গীতায় কর্মযোগ: প্রথম অংশ

আমরা দেখেছি, কিছু জ্ঞানবাদী সাধক কর্মফলের ভঙ্গুরতা, কর্মীর অধঃপতন, কর্মের বন্ধনযোগ্যতা প্রভৃতি দোষ দেখে একসময় সকল ধরনের কর্ম বর্জনের উপদেশ দিয়েছেন। এই শ্রেণীর সাধকেরা নিজেদেরকে কর্মসন্ন্যাসী বলে অভিহিত করতেন। তাঁরা নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য—কোনো ধরনের কর্মের মধ্যেই ছিলেন না; কর্তব্য ও অকর্তব্য—দুই ধরনের কর্মেরই বর্জন করতেন। এঁদের উদ্দেশে গীতা বলছেন—




ত্যাজ্যং দোষবদিত্যেকে কর্ম প্রাহুর্মনীষিণঃ।
যজ্ঞদানতপঃকর্ম ন ত্যাজ্যমিতি চাপরে॥ (১৮/৩)




অর্থ: কোনো কোনো মনীষী বলেন, কর্মমাত্রেই দোষযুক্ত, তাই ত্যাজ্য। 'কর্মমাত্রেই দোষযুক্ত'—কর্ম‌ই বন্ধনের কারণ। অতএব, কর্মত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে আত্মজ্ঞাননিষ্ঠ হতে হবে—এঁরা বিবিদিষু বা ব্ৰহ্মসাক্ষাৎকারবান (ব্রহ্ম বা আত্মজ্ঞানের খোঁজে নিযুক্ত) সন্ন্যাসী। এঁদের মত—যেমন অন্তঃকরণের কাম, ক্রোধ, রাগ, দ্বেষ, মান, দম্ভ, দর্প, অহংকার ইত্যাদি মল (সাধনার পথে অন্তরায়) ত্যাগ করতে হয়, তেমনি কাম্য সকল কর্মও ত্যাগ করতে হবে।




যাঁদের আত্মজ্ঞাননিষ্ঠা নেই, তাঁরা কর্মত্যাগ করে সন্ন্যাসী হলে তা বরং দুঃখেরই হেতু উল্লেখ করে ভগবান বলছেন—"সন্ন্যাসস্তু মহাবাহো দুঃখমাপ্তুময়োগতঃ" (৫/৬)—”হে মহাবাহো, নিষ্কাম কর্মযোগ ব্যতীত জ্ঞানযুক্ত পরমার্থিক সন্ন্যাস লাভ করা অসম্ভব।” একটু ভেঙে বলা যাক। আত্মজ্ঞানের স্বরূপই সন্ন্যাস। এইজন্য 'পরব্রহ্ম' শব্দ দ্বারা সন্ন্যাসই প্রতিপাদিত। বৈদিক কর্মযোগ এর উপায় বলে যোগও সন্ন্যাস নামে উপচরিত হয়। আর কর্মযোগ ছাড়া জ্ঞানপ্রাপ্তি অসম্ভব—ইহজীবনে বা পূর্বজন্মে নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠান আবশ্যক। (গীতা, ১৮/৪৫-৪৬, ৫০-৫৫ এবং ব্রহ্মসূত্র, ৩/৪/২৬ ও ৪/১/১৮)




যাঁরা কর্মী, তাঁরা ফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে ঈশ্বরার্থে নিরহংকার হয়ে কর্ম করবেন। তাঁরা যজ্ঞ-দান-তপঃ ক্রিয়া করবেন। আর যাঁরা বুদ্ধির জড়তা অথবা কায়ক্লেশের ভয়ে কর্ম ত্যাগ করতে চান, তাঁদেরকেই ভগবান বলছেন, যজ্ঞ-দান-তপঃ কর্ম ত্যাগ করবে না—অর্থাৎ এখানে কর্মীর মনোভাবের দিকটির দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে। জ্ঞাননিষ্ঠ সন্ন্যাসীদের কথা নয়, বরং আত্মজ্ঞানহীন অজ্ঞানীদের সম্পর্কে এই শ্লোকে বলা হচ্ছে।




যাঁদের জীবদেহে আত্মবোধ আছে, তাঁদের পক্ষে সর্বকর্মসন্ন্যাস পালন করা অসম্ভব। ভগবান বলছেন, "ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ" (৩/৫)—”কাজ না করে কেউই (পরমার্থজ্ঞানে সমাধিস্থ যোগী বাদে) ক্ষণকাল‌ও থাকতে পারে না—সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের প্রভাবে কাজ করতে বাধ্য হয়।” সমাধিস্তরে পৌঁছনোর আগে কর্মত্যাগ অজগর বৃত্তি অবলম্বন বাদে আর কিছু নয়।




আবার ১৮/১১-তে ভগবান বলছেন, "ন হি দেহভৃতা শক্যং ত্যক্তুং কর্মণ্যশেষতঃ"—"দেহাভিমানী বা মোহগ্রস্ত ব্যক্তি নিঃশেষে কর্মত্যাগ করতে সমর্থ হয় না।" এক্ষেত্রে বিবিদিষু (জ্ঞানেচ্ছুক) সন্ন্যাসীকেও কর্ম করতে হবে, কেননা তিনি পরমার্থিক জ্ঞানের সন্ধান করছেন মাত্র—এখন‌ও সেই জ্ঞান প্রাপ্ত হননি।




ভগবান ১২/১২ শ্লোকে বলছেন, "ধ্যানাৎ কর্মফলত্যাগস্ত্যাগাচ্ছান্তিরনন্তরম্"—–অজ্ঞানকৃত আসন প্রাণায়াম-জপাদি অভ্যাস থেকে শাস্ত্রজ্ঞান শ্রেষ্ঠ, শাস্ত্রজ্ঞান থেকে ধ্যান শ্রেষ্ঠ, ধ্যান থেকে কর্মফলত্যাগ (এবং কামনাত্যাগ) শ্রেষ্ঠ এবং ত্যাগ হতে দ্রুত শান্তি লাভ হয়। এর কারণ, কর্মফল ত্যাগ হলে চিত্তশুদ্ধ হয়, তখনই শাস্ত্রজ্ঞান ও শাস্ত্রপ্রতিপাদিত ব্রহ্মবস্তুর ধারণা তথা ধ্যান হয়, আর কেবল ধ্যানসিদ্ধেরই ব্রহ্মনির্বাণ শান্তি হয়— এভাবেই ভগবান কর্মফলত্যাগের স্তুতি করছেন।




দেহধারীরা অশেষরূপে কর্মত্যাগ করতে পারে না বলে কামনাত্যাগ ও কর্মফলত্যাগের স্তুতিই এখানে করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়েই ভগবান বলছেন, "যাঁরা কেবল আত্মাতেই প্রীত, তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট, তাঁদেরই কোনো কাজ নেই।" (৩/১৭)। আত্মতৃপ্তি মৃত্যুর সমান, কেননা আত্মতৃপ্ত মানুষ কোনো কাজে প্রবৃত্ত হতে চান না।




গীতামুখে ৩/৪-এ ভগবান বলছেন—




ন কর্মণামনারম্ভান্ নৈষ্কর্ম্যং পুরুষোহশ্নুতে।
ন চ সন্ন্যসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি॥




