রয়োগের ক্ষেত্র অনুযায়ী 'একদিন' বা 'এক দিন' হবে।




৬৯। 'বলতেবলতে/বলতে বলতে' --- অসমাপিকা ক্রিয়ার দ্বিত্ব, অবশ্যই আলাদা 'বলতে বলতে' হবে।
'সে ধীর, কিন্তু নিখুঁত / সে ধীর কিন্তু নিখুঁত' --- যেভাবেই লেখা হোক না কেন, বাক্যটি যৌগিক বাক্য --- [ সে (উদ্দেশ্য) ধীর (বিধেয়) ] | কিন্তু (যোজক) | [ (সে, অনুক্ত কর্তা) নিখুঁত (বিধেয়) ]। কমা অপ্রয়োজনীয়, কিন্তু লেখক যদি দুটো বাক্যের মধ্যে একটা বড়ো বিরাম আছে বলে অনুভব করেন তা হলে তিনি কমা দিতেও পারেন।




৭০। 'কতকিছু/কত কিছু' --- 'কতকিছু / কত কিছু দেখলাম, শুনলাম', এখানে 'কত' একটি তীব্রতাবোধক বিশেষণ, ইংরেজিতে intensifier --- 'কতকিছু' সমাসবদ্ধ পদ, বিশেষণপূর্বপদ কর্মধারয় (বিশেষণ + নামপদ), পৃথকভাবে 'কত কিছু' পুরোটা মিলিয়ে একটি সর্বনামীয় পদবন্ধ (phrase) --- যেভাবেই লেখা হোক না কেন, বাক্যে সর্বনামের কাজ করছে। তুলনীয়, 'কত কী', এখানে কিন্তু আমরা 'কতকী' লেখার কথা ভাবি না।
পুনশ্চ। 'কতকিছু/কত কিছু': অর্থের দিক থেকে দুটির মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই, তাই মনে হয় জুড়ে লেখা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু 'কতদিন পরে এলে!' এবং 'কত দিন পরে এলে?' বাক্য দুটিতে 'কতদিন পরে' অর্থ after how long এবং 'কত দিন পরে'-র অর্থ after how many days. বাংলা প্রয়োগে প্রথমটিতে 'কত' ও 'দিন' সমাসবদ্ধ হয়ে একটা অনির্দিষ্টতার সৃষ্টি করেছে। সেখানে 'কতদিন' একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ পদ বলা চলে, কেবল লেখকের খেয়ালে জুড়ে-যাওয়া পদ নয়।




৭১। 'কফি? না কি, চা?' ইত্যাদির সঠিক নিয়ম: এটি একটি বৈকল্পিক প্রশ্নবাক্য। 'না কি' তার সহায়ক অব্যয়। 'না কি'-র পরে কমা অর্থহীন ও বিভ্রান্তিকর। বাক্যটি 'কফি, না কি চা?' লেখা হলে 'কফি'-র পর ওই কমা বোঝাচ্ছে যে প্রাথমিক কফির প্রস্তাবের পর বিকল্প চায়ের প্রস্তাব করা হলো। আমার মতে, প্রশ্নবোধক চিহ্ন না দিয়ে বরং কমা দিয়েই লেখা উচিত এ ধরনের বাক্য। তবে পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে, কফির প্রস্তাবের পর বেশ কিছুটা ভেবে, ইচ্ছায় বা নিরুপায় হয়ে, চায়ের প্রস্তাব করা হচ্ছে, তা হলে দুটো বাক্যে ভেঙে 'কফি? না কি চা?' লেখা যেতে পারে, কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই 'না কি'-র পর কমা চলবে না। তুলনীয়: 'আমি, না তুমি?' এবং 'আমি না, তুমি।' --- দুটো ভিন্নার্থক বাক্য। এখানে কেবল 'আমি না তুমি।/?' লিখলে অর্থবোধে কিছু বিভ্রান্তি হতে পারে।




৭২। নেয়া/নেওয়া: প্রমিত বাংলায় 'নেওয়া' স্বীকৃত। আসলে নেওয়া/দেওয়া শব্দের ভিতরকার ধাতুগুলি নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। উত্তমপুরুষের সাধারণ বর্তমান কালের ক্রিয়া (নিই/দিই) থেকে বিভক্তি ছেঁটে ধাতু শনাক্ত করলে ধাতু হচ্ছে নি/দি। আমার ধারণা এখান থেকেই নি-(প্রত্যয়)আ > নিয়া (য়-শ্রুতি) > নেয়া (স্বরসঙ্গতি)। আবার যদি প্রথমপুরুষের সাধারণ বর্তমান কালের ক্রিয়া (নেয়/দেয়) থেকে ধাতু শনাক্ত করা হয়, তা হলে ধাতু নে/দে। সেখান থেকে নে-(প্রত্যয়)আ > নেওয়া (অন্তঃস্থ ব-শ্রুতি)। এ-ই মনে হয় ভেতরের কাহিনি।




৭৩। 'এবং-এর আগে কখন কমা বসে?' --- 'এবং' যদি একটা যৌগিক বাক্যের যোজক হয়, তা হলে কমা প্রয়োজনবোধে বসতেও পারে। যেমন, 'সে হেঁটে এল, এবং সভায় পৌঁছে দুর্ধর্ষ বক্তৃতা করল।' 'এবং' যদি দুটো পদের যোজক হয় তা হলে কমা না-ও বসতে পারে। যেমন, 'শিশুটি একইসঙ্গে হাসল এবং কাঁদল।'




৭৪। তাহলে, না কি তা হলে? ‘তা হলে’ মানে ‘কোনো কিছু ঘটলে’। সে আসবে, তা হলে তো আজকের প্রোগ্রামটা ভালোই হবে। (এখানে চাইলে ‘তা’-এর বদলে ‘সেটা’, ‘ওটা’ ইত্যাদি দিলেও চলে।)
‘তাহলে’ মানে ‘তবে’। এক্ষেত্রে ‘তা’-এর বদলে ‘সেটা’, ‘ওটা’ লেখা যায় না। কাজ শেষ, তাহলে এবার চলো। (এই বাক্যে ‘তাহলে’-র ‘তা’ বাদ দেওয়া যায় না।)




(চলবে . . . )