অর্ধেক বিশুদ্ধ

 
নলিনী, শিউলি-সকাল থেকে হলদে-সন্ধে অবধি খুব করে চেষ্টা করেছি গো এবং আবারও করেছি, আর তো মনে পড়ছে না…সেই যে ঘণ্টাবাজা রোববার, তুমি ছিলে বইয়ের ভাঁজ-করা বত্রিশ নং পৃষ্ঠায়; বয়োবৃদ্ধ হলদে গোলাপটার নিচে চাপাপড়া প্রথম যৌবনে!
অনেক খুঁজে দেখেছি, বুঝলে...বইয়ের তাকে কোথাও তুমি নেই!
অথচ কথা ছিল, তুমি প্রজাপতি হবে না…
 
সযতনে তুলে আনা রাঙা ময়ূরের পালকের নীলে তুমি ছিলে বেশ টাটকা গন্ধে…
দূর্বাদলে তখন সোনালি বউদের আগমন, এক ফোঁটা আলতা মুছে এনে তোমার সিঁথি হাতড়ে মরছিলাম,
তুমি বললে, সামনের বোশেখেই ফিরবে দণ্ডিত ফড়িং এবং প্রসূনের ছন্দে!
বৃক্ষবনে গিয়ে দেখি, সবুজের দুর্ভিক্ষে পাখিদের সংসারে থই থই করছে ধ্রুপদী বিরস…অথচ তুমিই এলে না!
আমার যে আর দেখা হলো না, আলতা-সিঁথি কতটা পোড়ায় সুখে, বুকের জমিন ঠিক কতখানি রাঙায় আদর মেখে মেখে!
বুঝলে, খ্যাপা মনপাগলা, ভালোবাসা যে এখন প্রশ্নবোধক প্রতিটি প্রণয়বাক্যে!
 
নলিনী, জানো, আমার ছাদজুড়ে যখনই রাত নামে, স্মৃতিগুলো ক্রমাগত মন্থন করতে থাকে আমাকে; জানতে চায়, সেই রাতে কেন দু-চোখের গর্ভে জন্মায়নি প্রেম? কেনই-বা জাগেনি কামিনী-বকুল?
কেমন করে বলি ওদের, অমীমাংসিত অনিদ্রায় যে বাঁচে, সে যে তীব্র পাললিক নারী!
আমি কোনও লাবণ্যময়ী মেয়ে দেখিনি সেদিন, দেখিনি চাঁদ।
এলোমেলো চুল দেখিনি, কৃষ্ণচূড়া চোখ দেখিনি, অশ্রু দেখিনি, দেখিনি…কীভাবে গ্রীবায়, মাংসে কদম ফোটে, ভীত-হওয়া মেয়ের ঠোঁট দেখিনি…নলিনী, আমি যে শুধুই তোমাকে দেখেছি!
তুমি জন্মে ফোটোনি, ফুটেই জন্মেছ।
 
পোড়া জোছনা, ভাঙা কুয়াশা, মার-খাওয়া শিউলি, নির্বাসিত প্রণয়, আধপেটা রামধনু, প্রৌঢ়া মেঘের দল…
ওরা জানে না, প্রাগৌতিহাসিক অন্ধকারে পাললিক নারী কতটা সত্য!
ওরা জানে না, চোখের কার্নিশে ভেজা রুমাল কখনও শুকোয় না…কেননা ধ্রুপদী ছন্দে রৌদ্র ছোঁয় না বিভাজিত রৌদ্রকেই!
অভিবাসী পুরুষের দীনতায় দুঃখী পূর্ণিমা দারুণ নিঃস্ব! সে চায়, আবার আসুক রোদ, আসুক মেঘ…একটি চুমু ছুঁয়ে যাক পুরোটা নাক-মুখ!
আর তুমি নলিনী, কী চেয়েছিলে অভেদ্য অমাবস্যায় অষ্টাদশী চাঁদটার কাছে? আরও একটু গহীনে, দু-ঠোঁটের দরোজায় খিল পরাতে?
অথচ বেভুলে পার হয়ে যাওয়া যাপিত জীবনে, এক তুমিই ছিলে স্বচ্ছ জোছনা!
কখনও মৃদু বইতে পানলতায়, কখনও সরলতায় ঝরতে ধুলোহীন মসৃণতায়, কখনোবা গলে গলে পড়তে বৃক্ষের শরীরে-মজ্জায়-ফলের বোঁটায়…কেননা তুমি ছিলে নকশিকাঁথার ত্রি-শৈবালিনী!
 