অর্থ: কাজ না করে কেউই নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধিতে অর্থাৎ নিষ্ক্রিয় হয়ে আত্মভাবে স্থির থাকতে পারে না। কাজের মাধ্যমে চিত্তশুদ্ধি ও আত্মবিবেক অর্জিত না হলে বৈদিক সন্ন্যাসের সাথে জ্ঞাননিষ্ঠা (গীতা, ১৮/৪৯) বা নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি হয় না। এখানে 'চিত্তশুদ্ধি' বলতে জ্ঞানযোগাভ্যাসের যোগ্যতালাভরূপ সিদ্ধি বোঝানো হচ্ছে। যজ্ঞাদি কাম্য কর্ম ও নিত্য কর্মসমূহ চিত্তশুদ্ধির দ্বারা আত্মজ্ঞান বা মুক্তিলাভের সাধক বা সহায়ক হয়। কর্মনিষ্ঠাই জ্ঞাননিষ্ঠার হেতু বলে পরোক্ষভাবে কাজই মুক্তির মূল কারণ। গীতামুখে ভগবান বলছেন—




অসক্তবুদ্ধিঃ, সর্বত্র, জিত-আত্মা, বিগত-স্পৃহঃ।
নৈষ্কর্ম্য-সিদ্ধিম্, পরমাম্, সন্ন্যাসেন, অধিগচ্ছতি॥
(গীতা, ১৮/৪৯)




অর্থ: যিনি সর্ববিষয়ে অনাসক্ত, জিতেন্দ্রিয় (নিরহংকার) ও নিস্পৃহ, তিনি অর্থাৎ সেই আত্মজ্ঞ ব্যক্তি কর্মফল ত্যাগরূপ সন্ন্যাস দ্বারা নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি লাভ করেন অর্থাৎ কর্মবন্ধন হতে মুক্ত হন।




কর্মমাত্রই দোষযুক্ততা বা বন্ধনের কারণ। কর্মফলেই দেহধারণ, আবার দেহধারণ হলেই কর্ম। এই জন্ম-কর্মচক্রের নিবৃত্তি নেই। সমগ্র অধ্যাত্মশাস্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে, কীভাবে জীব এই কর্মচক্র হতে নিষ্কৃতি লাভ করতে পারে, তার উপায়নির্দেশ। এই অবস্থাকেই নৈষ্কর্ম্য বলে এবং কর্মবন্ধন হতে মুক্তির নামই ‘নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি’। এর উপায় কী?




সন্ন্যাসবাদী বেদান্তী বলেন, আত্মজ্ঞান ছাড়া কর্মবন্ধন হতে মুক্তি নেই, এবং কর্ম থাকতে জ্ঞানও হয় না; সুতরাং সব কাজ ত্যাগ করে নিবৃত্তিমার্গ বা সন্ন্যাস গ্রহণই অমৃতত্ব লাভের একমাত্র উপায় –”কর্মণা বধ্যতে জন্তুর্বিদ্যয়া তু প্ৰমুচ্যতে” (মহাভারত, শান্তিপর্ব, ২৪০/৭) —”কর্মের দ্বারা জীব বদ্ধ হয় ও বিদ্যার দ্বারা মুক্ত হয়”; “ত্যাগেনৈকেন অমৃতত্বমানশুঃ” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, শঙ্করকৃত ভাষ্য)—”একমাত্র ত্যাগের দ্বারাই অমৃতত্ব লাভ করা যায়”; “প্ৰবাহপতিতঃ কাৰ্য্যং কুৰ্বন্নপি ন লিপ্যতে৷ /বাহ্যে সর্বত্র কর্তৃত্বমাবহন্নপি রাঘব॥” (অধ্যাত্মরামায়ণ, ২/৪/৪২)—”কর্মময় সংসারের প্রবাহে পতিত মনুষ্য বাহ্যত সমস্ত কর্তব্য কর্ম করেও অলিপ্ত থাকে।” সুতরাং তাঁরা ‘নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি' অর্থ করেন—কর্মশূন্যতা বা কর্মত্যাগ এবং ত্যাগানন্তর (ত্যাগের পরবর্তীতে) জ্ঞানলাভ। গীতা বলেন, জ্ঞান ভিন্ন মুক্তি নাই, তা ঠিক; কিন্তু সেই জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি-নিরপেক্ষ নয়; কর্ম ত্যাগ করলেই নৈষ্কর্ম্য লাভ হয় না, বস্তুত দেহধারী জীব নিঃশেষে কর্ম ত্যাগ করতেই পারে না (৩/৪-৫; ১৮/১১)। কর্মের বন্ধকত্বের কারণ বাসনা বা আসক্তি; আসক্তি ত্যাগ করে ঈশ্বরার্পণ-বুদ্ধিতে কর্ম করলেই নৈষ্কর্ম্য-সিদ্ধি লাভ করা যায় অর্থাৎ কর্ম-বন্ধন হতে মুক্ত হওয়া যায়, সেজন্য কর্মত্যাগ করার প্রয়োজন হয় না।








এখানে 'সন্ন্যাসেন'—'সন্ন্যাসদ্বারা' শব্দটি আছে। এর অর্থ কর্ম-সন্ন্যাস নয়, এর অর্থ ফল-সন্ন্যাস অর্থাৎ কর্মফল ত্যাগ করে বা সকল কাজ ঈশ্বরে অর্পণ করে—এই অর্থ। এই অর্থে ‘সন্ন্যাস', ‘সন্ন্যাসী’, ‘সন্ন্যস্ত' শব্দসমূহ গীতায় অনেকবার ব্যবহৃত হয়েছে (৩/৩০; ৪/৪১; ৬/১; ৯/২৮)। বস্তুত, আগের শ্লোকেই (১৮/৪৮) শ্রীভগবান বলেছেন যে, স্বভাবজ কর্ম দোষযুক্ত (ক্ষত্রিয়ের কাজে নরহত্যা, কৃষিকাজে কীটহত্যা ইত্যাদি) হলেও তা ত্যাগ করতে নেই। অগ্নি যেমন ধূম দ্বারা আবৃত থাকে, তেমনি কর্মমাত্রেই দোষযুক্ত। কর্মকে দোষমুক্ত করার কী উপায়, তা-ই ১৮/৪৯ শ্লোকে বলা হলো। পরে ১৮/৫৬ শ্লোকেও স্পষ্টই বলা হয়েছে, সব কর্ম করেও ভগবৎ-প্রসাদে (নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমে) শাশ্বত অব্যয় পদ বা মোক্ষ লাভ হয়। সুতরাং কর্মত্যাগের কোনো প্রসঙ্গই এখানে নেই।




লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক তাঁর ‘গীতারহস্য’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বলছেন, কর্ম করলেও যখন তা না-করার সমান হয়, অর্থাৎ যখন কর্মের পাপপুণ্যের বন্ধন কর্তার হয় না, সেই অবস্থাকেই ‘নৈষ্কর্ম্য' বলে। পূর্বে 'কর্মে অকর্ম দর্শন' ইত্যাদি কথায় এই অবস্থাই নানা স্থানে বর্ণনা করা হইয়াছে, (গীতা, ৪/১৮-২৩)।




বস্তুত ‘নৈষ্কর্ম্য’ শব্দের অর্থ যে কর্মত্যাগ নয়, তা শ্রীমদ্‌ভাগবতের আলোচনায়ও স্পষ্ট বোঝা যায়—




ক. “নারায়ণো নরঋষিপ্রবরঃ প্রশান্তঃ নৈষ্কর্ম্যলক্ষণমুবাচ চচার কর্ম” (১১/৪/৬)—এখানে ভাগবত-ধর্মের আদি প্রবর্তক ভগবান নরনারায়ণ ঋষি সম্বন্ধে বলা হচ্ছে, তিনি নৈষ্কর্ম্যলক্ষণযুক্ত (নিষ্কাম) কর্মের উপদেশ দিয়েছেন এবং নিজে তেমন কর্মের আচরণ করেছেন, অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ গীতায় যা বলছেন, ঠিক তা-ই।
খ. বেদোক্তমেব কুর্বাণো নিঃসঙ্গোবর্পিতমীশ্বরে।
নৈষ্কর্ম্যং লভতে সিদ্ধিং রোচনার্থা ফলশ্রুতিঃ৷৷ (১১/৩/৪৬)
এখানে বলা হচ্ছে, আসক্তিশূন্য হয়ে ঈশ্বরার্পণ-বুদ্ধিতে কর্ম (গীতা, ৩/৮-এ বর্ণিত ‘নিয়ত কর্ম’ বা ‘প্রাত্যাহিক কর্ম’) করলেই নৈষ্কর্ম্য লাভ হয়।
গ. “তন্ত্রং সাত্বতমাচষ্ট নৈষ্কর্ম্যং কর্মণাং যতঃ।”  (১/৩/৮)
শ্রীধরস্বামীর ভাষ্যে—এখানে সাত্বত-ধর্ম সম্বন্ধে বলা হচ্ছে যে, ওতে কর্মের নৈষ্কর্ম্য হয়, অর্থাৎ কর্মের বন্ধনত্ব ঘোচে (গীতা, ৪/১৭-২৩)।




অনাসক্ত চিত্তে ঈশ্বরার্পণপূর্বক কর্ম করাই নৈষ্কর্ম্য অবস্থা, ওটা কর্মশূন্যতা নয়—’নৈষ্কর্ম্য’ শব্দের ‘কর্মত্যাগ’ অর্থ গ্রহণ করে ‘ভাগবত-ধর্ম সন্ন্যাসাত্মক’ রায়ে প্রদত্ত সমস্ত ব্যাখ্যাই এখানে তাই বর্জনীয়। গীতার কর্মযোগের মূলভাব কর্মত্যাগের নয়, কর্মফলাকাঙ্ক্ষাত্যাগের।




নিষ্কাম পন্থায় অহংকারশূন্য হয়ে কর্তব্যকর্ম না করলে চিত্ত শুদ্ধ হয় না। চিত্ত শুদ্ধ হলে ভগবানে ভালোবাসা হয়। তখনই মানুষের ধর্মজ্ঞানলাভের স্পৃহা প্রবল হয়। তারই ফলে ক্রমে ক্রমে আত্মজ্ঞান হয়। সুতরাং কেবল বাইরে কর্মসন্ন্যাস করলেই কেউ সিদ্ধ হয় না। যথোচিত কাজ করতে হয়, অনেক খাটতে হয়। ধর্মকর্ম দ্বারা পাপ দূর হয়, সুতরাং নৈষ্কর্ম্যভাব পেতে চাইলে প্রথমে নিষ্কাম কর্ম করতেই হবে। তা না হলে চিত্তশুদ্ধি হবে না, জ্ঞানযোগাভ্যাসের যোগ্যতাও লাভ হবে না।




অনেকসময় জীব তার দেহকে কর্ম-বিরত রেখে মনকে কর্ম-নিরত করে—বাহ্যত ইন্দ্রিয়ের সংযম করেও অন্তরে কাম্যবস্তুর ধ্যান করে। এমন কর্মসন্ন্যাসীকে গীতা মিথ্যাচারী বা কপটাচারী বলছেন—




কর্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরন্।
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে॥ (৩/৬)




অর্থ: যে নির্বোধ ব্যক্তি পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় বাহ্যিকভাবে সংযত রেখে মনে মনে ইন্দ্রিয়সুখের কল্পনায় ভাসেন, তাঁকে মিথ্যাচারী বলে।




এ থেকে বোঝা যায়, গীতা কর্মীর মনের গঠন এবং কর্ম করার সময়কার নিয়তের উপর বারবার জোর আরোপ করছেন। ঠিক পরের শ্লোকেই ভগবান বলছেন—




যস্ত্বিন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্যারভতেহর্জুন।
কর্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্মযোগমসক্তঃ সঃ বিশিষ্যতে।। (৩/৭)




অর্থ: যিনি মনের দ্বারা পাঁচটি ইন্দ্রিয়কে সংযত রেখে অনাসক্ত হয়ে কর্মেন্দ্রিয়ের সাহায্যে কর্মানুষ্ঠান করেন, তিনি পূর্বোক্ত মিথ্যাচারী অপেক্ষা উত্তম।




কর্মানুষ্ঠান সম্পর্কে জানতে গীতার ১৮/৭ শ্লোকে যাওয়া যাক—




নিয়মতস্য তু সন্ন্যাসঃ কর্মণো নোপপদ্যতে।
মোহাৎ তস্য পরিত্যাগস্তামসঃ পরিকীর্তিতঃ।।




অর্থ: অবশ্যকর্তব্য নিত্যকর্ম ত্যাগ করা উচিত নয়, কারণ নিত্যকর্ম চিত্তশুদ্ধিকর। অজ্ঞানবশত নিত্যকর্ম ত্যাগ করাকে তামস ত্যাগ বলে।




নিত্যকর্ম অবশ্য কর্তব্য—এটা না জানাই অজ্ঞান। পঞ্চমহাযজ্ঞ (বেদাধ্যায়ন, অগ্নিহোত্র, পিতৃতর্পণ, ভূতবলি বা জীবে অন্নদান ও অতিথিপূজা), সন্ধ্যাবন্দনা, স্বাধ্যায় (বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্র পঠন ও মননের মধ্য দিয়ে আত্ম-অধ্যয়ন), দান, তপস্যা ইত্যাদি কর্ম ছেড়ে দিলে চিত্তের জন্য উন্নতিকর কোনো কিছুই তো আর থাকে না। নিত্যকর্মেরও ফল আছে, তবে কর্ম করতে হবে ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে—ফলাকাঙ্ক্ষাই বন্ধনের কারণ, তাই তা ত্যাগ না করলে জীবের মুক্তি অসম্ভব। সন্ন্যাসের নামে, মোহবশত কর্মত্যাগ মূলত তামস ত্যাগ, তাতে অধোগতিই হবে।




মনে স্থির ও দৃঢ় আত্মজ্ঞানাভিনিবেশ হতে থাকলে বা আত্মজ্ঞান লাভ হলে পরে তাঁকে আর নিত্যকর্মও করতে হয় না। সদা ঈশ্বরপ্রেমে মাতোয়ারা ব্যক্তি কখন সন্ধ্যা করবেন? আর তার দরকারই-বা কী? ব্রহ্মের সামীপ্যে চলে যাবার পর বাহ্যিক আচারাদির পালন নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু মনের ওই অবস্থা না এলে জোর করে কর্মত্যাগ করলে হিতে বিপরীত হবে।




শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন—"কাঁচা ঘায়ের মামড়ি ছিঁড়লে ঘা বাড়বে। ঘা শুকিয়ে গেলে মামড়ি আপনিই খসে পড়বে, জোর করে ছিঁড়তে আর হবে না।" তিনিও ইচ্ছে করে কর্মত্যাগ করেননি, ঈশ্বরপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে একসময় বৈধী কর্ম আর করতে পারলেন না। ধ্যানে বিভোর, কখন ভোগ দেবেন? তর্পণ করতে পারলেন না, হাত বেঁকে জল পড়ে গেল।




কর্মাসক্তি যেমন দোষের, অকর্মাসক্তিও তেমনি দোষের। ২/৪৭ শ্লোকে গীতা বলছেন—




কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি॥




অর্থ:  কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নয়; কর্মফলের আকাঙ্ক্ষায় কর্ম কোরো না, তাই বলে অকর্মে (আলস্যে বা কর্মত্যাগে) যেন তোমার মন না যায়।