একদিন কিংবা কখনও নয়, তুমি বললে, তুমি ফুল দিয়েছিলে দু-হাত ভরে।
তোমার মুঠোভরা উষ্ণ মাংসে পুড়তে থাকে আমার নিঃসঙ্গ অনামিকার ভরাশৈশব!
অথচ আমার অনুভূতির কোনও শরীর নেই, শিশিরে ধোয়া দুটো পা নেই; ওরা হেঁটে যেতে পারে না কালচে গোধূলি মাড়িয়ে বিপন্ন পরবাসে; দুঃখী পূর্ণিমা পরিহাসে বলে ওঠে, মনে আছে, সরষেফুলে কতটা সুখ ছিল?!
তবুও কবিতা লিখেছি চোখে জমাট অভিযোগহীন অশ্রু নিয়ে, কেননা সে জল শ্রাবণের মতো স্বাধীন ও বেখেয়ালি।
 
বৃষ্টির প্রেম নাকি অবহেলা করা যায় না, তবে বৃষ্টি কি শুধুই প্রেমের কথা বলে? ওটা তো বিষণ্ণ মেঘের কান্না…হয়তো অনেকেরই কান্না, যারা রোজ আকাশের দিকে চেয়ে এক-একটি দীর্ঘশ্বাসের জন্ম দেয়, তাদের কান্না।
বৃষ্টি আমায় খুব একটা প্রেম দেয় না, বুঝলে…তুমি বলেছিলে, বিষণ্ণতার সুন্দরগুলো দারুণ ধ্রুপদী!
বিরতিহীন মুগ্ধতায় আমি ফুল হয়ে ফুটেছিলাম অবেলায়!
 
তবে এ-ই কি সেই নলিনী? আজ যে সুখ গুনে রাখে, এক-একটা ঝলসানো সুখের জন্য প্রত্যেকটা জীবন্ত শপথ নির্বিকারচিত্তে নিমিষেই পিষে ফেলে!
যাকে আর বলা যায় না, চলো, সমুদ্রজলে হেঁটে যাই বেহুলার রূপনগরে!
থলথলে বাসি পাউরুটির মতো প্রতিরাতে যে মেলে দেয় নিজেকে…আর বলে, মাখনে নয়, ঝোলে ডুবিয়েই খেয়ে নাও!
 
আমি তো তোমার ললাটের ভাঁজে থাকতে চেয়েছি, নলিনী!
হাতের বহুগামী পথে কেন তুমি হাঁটতে চাইলে তবে?
আমি শিশিরে ভেজা দুটো পা চেয়েছি, কেন তুমি বাষ্পে ধোয়া ঠোঁটের দরোজা খুলে দিলে?
যে সময়টা আমাদের ছিল, তা বেহাত হয়ে যাক, চাইনি কখনও; কেন তবু আকাশপথে টেনে দিলে বলিরেখা?

আজ খুব বলতে ইচ্ছে করছে ঘাসফড়িংয়ের সুখে, ধন্যবাদ তোমাকে, নলিনী; কিছু স্বাধীন বিমুক্ত সময়ের অনুদানে কৃতার্থ করলে এই অধমে!
ভালো থেকো নৈরাজ্যে খণ্ডিত দুটি মানুষ, ভালো থেকো স্বজনে-সবুজে!
অর্জিত যতই অসুন্দর থাক না কেন এ জীবনে আত্মীয় হয়ে, ফিরে আসুক তা দু-কূল ছাপিয়ে ছিন্নস্রোতে!

আমিও আমার মতো তোমার গল্প ঘষে ঘষে তুলে ফেলি, শ্যাওলা-সবুজে ধূসর জীবন আর কত?
নিজের গল্পটাই আজ মরুপথে নিঃসঙ্গ বেদুইন, স্বপ্নের গলা কেটে অমৃতপান…এ নয় আমার অতীত!
কাঙালে-বাউলে এক কোরো না প্রণয়গীত, শাপমোচনের সহজ পথে কেন তুমি পলাশরাঙা পা ফেলবে, বলো!
নইলে যে…মাংসে কদম নয় গো, অবিশ্বাসে ফুটবে বিচ্ছিন্নতা!
 
নখ ডুবিয়ো না প্রজাপতির ডানায়, খসে পড়বে রঙ-পলেস্তারার খয়েরি চামড়া!
নিঃশ্বাসে ছুুঁইয়ো না ফলিত গানের বীজ, শুকিয়ে যাবে বাগানিয়া স্বপ্নগুলো এক এক করে।
আষাঢ় এলেই লিখতে বোসো না চিঠি; তুমি কি চাও অঙ্কুরেই ধর্ষিত হোক শব্দগুলো?
 
অতঃপর, অভিযোগের পসরা নিয়ে এসেছি বলে, ইচ্ছে করলে বলে দাও, আমি ভুল অস্তিত্বে বেড়ে ওঠা মানুষ এক!
হ্যাঁ গো নলিনী, আমি ভুল, কিন্তু অর্ধেক বিশুদ্ধ!