যেহেতু ফলে অধিকার নেই, কর্মফল চাইবও না, সুতরাং কাজও করব না—এমন ভাবনা মাথায় আসতে পারে। পরের উপকার করলে পরবর্তীতে উপকৃত ব্যক্তি দুঃখ দিতে পারে, এটা ভেবে যদি উপকার করা বন্ধ করে দিই, তাহলে পুণ্যার্জন হবে কী করে? যাঁরা ব্রহ্মধ্যানও করতে পারেন না, তাঁদেরই ভগবান নিষ্কামভাবে সৎকাজ করে যেতে অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন, অর্থাৎ ফল না চেয়ে সবসময় ভালো কাজ করে যেতে হবে। কর্মফল পাবার জন্যই আমাদের উদ্‌বেগ আর এমন সব আকাঙ্ক্ষাই আমাদের কর্মের স্পৃহা কমিয়ে দেয়— ফলে আকাঙ্ক্ষা না থাকলে উদ্‌বেগও থাকবে না। আমি আমার সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে যথাযথ উপায়ে চেষ্টা করে যাই, এর ফলাফল যা হবার হবে—এটাই আত্মবিশ্বাসের মূলসূত্র। পুরোপুরি বাসনাহীন অন্তঃকরণে ঈশ্বরভাব আসে, যদি সৎকর্ম সানন্দে শ্রদ্ধায় করা হয়ে থাকে।




স্বামী বিবেকানন্দের লেখায় পাচ্ছি—




"...অতি সামান্য কর্মকেও ঘৃণা করা উচিত নয়। যে-ব্যক্তি উচ্চতর উদ্দেশ্যে কাজ করিতে জানে না, সে স্বার্থপর উদ্দেশ্যেই—নাম-যশের জন্যই কাজ করুক। প্রত্যেককে—সর্বদাই উচ্চ হইতে উচ্চতর উদ্দেশ্যের দিকে অগ্রসর হইতে হইবে, এবং ঐগুলি কী—তাহা বুঝিবার চেষ্টা করিতে হইবে। ‘কর্মেই আমাদের অধিকার, ফলে নয়’—ফল যাহা হইবার হউক। ফলের জন্য চিন্তা করো কেন? কোনো লোককে সাহায্য করিবার সময় তোমার প্রতি সেই ব্যক্তির মনোভাব কীরূপ হইবে, সে বিষয়ে চিন্তা করিয়ো না। তুমি যদি কোনো মহৎ বা শুভ কার্য করিতে চাও, তবে ফলাফলের চিন্তা করিয়া উদ্বিগ্ন হইয়ো না।”




আমাদিগকে গোড়া হইতে আরম্ভ করিতে হইবে। আমাদের সম্মুখে যেরূপ কর্ম আসিবে, তাহাই করিতে হইবে এবং প্রত্যহ আমাদিগকে ক্রমশ আরও অধিক নিঃস্বার্থপর হইতে হইবে। আমাদিগকে কর্ম করিতে হইবে এবং ঐ কর্মের পশ্চাতে কী অভিসন্ধি আছে, তাহা দেখিতে হইবে। তাহা হইলে প্রায় সর্বত্রই দেখিতে পাইবে, প্রথম প্রথম আমাদের অভিসন্ধি সর্বদাই স্বার্থপূর্ণ, কিন্তু অধ্যবসায়-প্রভাবে ক্রমশ এই স্বার্থপরতা কমিয়া যাইবে। অবশেষে এমন সময় আসিবে, যখন আমরা সত্যই নিঃস্বার্থ কর্ম করিতে সমর্থ হইব। তখন আমাদের আশা হইবে যে, জীবনের পথে ক্রমশ অগ্রসর হইতে হইতে কোনো-না-কোনো সময়ে এমন একদিন আসিবে, যখন আমরা সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ হইতে পারিব। আর যে-মুহূর্তে আমরা সেই অবস্থা লাভ করিব, সেই মুহূর্তে আমাদের সকল শক্তি কেন্দ্রীভূত হইবে এবং আমাদের অন্তর্নিহিত জ্ঞান প্রকাশিত হইবে।"




এ বিষয়ে গীতার উপদেশ এই যে—




নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ।
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিদ্ধ্যেদকর্মণঃ।। (৩/৮)




অর্থ: তুমি শাস্ত্রোপদিষ্ট নিত্যকর্ম করো। কর্ম না করা অপেক্ষা কর্ম করাই শ্রেয়। কর্মহীন হলে তোমার দেহযাত্রাও (জীবিকাও) নির্বাহ হবে না।




"যজ্ঞ, দান ও তপস্যারূপ কর্ম ত্যাগ করা উচিত নয়—এ সকল করাই উচিত। যজ্ঞ, দান, তপস্যা কর্ম যদি ফল না চেয়ে, ঈশ্বরলাভের অনুপ্রেরণায় করা হয়, তবে তা মনীষীদের পক্ষে চিত্তশুদ্ধিকর হয়।" (গীতা, ১৮/৫) এই কর্ম কীরকম? গীতা কী বলছেন দেখা যাক—




অক্ষরং ব্রহ্ম পরমং স্বভাবোহধ্যাত্মমুচ্যতে।
ভূতভাবোদ্ভবকরো বিসর্গঃ কর্মসংজ্ঞিতঃ।। (৮/৩)




অর্থ: অক্ষরকে পরব্রহ্ম বলে। স্বভাবকে, প্রতিদেহে সেই পরব্রহ্মের প্রত্যগাত্মভাবে (ব্রহ্মচৈতন্যরূপে) অবস্থিতিকে অধ্যাত্ম বলে। ভূতবস্তুর উৎপত্তিকর দেবতার প্রতি দ্রব্যাদি ত্যাগরূপ যজ্ঞকে কর্ম বলে।




আত্মার যে-শক্তির সাহায্যে পঞ্চেন্দ্রিয়ের চঞ্চলতা এবং বাহ্যিক বিভিন্ন বিষয়ের দিকে আত্মার গতি বা বাহ্যবিষয়ে পরিচালনা নিরুদ্ধ হয়ে নির্বাত-স্থির প্রদীপের মতো ইন্দ্রিয়সমূহের স্থিরতা আসে, সেই নিরোধশক্তিই সমস্ত ধর্মের (যা মানুষকে ধারণ করে) বীজ। জল সেচনের ফলে যেমনি গাছ হতে ফল উৎপন্ন হয়, ঠিক তেমনি যজ্ঞব্রতাদির অনুষ্ঠান দ্বারা এই নিরোধশক্তি হতেই বিভিন্ন (আত্মিক ও আধ্যাত্মিক) ধর্ম বিকশিত হয়। এই বীজভূত যজ্ঞ হতেই বৃষ্টি-সেচন ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় জগতের স্থির ও গতিশীল পদার্থসমূহের উৎপন্ন হয়, অর্থাৎ নিজ-নিজ কর্তব্যকর্ম সাধনের মধ্য দিয়েই জগতের জন্য কল্যাণকর সকল বস্তুর উৎপাদন সম্পন্ন হয়।




বৃহদারণ্যক উপনিষদে পাচ্ছি—এতস্য বা অক্ষরস্য প্রশাসনে গার্গি সূর্যাচন্দ্রমসৌ বিধৃতৌ তিষ্ঠতঃ" (৩/৮/৯), অর্থাৎ "হে গার্গি, এই অক্ষরব্রহ্মের শাসনে সূর্য ও চন্দ্র বিধৃত রয়েছে।" শ্রীধরস্বামীর টীকায় আছে: "অংশরূপে ব্রহ্মের জীবভাব প্রাপ্ত হওয়াই স্বভাব।", অর্থাৎ সকল জীবের মধ্যেই ব্রহ্ম‌ই অবস্থান করেন।




গীতার ৩/(১৪-১৬) শ্লোক পর্যালোচনা করে দেখি—




অন্নাদ্ ভবন্তি ভূতানি পর্জন্যাদন্নসম্ভবঃ।
যজ্ঞাদ্ ভবতি পর্জন্যো যজ্ঞঃ কর্মসমুদ্ভবঃ॥ (১৪)




কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্।
তস্মাৎ সর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্॥ (১৫)




এবং প্রবর্তিতং চক্রং নানুবর্তয়তীহ যঃ।
অঘায়ুরিন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি॥ (১৬)




অর্থ: অন্ন হতে প্রাণীদের শরীর উৎপন্ন হয়, মেঘ হতে অন্নের উৎপত্তি হয়, যজ্ঞের ধূম হতে মেঘ উৎপন্ন হয় এবং যজ্ঞ (অদৃষ্ট বা অপূর্ব কর্মফল) বেদবিধি হতে উৎপন্ন হয়। (১৪)




মনুসংহিতা বলছেন: যজ্ঞাগ্নিতে [হবি ইত্যাদি] সম্যক আহুতিরূপে প্রদত্ত হলে তা আদিত্যে গমন করে। আদিত্য হতে বৃষ্টি, বৃষ্টির ফলে অন্ন এবং অন্ন হতে প্রাণিদেহ-সমূহ উৎপন্ন হয়।




যজ্ঞাদি কর্ম বেদ হতে উৎপন্ন অর্থাৎ তা বেদমূলক জানবে। বেদ অক্ষররূপ পরব্রহ্ম হতে সমুদ্‌ভূত। সেজন্য সর্বব্যাপী পরব্রহ্ম সদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন৷ (১৫)




(বেদের সংহিতাংশে প্রধানত যজ্ঞের বিধান ইত্যাদি দেওয়া হয়েছে—সেজন্য বেদকে যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত বলা হয়েছে। বৈদিক যজ্ঞাদি হতেই পরবর্তী পৌরাণিক যুগে পঞ্চ মহাযজ্ঞ ও অন্যান্য বহু যাগযজ্ঞাদির প্রচলন হয়েছে এবং বর্তমানে যে-সব যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তার সবই বৈদিক বড়ো বড়ো যজ্ঞের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ—দেশকালোপযোগী সংক্ষেপিত রূপ। যেহেতু যজ্ঞ নির্দোষ ও অপৌরুষেয় বেদের কর্মকাণ্ড দ্বারা প্রতিপাদিত, সেহেতু যজ্ঞ অবশ্যকর্তব্য।




‘ব্রহ্ম’ শব্দের একটি অর্থ বেদ। পরমাত্মা থেকে মানুষের নিঃশ্বাসের মতো অনায়াসে বেদ উৎপন্ন—তাই বেদ সমস্ত দোষশূন্য ও সর্বার্থপ্রকাশক বলে অতীন্দ্রিয় বিষয়ে প্রমাণ।…অস্য মহতো ভূতস্য নিঃশ্বসিতং এতদ্ য়দ্ ঋগ্‌বেদ…ইত্যাদি। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ২/৪/১০)




বেদকালে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য গৃহস্থদের নিত্যকর্ম ছিল অগ্নিহোত্র যজ্ঞ। বেদাশ্রিত সমাজের প্রধান অনুষ্ঠানই যজ্ঞানুষ্ঠান। এই তিন বর্ণের প্রত্যেক বালককে বেদবিদ্যা শিক্ষার জন্য আচার্যের কাছে যেতে হতো। একে বলে উপনয়ন—কাছে যাওয়া। আচার্যের বাড়িতে থেকে বেদবিদ্যা শিখে আচার্যের অনুমতি নিয়ে বাড়ি ফেরার নাম সমাবর্তন। (সমাবর্তনের ধারণাটি বৈদিক যুগেই সৃষ্ট।) ‘ব্রহ্ম’ এবং ‘বেদ’ সমার্থক বিধায় আচার্যের বাড়িতে বেদের আলোচনা যিনি করেন, তিনি ব্রহ্মচারী। ব্রহ্মচারী যে-সকল নিয়মআচার পালন করতেন, সেগুলির সমষ্টির নাম নাম ব্রহ্মচর্য। যে-সকল ছাত্র বেদবিদ্যার আলোচনাতেই গুরুগৃহে থেকে যেতেন, তাঁরা নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী; আর কেউ কেউ বেদের জ্ঞানকাণ্ডের চর্চায় সংসার ধর্মে প্রবেশ না করে ব্রহ্মধ্যানে জীবন কাটাতে চাইতেন, তাঁরা অগ্নিসাক্ষী করে যজ্ঞকর্ম না করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে নিরগ্নি সন্ন্যাসী হতেন। এই আজীবন ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসী ছাড়া বাকি সবাই সমাবর্তন করে গৃহে ফিরে যেতেন ও বিবাহ করতেন। দেশের মঙ্গলস্বার্থে সমাবর্তনের পর উক্ত দুই শ্রেণীর ব্যতীত সকলকে বিবাহ অবশ্যই করতে হতো। বিবাহের পরই কৃতবেদবিদ্য ব্যক্তিটি সমাজের মধ্যে গৃহপতি হিসাবে গৃহীত হবেন এবং বেদবিহিত সমুদয় ধর্মকর্মের অধিকারী হবেন। সমাবর্তনের পর অগ্নিস্থাপন করতে হতো। পত্নী গ্রহণকালে এই অগ্নিতে যজ্ঞহোমাদি সম্পন্ন হতো। এই অগ্নির নাম গৃহ্য অগ্নি, আবসথ্য অগ্নি বা স্মার্ত অগ্নি—এতেই গৃহস্থের সকল প্রকার স্মার্ত কর্ম করা হতো।




এ ছাড়া আর এক শ্রেণীর বৈদিক কর্ম ছিল। সেগুলির নাম— অগ্নিহোত্র, অগ্নিষ্টোম, অশ্বমেধ, রাজসূয় প্রভৃতি—শ্রৌত যজ্ঞ। শ্রৌত অগ্নি বিয়ের পর স্থাপিত হতো। অবিবাহিতের শ্রৌত অগ্নি স্থাপনে অধিকার নেই। আহিতাগ্নি বা সাগ্নিক ব্রাহ্মণেরই শ্রৌত কর্মে, দেবযজ্ঞে ও পিতৃযজ্ঞে অধিকার। দেবগণ ও পিতৃগণ মানুষের জীবনের নিয়ামক, শুভাশুভ ফলদাতা। দেবগণ মানুষের নিবেদিত হব্য ভোজন করেন, পিতৃগণ স্বধা (জল-পিণ্ডাদি) গ্রহণ করেন। দেবগণের আহুতি স্বাহা মন্ত্রে এবং পিতৃগণের আহুতি স্বধা মন্ত্রে দেওয়া হয়। দেবতা ও পিতৃগণের কাছে মানুষ ঋণী—সেই ঋণ শোধ করে যেতে হবে। তাই তাঁদের তৃপ্তিবিধান করতে হয়। (রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী থেকে প্রাপ্ত) এখানেই গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের ৯ থেকে ১২ শ্লোকে ভগবান যে যজ্ঞের জন্য কর্ম করতে বলেছেন এবং 'প্রজাপতি যজ্ঞের সাহায্যে প্রজা সৃষ্টি করেছেন' এবং 'দেবগণের যজ্ঞে তুষ্ট করে তাঁদের প্রসাদে প্রাপ্ত সম্পদ তাঁদের আগে দিয়ে (নিবেদন করে) অবশেষটুকু ভোজন করতে বলেছেন’—আর তাঁদের না দিয়ে নিজের জন্য যে পাক করবে, সে পাপান্নভোজী হবে বলে ভগবান যে বলছেন—তার মূল সুরটা আমরা পেয়ে গেলাম। তারপর অন্ন থেকে প্রজাসৃষ্টি, মেঘ থেকে অন্ন, যজ্ঞ থেকে মেঘ, কর্ম থেকে যজ্ঞ, কর্ম বেদ থেকে এবং শেষে বেদ অক্ষরপুরুষ থেকে উৎপন্ন হয়েছে উল্লেখ করে যে-চক্রের আবর্তনের কথা তিনি বলছেন, তারও মূল সুর বুঝতে পারলাম। এজন্য বেদধর্ম এক পারমার্থিক সত্তা-বিধৃত রূপে যজ্ঞাদি কর্মের মধ্যে ভাবিত ও গৃহীত হতো। সে-ভাবনার বাস্তবরূপ ছিল যজ্ঞানুষ্ঠান।)




এভাবে প্রবর্তিত জগচ্চক্রের অনুবর্তন যে না করে (অর্থাৎ যজ্ঞাদি কর্মানুষ্ঠান দ্বারা এই সংসারচক্র পরিচালনের সহায়তা যে না করে) সে ইন্দ্রিয়সুখাসক্ত ও পাপজীবনধারী; হে পার্থ, সেরকম ব্যক্তি বৃথাই জীবনধারণ করে৷ (১৬)




(কারণ, তার পক্ষে পরম শ্রেয়ঃ (গীতা, ৩/১১) লাভ করা অসম্ভব। সেজন্য অজ্ঞানীর পক্ষে কর্মই ধর্ম; আত্মজ্ঞানের অধিকারী হতে গেলে অজ্ঞানীদের তাই প্রথমে সকাম কর্ম করতে হবে। পরে ধীরে ধীরে নিষ্কাম কর্ম করার মনোবৃত্তি আসবে।)




শ্রীধরস্বামীর টীকার অনুসরণে ৩/১৫ শ্লোকে প্রথম চরণে ব্রহ্ম শব্দের 'বেদ' এবং দ্বিতীয় চরণে ‘ব্রহ্ম’ শব্দের 'পরব্রহ্ম' অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। ‘ব্রহ্ম’ অর্থ 'প্রকৃতি'ও হয়। (গীতা, ১৪/৩)




শ্রীরামানুজাচার্য ও লোকমান্য তিলক এই শ্লোকের সব জায়গাতেই ‘ব্রহ্ম’ শব্দের 'প্রকৃতি' অর্থটি গ্রহণ করেছেন। তাহলে অর্থ এই যে, প্রকৃতি হতে কর্ম ও পরমেশ্বর হতে প্রকৃতি উৎপন্ন হয়েছে এবং সমস্ত জগৎ-সৃষ্টি ('সর্বগতং ব্রহ্ম') যজ্ঞকে আশ্রয় করেই বর্তমান আছে—'অনুযজ্ঞ জগৎ সর্বম' (মহাভারত, শান্তিপর্ব, ২৬৭)।




শ্রীঅরবিন্দ 'ব্রহ্ম' শব্দের অর্থ করেন—“প্রকৃতিতে ক্রিয়াশীল সগুণ ব্রহ্ম।” (‘গীতায় যজ্ঞবিধি’)
গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শ্লোকসমূহের অর্থ একসঙ্গে এভাবে লেখা যায়—




“প্রাণিসকল অন্ন হতে উৎপন্ন হয়, মেঘ হতে অন্ন জন্মে, যজ্ঞ হতে মেঘ জন্মে, কর্ম হতে যজ্ঞের উৎপত্তি, কর্ম বেদ হতে উৎপন্ন জেনো এবং বেদ পরব্রহ্ম হইতে সমুদ্ভূত; সেই হেতু সর্বব্যাপী পরব্রহ্ম সদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন। এরূপে প্রবর্তিত জগচ্চক্রের যে অনুবর্তন না করে, (অর্থাৎ যে যজ্ঞাদি-কর্ম দ্বারা এই সংসার-চক্র পরিচালনে সহায়তা না করে,) সে ইন্দ্রিয়সুখাসক্ত ও পাপজীবনধারী; হে পার্থ, সে বৃথা জীবন ধারণ করে।”




ঈশ্বর-প্রবর্তিত এই কর্মপ্রবাহ চক্রের মতো আবর্তিত হয়ে জগৎকে চালাচ্ছে, এজন্য একে জগচ্চক্র বা সংসার বলা হয়। চক্রটি কীভাবে চলছে দেখা যাক। এই প্রাণিশরীর কীভাবে উৎপন্ন হয়?—অন্ন বা খাদ্য হতে। ভুক্ত অন্নই শুক্র ও রক্তে পরিণত হয়, তা হতে জীবের উৎপত্তি। অন্ন (শস্য) জন্মে মেঘ হতে। মেঘ জন্মে যজ্ঞ হতে। কীভাবে?—যজ্ঞের ধূমে মেঘ হয়, যা হতে বৃষ্টি হয়। দেবতাগণ যজ্ঞ দ্বারা সংবর্ধিত হয়ে বৃষ্টিদান করেন—এমন কথাও প্রসিদ্ধ। যজ্ঞের উদ্‌ভব কোথায়? ঋত্বিক-যজমানের কর্মবিশেষই যজ্ঞ, সুতরাং কর্ম হতেই যজ্ঞের উদ্‌ভব। কর্মের উদ্‌ভব কোথা হতে? বেদ হতে। বেদের উদ্‌ভব কোথা হতে? পরব্রহ্ম হতে—পরমব্রহ্মের নিঃশ্বাসরূপে বেদ স্বপ্রকাশিত, ঋষিগণ মন্ত্রদ্রষ্টা মাত্র। এভাবেই জগৎচক্রের গতি। যজ্ঞাদি কর্ম না করলে এই জগচ্চক্র বা সৃষ্টিরক্ষা হয় না।




যজ্ঞ হতে বৃষ্টি হয়—এটা অবশ্য ঠিক বৈজ্ঞানিক সত্য নয়। তবে মনে রাখতে হবে—জলীয় বাষ্প ও যজ্ঞীয় বাষ্প উভয়ই মেঘ। স্থূলকথা এই—দেবগণ বৃষ্টির সাহায্যে দ্বারা নরলোকের হিতসাধন করেন, সুতরাং মানুষের কর্তবা দেবলোকের পুষ্টিসাধন করা। তার একটাই উপায় যজ্ঞানুষ্ঠান। ঋষি শ্রীঅরবিন্দের ব্যাখ্যায় এটি পুরোপুরি স্পষ্ট হবে।




যাগযজ্ঞ ফলপ্রদ বটে, কিন্তু তা মোক্ষপ্রদ নয় এবং গীতায় অনুমোদিতও নয় (২/৪২-৪৪; ৮/২৭; ৯/২, ২০-২১)। কিন্তু পূর্বোক্ত কয়েকটি শ্লোকে (৩/১০-১৬) বেদোক্ত যজ্ঞাদি কর্তব্য বলে নির্দিষ্ট হয়েছে। গীতার অন্য জায়গাতেও যজ্ঞাদির প্রশংসাবাদ আছে (৪/৩১-৩২, ১৭/২৪- ২৫)। যজ্ঞাদি কর্তব্য কি না, তা নিয়ে এমন বিভিন্ন মত আপাতত পরস্পরবিরোধী বলে মনে হলেও বস্তুত তা নয়। গীতা সকাম-যজ্ঞেরই বিরোধী, নিষ্কাম-যজ্ঞের বিরোধী নয়। যজ্ঞ, দান ও তপস্যা—এ-সকল কর্ম চিত্তশুদ্ধি করে, তাই ওসব অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু আসক্তি ও ফলকামনা ত্যাগ করে এ-সকল কর্ম করতে হবে, এটাই গীতার মত ( ১৮/৫-৬)। অন্যান্য যজ্ঞও ভগবদ্‌উদ্দেশ্যেই কর্তব্য—ফলের আকাঙ্ক্ষা করে নয় এবং তিনিই সকল যজ্ঞের ভোক্তা, এ-কথাও আছে (৯/২৪, ২৭)। বস্তুত, অনাসক্তি, ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ, শ্রীকৃষ্ণে (পরমাত্মায়) সর্বকর্ম সমর্পণ ইত্যাদি নিষ্কাম কর্মের যা-কিছু মূলকথা, যজ্ঞকর্মেও তা-ই প্রযোজ্য। পূর্বে যে পঞ্চযজ্ঞাদির উল্লেখ আছে, তার সবই ত্যাগমূলক, কামনামূলক নয়। সুতরাং সেগুলি গীতোক্ত ধর্মের বিরোধী নয়। চতুর্থ অধ্যায়ে 'যজ্ঞ' শব্দটি আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলির মূলে ত্যাগ ও সংযম (৪/২৫-৩৩)।




এ প্রসঙ্গে শ্রীঅরবিন্দ বলেন, এ-শ্লোকগুলিতে যে-যজ্ঞের বিধান আছে, তাতে যদি আমরা কেবল আনুষ্ঠানিক যজ্ঞই বুঝি, তাহলে আমরা গীতোক্ত কর্ম-তত্ত্ব ঠিকভাবে বুঝতে পারিব না। বস্তুত, এই শ্লোকগুলির মধ্যে গভীর গূঢ়ার্থ আছে। ১৫শ শ্লোকে বলা হয়েছে যে, ব্রহ্ম হতে কর্ম সমুদ্‌ভূত হয়। এই ‘ব্ৰহ্ম’ শব্দে শব্দব্রহ্ম বা বেদ বোঝায় না—“এই ব্রহ্ম প্রকৃতির ক্রিয়ার মধ্যস্থিত সক্রিয় ‘সগুণ ব্রহ্ম’—ইনি অ-ক্ষর, সম, শান্ত, নিষ্ক্রিয় ব্রহ্ম হতে সমুদ্ভূত, অর্থাৎ তাঁরই এক বিভাব—ইনি ক্ষরজগতে সকল কর্মের স্রষ্টা ও উদ্‌ভবকর্তা—প্রকৃতিতে ক্রিয়াশীল পুরুষ। (‘নির্গুণ ব্রহ্ম’ সর্বদাই নিষ্ক্রিয়।) ভগবান পুরুষোত্তমের দুই বিভাব—সর্বগুণের অতীত অ-ক্ষরই তাঁর সমতার অবস্থা—তা হতেই প্রকৃতির গুণে ও বিশ্বলীলার মধ্যে তাঁর আত্মপ্রকাশ। এই প্রকৃতি-স্থিত পুরুষ হতে, এই সগুণ ব্রহ্ম হতে—বিশ্বশক্তির সমস্ত কর্মের উৎপত্তি। এই কর্ম হতেই যজ্ঞের তত্ত্ব উদ্ভূত। এমনকি, দেবতা ও মানুষের মধ্যে যে দ্রব্যাদির আদান-প্রদান, তা-ও এই তত্ত্বেরই অনুসরণে ঘটে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, যে-বৃষ্টি হতে অন্ন উৎপন্ন হয়, সেই বৃষ্টি এই কর্মের উপর নির্ভর করে এবং অন্ন হতে ভূতগণের শরীরের উদ্‌ভব হয়, কারণ প্রকৃতির সকল ক্রিয়াই প্রকৃতপক্ষে যজ্ঞ এবং ভগবানই সকল কর্ম ও যজ্ঞের ভোক্তা এবং সর্বভূতের মহেশ্বর।




(ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্বলোকমহেশ্বরম্ ।
সুহৃদং সর্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি॥
(গীতা, ৫/২৯)




অর্থ: মুক্ত যোগিপুরুষ আমাকে (অর্থাৎ কৃষ্ণরূপী সগুণ শ্রীভগবানকে) যজ্ঞ ও তপস্যাদির ফলভোক্তা, সর্বলোকের পরমেশ্বর এবং প্রাণিগণের অন্তরঙ্গ সুহৃদ জেনে পরম শান্তিলাভ করেন অর্থাৎ চিরশান্তিরূপ মুক্তিপদপ্রাপ্ত হন৷




এই শ্লোক থেকে এটা স্পষ্ট যে, প্রকৃতির সমস্ত কর্মই যজ্ঞের অন্তর্ভুক্ত। তাই যজ্ঞ হতে মেঘ জন্মে তা থেকে বৃষ্টি হওয়ার বিষয়টিও প্রকৃতির চক্র তথা যজ্ঞেরই অন্তর্ভুক্ত। তাই গীতার ৩/১৪ শ্লোকে “যজ্ঞ হতে মেঘ তথা বৃষ্টি হয়” কথাটি সর্বতোভাবে সত্য।)




এই ‘যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্' ভগবানকে জানাই প্রকৃত বৈদিকজ্ঞান। পরম শ্রেয়ঃ তখনই লাভ করা যায়, যখন আর শুধু দেবগণের উদ্দেশে যজ্ঞ না করে সেই সর্বব্যাপী যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত পরমেশ্বরের উদ্দেশে করা হয়। পরম শ্রেয়োলাভ তখনই হয়, যখন মানুষ নিম্ন প্রকৃতির কামনা পরিত্যাগ করে, নিজেই সমস্ত করছে—এই অহংকার পরিত্যাগ করে প্রকৃতিকেই সকল কর্মের তথা যজ্ঞের প্রকৃত কর্তা বলে বুঝতে পারে এবং নিজেকে ভোক্তা বলে মনে না করে বিশ্বাত্মা পরম পুরুষকেই প্রকৃতির সকল কাজের ভোক্তা বলে উপলব্ধি করে। নিজের ব্যক্তিগত ভোগে নয়, বরং পরমাত্মাতেই তখন পরম শান্তি, তৃপ্তি ও বিমলানন্দ লাভ করে। তখন কর্ম ও কর্মশূন্যতায় তার লাভ-অলাভ থাকে না—বরং সে শুধু ভগবানের জন্যই যজ্ঞরূপে আসক্তি ও কামনাশূন্য হয়ে কর্ম করে। এভাবেই যজ্ঞ হয় তার পরম শ্রেয়োলাভের পথ।




বেদান্তরত্ন হীরেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায় পাই—বাস্তবিকই যজ্ঞের প্রধান উপাদান ত্যাগ। প্রজাপতি যে বিরাট যজ্ঞানুষ্ঠান করে এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন, পুরুষসূক্তে তার ইঙ্গিত করা আছে। সে মহাযজ্ঞ আর কিছুই নয়, জীবের হিতার্থে ভগবানের বিপুল আত্মত্যাগ। জগতের এমন পোষণের জন্য নির্গুণ ঈশ্বরের উদ্দেশে যে ত্যাগ, আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাকেই যজ্ঞ নামে অভিহিত করতেন। যজ্ঞকে এখন আমরা ‘যগ্‌গিতে' পরিণত করেছি; একটা ধূমধাম হইচই ব্যাপারই আমাদের দৃষ্টিতে যজ্ঞ। যজ্ঞের কিন্তু আদিম অর্থ এমন নয়। যজ্ঞের মর্মভাব ত্যাগ।




(পুরুষসূক্তের উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্‌বেদ (১০/৯০), অথর্ববেদ (১৯/৬), সামবেদ (৬/৪), যজুর্বেদ (বাজসনেয়ী, ৩১/১-৬) ও তৈত্তিরীয় আরণ্যকের (৩/১২,১৩) মতো বৈদিক গ্রন্থে। শতপথ ব্রাহ্মণ, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদ ও মুদ্গল উপনিষদে এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। আধুনিক হিন্দুধর্মে গায়ত্রী মন্ত্রের মতো যে অল্প কয়েকটি ঋগ্‌বৈদিক স্তোত্র প্রচলিত আছে, তার মধ্যে এটি একটি। বাজসনেয়ী সংহিতা (৩১/১-৬), সামবেদ সংহিতা (৬/৪) ও অথর্ববেদ সংহিতায় (১৯/৬) এই সূক্তের অর্থের ব্যাখ্যা-সহ উল্লেখ পাওয়া যায়। পৌরাণিক সাহিত্যের মধ্যে ভাগবত পুরাণ (২/৫/৩৫ থেকে ২/৬/১-২৯) ও মহাভারতে (মোক্ষধর্মপর্ব, ৩৫১ ও ৩৫২) এই শ্লোকের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে—পুরুষসূক্তে ব্রহ্মাণ্ডের আধ্যাত্মিক একত্ব বা অদ্বৈত সত্তা বর্ণিত হয়েছে। এই সূক্তে পুরুষ বা পরব্রহ্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁকে সগুণস্বরূপে একাধারে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা এবং এর মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে।) 




প্রশ্ন: যজ্ঞের আদিম অর্থ যা-ই হোক, যজ্ঞ উপলক্ষ্যে রাজসিক "ধূমধাম হইচই" ব্যাপার সেকালেও ছিল। বড়ো বড়ো রাজারা আড়ম্বরের সাথে রাজসূয়, অশ্বমেধ যজ্ঞ করতেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরও রাজসূয়-যজ্ঞাদি করেছিলেন এবং স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের সম্মতি ও উপদেশক্রমেই তা সম্পন্ন হয়েছিল। গীতোক্ত ধর্মের সাথে সেটির সামঞ্জস্য কোথায়?




উত্তর: কামনামূলক রাজসিক যজ্ঞাদি তখনও ছিল, একথা ঠিক। গীতায়ও সাত্ত্বিক, রাজসিক, তামসিক তিন ধরনের যজ্ঞের উল্লেখ আছে এবং ফলাকাঙ্ক্ষাবর্জিত অবশ্যকর্তব্য বোধে অনুষ্ঠিত সাত্ত্বিক যজ্ঞের প্রশংসা আছে (১৭/১১-১৩)। গীতায় কামনাযুক্ত কর্মের স্থান নেই। রাজসূয় যজ্ঞ 'কাম্য-কৰ্ম' বটে এবং যুধিষ্ঠির শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শক্রমেই সেটির অনুষ্ঠান করেছিলেন, কিন্তু তা তিনি করেছিলেন নিষ্কামভাবে, কর্তব্যানুরোধে। (লক্ষণীয়, গীতায় যজ্ঞ তথা কর্ম সম্পাদনকারীর ভাব বা উদ্দেশ্য বা মনের ক্রিয়া সব ক্ষেত্রেই সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে।) এ সম্পর্কে যুধিষ্ঠির কী বলেন, দেখা যাক—




নাহং কর্মফলান্বেষী রাজপুত্রি চরাম্যুত।
দদামি দেয়মিত্যেব যজ্ঞে যষ্টব্যমিত্যুত॥
ধর্ম-বাণিজ্যকো হীনো জঘন্যো ধর্মবাদিনাম্।
(মহাভারত, বনপর্ব, ৩১/৪৫)




অর্থ: রাজপুত্রি, আমি কর্মফলান্বেষী হয়ে কোনো কর্ম করি না। দান করতে হয়, তাই দান করি; যজ্ঞ করতে হয়, তাই যজ্ঞ করি—ধর্মাচরণের বিনিময়ে যে ফল চায়, সে ধর্মবণিক, ধর্মকে সে পণ্যদ্রব্য করেছে; সে হীন, জঘন্য।




শ্রীকৃষ্ণানুগতপ্রাণ, শ্রীকৃষ্ণভক্তের উপযুক্ত কথাই বটে, কিন্তু এই ফলাকাঙ্ক্ষাবর্জিত রাজসূয় যজ্ঞের অবশ্যকর্তব্য ভাবটি হলো কীসে? তা বোঝা যায় শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে (মহাভারত, সভাপর্ব, ১৪-১৫ অধ্যায়)। এর উদ্দেশ্য প্রধানত জরাসন্ধ, শিশুপাল প্রভৃতি ধর্মদ্বেষী অত্যাচারী নৃপতিরূপী ‘অসুর’কে নত বা নিহত করে একচ্ছত্র ধর্মরাজ্য সংস্থাপন (গীতা, ৪/৮)। এই জরাসন্ধ এক-শো রাজাকে বলিদান করে এক নিদারুণ রাজসূয় বা 'রাজমেধ’ যজ্ঞ করার আয়োজন করেছিলেন। এ জন্য ছিয়াশি জন নৃপতি পরাজিত, ধৃত ও শৃঙ্খলিত হয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শত সংখ্যা পূর্ণ হলেই এই পাশবিক যজ্ঞ সংঘটিত হতো। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজনে সেটি ব্যর্থ হলো।




যুদ্ধ শেষ হলে যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞও করেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণেরই আদেশে। এ সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ যে অনুপম ধর্মোপদেশ দিয়েছিলেন, তা 'কামগীতা' নামে প্রসিদ্ধ। কামনা ও অহংকার বর্জনই সে গীতার প্রধান কথা। বনে গমনের জন্য প্রস্তুত শোককাতর ধর্মরাজকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন—"বিষয়-ত্যাগে কামনা ত্যাগ হয় না, বনে যেয়ো না, অনাসক্তভাবে রাজধর্ম পালন করো। সাত্ত্বিক যজ্ঞ, দান, তপস্যা ইত্যাদি চিত্তশুদ্ধিকর কর্ম দ্বারা কামনাত্যাগের চেষ্টা করো।” এ যেন রোগের ধরন অনুযায়ী ঔষধের ব্যবস্থা। এত তো গীতারই কথা, সুতরাং গীতোক্ত-ধর্মের সাথে এর কোথাও কোনো অসামঞ্জস্য নেই। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞ অপেক্ষাও যে বিশুদ্ধ ত্যাগ-লক্ষণযুক্ত নৃযজ্ঞাদির বা অতিথিসেবার শ্রেষ্ঠতা কম নয়, মহাভারতের সুবর্ণনকুল উপাখ্যানে তা স্পষ্ট।




এক নকুল যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞস্থলে এসে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। দেখা গেল, নকুলটির মুখ ও শরীরের অর্ধাংশ স্বর্ণময়। অদ্ভুত জীবটির অদ্ভুত কর্মের কারণ জিজ্ঞেস করা হলে নকুল বলল, দেখলাম, কুরুক্ষেত্রে এক উঞ্ছবৃত্তিধারী (হীন কর্মের দ্বারা জীবিকানির্বাহ করেন, এমন) ব্রাহ্মণ সপরিবারে উপোস থেকেও অতিথিকে ঘরে সঞ্চিত সমস্ত যবচূর্ণ দিয়ে দিলেন। সেই অতিথির ভোজনপাত্রে অতি সামান্য, উচ্ছিষ্ট অবশিষ্ট ছিল, সেই পবিত্র কণার সংস্পর্শে আমার মুখ ও দেহের অর্ধেক স্বর্ণময় হয়েছে ('যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ', 'যজ্ঞশিষ্টামৃতভুজো' ৩/১৩, ৪/৩০)। দেহের বাকি অর্ধেক স্বর্ণময় করার জন্য আমি নানা যজ্ঞস্থলে গিয়ে গড়াগড়ি খেলাম, এখানে এসেও খেলাম; কিন্তু দেখলাম, সকল যজ্ঞ অপেক্ষা সেই ব্রাহ্মণের শক্তুযজ্ঞই (যব-যজ্ঞ) শ্রেষ্ঠ, কেননা আমার বাকি অর্ধেক দেহ আর কোথাও গিয়ে স্বর্ণময় হলো না।